You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে আকবর বাহিনী - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে আকবর বাহিনী

আকবর বাহিনী (শ্রীপুর, মাগুরা) স্থানীয় একটি মুক্তিবাহিনী। এর প্রধান ছিলেন আকবর হােসেন মিয়া।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মাগুরায় যে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়েছিল, পরিস্থিতির অবনতি হলে মে মাসের প্রথম দিকেই কমিটির বেশির ভাগ নেতৃবৃন্দ ভারতে চলে যান। এক ধরনের নেতৃত্ব ও নির্দেশনাহীন অবস্থায় মাত্র কয়েকটি ৩০৩ রাইফেল, ১টি চাইনিজ রাইফেল ও কয়েক রাউন্ড গুলির ওপর নির্ভর করে ৩নং শ্রীকোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আকবর হােসেন মিয়া একটি সুশৃঙ্খল মুক্তিবাহিনী গড়ে তােলেন। যুদ্ধ চলাকালে এ বাহিনী ‘আকবর বাহিনী’ নামে পরিচিতি পায়। আকবর হােসেন মিয়া ১৯২৭ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর শ্রীপুর উপজেলার খামারপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম গােলাম কাদের মিয়া, মাতা নবেজান খাতুন। তিনি ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ১৯৫১ সালে রয়েল পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যােগ দেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে তিনি ১৯৫৪ সালে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। ১৯৬৪ সালে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যােগদান করেন এবং শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে তিনি শ্রীকোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ২৪ বছর এ পদে বহাল ছিলেন। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার পরপর তিনি হরিন্দীর শাহাদত আলী, সুধীর কুমার, শ্রীপুরের মুকুল, জোকার মাে. আলাউদ্দিন, গােয়ালপাড়ার আবু বকর, টুপিপাড়ার আবুল হােসেন মিয়া, খামারপাড়ার খন্দকার আবু হাসান, মিয়া সিরাজুল ইসলাম, হােগলডাঙ্গার নাছিরসহ শ্রীপুরের ছাত্র-যুবকদের নিয়ে মাগুরা আনসার ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করেন। পুলিশ হাবিলদার শাহজাহান, হারেছার রশীদ এবং আবদুল মান্নান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ২৪শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী মাগুরা শহর দখল করলে আকবর হােসেন মিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শ্রীপুরে স্থানান্তর করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি বাহিনী গড়ে তােলেন। শ্রীপুর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এ বাহিনী এলাকায় স্বাধীনতাবিরােধীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে থাকে। এ বাহিনীতে ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের মােট ১২৮ জন এবং সাধারণ পরিবার থেকে আসা হাজারেরও বেশি যােদ্ধা ছিলেন। এ বাহিনীর যােদ্ধারা শ্রীপুর, বালিয়াকান্দি, শৈলকুপা, পাংশা, ঝিনাইদহ, রাজবাড়ী অর্থাৎ ঝিনাইদহের গাড়াগঞ্জ থেকে ফরিদপুরের গােয়ালন্দ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাঁদের দখলে এনেছিলেন। অধিনায়ক আকবর হােসেন মিয়ার দক্ষ নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য সফল অভিযান চালানাে হয়েছিল। সেসব অভিযানের মধ্যে শ্রীপুর থানা দখল, শৈলকুপা থানা দখল, ইছাখাদা ও মাগুরা আনসার ক্যাম্প আক্রমণ, নাকোলের যুদ্ধ, কামারখালীর যুদ্ধ ও আলফাপুরের যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। শত্রুর কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েই এ বাহিনী তাদের অস্ত্রের চাহিদা মিটিয়েছিল। আর বাহিনীর খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা মিটিয়েছিল স্থানীয় জনগণ। অধিকৃত অঞ্চলে বাহিনী প্রধান একটি প্রশাসন গড়ে তােলেন। যেমন মুক্তাঞ্চল হিসেবে খ্যাত শ্রীপুরের অফিসার-ইন-চার্জ হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় বীর মুক্তিযােদ্ধা আকরাম হােসেনকে। আকবর মিয়া শ্রীপুরের চারপাশে ছােট-ছােট মুক্তিযােদ্ধা দল তৈরি করেছিলেন। তিনি গরিব মুক্তিযােদ্ধাদের বেতনেরও ব্যবস্থা করেন। এ বাহিনীর উল্লেখযােগ্য মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- নবুয়ত আলী মােল্লা (শ্রীপুর), সুবেদার মেজর মাে. আবদুল ওহাব (শ্রীপুর), মাে. আনােয়ার হােসেন (শ্রীপুর), মাে. বদরুল আলম (বেলনগর), সৈয়দ মারুফ আহমেদ (শ্রীপুর), মাে. আবদুল মান্নান মােল্লা (মােহাম্মদপুর), চৌধুরী জহুরুল হক (বরিশাট), আকরম হােসেন মিয়া (হরিন্দী), খােন্দকার আবু হাসান (খামারপাড়া), মাে. মনিরুল ইসলাম জেন্টেল (আমতৈল), মাে. আবদুল কাইয়ুম (পূর্বশ্রীকোল), হাবিলদার জালাল উদ্দিন মােল্লা (বালিয়াকান্দী, রাজবাড়ী), মুন্সী গােলাম মােস্তফা (খামারপাড়া বাজার), মাে. শফিউদ্দিন জোয়ার্দার (খামারপাড়া), মাে. গােলাম মােস্তফা (শ্রীপুর), আবদুল মালেক মােল্লা (শ্রীপুর), মাে. আবদুল আজিজ (রামনগর), আবদুস ছাত্তার শেখ (শ্রীপুর), মাে. ওলিয়ার রহমান (খামারপাড়া), মাে. সিরাজুল ইসলাম (আমতৈল), মাে. হাফিজুর রহমান (শ্রীপুর), মাে. সুলতান আহমেদ (শৈলকুপা, ঝিনাইদহ), শাহাবুদ্দিন চেয়ারম্যান (নবগ্রাম), খন্দকার সুজায়েত আলী (খামারপাড়া), খন্দকার নাজায়েত আলী (খামারপাড়া), আবদুর রশিদ মিয়া (বিলনাথর), কাজী ইউসুফ (আঠারােখাদা), খন্দকার আবদুল মাজেদ (শিবরামপুর), আবদুর রহিম জোয়ার্দার (শ্রীপুর), শাহাদত মােল্লা (কাবিলপুর), নওশের আলী চৌধুরী (সারঙ্গদিয়া), ইন্তজ বিশ্বাস (দ্বারিয়াপুর), তৈয়ব মাস্টার (চৌগাছী), হাফিজ মাস্টার (মােহাম্মদপুর), সৈয়দ আলী মেম্বর (অলংকারপুর, ফরিদপুর), আবদুল জলিল বিশ্বাস (বেলনগর), কামরুজ্জামান (মীনগ্রাম), মাে. হাফিজুর রহমান (খামারপাড়া), নায়েব সুবেদার আজিজুর রহমান (নাকোল), ইপিআর সদস্য আশরাফুল আহমেদ (শ্রীপুর), আনসার সদস্য আ. ছাত্তার মােল্লা (হরিন্দী), ইপিআর সদস্য মাে. হাফিজুর রহমান (নাকোল), মােল্লা মতিয়ার রহমান (কাজলী), হাবিলদার আবু জাফর (শ্রীপুর), ডা. সুধীর কুমার বিশ্বাস (পারনান্দুয়ালী) প্রমুখ। আকবর বাহিনীর কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হয়ে ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ মঞ্জুর এ বাহিনীকে শ্রীপুর বাহিনী ও এর অধিনায়ক আকবর হােসেন মিয়াকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। এ বাহিনীর ৪১ জন বীর যােদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। এ বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ ও প্রতিরােধের খবর তখন বিবিসি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-সহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়। আকবর বাহিনীই ৭ই ডিসেম্বর মাগুরা শত্রুমুক্ত করে এবং পরবর্তীতে যৌথবাহিনীর সঙ্গে ফরিদপুরে অভিযান চালায়। মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীর অবদান অসামান্য। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আকবর হােসেন মিয়া নিজ এলাকায় রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তিন সন্তানের জনক আকবর হােসেন মিয়া ২০১৫ সালের ২রা মে মৃত্যুবরণ করেন। [মনিরুজ্জামান শাহীন ও মিথুন সাহা]।
তথ্যসূত্র: জাহিদ রহমান (সম্পাদিত), মুক্তিযুদ্ধে আকবর বাহিনী : শতযােদ্ধার স্মৃতিকথা, ঢাকা, ২০১৩; আকবর হােসেন মিয়ার পুত্র কুতুবউল্লাহ হােসেন মিয়া কুতুর-এর সাক্ষাত্তার, ঢাকা ১৫ই জানুয়ারি ২০১৯

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড