দৈনিক পয়গাম
১৫ই মার্চ ১৯৬৯
শেখ মুজিবের ঢাকা প্রত্যাবর্তন : বিমানবন্দরে অভূতপূর্ব সম্বর্ধনা জ্ঞাপন
(ষ্টাফ রিপোর্টার)
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমানকে গতকল্য (শুক্রবার) সন্ধ্যায় ঢাকা বিমানবন্দরে এক অবিস্মরণীয় গণসম্বর্ধনা প্রদান করা হয়। আন্তরিকতার স্পর্শে সিক্ত বিশাল জনসমুদ্রের এমন প্রাণঢালা সম্বর্ধনার দৃশ্য ঢাকা বিমানবন্দরে খুব কমই পরিলক্ষিত হইয়াছে।
সামরিক শাসন আমলে কারাগার হইতে মুক্তি লাভ করিয়া ঢাকা আগমনের পর মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বিমানবন্দরে সকৃতজ্ঞ জাতি অনুরূপ সম্বর্ধনা দান করিয়াছিল।
শেখ মুজিব ‘ডাক’ নেতৃবৃন্দ কর্তৃক গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের দাবীর প্রতি সমর্থন দান না করায় ‘ডাক’-এর সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া গতকল্য রাওয়ালপিণ্ডি হইতে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন।
উদ্বেলিত জনসমুদ্রের চাপ চাপ ভীড়ের জন্য শেখ মুজিবকে বহনকারী পিআইএ বোয়িং বিমান বিমানবন্দরের টারমাকে আসিতে অসমর্থ হওয়ায় ইহা রানওয়ের সর্বশেষ প্রান্তে আসিয়া থামিতে বাধ্য হয়। টারমাক হইতে বিমান বন্দরের রানওয়ের যে স্থানে বিমানটিতে থামিতে হয় তাহার দুরত্ব প্রায় এক মাইল হইবে।
বিমান অনির্ধারিত এলাকায় থামিয়া যাওয়ায় মুহূর্তের মধ্যে জনতার দুর্বার স্রোত বিশাল রানওয়ের দুইকূল প্লাবিত করিয়া ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে সমগ্র এলাকা প্রকম্পিত করিয়া বিমানের দিকে ধাওয়া করে। এই অবস্থা লক্ষ্য করিয়া সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা এবং ‘ডাকসু’ সহ-সভাপতি জনাব তোফায়েল আহমদ একটি ট্রাকে করিয়া বিমানের সন্নিকটে গমন করিয়া বিমান হইতে শেখ মুজিবকে ট্রাকে উঠাইয়া লন। উদ্বেলিত জনসমুদ্র মৌমাছির মত উক্ত ট্রাককে ঘিরিয়া ফেলে এবং স্বায়ত্তশাসন ও জনসংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব দানের দাবীতে বিভিন্ন ধ্বনি উত্থাপন করে এবং শেখ মুজিবের প্রতি ফুলের পাঁপড়ি নিক্ষেপ করে। রানওয়ের শেষ প্রান্ত হইতে শেখ সাহেবকে বহনকারী ট্রাক বিমানবন্দরের টারমাকে জনতার অত্যধিক ভীড়ের জন্য শ্লথ গতিতে অগ্রসর হইলে বোয়িং বিমানটি ট্রাকের অনুসরণ করে। ট্রাকটি টারমাকের সন্নিকটে আগমনের পর পর চতুর্দিক হইতে জনতা ইহাকে ঘিরিয়া ফেলিলে বৃহদায়তন বোয়িং বিমানের পক্ষে টারমাকের চিহ্নিত স্থানে দাঁড়ান অসম্ভব হইয়া পড়ে। তখন শেখ সাহেব খোলা ট্রাকে করিয়া ধানমণ্ডীতে তাহার গৃহ অভিমুখে যাত্রা করেন। বিশাল জনতাও বিভিন্ন ধ্বনি প্রদান করিতে করিতে শোভাযাত্রা সহকারে ট্রাকের অনুগমন করে।
ঢাকায় বিমানটি আগমনের নির্ধারিত সময়ের বহু পূর্বেই বিমান বন্দর সংলগ্ন ভবনের অলিন্দগুলি হাজার হাজার মানুষে ভরিয়া যায়। বিমান অবতরণের অর্ধ ঘণ্টা পূর্বে বিমানবন্দরের সম্পূর্ণ টারমাক এবং রানওয়ের কিয়দংশও জনতায় ভরিয়া যায়।
বিমানবন্দরে সমবেত ছাত্রজনতা “জ্বালো জ্বালো, আগুন জালো” ‘জেগেছে জেগেছে, সোহরাওয়ার্দীর বাংলা জেগেছে, ক্ষুদিরামের বাংলা জেগেছে,” “স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে,” “জনসংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব দিতে হবে,” “আইয়ুব খান মুর্দাবাদ,” “বাঙ্গালী বিশ্বাসঘাতকরা ধ্বংস হোক” প্রভৃতি শ্লোগান দান করে।
একই বিমানে গোলটেবিল বৈঠকের অন্যতম প্রতিনিধি এবং পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালী গ্রুপ) সভাপতি অধ্যাপক মুজাফফর আহমদও ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একদল কর্মী “ন্যাপ-আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্ট গঠন কর”, “১১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গঠন কর”, “বিপ্লবী মোজাফফর জিন্দাবাদ”, “বঙ্গবন্ধু মুজিব জিন্দাবাদ” ধ্বনি তোলে।
শেখ মুজিবের সম্বর্ধনা উপলক্ষে ঢাকা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে অস্থায়ী দোকানপাট বসিয়া যায়। অসংখ্য রিক্সা, বেবী ট্যাক্সি ও ট্রাকও বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে গমন করে।
দূর-দূরান্তর হইতে হাজার হাজার ছাত্র, শ্রমিক ও জনতা ট্রাক ও বাসে করিয়া এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিছিল সহকারে বিমানবন্দরে আগমন করেন। একদল ক্রুদ্ধ জনতা লাহোর হইতে আগত বিমানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানকারী পূর্ব পাকিস্তানী নেতাদের খোঁজ করে। শেখ মুজিব এবং অধ্যাপক মোজাফফর ব্যতিত বৈঠকে যোগদানকারী অপর কোন পূর্ব পাকিস্তানী বিরোধী দলীয় নেতা উক্ত বিমানে ঢাকা প্রত্যাবৰ্ত্তন করেন নাই। জনতা বিমানের মধ্যে বিশেষভাবে মৌলবী ফরিদ আহমদ এবং অধ্যাপক গোলাম আজমকে খোঁজ করেন।
ন্যাপ কর্মীরা বিমানবন্দর হইতে অধ্যাপক মোজাফফরকে লইয়া অপর একটি পৃথক শোভাযাত্রা বাহির করে। শেখ মুজিব এবং অধ্যাপক মোজাফফর মিছিল করিয়া সড়ক প্রদক্ষিণ কালে রাস্তার দুই পার্শ্বে দণ্ডায়মান জনতা হাততালি দিয়া তাহাদের প্রতি সম্বর্ধনা জানায়।
শেখ সাহেবের সহিত একই বিমানে আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব কামরুজ্জামান এম, এন, এ, খোন্দকার মোস্তাক আহমদ, জনাব তাজুদ্দিন আহমদ, মোল্লা জামালুদ্দিন আহমদ, জনাব ইউসুফ আলী এম, এন, এ এবং জনাব নুরুল ইসলাম এম, এন, এ ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯