বীর বিক্রম আবু সালেহ মােহাম্মদ নাসিম
আবু সালেহ মােহাম্মদ নাসিম, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৪৬) যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযােদ্ধা, দ্বিতীয় বেঙ্গলের কোম্পানি কমান্ডার, একাদশ বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীর প্রধান ও লে. জেনারেল। তিনি ১৯৪৬ সালের ৪ঠা জানুয়ারি বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়ার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মােহাম্মদ ইদ্রিস ও মাতার নাম চেমন আরা বেগম। তিনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে অধ্যায়নরত অবস্থায় তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে যােগ দেন। সফলভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় দেশের ভেতরে ও বাইরে সামরিক বিষয় প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে একজন দক্ষ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তােলেন। ৭০-এর নির্বাচনােত্তর বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নতুন করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয়গ্রহণ এবং বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র ও অকার্যকর করার তাদের দুরভিসন্ধি সম্বন্ধে তিনি সচেতন ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এ তিনি অন্যান্য বাঙালি সেনাসদস্যদের মতাে করণীয় সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর প্রাক্কালে তিনি ক্যাপ্টেন পদমর্যদায় ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে জয়দেবপুর সেনানিবাসে নিয়ােজিত ছিলেন। ২৫শে মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে ঝাপিয়ে পড়লে তার কমান্ডিং অফিসার মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম-এর সঙ্গে তাৎক্ষণিক বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা শেষে মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে তাঁরা জয়দেবপুর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর তিনি সহযােদ্ধাদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভৈরব ও আশুগঞ্জে একাধিক প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশ নিয়ে বেশকিছু পাকসেনাকে তারা হত্যা করেন। ১৪ই এপ্রিল আশুগঞ্জ যুদ্ধে তিনি প্রথমবার আহত হন। পাকসেনাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধনের পর তিনি মাধবপুরে অবস্থান নেন। পাকবাহিনী ২১ ও ২২শে এপ্রিল এক ব্রিগেড সেনাসদস্য নিয়ে তাঁর অবস্থানে হামলা করলে তিনি মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যান। এ-যুদ্ধে বহুসংখ্যক পাকসেনা নিহত হয়। জুলাই মাসে সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধ শুরু হলে তাঁকে পঞ্চবটী সাব-সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধরত অবস্থায় তিনি একাদশ বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে একাধিক সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। অক্টোবর মাসে কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এস’ ফোর্স গঠিত হলে তিনি তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন। তার নেতৃত্বে ১১ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ক্যাপ্টেন মইনুল হােসেনের নেতৃত্বে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাসদস্যরা যৌথভাবে ধন্দাইল, মুকুন্দপুর, হরশপুর, বামুটিয়া, মুকুন্দপুর বিওপি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চান্দুরা, ভৈরব, আশুগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করেন। ৬ই ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী ইসলামপুর নামক স্থানে পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। ১১ জন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে বন্দি হয় এবং অন্যরা পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে শত্রুর ছােড়া গুলিতে ক্যাপ্টেন নাসিম দ্বিতীয়বার আহত হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরােচিত ও সাহসী ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযােদ্ধা আবু সালেহ মােহাম্মদ নাসিমকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। সুদীর্ঘ সামরিক জীবনে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন এবং লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন। তিনি ২ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম ইসমত নাসিম। [শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড