আটঘরিয়া উপজেলা
আটঘরিয়া উপজেলা (পাবনা) এখানে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পরপরই। তার আগে ২রা মার্চ থেকে দেশব্যাপী অসহযােগ আন্দোলন-এর ঢেউ এ উপজেলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সড়ক অবরােধ, মিটিং, মিছিলসহ আন্দোলন উপজেলার সকল স্কুল-কলেজে বিস্তার লাভ করে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এলাকার ছাত্র-যুবক ও শ্রমিকজনতা মুক্তিযুদ্ধের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর থেকেই মূলত অসহযােগ আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ নেয়। তখন মিটিং-মিছিলে বীর বাঙালী অস্ত্র ধরাে – বাংলাদেশ স্বাধীন করাে’, ‘তােমার আমার ঠিকানা – পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি স্লোগান যুব-সমাজে ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি করে। আন্দোলন-সংগ্রাম থানা সদর থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ, বিশেষ করে আটঘরিয়া থানা ও বাজার এলাকা, দেবােত্তর বাজার এলাকা, সড়াবাড়িয়া, বেরুয়ান, খিদিরপুর, মাজপাড়া, চাঁদভা, ভরতপুর, গােড়রী এবং একদন্ত ইউনিয়নের কিছু এলাকায় ছাত্র-যুবকরা যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। লাঠি, ফালা, সরকি, ডামি রাইফেল, কোথাও-কোথাও বন্দুকসহ ট্রেনিং শুরু হয়। এসব ট্রেনিং সেন্টারে আনসার, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক এবং স্কুলকলেজের স্কাউট সদস্যরা প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
আটঘরিয়া উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আজিজুর রহমান ফনি (অভিরামপুর)। তিনি ছিলেন মুজিবনগর সরকার-এর একজন কর্মকর্তা ও মুক্তিযােদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন আনােয়ার হােসেন রেনু (গকুলনগর), মােন্তাজ উদ্দিন (চাদভা), শাজাহান (নয়নামতি, পাবনা সদর), ওয়াছেব আলী (ঈশ্বরদী) এবং আব্দুল মান্নান গােরা (রাধানগর, পাবনা সদর)।
২৮ ও ২৯শে মার্চ পাবনা শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি যুদ্ধ হয়, যা “পাবনা প্রতিরােধ যুদ্ধ” নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে আটঘরিয়া উপজেলার অনেক তরুণ অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে প্রায় ২০০ পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে কয়েকজন প্রতিরােধযােদ্ধা শহীদ হন। পাবনা শহর প্রতিরােধ যুদ্ধে পরাজয়ের পর এপ্রিলের ১১ তারিখ পাকসেনারা পুনরায় পাবনা শহরে প্রবেশ করে এবং এর পরপরই আটঘরিয়া থানা সদর তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পরবর্তীতে পাকবাহিনী ও তাদের সহযােগীরা একদন্ত বাজারে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। আটঘরিয়া উপজেলায় স্বাধীনতাবিরােধীরা শান্তি কমিটি, আলবদর ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে পাকবাহিনীকে সহযােগিতা করে। এসব বাহিনীর সদস্যরা হলাে- শান্তি কমিটি: প্রেসিডেন্ট আব্দুল ওয়াহেদ খান (শ্রীকান্তপুর), সেক্রেটারি আবু বকর ওরফে বাকু কেরানী (উত্তরচক), সদস্য মৌলানা আ. লতিফ (রুস্তমপুর), জহির উদ্দিন (শিবপুর), আব্দুল জব্বার (রামচন্দ্রপুর), সদর উদ্দিন (কুষ্টিয়াপাড়া), সাহাজ উদ্দিন মােল্লা (বাচামারা), আমির উদ্দিন খান (ধলেশ্বর), মৌলানা তােরাব আলী (বিশ্রামপুর), তােফাজ্জল হােসেন (বেলদহ); আলবদর বাহিনী: কমান্ডার মৌলানা বেলাল হােসেন (ধলেশ্বর), পাবনা জেলা আলবদর বাহিনীর অন্যতম প্রধান আব্দুস সাত্তার মােল্লা (রঘুনাথপুর); রাজাকার বাহিনী: কমান্ডার আব্দুল মমিন (খিদিরপুর), সহ-কমান্ডার আব্দুর রশীদ (দেবােত্তর) ও তােরাব আলী (কুষ্টিয়াপাড়া), সদস্য আব্দুল লতিফ (বরুলিয়া), আবু তালেব (বরুলিয়া), মজিবুর রহমান ঠান্ডা (দেবােত্তর), আব্দুল মালেক (আটঘরিয়া), করম আলী (কন্দর্পপুর), আব্দুল জলিল (কন্দর্পপুর), আলাউদ্দিন (আটঘরিয়া), গুটু আলী (কুষ্টিয়াপাড়া), আকবর আলী (বিশ্রামপুর), আব্দুল মান্নান (বিশ্রামপুর), ইউনুছ আলী (বিশ্রামপুর), হাচেন আলী (চক ধলেশ্বর), রুহুল আমিন (চাদভা), হাসান আলী (চাদভা), দবির উদ্দিন (সঞ্জয়পুর) এবং মােসলেম উদ্দিন (গােয়ালপাড়া)।
মৌলানা বেলাল হােসেন মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযােগে স্বাধীনতার পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও পাবনা জেলা কারাগারে সে বন্দি ছিল। ১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় সে কারাগার থেকে মুক্তি পায়।
আব্দুস সাত্তার মােল্লা পাবনার মুক্তিযুদ্ধবিরােধীদের মধ্যে অন্যতম এবং কুখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা ক্যাপ্টেন জায়দী-র সহকারী ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সে পাবনা শহরের উপকণ্ঠে দোগাছী বাজারে সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করে বহু অপরাধ সংঘটিত করে। স্বাধীনতার পরে সে বিদেশে আত্মগােপন করে এবং ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে ফেরে।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা চাঁদভা ইউনিয়নের রুস্তমপুর, কুষ্টিয়াপাড়া, আটঘরিয়া, চাদভা, সঞ্জয়পুর; দেবােত্তর ইউনিয়নের অভিরামপুর, গােড়রী; একদন্ত ইউনিয়নের একদন্ত, শিবপুর; মাজপাড়া ইউনিয়নের মাজপাড়া, খিদিরপুর, কচুয়ারামপুর, কাগমারী, কৈডাঙ্গী, শ্রীপুর; লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের কৈজুরী ও লক্ষ্মীপুর গ্রামে হত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযােগ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটায়। এ উপজেলায় দুটি গণহত্যা সংঘটিত হয় – লক্ষ্মীপুর গণহত্যা ও দেবােত্তর গণহত্যা। লক্ষ্মীপুর গণহত্যা সংঘটিত হয় ২০শে আগস্ট। এতে বহু নিরীহ মানুষ নিহত হয়। দেবােত্তর গণহত্যা সংঘটিত হয় ২৬শে মে। এতে ২৪ জন নিরীহ গ্রামবাসী প্রাণ হারায়। আটঘরিয়া থানা ক্যাম্প ও একদন্ত ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। এখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লােকদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতাে।
উপজেলায় ছয়টি গণকবর রয়েছে। সেগুলাে হলাে-সােনাকান্দর গণকবর (মাজপাড়া), বংশিপাড়া গণকবর (মাজপাড়া), শ্রীপুর গণকবর (লক্ষ্মীপুর), লক্ষ্মীপুর গণকবর, দেবােত্তর গণকবর এবং আটঘরিয়া থানা সংলগ্ন গণকবর।
আটঘরিয়া উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের উল্লেখযােগ্য যুদ্ধগুলাে হলাে বেরুয়ান যুদ্ধ, বংশিপাড়া যুদ্ধ, আটঘরিয়া থানা অপারেশন এবং ২বেলদহ যুদ্ধ। বেরুয়ান যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২২শে অক্টোবর। এদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে রাজাকার প্রধান আব্দুল মমিনের নেতৃত্বে একদল রাজাকার খিদিরপুর, মাজপাড়া, হাড়লপাড়া প্রভৃতি গ্রামে লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ, নারীধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত করে। এদের ফেরার পথে আনােয়ার হােসেনের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা বেরুয়ান গ্রামে তাদের আক্রমণ করেন। এতে ৯ জন রাজাকার নিহত হয়। অপরদিকে মাে. হায়দার আলী ও তােয়াজ উদ্দিন নামে দুজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। বংশিপাড়া যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬ই নভেম্বর। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন তাহেরসহ ১৩ জন সৈন্য নিহত হয়। অপরপক্ষে ১১ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা দলের নেতৃত্ব দেন আনােয়ার হােসেন রেনু। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করলে পাকবাহিনী স্থানীয় ১২ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। আটঘরিয়া থানা অপারেশন পরিচালিত হয় ১১ই ডিসেম্বর। এদিন তিনশতাধিক মুক্তিযােদ্ধা আটঘরিয়া থানা আক্রমণ করলে থানায় অবস্থানরত হানাদার বাহিনী এক পর্যায়ে পালিয়ে যায়। এযুদ্ধে দুজন মুক্তিযােদ্ধা গুরুতরভাবে আহত হন। বেলদহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১১ই ডিসেম্বর। এদিন আটঘরিয়া থানায় অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর একটি দল বেলদহ গ্রামের বাসিন্দাদের ওপর হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযােগসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত করতে থাকে। এ খবর পেয়ে আশপাশে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা এসে তাদের এম্বুশ করেন। এক পর্যায়ে তারা আক্রমণ করলে শুরু হয় যুদ্ধ। এতে হানাদার বাহিনীর অনেক সদস্য হতাহত হয়। ১৩ই ডিসেম্বর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
আটঘরিয়া উপজেলার শহীদ মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- আব্দুল জলিল মিয়া (আটঘরিয়া থানা এলাকা; ২৯শে মার্চ পাবনা সদর থানার মালিগাছায় পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ এবং দেবােত্তর বাজার জামে মসজিদের পাশে সমাহিত), মাে. হায়দার আলী (পিতা বদর উদ্দিন, পাটেশ্বর; ২৩শে অক্টোবর রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ এবং মাজপাড়া কবরস্থানে সমাহিত), তােয়াজ উদ্দিন (পিতা কলিম উদ্দিন খান, ত্রিমােহন; ২৩শে অক্টোবর বেরুয়ান গ্রামে রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ এবং মাজপাড়া কবরস্থানে সমাহিত), আবুল কালাম আজাদ ওরফে আবুল কাশেম (পিতা শাহের আলী, বেরুয়ান; ৬ই নভেম্বর মাজপাড়া ইউনিয়নের বংশিপাড়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ এবং নিজ গ্রামে সমাহিত), আব্দুল খালেক (পিতা মাে. আব্দুল হক শেখ, মাজপাড়া; ৬ই নভেম্বর মাজপাড়া ইউনিয়নের বংশিপাড়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ এবং নিজ গ্রাম মাজপাড়ার কবরস্থানে সমাহিত) এবং তােতা মিয়া (পিতা দেওয়ান আলী, বাচামারা; ২০শে নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রােহনপুর রেল স্টেশনের পশ্চিমে সাহাপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন এবং সেখানেই সমাহিত)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযােদ্ধাদের স্মরণে মাজপাড়া ইউনিয়নের বংশিপাড়া গ্রামের যুদ্ধক্ষেত্র-সংলগ্ন স্থানে সরকারিভাবে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে মাজপাড়া ইউনিয়নের খিদিরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়। শহীদ আব্দুল খালেক উচ্চ বিদ্যালয়। দেবােত্তর থেকে মুলাডুলি পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ আবুল কাশেম সড়ক, দেবােত্তর থেকে একদন্ত পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ তােয়াজ উদ্দিন সড়ক, উত্তর চক থেকে গােড়রী বাজার পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ হায়দার আলী সড়ক, আটঘরিয়া বাজার থেকে চাঁদভা বাজার পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ তােতামিয়া সড়ক এবং চাঁদভা (কড়ইতলা) থেকে খিদিরপুর পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ আব্দুল খালেক সড়ক রাখা হয়েছে। এছাড়া আটঘরিয়া উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে দেবােত্তর বাজারের জামে মসজিদ-সংলগ্ন শহীদ আব্দুল জলিল মিয়ার কবর, চাঁদভা ইউনিয়নের বেরুয়ান গ্রামে শহীদ আবুল কালাম আজাদের কবর এবং মাজপাড়া ইউনিয়নের মাজপাড়া কবর স্থানে শহীদ আব্দুল খালেক, শহীদ হায়দার আলী ও শহীদ তােয়াজ উদ্দিনের কবর পাকা করা হয়েছে। [আমিরুল ইসলাম রাঙা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড