ভাটি অঞ্চলে পাকদস্যুদের পৈশাচিকতা অতীত রেকর্ডকেও ম্লান করিয়া দিয়াছে
[নিজস্ব প্রতিনিধি]
ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী সিলেট ও ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চলে বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলে নতুন করিয়া গণহত্যাভিযান, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতন শুরু করিয়াছে। গত তিন সপ্তাহে হানাদার পশুরা সুনামগঞ্জ মহকুমার জামালগঞ্জ, ধর্মপাল, দিরাই, জগন্নাথপুর ও শাল্লা; হবিগঞ্জ মহকুমার আজমিরিগঞ্জ, বানিয়াচঙ ও নবিগঞ্জ; কিশোরগঞ্জ মহকুমার ইটনা ও করিমগঞ্জ; নেত্রকোণা মহকুমার খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, কলমাকান্দা প্রভৃতি থানার অধীনে গ্রামগুলিতে হানা দিয়া সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করিয়াছে, ধান ও গবাদি পশু সহ কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি ধ্বংস ও লুট এবং কয়েকশত মহিলার উপর নির্যাতন করিয়াছে ও ধরিয়া নিয়া গিয়াছে। এই এলাকা হইতে প্রায় আড়াই লক্ষ লোক ইতিম্যেধই প্রাণভয়ে দেশত্যাগ করিয়া মেঘালয়ের দিকে যাত্রা করিয়াছে।
এতদিন মুক্ত ছিল
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই সকল এলাকা এতদিন পাক হানাদার দস্যুদের কবলমুক্ত ছিল। স্থানীয়ভাবে গড়িয়া ওঠা মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধে ও যোগাযোগের অসুবিধার দরুন পাকিস্তানী সৈন্যরা এই অঞ্চলে প্রবেশ করিতে পারে নাই। হানাদাররা এখন কিছু দালাল খুঁজিয়া বাহির করিয়া এবং রাজাকার ও চোরগুণ্ড বদমাইশদের সংগঠিত করিয়া তাহাদের সহায়তায় এই সকল অঞ্চলে প্রবেশ করিতেছে ও নিজস্ব কায়দায় গণহত্যা চালাইতেছে। পাকিস্তান সরকার একদিকে ‘স্বাভাবিক অবস্থা” বলিয়া চিৎকার করিতেছে, দালাল-চূড়ামণি মালেককে ‘গভর্নর’ বানাইয়া ‘বেসামরিক শাসন’ বলিয়া বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিতে চাহিতেছে, অন্যদিকে বাঙলাদেশের গ্রামাঞ্চলে নতুন নুতন এলাকায় প্রবেশ করিয়া হত্যা ও দস্যুবৃত্তি পূর্ণমাত্রায় চালাইয়া যাইতেছে।
উল্লিখিত এলাকাগুলিতে হানাদারেরা তাহাদের প্রধান লক্ষ্যস্থল হিসাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ন্যাপ, আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট প্রভাবিত গ্রামগুলিকে বাছিয়া নেয়।
দালালদের কীর্তি
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, গত ১৬ই আগস্ট বানিয়াচঙে কয়েকজন কুখ্যাত দালাল একটি জনসভার আয়োজন করে। উদ্যোক্তা দালালদের মধ্যে ছিল মোতওয়াল্লী ফয়জুল হক আব্দুল্লাহ বানিয়াচঙ্গী আজমিরিগঞ্জ নিবাসী সিরাজউদ্দিন, নবিগঞ্জের আব্দুর রহমান ও দিরাই অধিবাসী আব্দুল মালিক। অবিশ্বাস্য হইলেও সত্য যে, সভায় ‘ইসলামকে রক্ষা’ করার আহ্বান জানাইয়া প্রকাশ্যে পার্শ্ববর্তী হিন্দু প্রধান মাকালকান্দি ও আরও কয়েকটি গ্রাম আক্রমণ ও লুটতরাজের জন্য সমাজবিরোধীদের উস্কানো হয়। সভায় সিদ্ধান্ত করা হয় যে, ১৮ই আগস্ট মাকালকান্দি আক্রমণ করা হইবে।
উক্ত সভায় যোগদানকারী কয়েকজন ব্যক্তি মাকালকান্দি গ্রামে গিয়া সভার সিদ্ধান্ত জানাইয়া গ্রাবাসীকে সতর্ক করিয়া দেয়।
এই সংবাদে গ্রামের হিন্দু মুসলিম জনসাধারণ অনেকেই নৌকাযোগে গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে থাকে। কিন্তু অনেকে উহা বিশ্বাস না করিয়া গ্রামেই থাকিয়া যায়।
মাকালকান্দি আক্রমণ
১৮ই আগস্ট নৌকা যোগে দুই শত পাকিস্তানী সেন্য আরও প্রায় একশত দাগী চোর, ডাকাত ও সমাজবিরোধীদের লইয়া বানিয়াচঙ হইতে মাকালকান্দি গিয়া আক্রমণ চালায়। গ্রামের কাছাকাছি আসিয়া হানাদারেরা নৌকার সঙ্গে আনা অনেকগুলি ছোট ছোট স্পীড বোটে করিয়া চতুর্দিক হইতে তদ্রু গ্রামটি ঘিরিয়া ফেলে। তারপর মেশিনগান ও এল-এম-জি হইতে ঝাঁকেঝাঁকে গুলি বর্ষণ করিতে করিতে গ্রামে নামিয়া পড়ে। এই অতর্কিত হামলায় গ্রামবাসীরা দিশাহারা হইয়া আত্মরক্ষার্থে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করিতে থাকে। কিন্তু পাকসেনারা গ্রামটিকে চতুর্দিক হইতে ঘিরিয়া থাকয় তাহারা পালাইতে পারে না। অনেকে, বিশেষত মায়েরা তাহাদের শিশুসন্তান বুকে আঁকড়াইয়া লইয়া খড়ের গাদা ধানের গোলা এমনকি পানির নিচে ডুব দিয়া বাঁচিবার শেষ চেষ্টা করে। আহত, মৃত্যু যন্ত্রণাকাতর ও ভীতসন্ত্রস্ত নরনারী শিশু যুবা বৃদ্ধের আর্তচিৎকারে গ্রামের আকাশ বিদীর্ণ হইতে থাকে৷
পৈশাচিক বর্বরতা
হানাদার পিশাচরা যাহাকে সামনে পায় তাহার উপরই গুলি চালায় ও তারপর বাড়ি ঘরে আগুন ধরাইয়া দেয়। যাহারা প্রাণ বাঁচাইতে খড়ের দাগা ও ধানের গোলায় লুকাইয়া ছিল তাহারা জীবন্তদগ্ধ হয় অথবা বাইরে আসিয়া গুলির আঘাতে প্রাণ হারায়। ইয়াহিয়ার জল্লাদরা পৈশাচিক উল্লাসে শিশুদের ধরিয়া ধরিয়া অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে। মায়ের কোল হইতে শিশুদের ছিনাইয়া লইয়া আছাড় দিয়া মারে। বর্বরতার কোন অনুষ্ঠানই এই সব পিশাচেরা বাদ রাখে নাই।
এই গ্রামে মোট নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচশত হইবে। প্রায় ৭৫ হাজার মণ ধান পুড়িয়া নষ্ট হইয়াছে।
অন্যান্য গ্রামে ধ্বংস
মাকালকান্দি গ্রামকে এইরূপে শ্মশানে পরিণত করিয়া হানাদাররা পরদিন জহিরপুর, গোয়াউরি ইত্যাদি গ্রামে অনুরূপ হামলা চালায়। হানাদার সেনাবাহিনী ও তাহাদের সংগঠিত গুণ্ডা বাহিনী ইহার পর রুটিন মাফিক একের পর এক গ্রামে এইরূপ বীভৎস হত্যা-যজ্ঞ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন চালাইতেছে।
এই ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞের মধ্যে সঠিক সংবাদ সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য। এই সংবাদদাতা ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঐসকল এলাকায় ঘুরিয়া গণহত্যা ও অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছে এমন যে সব গ্রামের নাম সংগ্রহ করিয়াছেন তাহা নিম্নরূপ। বানিয়াচঙ থানার মধ্যে মাকালকান্দি, নজিরপুর, সিকান্দারপুর, গোয়াউরি, শিবপাশা ইত্যাদি গ্রামে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছে। ইহাছাড়া করিমপুর, সাইরামপুর, কামাগলা, চকি বাউশী, তেলঘরি, কনকপুর, কর্ষা, রউয়াই, মাখরাখাই, হিলালনগর, ঝিলুয়া, দীঘলবাঁধ, ঘোগরাইল ইত্যাদি গ্রাম আগুনে ভস্মীভূত করা হইয়াছে। আজমিরিগঞ্জ থানায় আজমিরি, জলসুখা, সামিপুর, বিরাট, পাহাড়পুর, বদলপুর ও কাটাখালি গ্রাম।
নবিগঞ্জ থানার নবিগঞ্জ বাজার, শল্লা থানার শল্লা গ্রাম ও জগন্নাথপুর থানার শ্রীরামশ্রী গ্রামে প্রায় আড়াই শত লোককে হত্যা করা হইয়াছে। রানীগঞ্জে দুইশত লোককে হত্যা করা হইয়াছে। জামালগঞ্জ থানার লালপুর গ্রামে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হইয়াছে। ছাতক থানার মাধবপুর ও জাগাইয়া গ্রামে প্রায় তিন চার শত লোককে খুন করা হইয়াছে।
ইহা ছাড়া নবিগঞ্জ থানার হরিপুর, নজীপুর, মেঘারকান্দি, সোনাপুর ও জগন্নাথপুর; শল্লা থানার ভেড়ারডর, সাউদেরশ্রী, মেধা ও আলীপুর; দিরাই থানার কচুয়ারপার, করিমপুর, চণ্ডীপুর, রাধানগর, রননারচর, কাচ্চিয়া, গরিয়া, কাগাউরা, পেড়য়া, শ্যামারচর, মেঘনা, বারঘর, বাংগাডর, ভোরামপুর, শেখবাড়ী, ও থানোয়ারপুর; সুনামগঞ্জ থানার লালপুর, লম্বাবাঁক ও কাশীপুর; ছাতক চেতুরা, নার নাইনগাঁও, রাজনপুর, হরশপুর, কানহিয়াতা ইত্যাদি গ্রাম ভস্মীভূত দেখা গিয়াছে। এই সকল অঞ্চলে নতুন নতুন গ্রামে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নরহত্যাভিযান এখনও চলিতেছে।
হাজার হাজার মানুষের দেশত্যাগ
এই আক্রমণের পর প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই সব থানা ও পার্শ্ববর্তী হইতে এলাকা মেঘালয়ের দিকে চলিয়া যাইতেছে। কিন্তু মৃত্যুভয়ে যে সকল অসহায় নরনারী ভারতে পাড়ি জমাইতেছে, তাহাদেরও নরঘাতী পিশাচরা রেহাই দিতেছে না। তাহারা সীমান্তবর্তী পথে পথে খরচার হাওর, শনির হাওর, ধনপুরের খাল, ইচ্ছার চরের খাল, গনিগঞ্জের খাল, ধনু নদী প্রভৃতি স্থানে সশস্ত্র গুণ্ডাদের পাহারায় বাসাইয়াছে। শরণার্থীদের নৌকা দেখামাত্র এই নরপশুরা গুলি চালাইয়া মানুষ হত্যা করে, শরণার্থীদের শেষ সম্বলটুকুও কাড়িয়া লয় ও নৌকাগুলি আটক করিয়া সাচনায় মিলিটারি ক্যাম্পে লইয়া যায়। সেখানে পাক সেনারা স্ত্রী-পুরুষ শিশু নির্বিশেষে নির্মমভাবে প্রহার করিয়া আধমরা অবস্থায় তাহাদের দু-একটি নৌকায় গাদাগাদি করিয়া উঠাইয়া ছাড়িয়া দিতেছে। শরণার্থীদের মধ্য হইতে যুবতী মেয়েদের আটক করিয়া রখিতেছে। এইভাবে এই এলাকায় কয়েক শত মেয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাম্পগুলিতে বন্দী হইয়া নিস্পেষিতা হইতেছে।
প্রতিরোধ
কিন্তু অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হইতেছে। হানাদারদের কবল হইতে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনী এই সকল এলাকাতেও প্রাণপণ লড়িয়া যাইতেছেন। উল্লিখিত অঞ্চল সমূহের কোন কোন জায়গায় এই চরম নির্যাতনের মধ্যেও গোপনে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা গ্রুপ গড়িয়া উঠিয়াছে। যুবকেরা অপরাপর মুক্ত এলাকা হইতে গেরিলা ট্রেনিং লইয়া এই এলাকায় আসিতেছেন। যৎসামান্য হালকা অস্ত্র লইয়া গেরিলারা বহু গুণে শক্তিশালী ও আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে সুসজ্জিত হানাদার সেনাবাহিনীকে গেরিলা কায়দায় মোকাবিলা করিতেছে। মুক্তিবাহিনী এখন এই এলাকায় প্রধানত রাজাকার ও দালালবাহিনীকে নির্মূল করার কাজে হাত দিয়াছে। পাহাড়পুর, বদলপুর, কাদিপুর, আবদা, আমরিয়া প্রভৃতি গ্রামে লুণ্ঠন, চলাকালে মুক্তিবাহিনী অতর্কিতে হানা দিয়া বহুসংখ্যক গুণ্ডা বদমাইশ রাজাকার ডাকাতকে সাবাড় করিয়াছে। ফলে এই এলাকায় পাক হানাদারদের পক্ষে দালালি ও গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য লোক খুঁজিয়া পাওয়া দুস্কর হইয়া উঠিতেছে। চতুর্দিকে হানাদার সেনায়রুদ্ধ অবএই এলাকায় মুক্তিবাহিনী যে দুর্জয় সাহসিকতা, দৃঢ়তা ও অপূর্ব কৌশলের সহিত লড়িতেছেন তাহা সত্যই বিস্ময়কর। মুক্তিবাহিনীর কাজের ফলে হানাদার আক্রমণে বিধ্বস্ত এই এলাকার জনসাধারণের মধ্যেও মনোবল বৃদ্ধি পাইতেছে। এই এলাকার দৃষ্টান্ত অন্যান্য এলাকার জনগণকেও উদ্বুদ্ধ করিতেছে।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১ : ১১ ॥ ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন