(একটি খোলা চিঠি)
রেজাকার ও শান্তি কমিটি সমীপেষু
—সীরাজ উদ্দিন
জালেম পাঞ্জাবী টিক্কার গড়া রেজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের বলছি— আপনাদেরকে ভুললে চলবে না, যে আপনারা ও আমরা একই বাংলাদেশের অধিবাসী। বাংলাদেশের মানুষ আজ এক চরমযুদ্ধে লিপ্ত। পৃথিবীর ইতিহাসে অমন অসমযুদ্ধের নজির অল্পই আছে। নিরপেক্ষ বিদেশী পর্যবেক্ষকদের মতে, হিটলার ইহুদীদের উপর যে অত্যাচার করেছিল বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের উপর পাঞ্জাবীদের অত্যাচার তাকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগে। মাত্র কয়েক মাস পূর্বেও যাদেরকে কিছুসংখ্যক মানুষ এক ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ ভাই বলে মনে করতো আজ ওরাও পাঞ্জাবীদের আসল চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছে তারা ‘ভাই’ নয়—‘চরম শত্রু। ওদেরকে ভালোবাসা যায় না শুধু ঘৃণাই করা যায়। তবে ওই বেইমানদের দিন শেষ হয়ে আসছে। কারণ পাঁচমাস পূর্বে বাংলার মানুষ নিরস্ত্র ও অসহায় ছিল। এবং সেজন্যই মেশিনগান, ট্যাংক ইত্যাদি মারণাস্ত্র দিয়ে সারা বাংলাদেশটি জুড়ে রক্তের হোলিখেলা খেলেছে পাঞ্জাবী দস্যুরা। এক তরফাভাবে করেছে খুন, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন।
আজকের বাংলাদেশ কিন্তু সেই মার্চ মাসের অসহায় বাংলাদেশ নহে। অগণিত বাঙ্গালী যুবক যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করে যোগ দিচ্ছে মুক্তিফৌজে। মুক্তিফৌজকে করে তুলছে দুর্জয়। তাদের অগ্রগতি আজ দুর্বার। হানাদার পাঞ্জাবীরা অমন শক্তিশালী নহে যে, আমেরিকার ভিয়েনাম কিংবা ফরাসীদের আলজিরীয় যুদ্ধের ন্যায় বাংলাদেশে বছরের পর বছর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে।
ভয়ে পাঞ্জাবীরা এখন আর সামনাসামনি যুদ্ধে আসছে না। কেন আপনারা আমাদের ভাই হয়েও ওদের চালাকী বুঝতে পারছেন না? ওরা মুক্তিফৌজের গুলির সামনে রেজাকার ও শান্তি কমিটির মেম্বারগণকেই ছুঁড়ে দিচ্ছে। মুক্তিফৌজ অস্ত্রবলে বলীয়ান বলেই আজ কাপুরুষ পাঞ্জাবীদের বীরত্বের দাপাদাপি কমে গেছে। বিনাযুদ্ধে বিজয়ী খেতাবধারী ফিল্ড মার্শাল আয়ুবের স্বজাতি যে ওরা।
সিপাহী যুদ্ধের পর থেকে আজকের পাঞ্জাবীদের যুগ পর্যন্ত প্রায় দুইশো বছর—আমাদের কেহ বন্দুক হাতে নেবার সুযোগ পায়নি। তাই ওরা ভেবেছিল আমরা বাঙালীরা ওদের বন্দুকের ভয়েই দাসত্ব স্বীকার করে নেবো। কিন্তু আজ ওরা বুঝতে পেরেছে ষ্টেনগান, মর্টার, এল, এম, জি—ইত্যাদি আগ্নেয়াস্ত্র আমাদের খেলার পুতুল ওদের বুক চিনে চিনেই নির্ভুল গুলী মারছি।
মওদুদী, মুক্তী মাহমুদ প্রভৃতি ধর্মব্যবসায়ী ও তাদের সর্দার ইয়াহিয়া খাঁ ও টিকিয়া খাঁ এর ফতোয়ানুযায়ী বাংলার মুসলমান আমরা নাকি হাবসী-গোলামদের মতো। যথা ইচ্ছা আমাদেরকে ওরা ধ্বংস করতে পারে। বাংলার মা-বোনদের উপর বলাৎকার করতে পারে। ওদেরকে নাকি সেই পশুবল দান করছে ওদের আল্লা। কিন্তু আমরা দেখছি আমাদের আল্লাহ্ এই অত্যাচারীদেরকে খতম করে আমাদের দেশে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠার তৌফিক আমাদেরকে দিচ্ছেন। এবং সেজন্যই হালকা পাতলা বাঙালী যুবকরা তাগড়া মোষের মতো পাঞ্জাবীদের যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে শুধু হত্যাই করে চলছে তা নয়, ওদেরকে জ্যান্তপাকড়াও করেও নিয়ে আসছে।
পাকিস্তানের সর্বমোট সৈন্য সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ। এর মধ্যে ওদের শাদ্দাদী বেহেশ্তখানা ইসলামাবাদ, লাহোর, ইত্যাদি শহরগুলো এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা রক্ষা ও পাঠান বালুচ-সিন্ধীদের বিদ্রোহ দমনের জন্য ২ লক্ষ ২৫ হাজার সৈন্য ওখানে মোতায়েন রাখতে হয়েছে। বাংলাদেশে এনেছিল ৭৫ হাজার। কিন্তু ইতিমধ্যে ২৭ হাজার হয়ে গেছে খতম। অবশিষ্ট ৪৮ হাজার বাছাধনেরা বিগত ৫ মাসের অনবরত যুদ্ধের মধ্যে বার শত মাইল দূরে মা-বোনদের হাতে বাংলার লুণ্ঠিত টাকা, অলংকার ও অন্যান্য দ্রব্যাদি সমজায়ে দিয়ে আসাতো দূরের কথা—লুণ্ঠিত সামগ্রী কোমরে ও পেটে বেঁধে রেখে মুহূর্তের জন্যও একবার বিশ্রামের সুযোগ পাচ্ছে না। দেশে যাওয়ার রাস্তাটাও বিপদসঙ্কুল। মুক্তিফৌজের চতুর্দিকে আক্রমণ তাদেরকে বঙ্গোপসাগরের অতল গহবরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পালাবার সুযোগের জন্য বড় অফিসারেরা বিমান ঘাঁটিগুলো কড়া পাহারায় রেখেছে।
পালিয়ে যাওয়ার সময় ওরা কিন্তু বাংলাদেশের সকল দালাল ও বিহারী গুন্ডাদেরকে মুক্তিফৌজের গুলির নিশানায় তাদের সকল পাপের কাফ্ফারা স্বরূপই ফেলে যাবে।
ভারত থেকে মার খাওয়া কালো চামড়ার যে বিহারীগণ পশ্চিম পাকিস্তানে মাথা গুঁজবার ঠাঁইও পায়নি পৃথিবীর সব চাহিতে ঘনবসতি অঞ্চল এই পূর্ব বাংলায় আমরাই ওদেরকে ভাই বলে স্থান দিয়েছিলাম। চাকুরী, ব্যবসা, এমন কি ক্ষেত খামারে পর্যন্ত অংশীদার করেছিলাম। কিন্তু সেই চরম বিশ্বাসঘাতকেরাই বাংলার মাটির সঙ্গে করেছে বেইমানী, নিমকহারামী এবং বাংলার মানুষের উপর করেছে অকথ্য অত্যাচার।
বাংলাদেশের ব্যাপারে দুনিয়ার জনমত আজ পাকিস্তানের নিন্দায় মুখর। নিরস্ত্র জনসাধারণ এবং বিশেষ করে নারী ও শিশুদের প্রতি পাক-সামরিক বাহিনী যে চরম অত্যাচার করছে দুনিয়ার ইতিহাসে তার কোন নজীর নেই। এসব কুকীর্তি আজ পৃথিবীর মানুষের অজানা নয়। তাই বিশ্বের সকল জায়গা থেকেই ওদেরকে ধিক্কার দেওয়া হচ্ছে এবং সেই জন্যই কুখ্যাত জল্লাদ টিক্কা খাঁকে বাংলা মুলুক থেকে সরিয়ে নিয়ে পাঠান, বালুচ ও সিন্ধীদেরকে শায়েস্তা করার ভার ওরি উপর দিয়েছে ইয়াহিয়া খাঁ। কারণ ওখানাকার জনমতও আজ বিক্ষুব্ধ। ভুট্টো সাহেব কলকে পাচ্ছেন না। আর্থিক দিক দিয়েও পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা কাহিল। পাকিস্তানের সর্বমোট আয়ের প্রতি তিন টাকার দু’টাকা বাংলাদেশের পাট, চা, তামাক ও বিলাত প্রবাসী বাংগালীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। মুক্তিযুেদ্ধের ঠেলায় দু’টাকার স্থলে আট আনাও এখন তাদের কপালে জুটছে না। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাজারে পশ্চিম পাকিস্তানের কাপড়ের মিলগুলো তাদের তৈরী কাপড় বিক্রী করতে না পারায় মিলগুলোতে তালা চাবী লাগাতে বাধ্য হচ্ছে। বেতন দিতে না পারায় পাঞ্জাবী মিল- শ্রমিকদেরকে পাইকারীভাবে চাকুরী হতে বরখাস্ত করা হচ্ছে। করাচী বাজারের আমদানীকারক ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের তেলতেলীভাব আজ আর নেই। মোগলাই মেজাজ ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। চব্বিশ বছরে গঠিত বাইশ পরিবারের শোষণের ভিত ভেঙ্গে আজ চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সিপাহীদের যুদ্ধকালীন অতিরিক্ত ভাতা হয়ে গিয়েছে বন্ধ। বাংলাদেশে নিয়োজিত সেপাইদেরকে আপাততঃ ঘুষের টাকা, লুণ্ঠিত ঘড়ি, রেডিও, অলংকার ইত্যাদি ও বদমায়েসের অবাধ লাইসেন্স দিয়েই খুশী রাখার চেষ্টা চলছে। বেতন ও ভাতা দিবে কোন টাকাশাল ?
আল্লাহর মেহেরবানীতে করাচী ও ঢাকার দূরত্ত্ব দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের উপর দিয়ে আগে ছিল ১২০০ মাইল আর এখন ভারত ঘুরে ৩ হাজার মাইল-পাক-ভারত যুদ্ধ বাঁধলে এই দূরত্বের মাত্রা দাঁড়াবে ৭ হাজার মাইলেরও বেশী। আপনারা তখন যাবেন বঙ্গোপসাগরে-আর ঐ পশ্চিমা দস্যুরা ডুবে মরবে আরব সাগরে।
মুক্ত বাংলা ॥ ১ : ১ ॥ ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন