You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে অষ্টগ্রাম উপজেলা (কিশােরগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে অষ্টগ্রাম উপজেলা (কিশােরগঞ্জ)

অষ্টগ্রাম উপজেলা (কিশােরগঞ্জ) কিশােরগঞ্জ জেলার হাওরবেষ্টিত একটি ঐতিহ্যবাহী উপজেলা। ১৯০৫ সালে অষ্টগ্রাম থানা গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলা সদরের সঙ্গে অষ্টগ্রামের যােগাযােগের একমাত্র মাধ্যম ছিল লঞ্চ ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা। অষ্টগ্রামের চার সীমান্তে রয়েছে কিশােরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন উপজেলা।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০-এর নির্বাচনের পর বাঙালিদের স্বাধীনতার দাবি অগ্রভাগে উঠে আসে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার সঙ্গে-সঙ্গে বাংলার মানুষের মধ্যে চরম বিক্ষোভ দেখা দেয়। এর ঢেউ সুদূর হাওর এলাকা অষ্টগ্রামেও এসে লাগে। সমস্ত দেশের মুক্তিকামী মানুষের মতাে অষ্টগ্রামবাসীও অপেক্ষায় থাকে একটি আহ্বানের – মুক্তির আহ্বান, স্বাধীনতার আহ্বান। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দেয়া
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণ থেকে সেই আহ্বান আসে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পরদিন রেডিওতে প্রচারিত হওয়ার পর ন্যাপনেতা কাজী আব্দুল বারী (যিনি আইয়ুব শাসনের বিরােধিতা করে সামরিক আইনে কারাভােগ করেন) দলমত নির্বিশেষে সবাইকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। অষ্টগ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির সভাপতি হন তিনি নিজে। কমিটিতে অন্যদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ আব্দুল নঈম, আবুল খায়ের খান ফিরােজ মিয়া, সুপ্রিয় দত্তরায় (পিন্টু বাবু), বিলু বিশ্বাস, আব্দুস শাহেদ, ফজলুল হক হায়দরী বাচ্চু, জহিরুল হক জারু, মজির উদ্দিন বুলবুল, জামাল উদ্দিন খান, হাফিজুল হক খসরু, মােস্তফা কামাল খান প্রমুখ। ফজলুল হক হায়দরী বাচ্চুর নেতৃত্বে গঠিত হয় থানা ছাত্র সংগ্রাম কমিটি। ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি ছাত্র-তরুণদের ঐক্যবদ্ধ করেন। সৈয়দ শাহজাহান, শহীদুল ইসলাম জেমস, হারুন, জাহেদ, মােরতুজ আলীসহ অনেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কার্যক্রম বেগবান করেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত হতে থাকে।
২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নারী-পুরুষ-শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করলে সমস্ত দেশ ফুসে ওঠে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌছে যায় স্বাধীনতার ডাক। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা সম্বলিত টেলিগ্রাম ২৬শে মার্চ অষ্টগ্রামে আসে। এদিন সংগ্রাম কমিটি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে একটি পথসভা অষ্টগ্রাম পাইলট স্কুল খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। বিদ্যুৎ গতিতে স্বাধীনতার তারবার্তার খবর সমগ্র এলাকায় পৌঁছে যায়। অসংখ্য মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা রুদ্ধশ্বাসে শােনে ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার কথা। কাজী আব্দুল বারী জনতার উদ্দেশে সেই গণহত্যার বর্ণনা দেন। জেগে ওঠে কৃষক-জেলে, কামার-কুমার, ছাত্র-শিক্ষক, তরুণ-বৃদ্ধ-সহ সর্বস্তরের মানুষ। স্বাধীনতা অর্জনে মানুষ যে-কোনাে ত্যাগ স্বীকারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
অষ্টগ্রামে সংগ্রাম কমিটি এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সকলকে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার আহ্বান জানান। শুরু হয় যুদ্ধের প্রস্তুতি। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয় প্রথমে পাইলট স্কুল খেলার মাঠে। তারপর নিরাপত্তা ও গােপনীয়তার স্বার্থে মধ্য-হাওরে তা স্থানান্তর করা হয়। সুবেদার মেজর হাফিজ উদ্দিন প্রশিক্ষণ কাজে নেতৃত্ব দেন। প্রশিক্ষণে অস্ত্র হিসেবে লাঠি, রড এবং হাল্কা সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। অষ্টগ্রামের মুক্তিকামী তরুণরা এ প্রশিক্ষণ শেষে ভারতের মেঘালয় ও ত্রিপুরার বিভিন্ন ক্যাম্পে আধুনিক অস্ত্রের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বাঙালপাড়া ইউনিয়ন ছাড়া অষ্টগ্রাম, পূর্ব অষ্টগ্রাম, দেওঘর, কাস্তুল, আদমপুর ও আব্দুল্লাপুর থেকে অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
অষ্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকগণ হলেন- কাজী আব্দুল বারী (থানা কমান্ডার), সৈয়দ আব্দুন নইম (সভাপতি, থানা আওয়ামী লীগ), হাফিজুল হক খান খসরু (সাধারণ সম্পাদক, থানা আওয়ামী লীগ), ফজলুল হক হায়দরী বাচ্চু (সভাপতি, ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ), আবুল খায়ের খান ফিরােজ মিয়া (সংগ্রাম কমিটির সদস্য, ন্যাপ), জামাল উদ্দিন খান (সংগ্রাম কমিটির সদস্য), আব্দুস সাহেদ (সংগ্রাম কমিটির সম্পাদক), নীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বিলু (সংগ্রাম কমিটির সদস্য), সৈয়দ মজির উদ্দিন বুলবুল (সদস্য ও সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রলীগ), মােস্তফা কামাল খান (সংগঠক), সৈয়দ মাে. ইসমাইল (সংগঠক), সুপ্রিয় দত্তরায় (সংগ্রাম কমিটির সদস্য), ছমির উদ্দিন, মফিজ উদ্দিন প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে অষ্টগ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বা রাজাকারদের কোনাে তৎপরতা ছিল না। বর্ষার সময় আগস্ট মাসের শেষদিকে কোনাে প্রাথমিক প্রতিরােধের মুখােমুখি না হয়েই পাকবাহিনী জলপথে আষ্টগ্রামে আসে। ২৮শে আগস্ট পকিস্তানি বাহিনী অষ্টগ্রামে প্রবেশ করে। উন্মুক্ত হাওর প্রান্তর তখন বর্ষার জলধারায় পরিপূর্ণ। এ প্রশস্ত জলপথে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণের কোনাে সুযােগ ছিল না। তাছাড়া সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মােকাবেলা করার মতাে সামরিক শক্তিও তখন ছিল না। তিনটি লঞ্চ ও গানবােট নিয়ে গুলি করতেকরতে পাকসেনারা ডাকবাংলাের ঘাটে পৌছে। পাকবাহিনী আসার খবর পেয়ে গ্রামের অনেক মানুষ বিশেষ করে তরুণীরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে নৌপথে মিটামইনের ঘাগড়ায় যায়। অষ্টগ্রাম পৌছে হানাদার বাহিনী প্রথমে থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। পরে তারা ডাকবাংলাে, মােস্তফা কামাল খানের বাড়ি, হাইস্কুল এবং ওয়ারলেস ভবনকে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। দেশের অন্যান্য স্থানের মতাে অষ্টগ্রামেও মুক্তিযােদ্ধাদের হানাদারদের পাশাপাশি যুদ্ধ করতে হয়েছে রাজাকার ও আলবদরদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ শুরুর প্রথমদিকে অষ্টগ্রামে মুসলিম লীগ-পন্থী কিছু কট্টর লােক ছিল। ২৮শে আগস্ট পাকবাহিনী অষ্টগ্রাম প্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গে তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। তারা পাকিস্তানিদের দোসররূপে মুক্তিযুদ্ধ এবং এলাকার মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে কার্যক্রম চালাতে থাকে। কিছু সাধারণ মানুষও ভয়ে তাদের দলে ভেড়ে। অষ্টগ্রাম থানার সার্কেল অফিসার শামসুল হকের নেতৃত্ব ও মদদে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। তার তত্ত্বাবধানে আস্তে-আস্তে শান্তি কমিটি সংগঠিত ও শক্তিশালী হতে থাকে। তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এ কমিটির নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে তাদের বিশ্বস্তদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু হয় তাদের ত্রাসের রাজত্ব। হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ, নারীনির্যাতন ইত্যাদি পৈশাচিক কাজে তারা মেতে ওঠে। সংখ্যালঘু পরিবার, রাজনীতি-সচেতন পরিবার এবং মুক্তিযােদ্ধাদের পরিবার এদের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কলঙ্কজনক পরিচিতি নিয়ে প্রতিনিয়ত ধিকৃত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিরােধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা। অষ্টগ্রামে এদের সংখ্যা কম নয়। তাদের দ্বারা সমাজ, জনপদ এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, স্বাধীনতার পর মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে দুই রাজাকারের ন্যক্কারজনক মৃত্যুও ঘটে। এদের কেউ-কেউ কারাগারে গেছে। কিন্তু দায়মুক্তি ঘটেনি কারাে। অষ্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতাকারীদের মধ্যে মাহবুবুল হক কুতুব মিয়া (সভাপতি, শান্তি কমিটি, মৌলবীবাড়ি মসজিদজাম), আব্দুল জব্বার ভূঁইয়া (কাস্তুল), ফতেউল ইসলাম ভূঁইয়া। (বাগেরহাটি), নিযামুল হক বাবু মিয়া (মৌলবীবাড়ি), সৈয়দ আব্দুল আজিজ হােসাইনী (হাবিলীবাড়ি), মৌলানা আব্দুল গণি ওরফে দৌলত মৌলানা আবদুল্লাহপুর), কে এম আমিনুল হক রজব আলী (সাভিয়ানগর), শফি মিয়া (সরকারবাড়ি), সইদ মিয়া (খানপাড়া), একরাম হােসেন (চেয়ারম্যান, আদমপুর), সাদত হােসেন (চেয়ারম্যান, আব্দুল্লাহপুর), আশরাফ উদ্দিন (চেয়ারম্যান, দেওঘর), তারা খলিফা (কাদিরখাদান) প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য।
পাকিস্তানি বাহিনী ২৮শে আগস্ট অষ্টগ্রামে পৌঁছে তাদের দোসরদের নিয়ে নয়াবাড়িতে (খান বাহাদুর সৈয়দ মােয়াজ্জেম উদ্দিন হােসেনের বাড়ি) সভা করে। সভাশেষে তারা কাজীপাড়ায় যায়। অষ্টগ্রাম ততক্ষণে জনশূন্য। কাজীপাড়ায় কাউকে না পেয়ে তারা অগ্নিসংযােগ করে কাজী আব্দুল বারীর বাড়িসহ চারটি বসতবাড়িতে। ফিরে আসার সময় খান ঠাকুর দিঘিরপাড়ের নিরীহ মানুষ কালা মিয়াকে হত্যা করে। তাকে হত্যার পর তার বড় ভাই কাঙালির ঘরটি পুড়িয়ে দেয়। এদিন তাদের গুলিতে আব্দুল মজিদ (কবিরখান্দান), আব্দুল মালেক (পশ্চিমপাড়), আরমান আলী (আলমদিঘীরপাড়) প্রমুখ প্রাণ হারান। পাকবাহিনী এদিন নাথপাড়া ও দত্তপাড়ায় অগ্নিসংযােগ করে। অনেকের অস্থাবর সম্পদ লুণ্ঠন করে। নিরীহ মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। অতর্কিত হামলা চালায় বিভিন্ন গ্রামে। অষ্টগ্রাম উপজেলায় পাকবাহিনী দুটি বড় গণহত্যা ঘটায়। ৩রা সেপ্টেম্বর তারা রাজাকারদের সহায়তায় ইকরদিয়া গ্রামে গণহত্যা চালায়। ইকরদিয়া গণহত্যা হিসেবে পরিচিত এ ঘটনার সময় হানাদাররা হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩৫ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
পাকবাহিনী ৫ই সেপ্টেম্বর উপজেলার সাভিয়ানগর গ্রামে একটি গণহত্যা সংঘটিত করে। স্থানীয় রাজাকার ও আলবদরদের সয়হতায় পাকবাহিনী সাভিয়ানগর গণহত্যায় ২০ জন সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় নারীদের নির্যাতন করে। মসজিদজামের দাসপাড়া ও ঋষিপাড়ার অনেক নিরীহ নারী তাদের দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে পরিচিত ছিল অষ্টগ্রাম থানা। এখানে বন্দিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চলত। মৃত্যু যাদের জন্য নির্ধারিত ছিল, পরদিন তাদের আর থানায় পাওয়া যেত না। বন্দির ভাগ্য নির্ধারণ করত শীর্ষস্থানীয় দালালরা। নয়াবাড়ির গৃহকর্মী আজম উদ্দিন দীর্ঘদিন বন্দিশিবিরের অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কোনাে খবর পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রী রিজিয়া সেই ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে আজো বেঁচে আছে। রিজিয়া বারবার ছুটে গেছে বন্দিশিবিরে স্বামীকে ফিরিয়ে আনতে। সেখানে গিয়ে সে বন্দিশিবিরের ভয়াবহ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে। অষ্টগ্রামে বধ্যভূমি গণকবর হিসেবে নদীর ওপারের মাঠসংলগ্ন (কুড়েরপার) জায়গাটিকে সরকারিভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পর মাটি খুঁড়ে ৬০টি মাথার খুলি পাওয়া যায় এখানে। হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতনকেন্দ্রে নির্যাতন শেষে হত্যার পর অনেককে এখানে মাটিচাপা দেয়া হয়। অষ্টগ্রামে হানাদার বাহিনীর ওপর মুক্তিযােদ্ধারা তিনবার আক্রমণ পরিচালনা করেন। প্রথম আক্রমণ ছিল সেপ্টেম্বর মাসে। তখন বর্ষাকাল থাকায় মুক্তিযােদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ করার সুযােগ পাননি, তাই তারা ফিরে যান। ফিরে গেলেও এ থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাওয়া যায়। অক্টোবর মাসের শেষদিকে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেন। সমস্ত দেশের আনাচে-কানাচে তখন মুক্তিযােদ্ধাদের সফল অভিযানের খবর প্রচারিত হচ্ছিল। এ আক্রমণের পর অষ্টগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের নাজুক অবস্থা টের পেয়ে রাজাকারদের হাতে থানা ক্যাম্পের দায়িত্ব দিয়ে কিশােরগঞ্জ চলে যায়।
অষ্টগ্রামে রাজাকার ও আলবদরদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয় ২৮শে নভেম্বর। এদিন ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ওয়ারলেস অফিসে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালান। আলবদর ও রাজাকার বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করে। ওয়ারলেস যুদ্ধ এ এলাকার একটি বিখ্যাত সম্মুখ যুদ্ধ। এ-যুদ্ধে অংশ নেন কমান্ডার মতিউর রহমান, বীর বিক্রম (নিকলী), কমান্ডার নাজিম কবীর (কিশােরগঞ্জ), শাহাবুদ্দিন (নিকলী), রিয়াজুল ইসলাম খান বাচ্চু, আব্দুর রহমান প্রমুখ। যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা শাহাবুদ্দিন শহীদ হন। কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। এ-যুদ্ধের সময় মুক্তিযােদ্ধাদের সাহসিকতায় ভীত হয়ে আলবদর ও রাজাকার বাহিনী পালিয়ে যায়। ২৮শে নভেম্বর রাজাকার বাহিনী অষ্টগ্রাম ছেড়ে গেলে যুদ্ধের অবসান এবং বিজয় নিশ্চিত হয়। ১লা ডিসেম্বর অষ্টগ্রাম উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এদিনটিকে হানাদারমুক্ত দিবস হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
অষ্টগ্রামে শত্রুদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে একজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। তাঁর নাম শাহাবুদ্দিন। তাঁর বাড়ি নিকলী উপজেলায়। অষ্টগ্রাম উপজেলায় শহীদ শাহাবুদ্দিনের নামে একটি স্মৃতিফলক রয়েছে। ফোরজানা আহমেদ]।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড