শরণার্থী শিবির প্রসঙ্গে
করিমগঞ্জ মহকুমার ৩৫ সহস্রাধিক শরণার্থীকে তিনটি বৃহৎ আধাস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা হইয়াছে। মহকুমার বিভিন্ন স্কুলগৃহে যে সমস্ত শরণার্থী আশ্রয় নিয়াছিলেন, তাঁহাদের অধিকাংশকেই স্থানান্তরিত করা হইয়াছে, বাকীদেরও অনতিবিলম্বেই করা হইবে বলিয়া জানা গিয়াছে।
এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থী অধ্যুষিত তিনটি শিবির পরিচালনা করার যথাযথ ব্যবস্থা করা একটি গুরুতর দায়িত্ব সন্দেহ নাই। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সঞ্জাত এই গুরুভার মানবিকতার কারণে গ্রহণ করিয়াছেন, এবং ভারতের আপামর জনসাধারণ কেন্দ্রীয় সরকারের এই মনোভাবকে সমর্থন করিয়াছেন, সুকঠিন হইলেও যোগ্যতার সহিত এই দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনকে পালন করিতে হইবে।
দুর্ভাগ্যবশতঃ আধাস্থায়ী শিবিরগুলো চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অব্যবস্থা ও দুর্নীতির কিছু কিছু অভিযোগ আমাদের কাছে পৌঁছিতেছে। কেন্দ্রীয় সরকার শরণার্থীদের জন্য যে দৈনিক বরাদ্দ নির্দিষ্ট করিয়াছেন, তাহা হয়তো পর্যাপ্ত নয়, কিন্তু আমরা অভিযোগ পাইয়াছি যে এই নির্দিষ্ট বরাদ্দটুকুও সমস্ত শিবিরে যথাযথভাবে বণ্টিত হইতেছে না। রেশনে যে দ্রব্যাদি পরিবেশিত হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাহা অত্যন্ত নীচু মানের এবং মুগ ডালের পরিবর্তে সর্বত্রই নাকি সম্পূর্ণ অন্য একটি বস্তু পরিবেশিত হইতেছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সরবরাহকারীদের নিকট হইতে টেণ্ডার গ্রহণ করার সময়ে কিন্তু সর্বোৎকৃষ্ট বস্তু সামগ্রী পরিবেশন করার নির্দেশই দেওয়া হইয়াছেন। শিবিরবাসীদের সহিত সরকারী কর্মচারীদের মনোমালিন্যের ঘটনা প্রায়ই ঘটিতেছে এবং অশোভন এবং অমানবিক ব্যবহারের অভিযোগও পাওয়া যাইতেছে। সম্প্রতি কালীগঞ্জের অস্থায়ী শিবিরে শান্তিভঙ্গের যে ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহার নানা ধরণের ভাষ্য শোনা যাইতেছে, এবং শিবিরবাসীরা এক ধরণের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করিয়াছেন। এই ঘটনাকে ধামাচাপা না দিয়া প্রকৃত তথ্য নিরূপণের জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন বলিয়া আমরা মনে করি। অন্যকোন একটি আধা স্থায়ী শিবির সম্পর্কেও অসামাজিক ক্রিয়া কলাপের অভিযোগ উঠিয়াছে এবং জনৈক পদস্থ সরকারী কর্মচারীর নামও এই প্রসঙ্গে শোনা যাইতেছে। এই সম্পর্কে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করিলে যে কোন দিন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটিতে পারে বলিয়া অনেকেই আশংকা করিতেছেন।
মানবতার নামে যাহাদের দায়িত্ব ভারত সরকার গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের ত্রাণ কার্য্যের ব্যাপারে আরো সহৃদয়ন এবং আন্তরিকতার নীতি গ্রহণের জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং কর্মচারীদের প্রতি অনুরোধ জানাইতেছি। শরণার্থীরা বহু দুর্বিপাক মাথায় বহিয়া একান্ত নিরূপায় হইয়া এই বিদেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন এবং তাঁহাদের প্রতি আমরা যে দায়িত্ব পালন করিতেছি তাহার আন্তর্জাতিক গুরুত্ব রহিয়াছে। ইহা পালনে কোনরূপ শৈথিল্য প্রদর্শন করিলে মানবতার দরবারে আমরা অপরাধী হইব, সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আমাদের মৰ্য্যাদাহানি ঘটিবে, এই সত্যটি আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে।
যুগশক্তি, ২৩ জুলাই ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন