সেই পুরাতন খেলা
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় একটি নতুন নাটকের অভিনয় চলছে। নাটকটি যদিও নতুন কিন্তু তার বিষয়বস্তু অত্যন্ত পুরোন। এই বিষয়বস্তু হল, একজন অসামরিক তাবেদার বাঙালীকে গভর্ণরের পদে বসিয়ে বিশ্ববাসীকে বোঝানো, বাংলাদেশে আর সামরিক শাসন নেই। এমন চেষ্টা আইয়ুব খাঁও করেছিলেন। তার দশ বছরের স্বৈরাচারী শাসনে মোনেম খাঁ নামক এক বটতলার উকিলকে গভর্ণর পদে বসিয়ে দুনিয়ার মানুষকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, বাঙালীদের দ্বারা শাসিত হচ্ছে। মোনেম খাঁর বদলে এবার ভাড়া পাওয়া গেছে আবদুল মোতালিব মালেক নামক এক দাঁতের ডাক্তারকে।
ঢাকার লাটভবনে শুধু তাবেদার গভর্ণর বসিয়ে নয়, পিণ্ডির জঙ্গীচক্র বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার আসল অবস্থা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্য আরো ছল চাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে। হঠাৎ খুনী ইয়াহিয়া একেবারে ‘মহানুভব’ ব্যক্তি সেজেছেন এবং তাদের কথিত এক শ্রেণীর “রাষ্ট্রবিরোধী” বাঙালীর প্রতি ‘সাধারণ অনুকম্পাও’ ঘোষণা করেছেন। দখলীকৃত ঢাকা বেতার থেকে বলা হয়েছে, কিছু সংখ্যক আটক লোককে নাকি জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই কিছু সংখ্যক লোক কারা, তাদের নাম ধাম কি, তা কিন্তু বেতার ঘোণায় বলা হয়নি। সুতরাং আশঙ্কা হয় শিয়ালের কুমীর ছানা প্রদর্শনের মত এই ‘ক্ষমা প্রদর্শনের’ মহড়াটিও জঙ্গীচক্রের কোন শয়তানি অভিসন্ধির বহিঃপ্রকাশ কিনা।
এদিকে এইসব লোক দেখানো ভড়ং, অন্যদিকে দখলীকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের বর্বরতা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এখনো বাঙালী মেয়েদের ইজ্জত নাশ করা হচ্ছে এবং এক একজন অশিক্ষিত সেপাইকে বাঙালী মেয়েদের বল পূর্বক পত্নী (উপপত্নী) হিসাবে গ্রহণে উৎসাহ জাগানো হচ্ছে। দখলীকৃত এলাকায় চলছে গ্রামের পর গ্রাম লুন্ঠন, হত্যা ও অগ্নিউৎসব। দখলীকৃত এলাকায় বাঙালীদের এই অবস্থা। বিদেশেও তাদের সঙ্গে একই আচরণ করা হচ্ছে। ইয়াহিয়া-চক্র বুঝতে পেরেছে, তাদের বিদেশী দূতাবাসে যেসব বাঙালী কর্মচারী রয়েছে, তাদের কেউ আর পিণ্ডির খুনী চক্রের প্রতি অনুগত নয়। তারা স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেন এবং সুযোগ পেলেই তা ঘোষণা করবেন। গত পাঁচ মাসে বহু বাঙালী কূটনীতিবিদ ও দূতাবাস কর্মচারী বাঙলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করে বহির্বিশ্বে ইয়াহিয়া চক্রের মিথ্যা প্রচারণার বেলুন ফুটো করে দিয়েছেন। শঙ্কিত ইয়াহিয়া-চক্র তাই অবশিষ্ট বাঙালী কর্মচারীদের আটকানোর জন্য তাদের পাসপোর্ট আটকের আদেশ দিয়েছেন। যদিও নির্দেশে বলা হয়েছে, এই আদেশ সকল দূতাবাস-কর্মচারীর বেলাতেই প্রযোজ্য, কিন্তু কাজের বেলায় বেছে বেছে যে কেবল বাঙালী কর্মচারীদের পাসপোর্টই আটকা কর হচ্ছে, বিশ্ববাসীর সে খবর জানতেও আর দেরী হয়নি।
দেশে বিদেশে এই বাঙালী-নিধন ও বাঙালী-বিতাড়ন নীতি অব্যাহত রেখেও ইয়াহিয়া-চক্র ঢাকায় কেন এক বিশ্বাসঘাতক বাঙালীকে তাবেদার হিসাবে লাটের গদিতে বসিয়ে এই অসামরিক শাসনের ভড়ং দেখাচ্ছে? এই প্রশ্নটির জবাব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ গত ৫ই সেপ্টেম্বর রাত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তাঁর ভাষণ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আসন্ন হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশে অসামরিক শাসন পূনঃ প্রবর্তনের ভাব সৃষ্টির একটা কৌশল অবলম্বন করেছে।” প্রধান মন্ত্রী আরো বলেছেন, ইয়াহিয়া ঘৃণ্য টিক্কা খাঁর স্থলে একজন অসামরিক সাক্ষী গোপালকে বসিয়েছেন এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন মুষ্টিমেয় হতাশ বাঙালীকে পাকিস্তানের প্রতিনিধি করে জাতিসঙ্ঘে পাঠাবার চেষ্টা করছেন- এ সবই ওই একই কৌশলের অঙ্গ। অর্থাৎ বাংলাদেশে যে সামরিক আইন, গণহত্যা ও দমন নীতি অব্যাহত রয়েছে, এই নগ্নসত্য গোপন করার চেষ্টা।”
কিন্তু পিন্ডির খুনী চক্রেই সত্য গোপন প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তাই বাংলাদেশে একজন তাবেদার গভর্ণর নিয়োগ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের “নিউ ইয়র্ক পোষ্ট’ পত্রিকা স্পষ্ট ভাষায় বলেছে, “বাংলাদেশে গভর্ণর হওয়ার কোন যোগ্যতা এই লোকটির নেই। বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণের একমাত্র অধিকার রয়েছে জনগণের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের।” নেদারল্যাণ্ডের একজন প্রভাবশালী পার্লামেন্ট সদস্য ডাঃ মালিককে বাংলার দখলীকৃত এলাকার গভর্ণর নিয়োগ করা সম্পর্কে বলেছেন, ‘এটা ঔপনিবেশিক ধরণের নিয়োগ।’ বস্তুত ইয়াহিয়া-চক্র যতই চেষ্টা করুণ, বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করা তাদের চোখের ধূলো নিক্ষেপের কোন চেষ্টাই সফল হবে না। বাংলাদেশের মানুষ আর ইয়াহিয়া-চক্রের দাসত্ব করবে না। বরং মুক্তিবাহিনী অস্ত্রের মুখেই ইয়াহিয়ার এই নবনাট্যাভিনয়ে সকল ভাঁড়ামীর অবসান ঘটাবে।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ১৯ ॥ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন