You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুুদ্ধে আটোয়ারী উপজেলা (পঞ্চগড়) - সংগ্রামের নোটবুক

আটোয়ারী উপজেলা

আটোয়ারী উপজেলা (পঞ্চগড়) একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা। এটি ১৯৮০ সালে পঞ্চগড় জেলার একটি থানা ছিল। ১৯৮৩ সালে এটি উপজেলায় উন্নীত হয়। আটোয়ারীর উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বােদা উপজেলা, উত্তর-পূর্বে পঞ্চগড় সদর উপজেলা, পূর্বে বােদা উপজেলা, দক্ষিণে ঠাকুরগাঁও সদর ও ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা এবং পশ্চিমে ভারত সীমান্ত। সীমান্তবর্তী অঞ্চল হিসেবে আটোয়ারীতে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য ছিল।
১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোল, ১৯৬২ সালে আইয়ুব প্রবর্তিত সংবিধান-বিরােধী আন্দোলন, ১৯৬৪ সালের হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট-বিরােধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা কর্মসূচির সমর্থনে ও আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ইত্যাদির প্রভাব পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারীতেও পড়ে। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসকগােষ্ঠী দেশবাসীর ব্যালটের রায়কে বুলেটের মাধ্যমে। বানচাল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। তারা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালরাত্রিতে বিশ্বের ইতিহাসের বৃহত্তম গণহত্যা সংঘটিত করে। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার আহ্বান সমগ্র দেশের মানুষের সঙ্গে আটোয়ারী-উপজেলাবাসীকেও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করে। ৮ই মার্চ থেকে আটোয়ারীতে অনুষ্ঠিত সভা-সমাবেশ ও মিছিলে প্রতিদিন হাজার-হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে। তখন শুধু তুমি কে-আমি কে, বাঙালি-বাঙালি’, ‘এক দেশ এক জাতি’, ‘একটি চাওয়া, স্বাধীনতা’ – এসব স্লোগান মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে। দ্রুত মানুষ বীর বাঙালি অস্ত্র ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ – এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে।
আটোয়ারী উপজেলাসহ সমগ্র পঞ্চগড় এবং ঠাকুরগাঁও-এ মুক্তিযুদ্ধের মূল সংগঠক হিসেবে অকুতােভয় বীর মুক্তিযােদ্ধা এডভােকেট সিরাজুল ইসলামের নাম সর্বজনস্বীকৃত। তাঁর উদ্দীপনায় এলাকার সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের তালিকাবদ্ধকরণ এবং প্রশিক্ষণ প্রদান তাঁরই নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়। আটোয়ারী উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে অন্য যারা অসহযােগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেন, তারা হলেন- মাে. নূরুল হক (সুখ্যাতি), মাে. মমতাজউদ্দীন মন্টু (নলপুখরী), মাে. তরিকুল ইসলাম (রসেয়া), মহেন্দ্রনাথ দেব (নিতুপাড়া), মাে. বদরুদ্দৌজা (সর্দারপাড়া), মাে. নূরুল ইসলাম (বামনকুমার), মাে. সামশুল হক তারা মিয়া (রসেয়া) প্রমুখ। এডভােকেট সিরাজুল ইসলাম এবং উপুযুক্ত নেতাদের নেতৃত্বে এলাকার আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র-জনতা ও ইপিআর-এর বাঙালি সদস্যদের সংগঠিত করে যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু হয়।
আটোয়ারী গিরাগাও ইপিআর ক্যাম্পের সুবাদার মাে. সামশু (কুমিল্লা) ও ওয়ারলেস অপারেটর মাে. আব্দুল খালেক থ্রিনট-থ্রি ও মার্ক ফোর রাইফেল দিয়ে সীমান্ত এলাকায় প্রশিক্ষণ দেয়া আরম্ভ করেন। এতে অংশগ্রহণ করেন মাে. জহিরুল ইসলাম (গিরাগাঁও), মাে. বিশু (ধামাের), মাে. আসির উদ্দীন (ফুটকীবাড়ী), মির্জা মাে. নূরুল ইসলাম হেলাল (মির্জাপুর), মাে. শামসুল হক (বােধগাঁও)-সহ আরাে অনেকে। আটোয়ারী থানা সদরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ দেন আনসার কমান্ডার মাে. আব্দুস সাত্তার (রাধানগর), মুজাহিদ কমান্ডার মাে. আবুল কাশেম (পাহাড়ভাঙ্গা), আনসার কমান্ডার মাে. নজির হােসেন নাইটু (ছােটদাপ), মাে. ছবিল উদ্দীন (ছােটদাপ), মাে. গিয়াসউদ্দীন মশা (ছােটদাপ) প্রমুখ। মার্চের অসহযােগ আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলােতে আটোয়ারী থানা সদরে অনেককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
আটোয়ারীতে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডাররা হলেন- মাে. জহিরুল ইসলাম (ধামাের গাছবাড়ী), মির্জা মাে. নূরুল ইসলাম হেলাল (মির্জাপুর), মাে. আনােয়ার হােসেন (সুখ্যাতি), মাে. সামশুল হক (বােধগাঁও), মাে. ইন্তাজুর রহমান (বামনকুমার), মাে. আইয়ুব আলী (তেঁতুলিয়া), মাে. আবুল কালাম (ঠাকুরগাঁও) এবং মাে. আকবর আলী (বােদা) প্রমুখ। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালি নিধন ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সংবাদ শুনে আটোয়ারীর মানুষ চরমভাবে বিক্ষুব্ধ হয়। আটোয়ারীতে এপ্রিলের শুরুতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং আনসার, মুজাহিদ, ইপিআর, পুলিশ ও স্থানীয় ছাত্রজনতা এ প্রতিরােধে অংশগ্রহণ করে। রুহিয়া-পঞ্চগড় পাকা সড়কের গােয়ালদিঘীলক্ষ্মীপুর মাদ্রাসা সংলগ্ন পাকা রাস্তা ও মির্জাপুরডাঙ্গী সংলগ্ন পাকা সড়কে গাছের গুঁড়ি কেটে প্রাথমিক প্রতিরােধ গড়ে তােলা এছাড়া বর্ষালুপাড়া, বােধগাঁও, গিরাগাঁও। সােনাপাতিলা ইপিআর ক্যাম্প থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি ইপিআর সদস্যদের প্রথমে প্রতিরােধ এবং পরে বন্দি করে আটোয়ারী থানায় আনা হয়।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে আটোয়ারীতে পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে। প্রথমে তারা আটোয়ারী থানায় এবং পরে মির্জাপুরের দাড়িয়ার দিঘি ও ডাঙ্গীতে ক্যাম্প স্থাপন করে। ডাঙ্গী ক্যাম্প সাব-হেডকোয়ার্টার্স হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। এছাড়া রাধানগরের রানীগঞ্জেও পাকসেনাদের একটি ক্যাম্প ছিল। জামায়াতে ইসলামী, কাউন্সিল মুসলিম লীগ এবং কনভেনশন মুসলিম লীগ এর নেতা-কর্মী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা আটোয়ারীতে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসেবে কাজ করে। এরা পাকবাহিনীকে রাস্তা দেখিয়ে দেয়া, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের চিনিয়ে দেয়াসহ পাকসেনাদের সব ধরনের সহযােগিতা করত। আটোয়ারী উপজেলায় যে-সকল ব্যক্তি রাজাকার হিসেবে পাকবাহিনীকে সহযােগিতা ও শান্তি কমিটি গঠন করে, তারা হলাে- মাে. ওয়াসিম (ইউপি চেয়ারম্যান, রাধানগর শান্তি কমিটির সংগঠক), মাে. ফজলুল হক (পােস্ট মাস্টার, রাধানগর শান্তি কমিটির সদস্য), মাে. সামশুল হক (থানা। সদর পাকবাহিনীর সহযােগী ও রাজাকার), মাে. সিরাজ উদ্দীন পাটোয়ারী (রানীগঞ্জ, রাধানগর শান্তি কমিটির সংগঠক), মাে. ইব্রাহিম মুন্সি (জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী, নিতুপাড়া তােড়িয়া শান্তি কমিটির সংগঠক), কালুয়া মুন্সি (জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী, তােড়িয়া শান্তি কমিটির সংগঠক), ওসমান গণি (জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী, বলরামপুর, শান্তি কমিটির সংগঠক), লেবদা পুলিশ (অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য ও রাজাকার, তােড়িয়া), গুমানু মহাম্মদ (রাজাকার, বলরামপুর), বাচ্চু মহাম্মদ (সুখ্যাতি; পঞ্চগড়), মাে. আফতাবউদ্দীন (সুখ্যাতি, তােড়িয়া), মাে. আবুল (পাকিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুজাহিদ ও পাকবাহিনীর সহযােগী, পাহাড়ভাঙ্গা, তােড়িয়া), মাে. হাফেজ মােল্লা (রাজাকার, রসেয়া মসজিদের ইমাম), মাে. আব্দুল হাকিম (রাজাকার, বলরামপুর), মাে. মমতাজউদ্দীন (রাজাকার, বলরামপুর), মাে. ইছার উদ্দীন (রাজাকার, বলরামপুর), মাে. আছির মুন্সি (রাজাকার, বলরামপুর; শান্তি কমিটির সংগঠক), মাে. নবির উদ্দীন (রাজাকার, লক্ষ্মীরদার, বলরামপুর), বাংঠু মােহাম্মদ (রাজাকার, রামপুর) প্রমুখ।
এদের মধ্যে যারা শান্তি কমিটির সংগঠক ও সদস্য ছিল তারা থানা সদর ও ইউনিয়ন সদরে প্রতি সপ্তাহে সভা করত। ওয়াসিম চেয়ারম্যান থানা সদরে ও মাঝে-মাঝে ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভায় বক্তৃতা করত। ইব্রাহিম মুন্সি তােড়িয়ায় শান্তি কমিটির সভাগুলােতে নেতৃত্ব দিত। জামায়াতের নেতারা সেসব সভায় উপস্থিত থেকে পাকবাহিনীর প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করত। লেবদা পুলিশ পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে সমগ্র এলাকা চষে বেড়াত। তােড়িয়া ইউনিয়নের সবকটি অভিযানের সময় আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া এবং সাধারণ মানুষদের ধরে আনতে লেবদা পুলিশ নেতৃত্ব দিত। ভয়ঙ্কর রাজাকার গুমানু রাধানগর-বলরামপুর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। প্রাণের ভয়ে যেসব মানুষ ভারতে চলে গিয়েছিল, তাদের আত্মীয়-স্বজনদের ধরে সে হত্যা করত। বাচ্চু রাজাকার পঞ্চগড় থেকে সশস্ত্র অবস্থায় আটোয়ারী এসে টহল দিত। হাফেজ মােল্লা অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন রাস্তায় মানুষের ওপর নির্যাতন চালাত। আবুল পাকসেনাদের সঙ্গে থাকত। সে উর্দু, পশতু ও পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলতে পারত বলে পাকসেনাদের কাছে তার আলাদা গুরুত্ব ছিল। শান্তি কমিটির সংগঠক সিরাজউদ্দীন পাটোয়ারীর বিশেষ প্রভাব ছিল। শান্তি কমিটির এসব সদস্য ও রাজাকাররা সারাক্ষণ পাকিস্তানিদের অপকর্মে মদদ দিত। পাকসেনারা প্রতিটি অপারেশনের সময় নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত। রাজাকাররা এসব ক্ষেত্রে হানাদারদের সহায়তা করত। অটোয়ারীর বিভিন্ন গ্রামে অনেক মানুষ পাকবাহিনী ও রাজাকারদের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়। ২৭শে মে রাধানগর গ্রামের মাে. খাদেমুল ইসলাম (পিতা খােশাে সরকার), মাে. জাহেরুল ইসলাম (পিতা খােশাে সরকার), মাে. ছুটু পাইকার, মহিউদ্দীন ও সালেহা খাতুন পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে নিহত হয়।
৬ই আগস্ট উপজেলার ডাঙ্গী গ্রামে পাকসেনা ও রাজাকাররা গণহত্যা চালায়। এখানে তারা ১৩ জন মানুষকে হত্যা করে। এ ঘটনা ডাঙ্গী গণহত্যা নামে পরিচিত। হত্যার পর ডাঙ্গী গণকবর-এ তাদের সমাহিত করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিকে বড়সিঙ্গিয়া, মলানি ও পূর্ব নিতুপাড়া গ্রামে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা কয়েকজন মানুষকে হত্যা করে। নিহতরা হলেন- মাে. আজিজার রহমান ফাগু (পিতা ইমাম উদ্দীন, বড়সিঙ্গিয়া), মাে. আইনুল হক (পিতা ঘিনাই মােহাম্মদ, বড়সিঙ্গিয়া), ঢাকাইয়া সামাদ (বড়সিঙ্গিয়া), বিলাতু (মলানি) এবং আ. হাকিম (পিতা কসিরতদ্দীন, পূর্ব নিতুপাড়া)। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী বলরামপুর গ্রামের মাে. আনােয়ার হােসেন (পিতা মাে. মােতলেব উদ্দীন) ও মাে. আব্দুল লতিফ মেম্বারকে হত্যা করে।
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা অক্টোবরের প্রথমদিকে সুখ্যাতি গ্রামের মাে. খয়ের আলী (পিতা কিয়ামত সরকার), মাে. আসির উদ্দীন (পিতা খয়ের আলী) ও মাে. আসিক উল্লাহ (পিতা হাজী কাশেম আলী)-কে হত্যা করে। অক্টোবর মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা মির্জাপুর, নলপুখরী, পূর্ব সুখ্যাতি, লক্ষ্মীপুর ও পানিয়াপুখরী গ্রামে মাে. মফিজ উদ্দীন (পিতা আব্দুর রহিম, নলপুখরী), মাে. ইমাম উদ্দীন (পিতা বুধারু মােহাম্মদ, পূর্ব সুখ্যাতি), নেলু মােহাম্মদ (লক্ষ্মীপুর) এবং ভাদ্র মােহাম্মদ (পানিয়াপুখরী)-কে হত্যা করে। ২৮শে অক্টোবর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা মির্জাপুর দাড়িয়ার দিঘিতে গণহত্যা চালায়। এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি মির্জাপুর দাড়িয়া দিঘি গণহত্যা নামে পরিচিত। এতে ১১ জন মানুষ শহীদ হন এবং তাদের গণকবর দেয়া হয়, যা মির্জাপুর দাড়িয়া দিঘি গণকবর নামে চিহ্নিত। এ গণহত্যার পূর্বে মুক্তিযােদ্ধা ও হানাদারবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধে ৮ জন পাকসেনা নিহত ও কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। ২রা নভেম্বর পাকবাহিনী বামনকুমার গ্রামের ৫ জনকে হত্যা করে। বামনকুমার গণহত্যায় নিহতরা হলেন- মাে. কুদ্দুস আলী (পিতা কানু মােহাম্মদ), মাে. কদম আলী, ইদ্রিস আলী (পিতা হাফিজ উদ্দীন), খবির উদ্দীন শাহ ও খাসির উদ্দীন। ১৭ই নভেম্বর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা উপজেলার তােড়িয়া গ্রামে এক নির্মম গণহত্যা চালায়। এতােড়িয়া গণহত্যায় এক সঙ্গে কমপক্ষে ২৫ জন মানুষ প্রাণ হারান। এছাড়া ৭-৮ জন নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে পাকসেনা এবং তাদের সহযােগী রাজাকার-আলবদর বাহিনী কর্তৃক এলাকায় বহু নারী নির্যাতিত হন। এসব নারীর অনেকে সেই দুর্বিষহ স্মৃতি নিয়ে এখনাে বেঁচে আছেন। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা আটোয়ারী উপজেলার পশ্চিম ও উত্তর পার্শ্বের এলাকা ছাড়া সমগ্র উপজেলায় অসংখ্য গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। তারা মির্জাপুর, ঝলঝলী, নলপুখরী, বারআউলিয়া, লক্ষ্মীপুর, উত্তর তােড়িয়া, দক্ষিণ তােড়িয়া, পশ্চিম তােড়িয়া, উত্তর ও দক্ষিণ সুখ্যাতি ইত্যাদি গ্রামের প্রায় সমস্ত বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। আলােয়াখােয়ার বামনকুমার, বালিয়া, রামপুর, মােলানী; রাধানগর ইউনিয়নের ছােটদাপ, বড়দাপ, রাধানগর, গােবিন্দপুর; ধামােরের পানিশাইল, গিরাগাঁও, ধামাের এবং বলরামপুরের সাতখামার গ্রাম তারা পুড়ে ছারখার করে দেয়। পাকবাহিনী এ এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন ও অগ্নিসংযােগের সঙ্গে-সঙ্গে অবাধ লুণ্ঠন চালায়। তারা নগদ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার ছাড়া গবাদি পশুও লুট করত। উপজেলার ডাঙ্গীতে পাকবাহিনীর একটি নির্যাতনকেন্দ্র ছিল।
আটোয়ারী ও পঞ্চগড়ের পশ্চিমাঞ্চল থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লােকজনদের ধরে এনে এখানে অমানুষিক নির্যাতন চালানাে হতাে। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর গুলবাহার, সুবেদার আলী নেওয়াজ ও মিলিশিয়া বাহিনীর রহমতের নেতৃত্বে তারা এখানে ভয়ঙ্কর নির্যাতন সেল গড়ে তােলে। এ কেন্দ্রের বটগাছের ডালে ঝুলিয়ে অবিরাম লাঠিচার্জ, পানি ঢালা, পা উপরে বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানাে, নখে সুঁই ফুটিয়ে দেয়া, পুরুষাঙ্গে ইট বেধে ঝুলিয়ে রাখা, হাত-পা বেঁধে দিঘির ঠাণ্ডা পানিতে সারারাত ফেলে রাখা প্রভৃতি যন্ত্রণাদায়ক নির্যাতন শেষে হত্যা করত। আর তােড়িয়া, আলােয়াখােয়া ও রাধানগর এলাকার মানুষদের ধরে প্রথমে আটোয়ারী থানা ক্যাম্পে নির্যাতন করত। পরে ওখান থেকে পার্শ্ববর্তী রুহিয়া রামনাথ হাট ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন শেষে হত্যা করত। ডাঙ্গী, মির্জাপুরের দাড়িয়ার দিঘি ও আটোয়ারী থানায় বন্দিশিবির ছিল। এ উপজেলায় দুটি গণকবর রয়েছে। সেগুলাে হলােডাঙ্গী গণকবর ও মির্জাপুর দাড়িয়ার দিঘি গণকবর। আটোয়ারী উপজেলায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ এবং অনেক খণ্ড যুদ্ধ হয়। জুলাই মাসের প্রথমদিকে কমান্ডার জহিরুল ইসলামের নেতৃত্বে মির্জাপুর পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ করলে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধ এক ঘণ্টা ধরে চলে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাকসেনা রহমত খানকে আটক করা হয়। পরে সে নিহত হয়। নুর ইসলাম ও জহিরুল ইসলামের নেতৃত্বে জুলাই মাসের শেষদিকে মুক্তিযােদ্ধারা আটোয়ারী থানা ক্যাম্প আক্রমণ করেন।
এ-যুদ্ধে ৪০-৫০ জন মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। জুলাই মাসের শেষদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এস মুখার্জীর নেতৃত্বে বালিয়া বহুবাধে পাকসেনাদের সঙ্গে একটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ৩রা আগস্ট বালিয়া ধনতলা সীমানায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর শেরকী এবং কমান্ডার মােস্তফার নেতৃত্বে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা সিরাজুল ইসলাম ও মুজাহিদ আলিম উদ্দীন আহত হন।
নভেম্বর মাসের প্রথমার্ধে মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার নুরল ইসলাম হেলালের নেতৃত্বে নয়নী বুরুজ রেলস্টেশনে পাকহানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করলে সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এতে ২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে পাকসেনারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রাজাকার মুক্তাবদ্দীনের বাড়িতে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল অবস্থান নিলে পাকসেনারা মুক্তাবদ্দীনের ইঙ্গিতে বাড়িটি ঘিরে ফেলে। এখানে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ৩ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। নভেম্বর মাসের শেষদিকে মির্জাপুর পানিয়াপুখরী গ্রামে পাকসেনা ও মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকসেনারা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। ৩০শে নভেম্বর বােদা মুক্ত হওয়ার দিন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিত্রবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধ ৩ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। অবশেষে পাকবাহিনী সৈয়দপুরের দিকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। আটোয়ারী উপজেলা ২রা ডিসেম্বর সম্পূর্ণভাবে হানাদারমুক্ত হয়। আটোয়ারীতে এ উপজেলার কোনাে মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হননি। তবে দিনাজপুর মহারাজার বাড়িতে পাকসেনা ক্যাম্পে মাইন বিস্ফোরণে এ উপজেলার ছেপড়াঝারের মুক্তিযােদ্ধা আবুল কাশেম, বােধগাঁও-এর সৈয়দ আলী, বর্ষালুপাড়ার নাইম উদ্দীন এবং ঢাকার ঘােড়াশালে বিস্ফোরণে নলপুখরী গ্রামের আজিজার রহমান শহীদ হন।
মির্জাপুর দাড়িয়ার দিঘি পাড়ে নিহতদের স্মৃতিতে একটি ফলক নির্মিত হয়েছে। তাতে শহীদদের নাম লেখা আছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ফকিরগঞ্জ বাজারের প্রবেশপথে মুক্তিযােদ্ধা মঞ্চ ও মুক্তিযােদ্ধা চত্বর নির্মাণ করা হয়েছে। দিনাজপুর মহারাজার বাড়ি ও ঘােড়াশালে বিস্ফোরণে যেসব মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন, তাঁদের স্মৃতিতে আটোয়ারী উপজেলা সংলগ্ন ফকিরগঞ্জ বাজারে ঢােকার রাস্তাগুলাের নাম দেয়া হয়েছে। মির্জাপুরের নলপুখরী গ্রামে হাইওয়ে সংলগ্ন শহীদ মুক্তিযােদ্ধা আজিজার রহমানের নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে। [মাে. রমজান আলী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড