You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.01.07 | নাটোর বন্দিশিবিরের নারকীয় কাহিনি | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

নাটোর বন্দিশিবিরের নারকীয় কাহিনি
বিশেষ প্রতিনিধি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যানের অধ্যাপক ড. কাজী সালেহ আহমেদ (২৮) নাটোরে এক পাক বন্দিশিবিরে চার মাস আটক ছিলেন। পাক সেনাদের হাতে তাঁর যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হয়েছে, নিচে তার বিবরণ দেওয়া হলো। এ বিবরণ অসম্পূর্ণ, কেননা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি ভেঙে পড়েন। তাঁর বিবরণ সবটা তাই শোনা যায়নি।
“এপ্রিল মাস নাগাদ রাজশাহী শহর কার্যত জনহীন হয়ে পড়ে। লোকেরা হয় ভারতে চলে গিয়েছে, নয়তো আশ্রয় নিয়েছে গ্রামে গিয়ে। আমি গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম এক গ্রামে।
মে মাসে আমার কয়েকজন সহকর্মী আমাকে শহরে ফিরে আসতে বললেন। তাঁরা বললেন, শহরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। গ্রামে তথাকথিত শান্তি কমিটির লোকেরা আমাকে সারাক্ষণ হয়রানি করছিল। তাই আমি স্থির করলাম শহরেই ফিরে যাব।
২৫ মে রাজশাহীতে আমি নিজের বাড়ি ফিরে যাই। সেই দিনই সন্ধ্যায় আমি বসে পড়ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কয়েকজন সৈনিকের সঙ্গে এসে আমাকে ডেকে ‘গেস্ট হাউসে’ নিয়ে গেলেন। সেখানে সৈন্যবাহিনী একটি আপিস খুলেছিল। যেতে যেতে সেনাবাহিনীর অফিসার আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, আমার কোনো ভয় নেই, কেননা খতমের লিস্টে যাদের নাম আছে তাদের গেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয় না, সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় বধ্যভূমিতে। তিনি বলেন, এখানে রাতটা বিশ্রাম করুন, সকালে সওয়াল হবে।
…সকালে এমন কিছু দৃশ্য দেখলাম যা থেকে ভবিষ্যতের কিছুটা আঁচ পাওয়া গেল। দেখলাম কলে গোসল করতে এসেছেন জনা বারো লোক, তাদের সকলেরই মুখ ফোলা ফোলা, দেহে রক্তের দাগ। কিন্তু এর চেয়েও বড় আঘাত আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। একজনকে দেখলাম ধুঁকতে ধুঁকতে কোনোরকমে কলের কাছে আসছেন। তিনি যে আমারই সহকর্মী, গণিতের অধ্যাপক মুজিবর রহমান, অনেক ঠাহর করে তবে তা বোঝা গেল। মেরে তাঁর চেহারাই পালটে দেওয়া হয়েছে।
…সওয়ালের জন্যে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো এক ক্যাপটেনের কাছে। তার প্রথম প্রশ্ন কেন উচ্চ শিক্ষার জন্য আমি সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলাম। আমি বললাম, আমাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাঠিয়েছিল সরকার একটা বৃত্তি দিয়ে। প্রশ্নটা … সরকারকেই করা উচিত। এতে তার ক্রোধের উদ্রেক হলো। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল আমি বিয়ে করেছি কিনা। আমি অকৃতদার শুনে সে বলল, বদমায়েশ, আন্তর্ঘাতী কাজ-কারবার চালাবার জন্যেই বিয়ে করনি।
অতঃপর আমাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো। বাড়িতে খানাতল্লাশি চালানো হলো তন্ন তন্ন করে। আপত্তিকর কিছুই পাওয়া গেল না, কিন্তু আমার দাড়ি কামাবার ইলেকট্রিক শেভার এবং বিদেশ থেকে আনা আরও কয়েকটা জিনিস দেখলাম ক্যাপটেনের নজর টেনেছে। সে বললে, জিনিস কটা আমাকে ধার দেবেন? এবং বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই জিনিসগুলো পকেটস্থ করল।
আমাকে আবার নিয়ে আসা হলো গেস্ট হাউসে। এবারে অভ্যর্থনা হলো কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এবারে আর চেয়ার দেওয়া হলো না, বসতে হলো মেঝের উপর। আদেশ হলো, কলমা পড়ো। কিন্তু পড়া শেষ হবার আগেই সান্ত্রীরা বাঁশের লাঠি দিয়ে আমার মুখে মাথায় মারতে শুরু করল।
কিছুক্ষণ বাদে আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হলো। এবারে আর একজনের পালা। এক কোণে বসে নিজের আঘাতের জ্বালা অনুভব করতে করতে আমি সওয়ালের ধরন দেখতে লাগলাম। বন্দিকে সারাক্ষণ একই প্রশ্ন করা হবে আর তার সঙ্গে সঙ্গেই চলবে মাথায় মুখে কানে আঘাতের পর আঘাত। কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর বন্দির নিজের উপর আর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, সে হয়তো ঝোঁকের মাথায় এমন কিছু একটা বলে ফেলবে, যা সে বলতে চায় না। সওয়াল এবং মার চলবে ততক্ষণ, যতক্ষণ আর-একজনকে সওয়ালের জন্য আনা না হচ্ছে।
রাত্রে সবাইকে বলা হতো প্রার্থনা করতে। প্রার্থনার পর কোনো কোনো বন্দিকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হত। তারা আর ফিরত না। কিছু দূরে বন্দুকের আওয়াজ জানাত তাদের ভাগ্যে কী ঘটল।
পরদিন সকালে আমাকে জেল খানায় নিয়ে যাওয়া হলো। পথে এক বাড়ির বারান্দা থেকে কয়েকটি মেয়ে সহানুভূতি ভরা চোখে আমাকে দেখছিল। অমনি ক্যাপটেন সাহেবের জিভে (ইনিই আমার জিনিসগুলো ‘ধার’ নিয়েছিলেন) জল এল, হাবিলদারের উপর আদেশ হলো বাড়ির নম্বরটা টুকে রাখতে এবং রাত্রে ঐ মেয়েদের তার কাছে পৌঁছে দিতে। হাবিলদার আমাকে বলল, জেলে আমাকে একলা পড়তে হবে না, বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার আরও কিছু সহকর্মীকে সেখানে আনা হচ্ছে।
এরপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো পাবনা কৃষি বিদ্যালয়ে। পাক সেনারা এটাকে একটা বন্দিশিবিরে পরিণত করেছিল। পাবনার পথে আমার সহযাত্রী ছিলেন অধ্যাপক মুজিবর রহমান। আগেই বলেছি মেরে তাঁর চেহারা পাল্টে দেওয়া হয়েছিল।
যে জিপে করে আমাদের পাবনা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তার ভারপ্রাপ্ত অফিসার অধ্যাপক সাহেবের রক্তাক্ত পোশাক দেখে জিজ্ঞাসা করল: বাছাধন গেরিলা বুঝি? নাম কী?
‘আমার নাম দেবদাস।’
আমি আঁতকে উঠে বললাম, কী বলছেন অধ্যাপক সাহেব!
কিছুই যেন হয়নি, এমনিধারা শান্তকণ্ঠে অধ্যাপক রহমান বললেন, আমি নাম অনুবাদ করেই বলেছি মাত্র। মুজিবুর রহমান মানে দেবদাস। ইসলামের নাম নিয়ে যা সব করা হচ্ছে তাতে আর নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেবার ইচ্ছে নেই। অধ্যাপক সাহেবের ঔদ্ধত্যে অফিসার ক্রুদ্ধ হলো। অধ্যাপক একটি চড় খেলেন। সান্ত্রীবর তাঁর একটি আঙুল মটকে ভেঙে দিল।
পাবনা বন্দিশিবিরের কাছে দেখলাম সারি সারি মৃতদেহ পড়ে আছে। তাতে তাজা রক্তের দাগ।
একটা একশ বর্গফুট ঘরে আরও ৪৫ জনের সঙ্গে নিক্ষিপ্ত হলাম। সেদিন রাত্রে প্রচণ্ড গরম ছিল কিন্তু দরজা জানালা সব বন্ধ। আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল, তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু কোথাও এক ফোঁটা জল নেই। জল চেয়েও কোন সাড়া পাওয়া গেল না। গলগল করে ঘাম বেরোচ্ছে। তৃষ্ণায় দেখলাম কেউ কেউ ঐ ঘামই চেটে খাচ্ছে।
মাঝরাতে একজন বন্দি হঠাৎ নামাজ পড়তে শুরু করে দিল। তারপর চেঁচাতে শুরু করল, জানালা বন্ধ করে দাও, জানলার মধ্যে দিয়ে ওরা গুলি ছুঁড়বে। বেচারা পাগল হয়ে গেছে।
পরদিন সকালে শুরু হলো সওয়াল। দেখলাম তাতানো লোহা দিয়ে নাকে ছেঁকা দেওয়া হচ্ছে একজনের। আর একজন বন্দিকে মাটিতে শুইয়ে তার বুকে একটা পাথর চাপা দেওয়া হয়েছে। সেই পাথরের উপর দাঁড়িয়ে নাচছে একজন পাকিস্তানি সৈন্য। দেখলাম, কয়েকজন সৈন্য জনৈক বন্দিকে শক্ত করে ধরে রেখেছে আর একজন ছুরি দিয়ে বন্দির শরীর থেকে চাক-চাক মাংস কেটে নিচ্ছে। আর সারক্ষণ তাদের সব প্রশ্ন করা হচ্ছে যার উত্তর তারা জানেই না।
পাবনা থেকে ঈশ্বরদি হয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো নাটোরে। সেখানে রেল স্টেশনে কিছু অবাঙালী মুসলমান আমার এবং অন্যান্য বন্দিদের মুখে থুতু দিল।
ইতিমধ্যে আমার দাড়ি বেশ বড় হয়ে গেছে। “মেহমানেরা এসে পড়েছে” বন্দিশিবিরের সান্ত্রীরা আমাদের দেখে এই বলে চেঁচিয়ে উঠল। একজন আমার দাড়ি ধরে টানল, নাকে ঘুষি মারল আর-একজন। অধ্যাপক রহমানের অভ্যর্থনাটা আর একটু সাংঘাতিক হলো। তাঁর জামাকাপড়ে রক্ত লেগেছিল এবং তাঁকে ধরে নিয়েছিল গেরিলা বলে। তারপর শুরু হলো সওয়াল এবং তার আনুষঙ্গিক প্রহার। আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, আমার দেহটাকে হেঁচড়ে নিয়ে গিয়ে আমার সেলে ফেলে রাখা হয়েছিল। রাত্রি দশটায় আমাকে আবার সওয়াল করতে নিয়ে যাওয়া হলো এবং সেই সঙ্গে হলো আর-একদফা মার। অর্ধ অচৈতন্য অবস্থায় ধাক্কা মেরে আমাকে আবার ঢুকিয়ে দেওয়া হলো আমার সেলে।
পরদিন সকালে দেখলাম একদল বন্দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সকলেরই শরীরে দগদগে ঘা। একজন বন্দি আমাকে বললেন গরম লোহা দিয়ে ছেঁকা দেওয়ার ফলেই নাকি ঐসব ঘা হয়েছে।
প্রত্যেকদিন সকালে শুরু হতো সওয়াল এবং তার সঙ্গে পাশবিক নির্যাতন। আমাদের সেলে সইফুল ইসলাম নামে বগুড়ার একটি অল্পবয়সী ছাত্র ছিল। একদিন তার পায়ের পাতার উপর প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে মারা হলো। কিন্তু তার গলা দিয়ে একটি আর্তনাদও বের হয়নি। যখন তাকে সেলে ফিরিয়ে আনা হলো তখন সে চেঁচিয়ে গান শুরু করে দিল: “সালাম, সালাম, হাজার সালাম…’
মারধোরটা যে শুধু সওয়ালের সময়ই করা হয় তা নয়। যেকোন সামান্য অজুহাতেই মারধোর করা হত। আমরা হয়তো লাইন বেঁধে খেতে যাচ্ছি, সান্ত্রী এসে বলবে, হুঁ মিলিটারি ট্রেনিং নিয়েছ? গেরিলা? বলেই মার। আবার যদি যে যেমন ইচ্ছে চলি তাহলে শৃঙ্খলাহীনতার জন্যে গালাগালি শুনতে হবে আর সেই সঙ্গে শুরু মার।
মারতে মারতে জিজ্ঞাসা করবে, কী, খুশী তো? যদি বলি হ্যাঁ, তাহলে আরও মারবে আর যদি বলি ‘না’ তাহলেও মার।
মার ছাড়াও নির্যাতনের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করা হত। কোনো সময় কোনো বন্দিকে হয়তো বক্সিং প্রাকটিসের বালির বস্তা হিসাবে ব্যবহার করা হত। কোন সময় কামড়ে তাদের দেহের মাংস ছিঁড়ে নেওয়া হত। এইরকম নরখাদক এক পাকিসেনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রবন্দী সুফি আর বাচ্চুর পেটের মাংস কামড়ে নিয়েছিল। তরুণ বন্দিদের অনেক সময় অস্বাভাবিক যৌনকার্যে লিপ্ত করা হত।
একদিন এক বয়স্ক বন্দিকে এমন নির্মমভাবে প্রহার করা করা হলো যে সে তার কাপড়-চোপড় নষ্ট করে ফেলল। বুড়ো চেঁচাচ্ছিল, এরকমভাবে মারছ কেন, তার চেয়ে আমাকে খুন করে ফেলো। দুর্গন্ধ আর সহ্য করতে না পেরে সৈন্যরা বুড়োকে সরে বসতে বলল। বুড়ো ভাবলে এবারে তাকে গুলি করে মারবে। সে সানন্দে হামাগুড়ি দিয়ে কিছুটা পিছনে সরে গেল। সে ভাবছিল এইবার তার সব যন্ত্রণার শেষ হবে। কিন্তু পাকসৈন্যরা চলে গেল। বুড়ো আশাহতের মতো চিৎকার করে কেঁদে উঠল, আমাকে তাহলে খুন করবে না…
এই পর্যন্ত বলে অধ্যাপক সালেহ ভেঙে পড়লেন। এই বিবরণ শুনতে শুনতে আমারও গা গুলাচ্ছিল। এতএব এইখানেই ইতি টানতে হলো।
দৈনিক কালান্তর, ৭ জানুয়ারি ১৯৭২

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন