কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য ও মুক্তিযােদ্ধা বীর বিক্রম আব্দুস সবুর খান
আব্দুস সবুর খান, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৩৮) কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য ও বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জের চর রাঘবরায় গ্রামে ১৯৩৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সুজাত আলী খান ও মাতার নাম আয়েশা বেগম। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তিনি একজন নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে টাঙ্গাইলের সন্তোষে বসবাস করতেন। আব্দুস সবুর খান মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর একটি দল পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে অনেক সফল যুদ্ধ পরিচালনা করেন। কালিহাতীর বল্লা যুদ্ধ, বাসাইল থানা আক্রমণ, কামুটিয়া যুদ্ধ, করটিয়ায় কমান্ডাে আক্রমণ ও ব্রিজ ধ্বংস, কোদালিয়া সেতু আক্রমণ, মীর্জাপুর থানা আক্রমণ, দেওহাট সেতু ধ্বংস, পাথরঘাটা, বাথুলি, চাড়ান, এলাসিন, নাগরপুর প্রভৃতি যুদ্ধে তিনি দুর্ধর্ষ যােদ্ধা হিসেবে যােগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন।
টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার পশ্চিম কামুটিয়া গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে ১৭ই জুন কাদেরিয়া বাহিনীর একটি যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধের সংবাদ পেয়ে সবুর খান একদল সহযােদ্ধা নিয়ে সে এলাকায় এসে পাকবাহিনীর সম্ভাব্য ফিরতি পথ অনুমান করে নিকটস্থ নদীর ঘাটে একটি সুবিধামতাে স্থানে ওঁৎ পেতে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হয় কয়েকজন শত্রুসেনা। একটু পরে পাকবাহিনীর আরাে একটি দল এসে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। দেখতে-দেখতে তারা মুক্তিযােদ্ধাদের নাগালের মধ্যে এসে পড়লে সবুর খান ও তার সহযােদ্ধারা একযােগে গুলিবর্ষণ করতে শুরু করেন। প্রথম আঘাতেই চারজন সেনা নদীতে এবং তিনজন নদীর তীরে গড়িয়ে পড়ে। বেঁচে যাওয়া বাকি সেনারা তাৎক্ষণিক পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকলে মেশিনগান, মর্টার, রকেটলাঞ্চার প্রভৃতির গুলি-পাল্টা গুলিতে সেখানকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে। প্রায় আধা ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর থেমে-থেমে প্রায় আরাে আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এ আড়াই ঘণ্টা সময়ে সবুর খান মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যাধিক্য এবং প্রায় আধা মাইল জুড়ে তাদের অবস্থান বুঝাতে একবার ডানে, একবার বামে একাই দৌড়াদৌড়ি করে পাকবাহিনীর দিকে গুলি ছুড়তে থাকেন। এমতাবস্থায় বিশৃঙ্খল পাকবাহিনী শেষ পর্যন্ত পালাতে বাধ্য হয়।
জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত একটানা কয়েকটি যুদ্ধ পরিচালনা করে আব্দুস সবুর খান যখন টাঙ্গাইলের সুবিরচালা গ্রামে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখন একদিন সেখান থেকে তিন মাইল দূরবর্তী মরিচা গ্রামে পাকসেনারা আক্রমণ করে। সবুর খান দ্রুত সেখানে গিয়ে দেখেন তাদের অধিকাংশ নৌকায় করে নদীর ওপাড়ে বল্লার দিকে চলে যাচ্ছে। এপাড়ে কয়েকজন অপেক্ষা করছে নৌকা ফেরত আসার জন্য। নৌকা ঘাটে ফিরে এলে পাকসেনারা তাতে ওঠামাত্র মাঝি নৌকা ছেড়ে দেয়। ঠিক তখনই পাকসেনাদের অপ্রস্তুত মুহূর্তে গর্জে ওঠে সবুর খানের অস্ত্র। সঙ্গে-সঙ্গে ৪-৫ জন নৌকা থেকে নদীর পানিতে আর তিনজন নৌকায় লুটিয়ে পড়ে। আকস্মিক এ আক্রমণে ভীত হয়ে নদীর ওপাড়ের সেনারা পাল্টা গুলি ছুড়তে-ছুড়তে পালাতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য ও বীরত্বগাথার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আব্দুস সবুর খানকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতার পর আব্দুস সবুর খান ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে টাঙ্গাইলের আদালত পাড়ায় বসবাস শুরু করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম রাবেয়া বেগম। এ দম্পতি ৫ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক-জননী। আব্দুস সবুর খান বর্তমানে অসুস্থ অবস্থায় নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড