বীর প্রতীক আনিসুর রহমান
আনিসুর রহমান, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৮) বীর মুক্তিযােদ্ধা ও কাদের সিদ্দিকী বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার। তিনি ১৯৪৮ সালের ১লা জুন জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার স্থল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মকবুল হােসেন এবং মাতার নাম আমেনা বেগম।
আনিসুর রহমান ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি-সচেতন ছিলেন। তিনি ৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর মার্চের অসহযােগ আন্দোলন প্রতিটিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ এবং ৭১-এর ২৫শে মার্চের গণহত্যা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে যােগদানে অনুপ্রাণিত করে। প্রাথমিকভাবে তিনি টাঙ্গাইলের বহেরাতলা এবং পরবর্তীতে ভারতের তুরা ক্যাম্পে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। দেশে ফিরে তিনি কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম-এর বাহিনীতে যােগ দেন এবং কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন।
কোম্পানি কমান্ডার আনিসুর রহমান জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে সেখানে অবস্থানরত বেশকিছু লঞ্চ ও স্টিমার ধ্বংস করতে সমর্থ হন। তিনি অসীম সাহসিকতা আর নিখুঁত যুদ্ধ কৌশল খাটিয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাকবাহিনীর ৪টি ফেরি ও ১টি স্টিমার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেন। কৌশলগত কারণে ফেরিঘাটটি অচল করে দেয়া তাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকেও কাদের সিদ্দিকীকে এ কাজটি করার জন্য পূর্বেই বলা হয়েছিল। কাদের সিদ্দিকী এলাচিপুরে বাহাদুরাবাদ ঘাট ধ্বংস করার জন্য আনিসুর রহমানকে দায়িত্ব দেন। তার পক্ষে সুবিধাজনক দিক ছিল, তিনি ঐ এলাকার সরিষাবাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দা। পূর্ব থেকেই জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে নজর রাখার দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। ১লা ডিসেম্বর রাত ১০টায় ১২ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে আনিসুর রহমান বাহাদুরাবাদ ঘাটের দশ মাইল উজানে ম্যাগনেটিক মাইনসহ তিস্তা, ধলেশ্বরী ও ব্রহ্মপুত্রের পানিতে নেমে পড়েন। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে ছিল দুটি করে মাইন ও টাইম ফিউজ। রাতের অন্ধকারে অত্যন্ত ঠাণ্ডা পানিতে এক ঘণ্টা ভাটি পথে সাঁতার কেটে তাঁরা বাহাদুরাবাদ ঘাটে পৌছান। স্রোতের টানে ফেরিগুলেরা একেবারে গা ঘেঁষে যাবার সময় টাইম ফিউজের বােতাম টিপে মাইনগুলাে হাত থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। মাইনগুলাে চৌম্বক আকর্ষণে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চারটি ফেরি ও একটি জেটির গায়ে আটকে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা চার মাইল ভাটিতে চলে যাওয়ার পর কাক্ষিত বিস্ফোরণটি ঘটে। দশ মিনিটের মধ্যে ছাব্বিশটি মাইনের ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে ৪টি প্রধান ফেরিসহ মূল জেটিটি নদীগর্ভে ডুবে যায়। এ বিস্ফোরণে পাহারারত ৪-৫ জন রাজাকারের মৃত্যু ঘটে। আনিসুর রহমানের কোম্পানি ধনবাড়ি, মধুপুর, কাউসিক ব্রিজ, ভূঞাপুর, কালিবাড়ি ইত্যাদি স্থানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে বীরত্ব ও সাহসিকতার স্বাক্ষর রাখেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আনিসুর রহমানকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তাঁর স্ত্রীর নাম সামছুন্নাহার। এ দম্পতির ৩ পুত্র সন্তান রয়েছে। [শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড