আর্চার কে ব্লাড
আর্চার কে ব্লাড (১৯২৩-২০০৪) আমেরিকান ফরেন সার্ভিসের পেশাদার কূটনীতিক ও একাডেমিক, একজন মানবতাবাদী, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকান কনসাল জেনারেল, যিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের পাকিস্তান বিষয়ক নীতির সমালােচনা করেন। তাঁর পুরাে নাম আর্চার ক্যান্ট ব্লাড। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী
কর্তৃক নিরস্ত্র বাঙালি জনগণকে হত্যার বিবরণ দিয়ে একের পর এক অসংখ্য টেলিগ্রাম পাঠান ওয়াশিংটনে এবং এ গণহত্যার প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অব্যাহত নীরবতার তীব্র নিন্দা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে ইয়াহিয়া সরকারকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং নৈতিক সমর্থন প্রদান করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক নৃশংস গণহত্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে অভিহিত করে। ব্লাড মার্কিন এ নীতির তীব্র বিরােধিতা করেন এবং চলমান নৃশংসতা বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে কঠোর ভাষায় একটি টেলিগ্রাম বার্তা পাঠান। তাঁর সেই বিখ্যাত টেলিগ্রাম বার্তাটি ‘দ্যা ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে পরিচিত। তিনি মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রাপ্ত বাংলাদেশের বিদেশী বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম। আর্চার কে ব্লাড ১৯২৩ সালের ২০শে মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগাের ইলিনয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ভার্জিনিয়া লিঞ্চবার্গ হাইস্কুল থেকে তিনি গ্রাজুয়েশন এবং ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে ব্লাড জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্লাড একজন নৌ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর তিনি ১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন সার্ভিসে পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে যােগ দিয়ে গ্রিস, জার্মানি ও আফগানিস্তানে মার্কিন কূটনৈতিক মিশনে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ব্লাড ঢাকাস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনসুলেট জেনারেল অফিসে দুই মেয়াদে কর্মরত ছিলেন। প্রথম মেয়াদে ১৯৬০ সালের জুন মাসে ডেপুটি প্রিন্সিপ্যাল অফিসার ও পলিটিক্যাল অফিসার হিসেবে যােগদান করেন। ১৯৬১ সালে তিনি FS0-3 (Foreign Service Officer-3) হিসেবে পদোন্নতি পান। এবং ১৯৬২ সালে তিনি পেনসিলভিনিয়ায় কারলিসলের আর্মি ওয়ার কলেজে ঊর্ধ্বতন প্রশিক্ষক হিসেবে যােগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি ১৯৭০ সালের ৩রা মার্চ পুনরায় FS0-1 এবং কনসাল জেনারেল হিসেবে ঢাকাস্থ আমেরিকার কনসুলেট জেনারেল অফিসে যােগদান করেন।
১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা দিয়ে বয়ে যায় এক প্রলয়ংকর ঘূর্ণিঝড়। মানবতাবাদী কূটনীতিবিদ আর্চার ব্লাড ভালােবেসেছিলেন বাংলার মানুষকে। সেই ভালােবাসার টানে ব্লাড দম্পতি পর্যাপ্ত রিলিফ সামগ্রী নিয়ে ছুটে যান ঘুর্ণিঝড় কবলিত এলাকায়; দাড়ান দুর্গতদের পাশে।
দ্বিতীয় মেয়াদে ব্লাড যখন ঢাকা আসেন, তখন ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল উত্তাল। ৭০-এর নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশই উত্তপ্ত হচ্ছিল। ইয়াহিয়া-ভুট্টো চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু তাঁর ৬-দফা প্রশ্নে নমনীয় হােক। পাকিস্তান সরকারের অন্যায়, অবিচার ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সমগ্র বাঙালি জাতি এক হয়ে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তােলে। বঙ্গবন্ধুর সুযােগ্য দিকনির্দেশনায় সমগ্র বাঙালি জাতি নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ব্লাড ৭০-এর নির্বাচনপরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনের খবর খুব আগ্রহের সঙ্গে রাখতেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পথে না গিয়ে পাকিস্তান সরকার কূট কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করছে। ব্লাড স্বয়ং খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন পাকিস্তান ভেঙ্গে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ব্লাড মন্তব্য করেছিলেন, আমরা নিশ্চিত যে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে স্বাধীনতা। ২৮শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জো ফারল্যান্ডের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর এক বৈঠকের ব্যাপারে ব্লাড লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব বুলেটকে মােকাবিলা করতে ভয় পান না। কারাগারে যেতে কিংবা তাঁকে টুকরাে-টুকরাে করে ফেলার ভয়েও তিনি ভীত নন। তিনি কোনক্রমেই ৬-দফার ভিত্তিতে জনগণের দেয়া ম্যান্ডেট থেকে বিচ্যুত হবেন না। ব্লাড বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের মানুষকে ভালােভাবেই বুঝেছিলেন। তাই মার্চ মাসে ভবিষ্যদ্রষ্ট্রার মতাে তিনি মন্তব্য করে রিপাের্ট করেছিলেন, আমি বিশ্বাস করি, পূর্ব পাকিস্তানে এখন যে সংগ্রাম চলমান রয়েছে, তার সম্ভাব্য যৌক্তিক পরিণতি হলাে বাঙালিদের বিজয় এবং এর পরিণতিতে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। ব্লাড এ রাতের নামকরণ করেন ‘a night of infamy’ বা ‘কলঙ্কিত রাত’ হিসেবে। পরবর্তী দুদিন তিনি ঢাকার গণহত্যা প্রত্যক্ষ করে ২৮শে মার্চ অত্যন্ত হতাশা ও ক্ষোভের সঙ্গে এটিকে ‘Selective Genocide’ বা ‘বাছাইকৃত গণহত্যা’ শিরােনাম দিয়ে ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দপ্তর এবং ভারত ও ইসলামাবাদে মার্কিন দূতাবাসকে টেলিগ্রামের মাধ্যমে জানান।
১। ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জঘন্য সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রত্যক্ষ করে আমরা বাকরুদ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, এমএলএ [Martial Law Authority] কর্তৃপক্ষ আওয়ামী লীগ সমর্থকদের তালিকা করে পর্যায়ক্রমে তাদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করছে।
২। উচ্চ পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের বাইরেও যাদের
হত্যা করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছে ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এ তালিকায় উল্লেখযােগ্য সংখ্যক এমএনএ ও এমপিএ-ও রয়েছেন।
৩। এছাড়াও, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযােগিতায় অবাঙালি মুসলমানরাও পরিকল্পিতভাবে সাধারণ মানুষ ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালাচ্ছে এবং তাদের হত্যা করছে। ঢাকার রাস্তায় হিন্দু সম্প্রদায় এবং ঢাকাত্যাগী মানুষের ভিড়। অনেক বাঙালিই আমেরিকানদের বাড়িতে।
আশ্রয় চেয়েছে, তাদের অনেকেই আশ্রয় দিয়েছেন।
৪। মনে হচ্ছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক তল্লাশি ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানাের জন্য আজ কড়া কাফু আরােপ করা হয়েছে (যা আজ দুপুর থেকে পুনর্বলবৎ করা হয়েছে)। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনাে প্রতিরােধ গড়ে ওঠেনি।
৫। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার পূর্ণাঙ্গ রূপটি দুদিন আগে বা পরে বেরিয়ে আসবেই। তাই সঙ্গত কারণেই পাকিস্তান সরকার অব্যাহতভাবে সব ঠিক আছে মর্মে যে ভ্রান্ত ধারণা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে দিচ্ছে, সে বিষয়ে আমি প্রশ্ন তুলছি। পাকিস্তান সরকারকে আমাদের জানিয়ে দেয়া উচিত যে, নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংস আচরণে আমরা ব্যথিত। তথ্য প্রদানের সূত্র হিসেবে আমি অবশ্যই চিহ্নিত হতে পারি এবং আমার ধারণা পাকিস্তান সরকার আমাকে বহিষ্কারও করতে পারে। আমি বিশ্বাস করি না। বর্তমান ঘটনার পরিণামে এখানকার আমেরিকান। সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। তবে আমাদের যােগাযােগ করার সামর্থ্য হ্রাস পেতে পারে।
উল্লেখ্য যে, ব্লাডই প্রথম ব্যক্তি যিনি ২৫শে মার্চ রাতের ঘটনাকে তার প্রতিবেদনে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ওয়াশিংটন বা ইসলামাবাদ থেকে এ টেলিগ্রামের কোনাে জবাব না এলেও পরের দিন ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কে কিটিং ব্লাডকে জানান যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংস গণহত্যায় তিনিও গভীরভাবে মর্মাহত। তিনি আরাে জানান যে, এ মুহূর্তে মার্কিন সরকারের উচিত পাকিস্তানি বর্বরতার নিন্দা করে এ হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার ব্যবস্থা করা। তা না হলে হয়ত ঠাণ্ডা যুদ্ধের মধ্যে কমিউনিস্টরা এ পরিস্থিতির সুযােগ নিয়ে নেবে। উল্লেখ্য, কে কিটিং-এর বক্তব্যের ওপরও ওয়াশিংটন থেকে নিক্সনকিসিঞ্জার কোনাে মন্তব্য করেনি। আরাে উল্লেখ্য যে, কয়েকদিনের মধ্যেই ব্লাডের এ রিপাের্টটি হােয়াইট হাউসের নথি থেকে ফাঁস হয়ে ডেমােক্র্যাট দলের জন এফ কেনেডি-র নিকট পৌছে যায়। কেনেডি নিক্সন-কিসিঞ্জারের পররাষ্ট্রনীতির নিন্দা করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্রের সাহায্যে বাংলদেশে এ গণহত্যা পরিচালিত হচ্ছে বলে সরকারের কঠোর সমালােচনা করেন।
২৯শে মার্চ ব্লাড পুনরায় রিপাের্ট করেন, পুরাতন ঢাকার আমেরিকান পাদ্রিরা আমাদেরকে জনিয়েছেন যে, কোন প্রকার উস্কানি ছাড়াই ২৫ ও ২৬ তারিখ সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়েছে।… সেনাবাহিনীর কৌশলটা ছিল প্রথমে বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া এবং তারপর পলায়নরত মানুষকে গুলি করে হত্যা করা। যদিও ধারণা করা হয় হিন্দুরাই ছিল সেনাবাহিনীর অভিযানের মূল টার্গেট, আসলে গণহত্যা চালিয়েছে নির্বিচারে। ৩০শে মার্চ তারিখে ব্লাড তাঁর টেলিগ্রাম প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ দেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন যে, ২৭শে মার্চ আমেরিকার কূটনৈতিক মিশনের অফিসারগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিদর্শন করেন এবং তারা সেখানে অন্তত দুটি গণকবরের সন্ধান পেয়েছেন।
ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে কোনাে সাড়া না পেয়ে ব্লাড ৬ই এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সংবাদটি তীব্র ক্ষোভ ও হতাশাপূর্ণ প্রতিক্রিয়াসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রশাসনকে জানান, পরবর্তীতে যা আখ্যায়িত হয় ব্লাড টেলিগ্রাম হিসেবে। ব্লাডের টেলিগ্রামটি ছিল তীব্র প্রতিবাদ। এ প্রতিবাদ মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের এক বিরল মতদ্বৈধতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ব্লাড অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে ওয়াশিংটনস্থ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে টেলিগ্রাম করে জানিয়েছিলেন যে, মার্কিন সরকার বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকাস্থ আমেরিকান কনসাল জেনারেল অফিস, ইউএসএইড এবং ইউএসআইএস (ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিস)-এর ২০ জন অফিসার স্বাক্ষরিত এ টেলিগ্রামটির শিরােনাম ছিল ‘Dissent from U.S. Policy Toward Pakistan’। এতে বলা হয়-
পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান, তা বৃহত্তর অর্থে দেশটির নৈতিক স্বার্থ কিংবা ক্ষুদ্রতর অর্থে জাতীয় স্বার্থ এ দুটির কোনটিই পূরণ না করায় … ঢাকাস্থ আমেরিকান কনসুলেট জেনারেল, ইউএসআইএস এবং ইউএসএইড-এর উল্লেখযােগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতির মূল ধারার সঙ্গে ভিন্নমত পােষণ করাকে কর্তব্য মনে করেন। আমাদের সরকার গণতন্ত্রকে স্তব্ধ করার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার নৃশংসতার বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার তার নিজ নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে বরং একই সময়ে তারা পশ্চিম পাকিস্তান শাসিত সরকারকে শান্ত করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য ও সঙ্গত আন্তর্জাতিক জনসংযােগের চাপ হাস করতে নমনীয়তা প্রদর্শন করছে। আমাদের সরকার সেটাই প্রমাণ করছে যা অনেকের নিকট নৈতিক স্খলন বলে বিবেচিত হবে। অন্যরা গণতন্ত্র রক্ষা এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচিত দলের নেতাকে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়েছে এবং সংঘাত ও রক্তপাত বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ইউএসএসআর (সােভিয়েত ইউনিয়ন) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বার্তা প্রেরণ করেছে। পাকিস্তানের প্রতি আমাদের অতি সাম্প্রতিক কালের নীতি হচ্ছে এখানে আমাদের স্বার্থ মূলত মানবিক, কৌশলগত নয়। এমনকি আমাদের সরকার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘাতকে, যা বহুল ব্যবহৃত শব্দ ‘গণহত্যা’ দিয়েও প্রকাশ করা যায়, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে দেখে কোনাে ধরনের নৈতিক বা মানবিক হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাধারণ আমেরিকানরা এ নীতির তীব্র বিরােধিতা করেছে। পেশাদার সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আমরাও আমাদের সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরােধিতা করছি। আশা করছি যে, আমাদের সত্যিকার এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ এখানে রক্ষিত হবে এবং মুক্ত বিশ্বে আমাদের নৈতিক নেতৃত্বের অবস্থানটি পুনরুদ্ধারে নীতিমালার পরিবর্তন ঘটবে।
আমাদের ভিন্নমতের সুনির্দিষ্ট অংশ এবং সে সম্পর্কে আমাদের নীতিগত প্রস্তাবসমূহ একটি আলাদা টেলিগ্রামে পেরণ করা হবে।
ব্লাড টেলিগ্রামে আমেরিকান ফরেন সার্ভিসের যে-সকল অফিসার স্বাক্ষর করেছেন, তাঁরা হলেন- ব্রায়ান বেল, রবার্ট এল বারকোয়েন, ডব্লিউ স্কট বুচার, এরিক গ্রিফেল, যাকারি এম হ্যান, জেইক হার্সবারজার, রবার্ট এ জ্যাকসন, লরেন্স কোয়েজেল, জোসেফ এ মালপেলি, উইলার্ড ডি ম্যাকলিয়ারি, ডিসেইক্স ম্যায়ার্স, জন এল নেসভিগ, উইলিয়াম গ্রান্ট পার, রবার্ট কার্স, রিচার্ড এল সিম্পসন, রবার্ট সি সিম্পসন, রিচার্ড ই সাটোর, ওয়েন এ সুয়েডেনবার্গ, রিচার্ড এল উইলসন এবং শ্যানন এল উইলসন।
আমি উপযুক্ত কর্মকর্তাদের ভিন্নমত পােষণের অধিকার সমর্থন করি। যেহেতু তারা জরুরি ভিত্তিতে তাদের ভিন্নমত প্রেরণ করতে চাইছিলেন এবং যেহেতু আমাদের টেলিগ্রাম ছাড়া যােগাযােগের ভিন্ন কোনাে মাধ্যম নেই, তাই আমি তাদের এ উদ্দেশ্যে একটি টেলিগ্রাম করার অনুমতি প্রদান করি। আমি বিশ্বাস করি পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত সেরা মার্কিন কর্মকর্তা হিসেবে তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গি মার্কিন সম্প্রদায়ের অধিকাংশের (সরকারি ও বেসরকারি) মতামতরূপে প্রতীয়মান হবে। আমিও তাদের এ বক্তব্য সমর্থন করি। কিন্তু আমি মনে করি না যে, এখানকার প্রধান কর্মকর্তারূপে বহাল থাকা অবস্থায় তাদের এ বিবৃতিতে আমার স্বাক্ষর করা উচিত।
তাদের অবস্থানের প্রতি আমার যে সমর্থন, তার অন্য একটি কারণ রয়েছে। যেহেতু পরবর্তীকালেও আরাে প্রতিবেদন প্রেরণের আশা রাখি, তাই আমি বিশ্বাস করি পূর্ব পাকিস্তানে যে সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠেছে, তার সম্ভাব্য ফলাফল হচ্ছে বাঙালিদের বিজয় এবং এর ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের কাছে আমাদের সুনাম রয়েছে, তাই সম্ভাব্য পরাজিতের [পাকিস্তানের পাশে থেকে এ সম্পদ সুনাম] স্বেচ্ছায় খােয়ানাে হবে বােকামি।
‘দ্যা ব্লাড টেলিগ্রাম’ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে টেলিগ্রাম পাঠানাের জন্য ব্লাডকে তার মূল্য দিতে হয়েছে। এতে তাঁর কূটনৈতিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৮২ সালে ব্লাড ওয়াশিংটন পােস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি আমার ভিন্ন মতের জন্য মূল্য দিয়েছি। কিন্তু আমার সামনে কোনাে বিকল্প ছিল না। কারণ, ভুল ও শুদ্ধের মধ্যে ব্যবধান রেখা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। তাঁর মার্কিনবিরােধী অবস্থানের কারণে সরকার তাঁকে ৫ই জুন ১৯৭১ ঢাকা থেকে প্রত্যাহার করে ওয়াশিংটন ফিরিয়ে নিয়ে মানব সম্পদ বিভাগে নিয়ােগ করে।
পেশাগত কূটনৈতিক জীবনের শেষের দিকে ব্লাড আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত এবং দুই মেয়াদে নয়া দিল্লির মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্ব পালন করে ১৯৮২ সালে অবসর নেন। অবসরকালীন সময়ে তিনি কারলিসনির ইউএস আর্মি ওয়ার কলেজের কমান্ড্যান্টের কূটনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি আলগেনি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে ব্লাডের লেখা স্মৃতিরােমন্থনমূলক গ্রন্থ The Cruel Birth of Bangladesh : Memoirs of an American Diplomat ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা ছাড়াও এ গ্রন্থে তিনি ৭০-এর নির্বাচন, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ইত্যাদি বিষয় বর্ণনা করেছেন। তাছাড়াও ২০১৩ সালে প্রকাশিত গ্যারি জে বাস-এর The Blood Telegram : Nixon, Kissinger and a Forgotten Genocide গন্থে নিক্সন প্রশাসনের পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন ও বাংলাদেশে গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে। এদুটি গ্রন্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। গ্রন্থদুটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং এ-যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার প্রামাণ্য দলিল। এতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত বাংলাদেশের গণহত্যাকে প্রমাণিত গণহত্যা হিসেবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা সংঘটিত সে গণহত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে এবং নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন হত্যাকারীদের সব ধরনের সহযােগিতা করেছে।
বাংলাদেশের পাশে থাকার জন্য ব্লাড নিজ দেশে দুটি পুরস্কার পেয়েছিলেন। একটি হলাে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সম্মানসূচক মেধা পুরস্কার – ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের ঘূর্নিঝড়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানাের জন্য এবং অন্যটি হলাে ‘ক্রিশ্চিয়ান এ হার্টার’ পুরস্কার – ১৯৭১ সালে ‘দি ব্লাড টেলিগ্রাম পাঠিয়ে ‘উদ্যোগ, অখণ্ডতা, বুদ্ধিবৃত্তিক সাহস ও সৃজনশীল ভিন্নমত প্রকাশের অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য। এছাড়া ২০০৫ সালের ১৩ই ডিসেম্বর ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস তাদের আমেরিকান সেন্টার লাইব্রেরির নামকরণ করে ‘আর্চার কে ব্লাড আমেরিকান সেন্টার লাইব্রেরি।
এই সাহসী মার্কিন কূটনীতিক ২০০৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর ৮১ বছর বয়সে কলােরাডাের ফোর্ট কলিন্স হাসপাতালে মারা যান। উল্লেখ্য যে, ২০১৫ সালে ব্লাড ও তাঁর অন্যান্য সহযােগীদের স্বাক্ষর করা ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’-টি বন্ধুত্বের প্রতীক। হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচনা করে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে হস্তান্তর করেন। এছাড়া সাম্প্রতিক কালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ব্লাডের ভিন্ন মত প্রকাশ এবং নিক্সন-কিসিঞ্জার বিরােধী কর্মকাণ্ড মেনে নিয়ে তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সর্বপ্রথম গণহত্যার ভয়াবহতা কূটনীতিক বার্তার মাধ্যমে মার্কিন নীতিনির্ধারকের কাছে তুলে ধরা এবং পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আর্চার কে ব্লাডকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ (Friends of Liberation War Honour) (মরণােত্তর) প্রদান করা হয়। ২৭শে মার্চ ২০১২ তারিখে তার কন্যা বারবারা ব্লাড রাস্কিন পিতা ব্লাডের পক্ষে এ সম্মাননা গ্রহণ করেন। [সােজাহান মিয়া]
তথ্যসূত্র: Archer K Blood, The Cruel Birth of Bangladesh : Memoirs of an American Diplomat, Dhaka, The University Press Limited, 2002; Gary J. Bass, The Blood Telegram : Nixon, Kissinger and a Forgotten Genocide, New York, Alfred A Knopf, 2013; Gary J. Bass, The Blood Telegram : India’s Secret War in East Pakistan, Random House India, 2013
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড