বাংলাদেশে হিন্দুরা হারানো সম্পত্তি ফিরে পাচ্ছেন
রাজনৈতিক সংবাদদাতা
হিন্দুদের লুণ্ঠিত সম্পত্তি ফেরত পাইয়ে দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিবাহিনী গোটা বাংলাদেশে এক যৌথ অভিযান শুরু করেছেন। সর্বত্র ঢোল পিটিয়ে দেওয়া হয়েছে : যারা হিন্দুদের সম্পত্তি লুঠ করেছিল তাদের তা অবিলম্বে ফেরৎ দিতে হবে। যারা হিন্দুদের বাড়িঘর দখল করে নিয়েছিল তাদের তা অবিলম্বে ছেড়ে দিতে হবে। যে এই নির্দেশ অমান্য করবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
গত দশ বারোদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে আমরা দেখেছি, ভয়ে দুষ্কৃতকারীরা হিন্দুদের লুণ্ঠিত সম্পত্তি ফেরৎ দিচ্ছে দখল করা ঘরবাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে এবং তাঁদের পুনর্বাসনে সহযোগিতা করছে। আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা এবং মুক্তিবাহিনীর সৈনিকরা জানিয়ে দিয়েছে, যার ঘরে পরে লুণ্ঠিত জিনিষপত্র পাওয়া যাবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
২৫ মার্চের পর থেকেই পাক দখলদার বাহিনীর উৎসাহ এবং সহযোগিতায় লীগ ও জামায়েত পন্থীরা বহু হিন্দুর বাড়িঘর লুঠ করেছিল। যেসব হিন্দু ভয়ে পালিয়ে এসেছিল তাদের বাড়িঘর দোকানপাট ও দখল করে নিয়েছিল। যারা এইসব কাজ করেছিল তাদের মধ্যে বাঙালী অবাঙালী দুই-ই ছিল। রাজাকার আলবদর প্রভৃতির সদস্যরা এই কাজে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল।
এরা যে শুধু হিন্দুর বাড়িঘর লুঠ বা দখল করেছিল তা-ই নয়, মুসলমানের বাড়িঘরও লুঠ এবং দখল করেছিল। আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিবাহিনীর লোকজন আগে হিন্দুর লুণ্ঠিত সম্পত্তি এবং বেদখল বাড়িঘর ফেরৎ দেওয়ার কাজে হাত দিয়েছেন।
আমরা প্রথমে খুলনার কালিগঞ্জে এ জিনিস দেখেছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চল বলেই এই কাজ আগে শুরু হয়েছে। কিন্তু ময়মনসিং, টাঙ্গাইল, ঢাকা, আরিচাঘাট প্রভৃতি বাংলাদেশের ভিতরের দিকের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখলাম এই কাজ সর্বত্রই সবচেয়ে আগে শুরু হয়েছে।
প্রথমে ব্যাপারটা দেখি ময়মনসিং-এ। … আমরা তুরা থেকে হালুয়াঘাট হয়ে ময়মনসিং-এর পথে ঢাকার দিকে যাচ্ছিলাম। ময়মনসিং-এ রাজবাড়ির সামনেই কয়েকজনার সঙ্গে দেখা হল। ময়মনসিং দিন তিনেক আগে মুক্ত হয়েছে। রাস্তায় তখন গাড়ি ঘোড়া চলছে। প্রথমেই গেলাম হাটের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ীর কাছে। কি নাম? যতীন্দ্র দাশ। বেশ ধুতি পরে চাদর গায়ে দিয়ে দাশ মশাই কয়েকশ শাড়ি নিয়ে বসেছেন। বললেন : আসুন, আসুন-দেখুন টাঙ্গাইলের শাড়ি, বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ি। আমরা জানতে চাইলাম তাঁদের অবস্থা। বললেন এত দিন অনেক অত্যাচার চলেছে, অনেক লুঠতরাজ। এখন আমরা স্বাধীন যারা লুঠতরাজ করেছিল এখন তারাই আমাদের ভয় পাচ্ছে। লুটের মাল ফেরৎ দিয়ে যাচ্ছে। মুক্তি সেনারা ঢোল পিটাইয়া গেছে। আমাদের এখন আর দুঃখ নাই। এই দেখেন, কতদিন পরে ধূতি পইড়া চাদর গায়ে হাটে আইছি। এখন যদি একটু ভাল সূতা পাই তাইলেই আবার ব্যবসা পাকা কইরা বইসমু। পাশের দোকানের নগেন সাহাও ততক্ষণে এসে আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। তিনিও একই কথা জিজ্ঞেস করলেন : এবার ভাল সূতা পামু তো? এখন তাঁদের কাছে মূল সমস্যা সূতো। গোটা হাটে দেখলাম বহু হিন্দু। অধিকাংশই হিন্দু।
দৈনিক আনন্দবাজার, ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন