মুক্তিবাহিনী অধ্যাপক শামসুল ইসলাম গ্রুপ
অধ্যাপক শামসুল ইসলাম গ্রুপ (পটিয়া, চট্টগ্রাম) স্থানীয় একটি মুক্তিবাহিনী। এর প্রধান ছিলেন অধ্যাপক শামসুল ইসলাম।
১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান, এম এ মান্নান (স্বাধীনতা পরবর্তীকালে শ্রমমন্ত্রী), ডা. এম এ মান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, ডা. জাফর, এ কে এম আবদুল মন্নানসহ কয়েকজন দুটি গাড়িতে করে পটিয়া কলেজ ক্যাম্পে আসার পর এম এ মান্নান পটিয়া সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক সামশুদ্দিন আহমদকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা সম্বলিত ৪-৫ হাজার প্রচারপত্র প্রদান করে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে যেতে আগ্রহীদের তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন। ফলে, দু-এক দিন পরে পটিয়া রাহাত আলী হাই স্কুলে পটিয়া সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় সামশুদ্দিন আহমদ যুদ্ধের ট্রেনিং-এর জন্য ভারতে যেতে আগ্রহীদের নাম দিতে বলেন। এর কয়েকদিন পর ৭০ জনের একটি দল তাঁর নেতৃত্বে পটিয়া ক্লাব মােড় থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। পথ-খরচ, খাওয়া-দাওয়া ও আনুষঙ্গিক খরচের জন্য অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী পটিয়া সরকারি রেশনশপের ডিলার গােলাল সওদাগরের নিকট থেকে ৩০০০ টাকা ঋণ করে তাঁদের হাতে দেন। তাঁরা পটিয়া ক্লাব মােড় থেকে যাত্রা শুরু করে নাজিরহাট কলেজে পৌছলে উক্ত কলেজের অধ্যাপক শামসুল ইসলাম তাদের সঙ্গে ভারতে যাওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করায় সামশুদ্দিন আহমদ তাঁকেও সঙ্গে নেন। অতঃপর সকলে রামগড়ে পৌছলে সেখানে আরাে কিছু লােক তাদের সঙ্গে যােগ দেন। থানায় সামশুদ্দিন আহমদ সকলের নাম লিপিবদ্ধ করানাের পর মােট ১০০ জনের একটি দল সাবরুম পৌছে। সেখান থেকে বিএসএফ-এর ট্রাকে করে তারা বগাফা বিএসএফ ট্রেনিং সেন্টারে পৌঁছে সেখানকার তাঁবুতে অবস্থান নেন। এই ট্রেনিং সেন্টারে তাঁদের ১৫ দিন ট্রেনিং চলে। তাঁদেরকে গেরিলা ট্রেনিং বা ‘হিট এন্ড রান’-এর আওতায় থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, এলএমজি, এসএমজি, দুই ইঞ্চি মর্টার, গ্রেনেড প্রভৃতি পরিচালনা এবং ক্রলিং-এর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বগাফা বিএসএফ ট্রেনিং সেন্টারে এই ১০০ জনের আগে অপর একটি ব্যাচে কিছু ইপিআর সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছিল। সেই দিক থেকে এই ১০০ জনই বাংলাদেশের এই ক্যাম্পে প্রথম প্রশিক্ষিত সিভিলিয়ান মুক্তিযােদ্ধা। ট্রেনিং শেষে এই ১০০ জনকে রামগড় স্কুলের মাঠে এনে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। অধ্যাপক শামসুল ইসলামকে ৩৪ জন নিয়ে গঠিত একটি গ্রুপের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। এ গ্রুপকে ৩৪টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ১৭০টি গ্রেনেড ও ১০২০টি গুলি প্রদান করা হয়। রাইফেলগুলাে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত। প্রত্যেকটি রাইফেলের গায়ে লেখা ছিল ‘Second World War’। এ গ্রুপের সদস্যদের ২৩ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- অধ্যাপক শামসুল ইসলাম (কমান্ডার), সামশুদ্দিন আহমদ (পিতা মাে. আবদুল মন্নান, পশ্চিম গােবিন্দারখীল), গােলাম কিবরিয়া বাবুল (পিতা শফিকুর রহমান, পটিয়া), ছৈয়দুল হক ছৈয়দ ওরফে শহীদ (আলমদারপাড়া, পটিয়া), মােহাম্মদ ইউসুফ (মনসা, পটিয়া), রফিক আহমদ, মােহাম্মদ আসলাম, আবু সিদ্দিক, গাজী সবুর, কবির, কালাম, টাইগার জলিল, নাজিরুল হক রুমি, বদিউল আলম, আবদুল লতিফ ভেট্টা, আবুল কাশেম, আবুল বশর, আবদুল গফুর, রুহুল আমিন, মাহফুজুর রহমান, মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, আবু তাহের এবং এ কে এম আবদুল মতিন চৌধুরী।
গ্রুপটি মহালছড়িতে এলে তাঁদের সঙ্গে মেজর মীর শওকত আলীর সাক্ষাৎ ঘটে। মেজর মীর শওকত আলীর সঙ্গে কতিপয় নতুন রিক্রুট ইপিআর সদস্য ছিলেন, যাদের এমএমজি (মিডিয়াম মেশিনগান) চালনার প্রশিক্ষণ ছিল না। ফলে তাঁর অনুরােধে এই ইপিআর সদস্যদের এমএমজি চালনার প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য গ্রুপটি তিন জন সদস্য গােলাম কিবরিয়া বাবুল, ছৈয়দুল হক ছৈয়দ ওরফে শহীদ ও মােহাম্মদ ইউসুফকে মহালছড়িতে রেখে পটিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। এদিকে এই ৩ জন মহালছড়িতে প্রায় দুঘণ্টা উক্ত ইপিআর সদস্যদের ওয়াটার ও এয়ার কুলিং এমএমজি চালনার প্রশিক্ষণ প্রদান করে একটি ছড়ার মধ্য দিয়ে নৌকাযােগে অচেনা স্থানে উঠে পায়ে হেঁটে রানীর হাটে এসে দেখেন তাদের গ্রুপ সেখানে। তারা গ্রুপের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর গ্রুপটি বােয়ালখালীতে এসে এক বাড়িতে অবস্থান নেয়। অতঃপর বাড়িটির গােয়ালঘরে গােলাম কিবরিয়া রাইফেলগুলাে থেকে গুলি আনলােড করতে গিয়ে হঠাৎ ট্রিগারের চাপে একটি গুলি আকাশের দিকে বেরিয়ে গেলে তার আওয়াজে নিকটস্থ গােমদণ্ডিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী বাড়িটির দিকে অগ্রসর হয়। বাড়িতে গ্রুপটির জন্য রান্নাবান্না চলছিল। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার খবরে গ্রুপটি বাড়িটি থেকে সরে গিয়ে প্রায় ৫০০ গজ দূরে দক্ষিণে বােয়ালখালী-কধুরখীল সড়কের দক্ষিণ পাশে দিঘিতে লুকিয়ে থাকে। এর পরপরই উক্ত সড়কের ওপর দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী বাড়িটিতে পৌছে গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী ঐ বাড়িতে পৌছার জন্য দিঘি অতিক্রম করে গেলে গ্রুপটি দিঘি থেকে উঠে পটিয়ার দিকে রওয়ানা হয়। তখন সন্ধ্যা। পথিমধ্যে গ্রুপটি দুদলে বিভক্ত হয়। একদল পটিয়া সদরে, অপর দল পটিয়ার হাবিলাস দ্বীপে পৌছায়।
অধ্যাপক শামসুল ইসলাম গ্রুপের সদস্যরা পটিয়া রাহাত আলী হাইস্কুলে চলমান এসএসসি পরীক্ষা বানচালের জন্য গ্রেনেড চার্জ করেন এবং পটিয়া তহসিল অফিসে অপারেশন পরিচালনা করেন। [শামসুল আরেফীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড