আন্দিউড়া এম্বুশ
আন্দিউড়া এম্বুশ (মাধবপুর, হবিগঞ্জ) রচিত হয় ১৪ই মে। এতে বহু পাকসেনা হতাহত এবং পাকবাহিনী বেশ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।
২৮শে এপ্রিল মাধবপুরের পতন ঘটে। পাকিস্তানি সেনারা শেরপুর-শাদীপুর লাইন আগেই দখল করে নিয়েছিল। তাই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক তাদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু তারা এ মহাসড়কটি নিজেদের যানবাহনের জন্য সরাসরি ব্যবহার করতে পারেনি। কেননা সড়কের ওপর বহু সেতু মুক্তিযােদ্ধারা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। তবে মুক্তিযােদ্ধারা যেসকল সেতু বিনষ্ট করেছিলেন, পাকসেনারা তাদের চলাচলের সুবিধার্থে মাটি ফেলে সেখানে বিকল্প রাস্তা তৈরি করে নিয়েছিল।
ঢাকা-সিলেট সড়কটি শত্রুদের চলাচলের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক করে তােলার জন্য মেজর কে এম সফিউল্লাহ তাদের সামরিক বহরে অতর্কিত আক্রমণের পরামর্শ দেন। শত্রুদের যােগাযােগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এ ধরনের একটি অভিযানে লেফটেন্যান্ট হেলাল মােরশেদকে মাধবপুরে প্রেরণ করা হয়। তিনি ১৩ই মে ১২ জন সৈন্য নিয়ে মাধবপুর সদর ইউনিয়নের বাগসাইর গ্রামে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। গ্রামটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী আন্দিউড়া গ্রামের পাশেই অবস্থিত। ঢাকা-সিলেট সড়কের সংশ্লিষ্ট সেতুর পাশেই আন্দিউড়া উম্মেতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয় ঘেঁষে মাধবপুর ইউনিয়ন কাউন্সিল কার্যালয় (বর্তমানে আন্দিউড়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়) অবস্থিত। বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী এই আন্দিউড়া গ্রামে ছিল মাধবপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বাড়ি। সেখানে মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতার আশংকায় পাকবাহিনী সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ে একটি অস্থায়ী ক্যাম্পও স্থাপন করেছিল। উক্ত বিদ্যালয়ের সঙ্গেই অবস্থিত ঢাকা-সিলেট সড়কের সংশ্লিষ্ট সেতুটি ইতঃপূর্বে বিধ্বস্ত হওয়ায় যােগাযােগের সুবিধার্থে এর পাশ দিয়ে প্রবাহিত খালের ওপর একটি বিকল্প রাস্তা নির্মিত হয়েছিল। রাস্তাটি মূল সড়ক থেকে অনেক নিচু হওয়ায় দূরে থেকে রাস্তার পুরােটা দেখা যেত না। তাই নিকটে শত্রু সেনাদের ক্যাম্প থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযােদ্ধারা এম্বুশের জন্য এ স্থানটিকেই উপযুক্ত মনে করে এক দুঃসাহসিক হামলা চালানাের জন্য পরিকল্পনা করেন।
নির্দিষ্ট স্থানে পৌছে লেফটেন্যান্ট মােরশেদ এবং তার লােকজন সেখানে দুটি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে রেখে শত্রুদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত তারা ওঁৎ পেতে থাকেন। কিন্তু পাকসেনারা আসেনি। লে. মােরশেদ এবং তার ১২ জন সৈনিক বিদ্রি রাত যাপনের ফলে ভীষণ ক্লান্ত। তাই সামান্য বিশ্রামের জন্য বাগসাইর গ্রামের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নেন।
তখন বেলা ৩টা। লেফটেন্যান্ট মােরশেদ এবং তার সৈন্যরা অতি গােপনে সেতুর কাছে ঘটনাস্থলে যান। একটি পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ন কনভয় সিলেট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে সেখানে আসতে দেখা যায়। কনভয়ের সামনের জিপটি যেই মাত্র ডাইভারশন রােডে প্রবেশ করে ঠিক তখনি পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণ ঘটে। জিপটি উড়ে গিয়ে রাস্তার বাইরে পড়ে। দ্বিতীয় জিপের ভাগ্যেও একই অবস্থা হয়। কনভয়টি থেমে যায়। এটি একটি বড় ধরনের কনভয় ছিল। শত্রুসৈন্যরা সংখ্যায় প্রায় ৩০০ জন ছিল। লেফটেন্যান্ট মােরশেদ এতটা আঁচ করতে পারেননি। কিন্তু তখন আর এ বিষয়ে ভাববার সময় ও সুযােগ ছিল না। সাহসে ভর করে তিনি তাঁর সবকটি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালান। এতে শত্রুরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু হতাহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবার পূর্বেই লে. মােরশেদ তাঁর দলবলসহ দ্রুত স্থান ত্যাগ করে নিরাপদ দূরত্বে চলে যান। পাকসেনারা গুলি ছুড়তে-ছুড়তে দুমাইল পর্যন্ত তাঁদের ধাওয়া করে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের ধরতে না পেরে পাকবাহিনী সেখানকার গ্রামগুলােতে নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন চালায়।
এ ধরনের অপারেশনে এবারই প্রথম এন্টিট্যাঙ্ক মাইন ব্যবহার করা হয়। এর ফলে শত্রুর জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা সম্ভব হয়। একজন এনসিও (নন কমিশন্ড অফিসার) এবং লে. মােরশেদ ব্যতীত উক্ত এম্বুশ পার্টিতে মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন ছাত্রও ছিলেন। ছাত্রদের মধ্য থেকে সাদেক, ওয়াকার, ফজলে হােসেন, সাদী, সেলিম, সালাম এবং আনিস অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশন লাভ করেন। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড