You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.05.07 | হাইকোর্ট কর্তৃক শেখ মুজিবর বে-কসুর খালাস | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
৭ই মে ১৯৬৯
‘ভাষণের কোন কোন কথা অপ্রিয়, কিন্তু অপ্রিয় সত্য’ : হাইকোর্ট কর্তৃক শেখ মুজিবর বে-কসুর খালাস : ‘আপত্তিকর ভাষণ’ মামলায় নিম্ন আদালতের দণ্ডাজ্ঞা অবৈধ ঘোষিত
(হাইকোর্ট রিপোর্টার)

গতকল্য (মঙ্গলবার) ঢাকা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবর রহমানের রিভিশন মামলার রায় প্রদান প্রসঙ্গে শেখ সাহেবের প্রতি নিম্ন আদালত কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ডাজ্ঞা অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করতঃ সরকার পক্ষের সকল অভিযোগ হইতে তাঁহাকে বেকসুর খালাস দেন।
মামলার শুনানী শুরু হইলে গত বুধবার সরকার পক্ষ হইতে শেখ সাহেবের দণ্ডাজ্ঞা মার্জনা করা হইয়াছে বলিয়া জানানো হয়। এই পর্যায়ে আবেদনকারীর কৌসুলী উক্ত দণ্ডাজ্ঞার আইনগত বৈধতা নির্ণয়ের জন্য আদালতে আবেদন জানান। দুইদিনব্যাপী শুনানী ও সওয়াল-জওয়াবের পর বিচারপতি জনাব আবদুল হাকিম গতকল্য তাঁহার রায়ে সরকার পক্ষের কৌসুলির সকল যুক্তি প্রত্যাখ্যান করিয়া আবেদনকারীর কৌসুলির যুক্তি গ্রহণ করেন এবং নিম্ন আদালতের প্রদত্ত দণ্ডাজ্ঞা অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করিয়া শেখ সাহেবকে বে-কসুর খালাস দান প্রসঙ্গে বলেনঃ আবেদনকারীর আলোচ্য বক্তৃতার কোথাও কোথাও সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর শব্দ ব্যবহার করা হইয়াছে সত্য এবং সে শব্দগুলি অপ্রিয়ও হইতে পারে-তবে সেগুলি অপ্রিয় সত্য।
মাননীয় বিচারপতি গত সোমবার এই মামলার রায় প্রদান শুরু করেন এবং গতকল্য উহা শেষ হয়। দুইদিনে মোট প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ধরিয়া প্রদত্ত এই দীর্ঘ রায়ে মাননীয় বিচারপতি বিভিন্ন আদালতের রায়ের আলোকে অত্র মামলার বিচার করিয়া বলেন যে, এইসব রায়ে এই নীতিই স্বীকৃত হইয়াছে যে, বিক্ষিপ্তভাবে কাহারো ভাষণ বা বক্তৃতা-বিবৃতির বিচার করা সঙ্গত নহে এবং সেই হেতু আবেদনকারীর বক্তব্যের আসল লক্ষ্য ও মর্ম উপলব্ধি করিতে হইলে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী ও উদার মনোভাব লইয়া সামগ্রিকভাবে তাঁহার ভাষণটির বিচার করিতে হইবে।
বিচারপতি হাকিম তাহার রায়ে আরও বলেন, আবেদনকারী পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নামক একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি। তাঁহার দল ‘ছয়দফা’ কর্মসূচী বিশ্লেষণ ও দলীয় মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মপন্থা গ্রহণ করে। সরকার তাহার দলের উক্ত কর্মসূচী বা তৎসংক্রান্ত প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন নাই এবং উহা অবৈধ বলিয়াও ঘোষিত হয় নাই। শাসনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী ‘ছয়দফা’ কর্মসূচী বিশ্লেষণ ও দেশের কল্যাণের জন্য সরকারের সমালোচনা করার অধিকার শেখ মুজিবর রহমানের ছিল। তিনি তাঁহার ভাষণে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা ও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার কথা বলিয়াছেন। তাঁহার ভাষণের দুই একস্থানে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন সত্য। উক্ত ভাষণের ঐ সব অংশের কোন কোন কথা অপ্রিয় হইতে পারে, তবে সেগুলি অপ্রিয় সত্য।
শেখ মুজিবর রহমানের ভাষণের সপ্তম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সরকার পক্ষের আপত্তির প্রশ্ন আলোচনা প্রসঙ্গে বিচারপতি বলেন যে, বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করিলে উহাতে ঘৃণা, বিদ্বেষ বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রবণতা আছে বলিয়া মনে হইতে পারে। কিন্তু পূর্বাপর অনুচ্ছেদগুলি বিচার করিলে সেই প্রবণতা বহুলাংশে ম্লান হইয়া যায়।
মাননীয় বিচারপতি বলেন যে, আবেদনকারীর ভাষণটিকে সামগ্রিকভাবে বিচার করিলে তাঁহাকে বিদ্রোহাত্মক বলিয়া অভিহিত করা যায় না। আবেদনকারী পূর্ব পাকিস্তানীদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করিতে চাহিয়াছেন, এই কথাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তিনি তাঁর দলীয় কর্মীদিগকে সংগ্রামের আহ্বান জানাইলেও শান্তিপূর্ণভাবেই সেই সংগ্রাম চালানোর জন্য অনুরোধ করিয়াছেন। তদুপরি তিনি পূর্ব পাকিস্তানীদের অভাব-অভিযোগের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের প্রতি আবেদন জানাইয়াছেন।
মাননীয় বিচারপতি তাঁহার দীর্ঘ রায়ের উপসংহারে বলেন যে, আবেদনকারীর ভাষণটিকে সামগ্রিকভাবে বিচার করিয়া আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা পূর্ব পাকিস্তানীদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করা তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল না। অতএব তিনি তাঁহার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ হইতে অব্যাহতি লাভের যোগ্য।
উপরোক্ত মন্তব্যের পর মাননীয় বিচারপতি জনাব আবদুল হাকিম শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি প্রদত্ত দণ্ডাজ্ঞা অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করিয়া আবেদনকারীকে সরকার পক্ষের সকল অভিযোগ হইতে বে-কসুর খালাস দেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, বিগত ১৯৬৬ সালের ২০শে মার্চ পল্টনের জনসভায় প্রদত্ত ভাষণকে কেন্দ্র করিয়া সরকার পক্ষ হইতে শেখ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে পাকিস্তান দেশরক্ষা বিধির ৪১ (৬) ধারা বলে যে মামলা দায়ের করা হয়, কারাভ্যন্তরে বিচারের পর ঢাকার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব আফসার উদ্দীন আহমদ দেশরক্ষা বিধির ৪৭ (৫) ও ৪১ (৬) ধারামতে আবেদনকারীকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া ১৯৬৭ সালের ২৭শে এপ্রিল তাঁহাকে এক বৎসর তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেটের প্রদত্ত এই দাজ্ঞার বিরুদ্ধে দায়রা জজের আদালতে শেখ সাহেব আপীল করিলে আপীলের শুনানীর পর অতিরিক্ত দায়রা জজ জনাব কায়সার আলী উক্ত দণ্ডাজ্ঞা হ্রাস করিয়া শেখ সাহেবকে আট মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
দায়রা আদালতের এই রায়ের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করিয়া শেখ মুজিবর রহমান ঢাকা হাইকোর্টে এক রিভিশন মামলা দায়ের করেন। গত বুধবার বিচারপতি জনাব আবদুল হাকিমের এজলাসে এই মামলার শুনানী শুরু হইলে সরকারের পক্ষ হইতে ডেপুটি লিগ্যাল রিমেব্রান্সার মাননীয় আদালতকে জানান যে, সরকার শেখ সাহেবের দণ্ডাজ্ঞা মার্জনা করিয়াছেন। এই পর্যায়ে উক্ত দণ্ডাজ্ঞার আইনগত বৈধতা নির্ণয়ের জন্য শেখ সাহেবের প্রধান কৌসুলি জনাব সিরাজুল হক আবেদন জানাইলে বিচারপতি জনাব আবদুল হাকিম গত বুধবার এই প্রশ্নে মামলাটির শুনানী শুরু করেন। বৃহস্পতিবার আবেদনকারী ও সরকার পক্ষের কৌসুলিদ্বয়ের সওয়াল-জবাব শেষ হইলে বিচারপতি সোমবার পর্যন্ত মামলার রায় দান স্থগিত রাখেন। তদনুযায়ী গত সোমবারে তিনি রায় দান শুরু করিয়া গতকল্য উহা শেষ করেন। আবেদনকারীর পক্ষে এ্যাডভোকেট সিরাজুল হক মামলা পরিচালনা করেন। তাঁহাকে সাহায্য করেন এ্যাডভোকেট তাজুদ্দীন আহমদ, আবুল হোসেন, আবদুল মান্নান, আবদুল হাই, সিদ্দিকুর রহমান হাজরা প্রমুখ। সরকার পক্ষে উপস্থিত থাকেন ডি,এল,আর জনাব মাসুদ।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯