সংবাদ
৭ই মে ১৯৬৯
ঢাকা হাইকোর্টের একক বেঞ্চের রায় : শেখ মুজিবরকে প্রদত্ত দণ্ডাদেশ বাতিল
(হাইকোর্ট রিপোর্টার)
গতকাল (মঙ্গলবার) ঢাকা হাইকোর্ট আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমানকে প্রদত্ত নিম্ন আদালতের দণ্ডাদেশ বাতিল করিয়া তাঁহার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ হইতে তাঁহাকে মুক্তি দিয়াছেন।
ঢাকা হাইকোর্টের একটি একক বেঞ্চ শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক আনীত একটি ফৌজদারী রিভিশন মামলার রায়দান করিয়া আবেদনকারীকে বেকসুর খালাস দেন।
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রকাশ, ১৯৬৬ সালের ২০শে মার্চ জনাব শেখ মুজিবর রহমান আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়োজিত ঢাকার আউটার ষ্টেডিয়ামে একটি বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় তিনি তাঁহার দলের বহু বিঘোষিত ৬ (ছয়) দফার কথা তুলিয়া ধরেন। উভয় পাকিস্তানের আয় ও ব্যয়ের বৈষম্যের কথা তুলিয়া ধরিয়া কিভাবে তাহার সমাধান হইতে পারে তাহার দিক নির্ণয়ের ইঙ্গিত প্রদান করিয়া তিনি বক্তৃতা করেন।
ইহার কিছুকাল পরে ঐ বক্তৃতাদানের অভিযোগে দেশরক্ষা আইনের বিভিন্ন ধারায় তাঁহাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৯৬৬ সালের ১৭ই এপ্রিল তাঁহার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৬৭ সালের ২৭শে এপ্রিল ঢাকার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব আফসারউদ্দিন আহমেদ অভিযুক্ত জনাব শেখ মুজিবর রহমানকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া ১ বৎসর ৩ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। উক্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে শেখ সাহেব আপীল করিলে ঢাকার দায়রা জজ আপীল আবেদনটি গ্রহণ করেন। ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজ জনাব কায়সার আলী আপীল আবেদনটির চূড়ান্ত শুনানীর পর আবেদনকারীর দণ্ডাদেশ হ্রাস করিয়া তাঁহাকে ৮ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন। দায়রা জজের উপরোক্ত রায়ে অসন্তুষ্ট হইয়া জনাব শেখ সাহেব ঢাকা হাইকোর্টে উহার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করিয়া এই রিভিশন আবেদন করিলে পূর্বাহ্নে হাইকোর্ট কেন ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজের উক্ত দণ্ডাদেশ অবৈধ ঘোষণা করা যাইবে না তাহার কারণ দর্শাইবার জন্য ঢাকা ডেপুটি কমিশনার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপর নির্দেশ জারী করেন। গত সপ্তাহের প্রথমদিকে শুনানীর জন্য উক্ত রিভিশন মামলাটি বিচারপতি জনাব আবদুল হাকিমের এজলাশে আসিলে তিনি উভয় পক্ষের বক্তব্য দুইদিন ধরিয়া শ্রবণ করেন। চূড়ান্ত শুনানীর পর তিনি গত সোমবার রায়দানের জন্য দিন নির্ধারিত করেন। গতকল্য তিনি উপরোক্ত মর্মে রায়দান শেষ করেন।
রায়দান প্রসঙ্গে বিচারপতি জনাব আবদুল হাকিম অভিমত প্রকাশ করিয়া বলেন যে, জনাব শেখ মুজিবর রহমানের বক্তৃতায় কোথাও কোথাও কটুক্তি থাকিলেও তাঁহার বক্তৃতাটির তাৎপর্য সার্বিক বা সর্বাঙ্গীন দৃষ্টিতে বিচার করিতে হইবে। শুধু তাহাই নহে, উহাকে স্থান, কাল এবং বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও বিচার করিতে হইবে। জনাব শেখ মুজিবর রহমানের একটি রাজনৈতিক দল রহিয়াছে এবং ৬-দফা উহাদের একটি প্রোগ্রাম। তিনি বক্তৃতায় তাঁহার ৬-দফার প্রচার, সরকারী নীতির ও রাজনৈতিক নেতাদের এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা করিতেছিলেন। তাঁহার বক্তৃতায় জনাব শেখ মুজিবর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানী জনতার প্রতি কোন বিদ্বেষ বা ঈর্ষা প্রকাশ করেন নাই বা তাহাদের প্রতি কোন ঘৃণা সৃষ্টির চেষ্টাও করেন নাই। তিনি তাঁহার বক্তব্য এমনভাবে প্রকাশ করিয়াছেন যে, ইহা পূর্ব পাকিস্তানীদের অভাব অভিযোগ ও অসুবিধাগুলি যাহাতে পশ্চিম পাকিস্তানী জনসাধারণের সহজেই বোধগম্য হইতে পারে। তিনি যাহাই বলিয়া থাকুন না কেন, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি সেখানকার জনতার প্রতি ঘৃণার বিদ্বেষ সৃষ্টি করা তাঁহার কোন ইচ্ছা ছিল না। তাহা ছাড়া তিনি কর্মীদিগকে শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে নির্দেশ দিয়াছেন, কোন হিংসাত্মক কার্যকলাপ তিনি কাহাকেও উত্তেজিত করেন নাই।
আবেদনকারীর পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন এডভোকেট জনাব সিরাজুল হক।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯