You dont have javascript enabled! Please enable it! শহীদ বুদ্ধিজীবী আবদুল আলীম চৌধুরী - সংগ্রামের নোটবুক

শহীদ বুদ্ধিজীবী আবদুল আলীম চৌধুরী

আবদুল আলীম চৌধুরী (১৯৩১-১৯৭১) বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ এবং ৭১-এ আলবদর বাহিনী কর্তৃক নির্মম হত্যার শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবী। তার পুরাে নাম এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরী। তিনি ১৯৩১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি কিশােরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম থানার খয়েরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল হাকিম চৌধুরী ও মাতা সৈয়দা ইয়াকুতুন্নেছা। তার পিতা ছিলেন জেলা স্কুল পরিদর্শক। আবদুল আলীম চৌধুরী ১৯৪৫ সালে কিশােরগঞ্জ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও ১৯৪৮ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৫৫ সালে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৬১ সালে তিনি রয়্যাল কলেজ অব ফিজিসিয়ান্স অব ইংল্যান্ড থেকে ডিও ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আইপিজিএমআর (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়), ঢাকা মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনায় নিয়ােজিত ছিলেন।
ডাক্তার আলীম চৌধুরী পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি একই সঙ্গে ছিলেন খুবই রাজনীতি সচেতন। তিনি বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ়চেতা ও স্পষ্টবাদী। মানুষের প্রতি তাঁর ছিল গভীর মমত্ববােধ। সব কিছুর উর্ধ্বে ছিল তাঁর দেশপ্রেম। বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি গভীরভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন।
৭১-এ তিনি ডাক্তারি পেশায় নিয়ােজিত থাকা অবস্থায়ও মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের জন্য অর্থ ও ঔষধ সংগ্রহ করেছেন, আহত মুক্তিযােদ্ধাদের গােপনে চিকিৎসা করেছেন, অনেককে নিজে গাড়ি চালিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌছে দিয়েছেন। এসবই করেছেন নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।
জুলাই মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কুখ্যাত দালাল ও আলবদর বাহিনীর অন্যতম সংগঠক মাওলানা আব্দুল মান্নান-এর গ্রামের বাড়িঘর (ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর) মুক্তিযােদ্ধারা জ্বালিয়ে দিলে, ঢাকায় এসে অতি কৌশলে ডাক্তার আলীম চৌধুরীর ২৯/১ পুরানা পল্টনের বাসার নীচতলায় এসে ওঠে। তার সম্বন্ধে ডাক্তার আলীম চৌধুরীর কোনাে পূর্ব ধারণা ছিল না। এই মাওলানা মান্নানই মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের একদিন পূর্বে অর্থাৎ ১৫ই ডিসেম্বর বিকেল ৪:৩০টার দিকে ডাক্তার আলীম চৌধুরীকে আলবদর সদস্যদের হাতে ধরিয়ে দেয়। আলীম চৌধুরীর পরনে ছিল লুঙ্গি, গেঞ্জি ও শার্ট। কাদালেপা একটি ছােট মাইক্রো বাসে করে ঘাতকরা এসে তাকে তুলে নিয়ে মােহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজের নির্যাতনকেন্দ্রে আরাে অনেকের মতাে চোখ ও হাত বেঁধে অন্ধকার কুঠরিতে ফেলে রেখে তার ওপর সারারাত অমানবিক নির্যাতন চালায়। পরের দিন ১৬ই ডিসেম্বর খুব ভােরে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে ঘাতক আলবদররা গুলি আর বেয়নেট চার্জ করে অত্যন্ত নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে তাকে হত্যা করে। তার ক্ষতবিক্ষত লাশ সেখানকার ইটের ভাটায় আরাে অনেকের লাশের সঙ্গে পড়ে থাকে। তার হাত দুটি দড়ি দিয়ে শরীরের পেছন দিকে বাঁধা ছিল। গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল তার চোখ। লাশের স্তুপে আলীম চৌধুরীর মৃতদেহ উপুড় হয়ে পড়েছিল। শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর বর্ণনায়, ‘আলীমের বুকে ছিল অনেকগুলাে গুলির চিহ্ন। কপালের বাঁ-দিকে এবং তলপেটে ছিল বেয়নেটের গভীর ক্ষত। আলীমের পাশেই ছিল ডাক্তার ফজলে রাব্বীর লাশ। সে লাশেরও ছিলাে একই রকমহাল। সবাইকে ক্ষত-বিক্ষত করেই মারা হয়েছে। শহীদ আবদুল আলীম চৌধুরীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা আবদুল হাফিজ চৌধুরী দুই বন্ধুসহ ১৮ই ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে তাঁর ভাইয়ের লাশ খুঁজে পান। তার পরিধেয় বস্ত্র দেখে লাশ শনাক্ত করেন। সেখান থেকে তার লাশ উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে আসা হয় এবং একইদিন আজিমপুর কবর স্থানে শহীদ আবদুল আলীম চৌধুরীকে সমাহিত করা হয়।
ঘাতকদের হাতে শহীদ হওয়ার সময় ডাক্তার আবদুল আলীম চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজে সহযােগী অধ্যাপক পদে নিয়ােজিত ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী (শহীদ জায়া হিসেবে খ্যাত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদয়ন বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষিকা)। এ দম্পতির ফারজানা চৌধুরী নীপা ও নুজহাত চৌধুরী শম্পা নামে দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, একাত্তরের শহীদ ডাঃ আলীম চৌধুরী, ঢাকা, আগামী প্রকাশনী ১৯৯১

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড