You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে আদিতমারী উপজেলা (লালমনিরহাট) - সংগ্রামের নোটবুক

আদিতমারী উপজেলা

আদিতমারী উপজেলা (লালমনিরহাট) মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল কালীগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত একটি ইউনিয়ন। ১৯৮০ সালে এটি থানা এবং ১৯৮৩ সালে উপজেলার মর্যাদা লাভ করে। জেলা সদর থেকে ১১ কিমি পশ্চিমে বুড়িমারী রাস্তার পাশে এর অবস্থান।
সারা বাংলার জনগণের মতাে এ উপজেলার মানুষও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর দুঃশাসন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বরাবর সােচ্চার ছিল। জাতীয় বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তারা সক্রিয়ভাবে অংশ্রহণ করে। ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ভােট দেয়। ফলে আদিতমারী-কালীগঞ্জ এলাকা থেকে জাতীয় পরিষদে মাে. আজিজুর রহমান এমএনএ এবং প্রাদেশিক পরিষদে করিমুদ্দিন আহমেদ (থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি) এমপিএ নির্বাচিত হন। সারা দেশে উভয় পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর ফলে বাঙালিদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর তীব্র প্রতিবাদ করতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করে ১লা মার্চ তা স্থগিত ঘােষণা করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সঙ্গে হাত মেলান। অধিবেশন স্থগিত ঘােষণায় বাঙালিরা আরাে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক কালজয়ী ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি পাকিস্তানি দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আদিতমারী উপজেলার সর্বস্তরের জনগণ মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেয়।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর আদিতমারীর জনগণ পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী ও তাদের দোসরদের চিরতরে বাংলার মাটি থেকে উৎখাতের দৃঢ় সংকল্পে চারদিক স্লোগানে মুখরিত করে তােলে। বিহারি অধ্যুষিত এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। বিভিন্ন স্থানে নানা পেশার বাঙালিরা ৯ই মার্চ বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। ১০ই মার্চ খণ্ডখণ্ড বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। পাকহানাদার ও তাদের দোসরদের প্রতিহত করার প্রস্তুতি ও অস্ত্রসংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। শফিকুল ইসলাম মন্টু, শফিকুল ইসলাম কানু, নুরুল ইসলাম বাচ্চা, আব্দুস ছাত্তার এবং আব্দুল হামিদ মােল্লা ছাত্র-যুবদের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করেন। ১৫ই মার্চ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে করিমুদ্দিন আহমেদ এমপিএ-কে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এ পরিষদের সদস্য ছিলেন অলিউদ্দিন আহমেদ (থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও ইউনিয়ন বাের্ডের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট), ডা. আব্দুল হামিদ (থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), আবু জাফর সকাল থেকে এখানে সতর্ক অবস্থান নেন। এদিন বিকেল ৩টার দিকে পাকবাহিনী ব্রিজের দক্ষিণ পাড়ে অবস্থান নিয়ে হামলা চালায়। পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজ আহাদ ব্রিজ অতিক্রম করার চেষ্টা করলে মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে সে নিহত হয়। এক পর্যায়ে পাকবাহিনী পিছু হটে এবং পরের দিন ৩রা এপ্রিল ব্রিজের দক্ষিণ পাড়ে অবস্থান নিয়ে পুনরায় গােলাবর্ষণ শুরু করে। অবশেষে ৪ঠা এপ্রিল বিমান বাহিনীর সহায়তায় ত্রিমােহনী নদী অতিক্রম করে তারা আদিতমারী ও সাপটিবাড়ীতে প্রবেশ করে। তবে এ এলাকায় তাদের কোনাে ক্যাম্প ছিল না। আদিতমারী উপজেলায় অবাঙালি বিহারি ও স্বাধীনতাবিরােধী রাজাকাররা তৎপর ছিল। শীর্ষস্থানীয় চার রাজাকার হলাে- মােয়াজ্জেম হােসেন ওরফে ই আই সাহেব, মতিয়ার রহমান খান, নবীর হােসেন এবং আমির আলী মােক্তার। পাকবাহিনী আদিতমারীতে প্রবেশ করেই তাদের দোসরদের সহায়তায় নামড়ীর পাড়, ভেলাবাড়ী, পলাশী, কুমড়ীর হাট, আদিতমারী, মহিষখোচাসহ বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিসংযােগ ও হত্যাকাণ্ড শুরু করে। নামড়ীর পাড় গণহত্যা সংঘটিত হয় দুবার। এতে বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। এছাড়া হানাদাররা শঠিবাড়ী ও গন্ধমরুয়াসহ আশপাশের এলাকায় হত্যা ও অগ্নিকাণ্ড চালায়।
আদিতমারী উপজেলায় পাকবাহিনীর কোনাে নির্যাতনকেন্দ্র বা বন্দিশিবির ছিল না। তারা বাউরা ও বড়খাতা এলাকা এবং লালমনিরহাটের মােগলহাটে স্থাপিত ক্যাম্প থেকে এসে অভিযান চালাত।
উপজেলা সদর থেকে দুই কিমি দক্ষিণ-পূর্বে সতি নদীর ওপর স্বর্ণমতি ব্রিজে নিরীহ লােকদের হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হতাে। তাই এটি স্বর্ণমতি ব্রিজ বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। এ উপজেলায় বত্রিশ হাজারী হাইস্কুল মাঠে একটি গণকবর রয়েছে।
আদিতমারী উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের সরাসরি কোনাে যুদ্ধ হয়নি। তবে মহিশাশহরসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযােদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার চেষ্টা করেন।
৬ই ডিসেম্বর লালমনিরহাট জেলার সঙ্গে আদিতমারী উপজেলাও হানাদারমুক্ত হয়। আদিতমারী উপজেলার শহীদ মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- সিরাজ উদ্দিন (পিতা ইব্রাহিম, চরিতাবাড়ী), আহম্মেদ আলী (পিতা ছাবুল্লা মুন্সী, পশ্চিম ভেলাবাড়ী), আব্দুল খালেক (পিতা আরছুব আলী, চন্দনপাঠ), সাইদুর রহমান (পিতা ছফর উদ্দিন, চন্দনপাঠ), ওসমান গণি (পিতা হাজী জসমত আলী, চন্দনপাঠ), মােক্তকোমল হক (পিতা কেরামত আলী, সাপটিবাড়ী) এবং লুৎফর রহমান (পিতা আব্দুস ছােবাহান, মহিষখোচা)।
শহীদদের স্মরণে উপজেলা পরিষদের পাশে বুড়ির বাজারসংলগ্ন এলাকায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া শহীদ মুক্তিযােদ্ধা সিরাজ উদ্দিনের নামে লালমনিরহাট-বুড়িমারী সড়ক থেকে উপজেলা সদর পর্যন্ত লিংক রােডের নামকরণ করা হয়েছে সিরাজ উদ্দিন সড়ক। [মাে. কামরুল ইসলাম কাজল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড