সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কাছে একটি অতি প্রিয় নাম
স্বাধীন-সার্বভৌম বাঙ্গলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কাছে আজ একটা অতি প্রিয় নাম।
বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ ২৭ বছরের একনিষ্ট সহকর্মী তাজউদ্দীন। বিশ্ব ইতিহাস, ভূগোল ও রাজনীতি সম্পর্কে তিনি লেখাপড়া করেছেন প্রচুর। বিশ্ব ইতিহাসের বা বিশ্ব রাজনীতির যে কোন ঘটনা সাল তারিখ দিয়ে তিনি মুহূর্তের মধ্যে আপনাকে বলে দিতে পারবেন, অথবা বিশ্ব মানচিত্রের যে কোন স্থানের অবস্থিতি তিনি সাথে সাথে বলে দিতে পারবেন। আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ, ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীনে কম্যুনিষ্টদের ক্ষমতা দখল, মধ্যপ্রাচ্যে আরব ইসরাইল সংঘাত এবং ভিয়েতনাম ও আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ইতিহাসই যেন তার নখদর্পণে।
তাই বোধ হয় এ সমস্ত ইতিহাসের আলোকেই সেদিন তিনি জোর করেই বলেছিলেন, “আমরা কামিয়াব হবোই।’ এ কথা বলার সময় যেন তার চোখে মুখে একটা আত্মপ্রত্যয়ের দ্যূতি খেলে গেল।
আজ থেকে ৪৬ বছর আগে ঢাকা জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। ছাত্র হিসাবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমান। তবে নিয়মিত ছাত্র হিসাবে পরীক্ষা দেওয়া তার ভাগ্যে বড় একটা জোটেনি। তাই বলে তিনি কোনদিন পরীক্ষায় খারাপ করেছেন এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। এম, ই স্কলারশীপ পরীক্ষায় জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন আর ম্যাটিক পরীক্ষায় দ্বাদশ স্থান এবং ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। অর্থনীতি শাস্ত্রে অনার্স সহ তিনি বি এ পাশ করেন এবং জেলে আটক থাকা অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে আইনের ডিগ্রী লাভ করেন।
প্রাথমিক ছাত্রাবস্থাতেই তার হাতে খড়ি হয় রাজনীতিতে নেহায়েত অলক্ষ্যে। সেটা ১৯৩৭ সালের কথা। তখন তিনি সবেমাত্র চতুর্থ শ্রেণীতে উঠেছেন। সে অবস্থায় তিনজন শিক্ষিত রাজবন্দীকে কাপাসিয়া থানার কর্তৃত্বে রাখা হতো। তদানুসারে তিন জন রাজবন্দীকে রাখা হয়েছিল কাপাসিয়ার কর্তৃত্বে। ১৩ বছরের ফুটফুটে ও চটপটে তাজউদ্দীনকে দেখেই তাদের একজন একদিন কাছে ডেকে নিয়ে পটাপট কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। তাজউদ্দীনের মত একটা গ্রাম্যছেলের বিদ্যাবুদ্ধিতে তিনি সত্যই অবাক হলেন, তারপর তারা তাকে ইতিহাস, ভূগোল, যুদ্ধ, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং মনীষীদের জীবনী সম্পর্কিত প্রায় তিনকুড়ি বই পড়ালেন। তার পরে শুরু হলো পরীক্ষা। তাজউদ্দীন সব বিষয়ে পাশ করলেন, তবে রাজনীতিতে পেলেন বেশী নম্বর। তাঁর তাকে বললেন ভবিষ্যতে রাজনীতি করতে। এই রাজবন্দীদের সংস্পর্শে এসেই তাজউদ্দীনের হাতে খড়ি হয় রাজনীতিতে, কয়েকমাস পর তাঁরা অন্তরীণাবস্থার অবসান শেষে কোথায় চলে গেলেন তা তাজউদ্দীন আজও জানেন না। যাবার সময় তাজউদ্দীনের সাথে তাদের শেষ সাক্ষাটুকু হয়নি। কারণ তাজউদ্দীন তখন ভীনগাঁয়ে ফুটবল খেলতে গিয়েছিলেন। তবে তারা যাবার সময় তাজউদ্দীনের ঘরে রেখে গিয়েছিলেন এক তোড়া গোলাপ। সে গোলাপ অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে কিন্তু তাজউদ্দীন তার সুবাস এখনও পাচ্ছেন।
তাজউদ্দীন বরাবরই ছাত্র রাজনীতি করতেন। তবে তিনি ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির চেয়ে সমাজ সেবাই বেশী করতেন।
মুসলিম রাজনীতির সাথে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হন ১৯৪৩ সালে আবুল হাশেমের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর, এর আগে তিনি মুসলিম লীগকে মনে করতেন বৃটিশের পদলেহী খাজাগজাদের একটা সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানরূপে, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে সর্বপ্রথম বৃটিশ বিরোধী কথা শুনতে পাই জনাব আবুল হাশেমের মুখে। তাই তিনি আকৃষ্ট হলেন মুসলিম লীগের প্রতি। তিনি আরও বলেন, প্রথম নারায়ণগঞ্জে এবং পরে ঢাকার পাকিস্তান ময়দানে প্রকাশ্য জনসভায় আবুল হাশিম মুসলিম লীগকে ঢাকার নবাবদের প্রাসাদ-আহসান মঞ্জিল থেকে বের করে আনার আহ্বান জানালেন। কেবল তখনই আমি মুসলিম লীগ রাজনীতির একটা অর্থ খুজে পেয়েছিলাম। তাই জনাব শামসুল হকের নেতৃত্বে মাত্র ১২ জন কর্মী নিয়ে ইসলামপুরের একটা ছোট্ট ঘরের ছাদে চালু করেছিলাম মুসলিম লীগ সংগঠনের ভবিষ্যত পরিকল্পনা। আমাদের এক মাত্র লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগকে আহসান মঞ্জিল থেকে বের করে এনে সাধারণ মানুষের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।” ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম কাউন্সিলের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর পাকিস্তান হলো, মুসলিম লীগ আবার খাজাগজাদের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। আর তাজউদ্দীন তার সাথে ছিন্ন করলেন সকল প্রকার সম্পর্ক।
মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও তাজউদ্দীন রাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এমন ভাবলে মহাভুল করা হবে। বস্তুতঃ দেশ বিভাগের সময় থেকে ৪/৫ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে যত আন্দোলন হয়েছে তার প্রতিটির সাথে তাজউদ্দীন ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৪৮ সালে ৪ঠা জানুয়ারী যখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) গঠিত হয় তিনি ছিলেন তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আর বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রশ্নে যে ক’জন নেতা জিন্নাহ সাহেবের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি ছিলেন তাদের একজন।
শেখ মুজিবরের সাথে তার প্রথম পরিচয় ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতায়। প্রথম সাক্ষাতেই যেন তাদের মধ্যে একটা ভাবের আদানপ্রদান হয়েছিল। তদবধি তাদের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক চলে আসছে।
শেখ সাহেবের নেতৃত্ব সম্পর্কে তাজউদ্দীনের একটা বিরাট আস্থার ভাব প্রকাশ হয়ে গেল সেদিন, কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘শেখ সাহেবকে আমি ছাত্রাবস্থা থেকে জানি, চিনি। তাকে আমি কোনদিন কোন ব্যাপারে পরাজয় বরণ করতে দেখিনি। বিশ্বাস করুন, তিনি এবারও জিতবেন।’
১৯৪৯ সালের ২০শে জুন ঢাকায় বসিরের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। তাজউদ্দীন ছিলেন তারও একজন উদ্যোক্তা। কিন্তু তিনি সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত হলেন না। কারণ তখন তিনি দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তারপর, পাকিস্তানের রাজনীতিতে অনেক উত্থান পতন ঘটেছে তাজউদ্দীন তার সাথে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। লিয়াকত আলীর মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে ১৯৫০ সালের ৫ই নভেম্বর ঢাকায় যে গ্রাণ্ড ন্যাশনাল কনভেনশন বা জাতীয় মহাসম্মেলন হয় তাজউদ্দীন ছিলেন তার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। ১৯৫৩-৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬৫ সালে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সমাজসেবা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং শেখ মুজিবের অবর্তমানে কিছুদিন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সে থেকে পর পর আরো দুবার নির্বাচিত হয়ে আজ পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে বহাল আছেন।
১৯৬৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী লাহোরে যে সর্বদলীয় নেতৃ-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় শেখ সাহেবের সাথে তিনিও তাতে যোগদান করেন। ঐ সম্মেলনেই শেখ সাহেব পেশ করেছিলেন তার ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচী। সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতেও তাজউদ্দীন ছিলেন শেখ সাহেবের সাথে অন্যতম সদস্য। তিনি ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের জন্য গঠিত আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী বোর্ডের সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্যও নির্বাচিত হন। এ ছাড়া তিনি ১৯৫৪ সালের তদানিন্তন বাংলার নির্বাচনে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। তখন তিনি আইন ও এম-এ ক্লাশের ছাত্র ছিলেন। তিনি পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ পরিভ্রমণ করেছেন।
জয়বাংলা ॥ ১ : ৬ ॥ ১৮ জুন ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন