আবদুল হামিদ বাহিনী
আবদুল হামিদ বাহিনী (চকরিয়া, কক্সবাজার) দেখুন আবদুল হামিদ আবদুল হালিম চৌধুরী (১৯২৮-১৯৮৭) বীর মুক্তিযােদ্ধা। ১৯২৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল মতিন চৌধুরী এবং মাতার নাম হাসিনা বেগম। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামেই সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি ফরিদপুর জেলা স্কুল ও কোলকাতায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে বিএ অনার্স ডিগ্রি লাভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগদান করেন। পাঞ্জাব রেজিমেন্টে থাকাকালে তিনি পাকিস্তান ইউটিসি-র প্রধান ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দিয়ে কুষ্টিয়া সুগার মিলে প্রশাসক হিসেবে যােগ দেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অংশগ্রহণ করতে তাঁকে বাধ্য করা হয়। যুদ্ধ শেষ হলে ১৯৬৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাপ-এর রাজনীতিতে যােগদান করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মানিকগঞ্জ মহকুমা ন্যাপের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
মুজিবনগর সরকার নামে খ্যাত প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর বাংলাদেশকে ৬টি অঞ্চল ও ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতিটি সেক্টরে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়ােগ দেয়া হয়। বৃহত্তর কুমিল্লা, বৃহত্তর ঢাকা ও নােয়াখালী অঞ্চল নিয়ে ২নং সেক্টর গঠিত হয়। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মােশাররফ, বীর উত্তম দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি ২নং সেক্টরকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করেন। ঢাকা জেলার ২২টি থানা নিয়ে একটি সাব-সেক্টর গঠিত হয়। বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলার ৭টি থানা এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সাব-সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি বিশেষ করে মানিকগঞ্জের ঐ ৭টি থানার প্রতিটি অঞ্চলে গােপনে ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছেন। ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিক, শিক্ষকবুদ্ধিজীবীসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষদের নিয়ে বৈঠক করে প্রত্যেকটিতে শক্তিশালী মুক্তিসেনার দল গঠন করেন।
৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী কোনাে বাধা ছাড়া মানিকগঞ্জ শহর, তরাঘাট ও আরিচা দখল করলে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী অল্প কিছু মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে হরিরামপুর ও শিবালয় এলাকায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু করেন। সেখানে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্র-জনতাকে নিয়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও যােগ দেন। তিনি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক অপারেশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে এ অঞ্চলের মুক্তিযােদ্ধারা প্রচণ্ড সাহস লাভ করেন। ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী ছদ্মবেশ ধারণ করে পাকসেনা ক্যাম্পের সংবাদ সংগ্রহ করতেন। কখনাে গুপ্তচরের বেশে পাকহানাদারদের অবস্থান নিশ্চিত করতেন। তিনি কখনাে জেলের বেশে, কখনাে কৃষকের বেশে, কখনাে মাঠা (দধি) ওয়ালার বেশে আবার কখনাে ধােপার বেশে সর্বত্র বিচরণ করতেন। তিনি ৫০টিরও অধিক অপারেশনে নেতৃত্ব দেন। এসব অপারেশনের মধ্যে দৌলতপুর ইপিআর ক্যাম্প, সাটুরিয়া ইপিআর ক্যাম্প, সিঙ্গাইর ইপিআর ক্যাম্প, শিবালয় ইপিআর ক্যাম্প ও হরিরামপুর ইপিআর ক্যাম্প অপারেশন উল্লেখযােগ্য। তাছাড়া গােলাই ডাঙ্গার যুদ্ধ, কাকণার যুদ্ধ, নিলুয়ার যুদ্ধ-সহ সমগ্র মহকুমায় তার নেতৃত্বে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস আবদুল হালিম চৌধুরী পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অনবদ্য যুদ্ধ চালিয়ে যান। দেশের ভেতরে থেকেই তিনি আগরতলায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করতেন। এক পর্যায়ে হাইকমান্ড তাঁকে আগরতলায় ডেকে পাঠায়। আগরতলায় অবস্থানকালে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীকে মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা সদর দক্ষিণ ও উত্তর মহকুমা কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। আগরতলায় যাওয়ার আগেই ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী হরিরামপুর ও শিবালয় থানা এলাকায় কয়েকটি সামরিক কোম্পানি গঠন করেন। এর মধ্যে আলফা, বেটা, চার্লি ও ডেলটা কোম্পানির কমান্ডারগণ অনেকগুলাে সফল অভিযান পরিচালনা করেন। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর ভয়ে তটস্থ থাকত। মাস দেড়েকের মতাে ভারতে অবস্থান করার পর তাঁকে এরিয়া ফোর্স কমান্ডার হিসেবে নিয়ােগ দিয়ে মানিকগঞ্জ পাঠানাে হয়।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আবদুল হালিম চৌধুরী ন্যাপ-এর রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৭৪ সালে ভাসানীপন্থী ন্যাপের একটি অংশ ইউনাইটেড পিপলস পার্টি প্রতিষ্ঠা করলে তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যােগ দেন এবং মন্ত্রী হন। পরবর্তীকালে তিনি জাতীয় পার্টিতে যােগ দেন এবং মন্ত্রী হন। ১৯৮৭ সালে তিনি পরলােক গমন করেন। [মাে. আমিনুর রহমান এবং শহীদুল ইসলাম ফারুক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড