আলেক্সি নিকোলভিচ কোসিগিন
আলেক্সি নিকোলভিচ কোসিগিন (১৯০৪-১৯৮০) সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের মন্ত্রী পরিষদের চেয়ারম্যান, ৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাঙালি হত্যাযজ্ঞের বিরােধিতা ও প্রতিবাদকারী এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশ-নীতির অন্যতম রূপকার। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তাঁকে বাংলাদেশ সরকার Bangladesh Liberation War সম্মাননা (মরণােত্তর) প্রদান করে।
আলেক্সি নিকোলভিচ কোসিগিন ১৯০৪ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অধ্যয়ন শেষে ১৯২১ সালে তিনি লেনিনগ্রাদ কো-অপারেটিভ টেকনিক্যাল স্কুলে যােগ দেন। উচ্চতর অধ্যয়নের জন্য ১৯৩০ সালে তিনি লেনিনগ্রাদ টেক্সটাইল ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন। ১৯৩৫ সালে এ ইন্সটিটিউট থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। বলশেভিক পার্টির লেবার আর্মির সদস্য হিসেবে তিনি রুশ বিপ্লবে ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৭ সালে তিনি সােভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং ১৯৪৮ সালে পার্টির পলিটব্যুরাের সদস্য হন। কোসিগিন ১৯৬৬ সালে প্রথম সােভিয়েত মন্ত্রী পরিষদের চেয়ারম্যান হন। ১৯৮০ সালে পদত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। একজন উদার, সংস্কারপন্থী ও বাস্তবতাবাদী নেতা হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। ৭১ সালে তিনি সােভিয়েত নেতা লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ ও নিকোলাই ভিক্টোরােভিচ পদগনি-র সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সােভিয়েত মন্ত্রী পরিষদের চেয়ারম্যান কোসিগিন মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্ব থেকেই পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ঘেঁষা নীতির তীব্র বিরােধী ছিলেন। ১৯৬৯ সালের মে মাসে ইসলামাবাদ সফরকালে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, একই সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর কোসিগিন ক্রমান্বয়ে সােভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশ পলিসির অন্যতম রূপকারে পরিণত হন। সুপ্রিম সােভিয়েতের নির্বাচনের প্রাক্কালে ১০ই জুন দেয়া এক বক্তৃতায় কোসিগিন বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট পরিস্থিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশের লাখ-লাখ লােকের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ এবং তাদের দুর্বিষহ জীবন যাপনের কথা উল্লেখ করে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের রাজনৈতিক উপায় বের করার ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন। তিনি বলেন, “The situation in East Pakistan has forced millions of people to leave their land, homes and property and seek refuge in neighbouring India. The masses of refugees, despite the aid given them are in an extremely grave position.’ তার এ বক্তৃতার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে কোসিগিন ভারতের আনুষ্ঠানিক অনুরােধ পেলে বাঙালিদের গেরিলা যুদ্ধে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। আগস্টের শেষের দিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতাম মহাম্মদ খান তার মস্কো সফর কালে সােভিয়েত ইউনিয়নের নীতি পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। এ-সময় কোসিগিন প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অপকর্মের সমালােচনা এবং পাকিস্তানের নীতিকে ‘indefensible’ বলে এর বিরােধিতা করেন।
সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সােভিয়েত ইউনিয়ন সফর কালে আলেক্সি কোসিগিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দুই নেতা বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন। উভয় নেতা সােভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পরিস্থিতি তৈরির জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে দায়ী করেন। এ-সময় কোসিগিন পাকিস্তান বা চীন ভারতের ওপর আক্রমণ করলে ভারতকে সামরিক সাহায্যের আশ্বাস দেন। তিনি ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও প্রদান করেন। ইন্দিরা গান্ধী ও কোসিগিনের সাক্ষাতের তথ্য ২৯শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সােভিয়েত-ভারত যৌথ বিবৃতিতে উল্লিখিত হয়। এ বিবৃতিতে ২৫শে মার্চের পর সৃষ্ট বাংলাদেশ সংকট সমাধানে বাঙালিদের ইচ্ছা, তাদের অধিকার ও আইনগত স্বার্থ সংরক্ষণ এবং ভারতে আশ্রয় নেয়া মানুষের মাতৃভূমিতে দ্রুত সম্মান ও মর্যাদের সঙ্গে ফিরে যাওয়ার ওপর জোর দেয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়: Taking note of the developments in East Bengal since 25th March, 1971, both sides consider that the interests of the preservation of peace demand that urgent measures should be taken to reach a political solution of the problems which have arisen there paying regard to the wishes, the inalienable rights and lawful interests of the people of East Bengal as well as for the speediest and safe return of the refugees to their homeland in conditions safeguarding their honour and dignity.
১৫ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন মস্কোস্থ আমেরিকার দূতাবাসের মাধ্যমে সােভিয়েত মন্ত্রী পরিষদের চেয়ারম্যান কোসিগিনের কাছে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে তিনি বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সােভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা কামনা করেন। এ চিঠিতে পূর্ব পাকিস্তানের যশােরে ভারত ও পাকিস্তানি বাহিনী বিমান, ট্যাংক ও আর্টিলারির সাহায্যে যেভাবে পরস্পরের মুখােমুখি হচ্ছে, তাতে তিনি চিন্তিত বলে উল্লেখ করেন। চিঠি হস্তান্তরের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত জ্যাকব বিম একাধিকবার কোসিগিনের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশে যুদ্ধ বন্ধে সহযােগিতা করতে অনুরােধ জানান। উল্লেখ্য, নিক্সনের এ চিঠি ও রাষ্ট্রদূতের এসব চেষ্টা সত্ত্বেও সােভিয়েত ইউনিয়নের নীতিতে কোনাে পরিবর্তন আসেনি।
সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যকার মৈত্রী চুক্তি (৯ই আগস্ট), প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সােভিয়েত ইউনিয়ন সফর, সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবল জনমত সৃষ্টি ইত্যাদির পটভূমিতে সােভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন শহরেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সভা ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সােভিয়েত ইউনয়নের নারী কমিটির বিবৃতি, সংবাদ সংস্থা ‘তাস’ ও পত্রিকা প্রাভদা-র প্রচার ইত্যাদির ফলে বাংলাদেশের পক্ষে সােভিয়েত ইউনিয়নে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। একদিকে জনমত তৈরি এবং অন্যদিকে কোসিগিনসহ অন্য সােভিয়েত নেতাদের প্রচেষ্টার ফলে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের বিপরীতে ভারত মহাসাগরে সােভিয়েত ৬ষ্ঠ নৌবহরের অবস্থান গ্রহণ, ডিসেম্বরে সােভিয়েত ইউনয়নের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সংগ্রামকে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে ঘােষণা দান এবং জাতিসংঘে পাকিস্তান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে বারবার সােভিয়েত ‘ভেটোপ্রদান সম্ভব হয়। ডিসেম্বরে ভারতের প্রতিনিধি ডি পি ধর সােভিয়েত ইউনিয়ন সফর কালে ব্রেজনেভ ও কোসিগিনকে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের ভারত মহাসাগরে অবস্থান সম্পর্কে জানালে কোসিগিন তাঁকে এ কথা বলে আশ্বস্ত করেন যে, don’t worry, our vessels are following the US fleet. কোসিগিন ও সােভিয়েত নেতাদের সময়ােচিত ভূমিকার কারণেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য ত্বরান্বিত হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ আলেক্সি নিকোলভিচ কোসিগিনকে Bangladesh Liberation War সম্মাননা (মরণােত্তর) প্রদান করে। বাংলাদেশের এ অকৃত্রিম বন্ধু ১৯৮০ সালের ১৮ই ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। [জালাল আহমেদ]।
তথ্যসূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ত্রয়ােদশ খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ঢাকা sodo; Enayetur Rahim and Joyce L Rahim, Bangladesh Liberation War and the Nixon White House 1971, Pustaka, Dhaka 2000; B. Z. Khasru, Myths and Facts : Bangladesh Liberation War, Rupa Publishing House, New Delhi 2010; Kamal Matinuddin, Tragedy of Errors : East Pakistan Crisis 1968-1971, Rawalpindi 1994
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড