You dont have javascript enabled! Please enable it! রাজনীতিবিদ, ভাষা-সংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আব্দুর রউফ চৌধুরী - সংগ্রামের নোটবুক

আব্দুর রউফ চৌধুরী

আব্দুর রউফ চৌধুরী (১৯৩৫-২০১৪) রাজনীতিবিদ, ভাষা-সংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে কুষ্টিয়া হানাদার মুক্তকরণে সশস্ত্র লড়াইয়ের অন্যতম সংগঠক এবং মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। তিনি ১৯৩৫ সালের ১৮ই আগস্ট কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার ছত্রগাছা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল জব্বার চৌধুরী ও মাতার নাম হুযূরাতুন নেসা। তিনি কুষ্টিয়া মুসলিম হাইস্কুল থেকে ১৯৫০ সালে মেট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৬ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর তিনি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে ১৯৬২ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কোর্স সম্পন্ন করা সত্ত্বেও ফাইনাল পরীক্ষার পূর্বে কারাবরণ করার কারণে তাঁর পক্ষে আর পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি।
কলেজে ছাত্র থাকাকালে আব্দুর রউফ চৌধুরী রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তবে ১৯৪৬ সালে ৭ম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে তিনি ঐতিহাসিক ‘রশীদ আলী দিবস’-এর বিক্ষোভ মিছিলে যােগ দেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন-এ তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ-এর সভাপতি ছিলেন। সে-সময় আইয়ুব সরকারের গণবিরােধী শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপাের্টের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আইয়ুব খানের কুখ্যাত গভর্নর মােনায়েম খানের উপস্থিতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন এবং গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৬ সালে তিনি কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগ এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরের বছর সরকারবিরােধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি পুনরায় গ্রেপ্তার হন। তিনি আইয়ুববিরােধী মঞ্চ পিডিএম (পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট)-এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হন। ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে তিনি কুষ্টিয়া অঞ্চলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে কুষ্টিয়া শহরকে হানাদারমুক্ত করতে তিনি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। তিনি কুষ্টিয়া অঞ্চলের গণপ্রতিনিধি, ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) চুয়াডাঙ্গা ৪নং উইং-এর কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম- প্রমুখের সঙ্গে এ ব্যাপারে যােগাযােগ করেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কুষ্টিয়ার প্রতিরােধ যুদ্ধে অস্ত্র সংগ্রহে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
৩০শে মার্চ কুষ্টিয়া শহর থেকে হানাদারদের বিতারিত করতে ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও কয়েক হাজার সাধারণ মানুষ পুলিশ লাইন্স, জেলা স্কুল ও টিএন্ডটি ভবনে শত্রুর ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। এসময় কুষ্টিয়ায় তাঁর বাসভবনকে হানাদারদের বিরুদ্ধে আক্রমণে দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করা হয় (যে কারণে পরবর্তীতে হানাদার বাহিনী তাঁর বসতবাড়িতে আক্রমণ করে তা ধ্বংস ও অগ্নিসংযােগ করে পুড়িয়ে দেয়)। তিন দিনের প্রতিরােধ যুদ্ধে হানাদার বাহিনী সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। তাদের অনেক সৈন্য প্রতিরােধযােদ্ধা এবং পলায়নকালে গ্রামবাসীর হাতে নিহত হয়। মধ্য-এপ্রিল পর্যন্ত কুষ্টিয়া জেলা হানাদারমুক্ত থাকে। মুক্তিযুদ্ধকালে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে ১১টি জোনাল কাউন্সিলে বিভক্ত করা হলে আব্দুর রউফ চৌধুরীকে বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও পাবনা নিয়ে গঠিত দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিং, শরণার্থী শিবির ও ইয়ুথ ক্যাম্প পরিচালনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আব্দুল রউফ চৌধুরীকে কুষ্টিয়া জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। তিনি কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক দেশের সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হলে তিনি কুষ্টিয়া জেলার গভর্নর নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আব্দুর রউফ চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তন ঘটে। তিনি খন্দকার মােশতাকের নেতৃত্বাধীনে গঠিত ডেমােক্রেটিক লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে ডেমােক্রেটিক লীগের একাংশ নিয়ে প্রথমে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭-দলীয় ঐক্যজোট এবং পরে সদলবলে বিএনপি-তে একীভূত হন। ১৯৯১ সালে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সাল থেকে তিনি রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকেন। তিনি নিজ এলাকায় বহু স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ২০১৪ সালের ২৪শে জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম নার্গিস চৌধুরী। এ দম্পতির ৩ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তান রয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড