বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় কি দেখিলাম-
॥ নিজস্ব প্রতিনিধি॥
অতি সম্প্রতি ‘বাংলার বাণীর একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা সফর করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন। সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধি যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তারই অংশ বিশেষ এখানে ছাপা হইল।
‘বিশ্বের সেরা সৈনিকরা’ মুক্তিযোদ্ধাদের সহিত সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হইবার পরিবর্তে সাধারণ গ্রামবাসীর উপর চরমতম নিগ্রহ চালাইয়া তাহাদের দুর্বলতা ঢাকিবার চেষ্টা করিতেছে। ভীত সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীদের তাহারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করিতেছে। বিশেষ করিয়া মুক্তিযোদ্ধারা যে জায়গায় একবার খান সেনাদের উপর হামলা করিয়া গিয়াছে তাহার আশেপাশে সাধারণ মানুষের উপর হানাদাররা বর্বর নির্যাতন চালাইতেছে। অতি সম্প্রতি গাইবান্ধার রসুলপুরের ফ্লুইস গেটের নিকটবর্তী ফুলছড়ির বাঁধের উপর মানাস নামক জায়গার একটি পুল গেরিলা যোদ্ধারা রাত্রিকালে আক্রমণ করিয়া রাজাকার ও পাকসেনাদের একটি ছোট পাহারা ঘাঁটি বিধ্বস্ত করিয়াছেন এবং পুলটির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। মানাশের নিকটবর্তী কামারজানী ও গাইবান্ধাতে পাকসেনাদের দুই বিরাট শক্ত ঘাঁটি থাকা সত্বেও যুদ্ধ চলাকালে তাহারা আক্রমণস্থলে আসতে সাহস পায় নাই। পরদিন সকালে একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে একদল বর্বর সৈন্য ঘটনাস্থলে আসিয়া ৩/৪ মাইল এলাকা জুড়িয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালাইয়া প্রায় ১০০ লোক হত্যা করে। রাজাকার ও স্থানীয় অবাঙালরা পরে তাহাদের সহিত মিলিত হইয়া মানাশ ও রসুলপুর এলাকা তছনছ করিয়া ফেলে।
অনুরূপভাবে গেরিলারা রেডিও পাকিস্তান রংপুরের উপর আক্রমণ চালাইলে পাহারারত পঞ্চাশজনেরও অধিক পাকসেনা আত্মগোপন করে এবং তাহাদের অনেকে আহত হয়। রেডিও ষ্টেশন হইতে মাত্র হাফ কিলোমিটার দূরে পাক সরকারের সিভিল আর্ম ফোর্সের সেক্টর অফিস এবং মাত্র এক কিলোমিটার দূরে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থাকা সত্ত্বেও তাহারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পাল্টা আক্রমণ করিবার জন্য কেহই বাহির হয় নাই। এখানে অর্ধঘন্টা ব্যাপী যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা রেডিও ষ্টেশনের বেশ ক্ষতিসাধন করে। পরদিন সকালে যথারীতি “বিশ্বের সেরা সৈনিকেরা” রেডিও ষ্টেশনের সংলগ্ন এলাকা ছাড়াও প্রায় পাঁচ মাইল পর্যন্ত ব্যাপক অভিযান চালাইয়া বহু ঘর বাড়ি জ্বালাইয়া দেয় ও বহু নিরপরাধ গ্রামবাসী ও ৩৮ জন তরুণীকে ধরিয়া নিয়া যায়। তাহাদের ভাগ্যে কি হইয়াছে তাহা জানা যানা নাই। একইদিনে তাহারা উক্ত রেডিও ষ্টেশনের প্রোগ্রাম অরগানাইজার জনাব মহিউদ্দিন হায়দার, ড্রাইবার তারামিয়া ও কয়েকজন টেকনিশিয়ানকে রংপুরের দ্বিতীয় সামরিক শিবির মডেল স্কুলের নিকট দমদম পুলের নিকট অতি নৃশংসভাবে হত্যা করে।
পাকবাহিনীর হিংস্রতা যেভাবে দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে তাহাতে তাহাদের দুর্বলতাই প্রকাশ পাইতেছে। দেশবাসীকে আতঙ্ক ও ভীতগ্রস্থ করিয়া তাহারা “স্বাভাবিক অবস্থা” ফিরাইয়া আনিতে চাহিতেছে। কারণ তাহারা বুঝিতে পারিয়াছে এদেশে তাহাদের আয়ু ফুরাইয়াছে।
বাংলার বাণী ॥ ৫ সংখ্যা ॥ ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন