You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.10 | বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নবতর পর্যায় - সরকারকে উপদেশ দানের জন্য সর্বদলীয় কমিটি গঠন | জয়বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নবতর পর্যায়
সরকারকে উপদেশ দানের জন্য সর্বদলীয় কমিটি গঠন

বাংলাদেশের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে বাংলাদেশের ৪টি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ের একটি ‘উপদেষ্টা কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যগণ হচ্ছেন : মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ভাসানী ন্যাপ), মিঃ মনি সিং (বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট পার্টি), মিঃ মনোরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস), অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ (মুজাফফর ন্যাপ), জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ, প্রধান মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও খোন্দকার মোস্তাক আহমদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এছাড়া কমিটিতে আওয়ামী লীগের আরও দুইজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক আহ্বান ও পরিচালনা করবেন।
গত বৃহস্পতিবার প্রচারিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, মুজিব নগরে দলগুলার নেতৃবৃন্দের দুই দিন ব্যাপী বৈঠক শেষে সর্বসম্মতিক্রমে এই কমিটি গঠন করা হয়।
মুজিব নগরের বৈঠকে যোগদানকারী নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টার প্রতি দৃঢ় আস্থা ও দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জ্ঞাপন করেন। নেতৃবৃন্দ বিজয়ের দিনটিকে নিকটতর করার জন্য জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমবায়ে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের পশ্চাতে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয় সমর্থন দানের জন্য নেতৃবৃন্দ বিশ্বের মুক্তি কামী ও সংগ্রামী মানুষের প্রতিও আবেদন জানান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, আওয়ামী লীগ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের—বাংলাদেশে যা একমাত্র বৈধ সরকার—প্রতি আস্থাবান বাংলাদেশের সর্বস্তরের মুক্তি কামী মানুষের সার্বিক-ঐক্যের অভিব্যক্তি ঘটেছে এই কমিটি গঠনের মাধ্যমে। এতে বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সক্রিয় সংগ্রামে লিপ্ত সকল মত ও পথের মানুষের মুক্তি সংগ্রামে অংশ গ্রহণের ধারণা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এক প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলাদেশের অবিসম্বাদিত জাতীয় নেতা শেখ মুজিবর রহমানের বে-আইনী আটকের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ কর্তৃক শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনের নির্লজ্জ প্রচেষ্টার নিন্দা করা হয়। সভা এই পৈচাশিক বিচার বন্ধ করে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধানের মুক্তির জন্য আশু ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে বিশ্বে সমস্ত শক্তি ও জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান হয়।
সভার দ্বিতীয় প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ আন্তরিক আস্থা ও বিশ্বাস জ্ঞাপন করা হয় এবং বাংলাদেশ সরকারকে সার্বিক সমর্থন দানের কথা ঘোষণা করা হয়।
তৃতীয় প্রস্তাবে ভারতসহ বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের প্রতি অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদান করে বাংলাদেশের শান্তি ও গণতন্ত্রকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান হয়। সভা বাংলাদেশ সরকারকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রদান সহ সর্বপ্রকারে সক্রিয় সাহায্য দানের জন্য বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের প্রতি অনুরোধ জানান হয়।
চতুর্থ প্রস্তাবে সভা মাতৃভূমিকে পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদীদের দখলদার বাহিনীর কবলমুক্ত করার জন্য শত প্রতিকুলতার মধ্যেও বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধারা যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্বীকার করা হয় এবং এ কাজে মাতৃভূমির যে সমস্ত বীর সন্তান শাহাদাৎ বরণ করেছেন তাঁদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
পঞ্চম প্রস্তাবে বাংলাদেশের সর্বহারা বাস্তুত্যাগীদের প্রতি অকাতরে সাহায্যের হস্ত প্রসারের জন্য ভারতের জনগণ ও ভারত সরকাররের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থনের জন্যও সভা সন্তোষ প্রকাশ করে৷
অপর এক প্রস্তাবে সভা শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি একাত্বতা ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশে তাদের ভাইদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়।
সভায় ৭ম ও সর্বশেষ প্রস্তাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয় যে পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোন রাজনীতিক সমাধান কোনদিনও বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। প্রস্তাবে বলা হয়, মুক্তি অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং রক্ত যদি মুক্তির মূল্য হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণ প্রতি মুহূর্তেই তা দিয়ে চলেছেন।
দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সভায় উপদেষ্টা কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত ৬ জন জননায়ক ছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব এ,এইচ, এম, কামারুজ্জামান ও বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা জনাব এম, এ, সামাদ উপস্থিত ছিলেন।
জয়বাংলা ॥ ১ : ১৮ ॥ ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন