You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক আকবর হােসেন - সংগ্রামের নোটবুক

আকবর হােসেন, বীর প্রতীক

আকবর হােসেন, বীর প্রতীক (১৯৪১-২০০৬) ক্যাপ্টেন, বীর মুক্তিযােদ্ধা ও ২নং ইস্ট বেঙ্গলের ‘বি’ কোম্পানির কমান্ডার। ১৯৪১ সালে তিনি কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হােসেন আলী মােক্তার ও মাতার নাম ছালেহা খাতুন। ১৯৬৬ সালের ৮ই মে তিনি পাকিস্তানের কাকুলস্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি হন। এবং সাফল্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টে তাঁর সৈনিক জীবন শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। ৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল বাঞ্চালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ তাঁকে বিক্ষুব্ধ করে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ তাঁকে দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে অনুপ্রাণিত করে। তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। তিনি পালিয়ে ২নং সেক্টরে মেজর খালেদ মােশাররফ, বীর উত্তমএর নেতৃত্বে নির্ভরপুর সাব-সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করে শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি ২নং সেক্টরে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। নির্ভরপুর সাব-সেক্টরে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনায় সহযােগী ছিলেন ক্যাপ্টেন মেহবুব ও লে. কবির। তাঁদের নির্দেশনা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর নেতৃত্বে একটি গােপন ঘাঁটি থেকে নােয়াখালী, লাকসাম, কুমিল্লা ও চাঁদপুরের বিভিন্ন সড়কে পাকসেনাদের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ পরিচালিত হয়। জুলাই মাসে চাঁদপুর থেকে ডাকাতিয়া নদীপথে অগ্রসরমাণ পাকসেনাদের একটি দলকে ছাতুরায় এম্বুশ করে বিপর্যস্ত করা হয়। এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। ক্যাপ্টেন আকবরের পরিকল্পনা অনুযায়ী লাকসাম-চট্টগ্রাম রেললাইনে কয়েকটি রেলসেতু ও তার পার্শ্ববর্তী কয়েকটি সড়কের সেতু ধ্বংস করা হয়। এতে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার মধ্যে যােগাযােগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ৩০শে মে ক্যাপ্টেন আকবরের পরিচালনায় মিয়াবাজার এম্বুশে ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। ২৫শে মে ভাটপাড়া জোড়কাননের নিকট একটি এম্বুশে ২০ জন পাকসেনা নিহত এবং একটি ট্যাঙ্ক ও একটি জিপ ধ্বংস হয়। ২৮শে মে মুক্তিযােদ্ধাদের কর্তৃক কালিকা সেতু উড়িয়ে দেয়া হয়। রঘুনাথপুরে এক এম্বুশে ৩৫ জন পাকসেনার মৃত্যু ঘটে। ৩১শে মে ক্যাপ্টেন মেহবুবের নেতৃত্বে এক এম্বুশে ১১ জন পাকসেনার মৃত্যু হয়। লে. কবিরের নেতৃত্বে এক এম্বুশে ইয়াকুবপুর, কুয়াপাইন্যা ও খৈনলে ৯ জন পাকসেনার মৃত্যু ঘটে। একইভাবে বােগাদিয়া ও বজরাতে পাকসেনাদের দুটি ট্যাংক ধ্বংস ও ১২ জন পাকসেনাকে হত্যা করা হয়।
সেপ্টেম্বর মাসে ক্যাপ্টেন আকবর মেজর শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বাধীন তৃতীয় বেঙ্গলে যােগ দেন। তিনি ছাতক সিমেন্ট কারখানায় পাকহানাদারদের ঘাঁটি আক্রমণে অংশ নেন। এখানে ৫দিন ধরে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। মুক্তিসেনারা শেষ পর্যন্ত ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে পাকসেনাদের হটিয়ে সেখানে অবস্থান নেন। তবে তাদেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ছাতক যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন আকবর হােসেনকে ‘বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। সেনাবাহিনীতে চাকরিকালে আকবর হােসেন লে. কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৭৩ সালে তিনি স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি প্রথমে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপ)-এর প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি ছিলেন (১৯৭৪)। পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীর উত্তমপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-তে যােগদান করেন। তিনি এ দলের অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে তিনি কুমিল্লা সদর আসন থেকে ৫বার (১৯৭৯, ১৯৯১, ১৯৯৬-র মধ্য ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ ও ২০০১) জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মন্ত্রী হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৬ সালের ২৫শে জুন মাসে মৃত্যুবরণ করেন। [শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড