আজিজুল হক, বীর প্রতীক
আজিজুল হক, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৫) বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৪৫ সালের ১লা এপ্রিল ভারতের জলপাইগুড়ির আলীপুরদোয়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের পর তাদের পরিবার লালমনিরহাটে স্থানান্তরিত হয়। তাঁর পিতার নাম ছখি উদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম আছিয়া খাতুন। তিনি ১৯৬৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আজিজুল হক স্কুল ও কলেজে ছাত্র থাকাকালে রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। ১৯৬৮ সালে তিনি মুজাহিদ বাহিনীতে যােগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এ যােগ দেন। ১৯৭১ সালের মার্চে ছুটিতে বাড়ি আসার পর তিনি মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ করে ছাত্র ও তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে মার্চের শেষ ও এপ্রিলের শুরুতে লালমনিরহাট হাইস্কুল মাঠে প্রায় অর্ধশত ছাত্র ও যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ৩রা এপ্রিল ফুলবাড়িয়া থেকে আসা অবাঙালি ইপিআরদের ৬ জনের একটি দলের সঙ্গে আজিজুল হকের নেতৃত্বাধীন বাঙালি ইপিআর সদস্যদের বর্তমান টিএনও অফিসের সামনে যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে লুৎফুর রহমান নামে একজন বাঙালি ইপিআর সদস্য শহীদ হন। তিনি ছিলেন লালমনিরহাটের প্রথম শহীদ। অবাঙালি ইপিআর-রা এখান থেকে কিছুদূর এগিয়ে বর্তমান বিজিবি ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী বড় মাঠের কাছে গেলে জনতা তাদের ঘেরাও করে। ঘেরাও হওয়ার পর ইপিআর সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে মারমুখী অবস্থান নেয়। তবে তারা কোনাে নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের কাছে। আত্মসমর্পণ করবে বলে জানায়। খবর পেয়ে আজিজুল হক তাঁর সহযােদ্ধাদের নিয়ে সেখানে গেলে অবরুদ্ধ অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। উপস্থিত বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে সেখানে ৫ জন নিহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আজিজুল হক ১১ই এপ্রিল তাঁর পিতামাতা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ভারতের জলপাইগুড়িতে তাঁদের পুরনাে বাড়িতে যান। সেখানে বৃদ্ধ ও অসুস্থ পিতা মাতাকে রেখে তিনি সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে যােগ দেন। সেখানে প্রথমে তিনি এক কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। মুজিবনগর সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর পরিদর্শনে এলে আজিজুল হক ও অন্য মুক্তিযােদ্ধারা তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। আজিজুল হক যখন দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত, তখন তাঁর অসুস্থ পিতা মৃত্যুবরণ করেন।
সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধ শুরু হলে আজিজুল হক ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন। তাঁর সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন নওয়াজিশ উদ্দিন। সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের অধীনে ফুলবাড়ী-ভুরুঙ্গামারী-উলিপুর এলাকায় যুদ্ধ করার জন্য আজিজুল হককে কোম্পানি কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। তিনি এসব এলাকার বিভিন্ন যুদ্ধ অসীম সাহসিকতার সঙ্গে পরিচালনা করেন। তিনি একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। ক্যাপ্টেন নওয়াজিশ নভেম্বর মাসে আজিজুল হককে নাগেশ্বরী-ভুরুঙ্গামারী সড়কের সন্তোষপুরের পার্শ্ববর্তী স্থানে রাস্তা বিধ্বস্ত করে পাকবাহিনীর যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেন। নির্দেশ অনুযায়ী রেকি ও অন্যান্য প্রস্তুতি শেষে তিনি ১৪ই নভেম্বর সন্তোষপুরের কাছে সড়ক ধ্বংস করেন। ১৬ই নভেম্বর আজিজুল হক পুনরায় সন্তোষপুর গেলে তিনি দেখেন যে, পাকসেনারা রাস্তা পুনর্নির্মাণ করছে। এদিন তিনি সাহস ও বুদ্ধি প্রয়ােগ করে পাকবাহিনীর ৪৮ কিউ আর্টিলারি কোরের আতা মােহাম্মদ ও ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মােহাম্মদ আসলাম নামে ২ জন সিপাহিকে আটক করেন। এদের কাছ থেকে দুটি রাইফেল ও কয়েক শত রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেন। আজিজুল হক এ দুই হানাদার সৈন্যকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে সােপর্দ করেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার আজিজুল হককে বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নম্বর ৪০৯, খেতাবের সনদ নম্বর ১৫৯)।
মুক্তিযুদ্ধের পর ন্যাশনাল মিলিশিয়া গঠিত হলে আজিজুল হক তাতে যােগ দেন। তিনি গাইবান্ধা ও রংপুরে দায়িত্ব পালন করেন। ৬ মাস এ বাহিনীতে দায়িত্ব পালনের পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। তাঁকে কুমিল্লায় বদলি করা হয়। ১৯৭৩ সালে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।
নিয়মিত চাকরি জীবন থেকে অবসর নেয়ার পর বর্তমানে তিনি সমাজ উন্নয়ন, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং দুর্নীতি দমন বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থা ও কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তিনি ব্যক্তি জীবনে ১ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম ফরিদা হক। তারা বর্তমানে লালমনিরহাটে বসবাস করছেন। [জালাল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড