You dont have javascript enabled! Please enable it! 1968.10.19 | আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনের প্রাক্কালে | সংবাদ - সংগ্রামের নোটবুক

সংবাদ
১৯শে অক্টোবর ১৯৬৮
আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনের প্রাক্কালে-

আজ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দুইদিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হইতেছে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই অধিবেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাংগঠনিক দিক হইতেও এবারের কাউন্সিল অন্যান্য বারের অধিবেশন হইতে স্বতন্ত্র। দলের দুইজন প্রধান কর্মকর্তাসহ বেশ কিছুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় সদস্যকে কারাগারে রাখিয়া এবারের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইতে যাইতেছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ‘সশস্ত্র বিদ্রোহ’ দ্বারা পাকিস্তানের একাংশকে বিচ্ছিন্ন করার’ দায়ে অভিযুক্ত- সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ প্রায় আড়াই বৎসর যাবৎ দেশরক্ষা আইনে বিনাবিচারে বন্দী। আওয়ামী লীগের বিগত নিয়মিত কাউন্সিল অধিবেশনের পরবর্তী তিনটি বৎসরের ইতিহাস মোটেই সহজ সরল বা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ একদিকে স্বায়ত্তশাসন ও পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের দাবীতে আন্দোলন করিয়া বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছে, অপরদিকে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বিভেদ ও ভাঙ্গনের সম্মুখীন হইয়াছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একটি অংশ পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে (পি ডি এম) যোগদান করিয়াছেন।
আসন্ন নির্বাচনে বিরোধী দলসমূহের ভূমিকা এবং বিরোধীদলীয় ঐক্যজোট গঠনের প্রশ্ন দুইটি অন্যান্য দলের ন্যায় আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গ ও কাউন্সিলারগণের মন ও মস্তিষ্ককেও আলোড়িত করিতেছে নিশ্চয়। আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যথাযথরূপে বিশ্লেষণ করিয়া এই সকল জরুরী প্রশ্নে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবেন বলিয়া আমরা আশা করি। বর্তমান সরকারের কুশাসনে দেশে যে অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে উহার নিগড় হইতে দেশবাসীকে মুক্ত করার জন্য বৰ্ত্তমান অগণতান্ত্রিক সরকারের পরিবর্তে একটি জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা মৌলিক ও জরুরী কর্তব্য। এই কর্তব্য সুসম্পন্ন করিতে হইলে সকল দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গঠন করা দরকার। কারণ, অভিজ্ঞতা হইতে দেখা গিয়াছে যে, কোন দলের পক্ষের এককভাবে যে এই দায়িত্ব সম্পাদন করা সম্ভব নয়। ইহা ছাড়াও জনগণের আশু ও জরুরী দাবী-দাওয়া যেমন পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র, প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল, সকল রাজবন্দীর মুক্তি, রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারণে সাজাপ্রাপ্তদের দণ্ড মওকুব, বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ সকল মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি প্রবর্তন, বর্ধিত খাজনা-ট্যাক্স বাতিল, একচেটিয়া পুঁজি খর্ব করার জন্য ব্যাঙ্ক-ইনস্যুরেন্স কোম্পানী জাতীয়করণ, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকর বৈষম্য নিরসন, স্থায়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পূর্ণাঙ্গ মহাপরিকল্পনা গ্রহণ, কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক দাবী-দাওয়া প্রভৃতি আদায় করিতে হইলেও সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হইতে হইবে। বিরোধীদলীয় ঐক্যজোটের কর্মসূচী কি হইবে অর্থাৎ জনসাধারণের দাবী-দাওয়ায় কোন্ কোটি বিরোধীদলীয় ঐক্যজোটের আশু কর্মসূচীর অন্তর্ভূক্ত হইবে, তাহা বিরোধীদলসমূহের আলাপ-আলোচনার দ্বারা স্থির করিতে হইবে। অবশ্য ঐক্য বলিতে আমরা নেতৃবৃন্দের বৈঠকখানার ঐক্য বুঝাইতেছি না, আন্দোলনের ঐক্য, সংগ্রামের ঐক্যকেই বুঝাইতেছি।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা নির্বাচন বর্জনের প্রশ্নটিও বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার সঠিক বিশ্লেষণের আলোকে সমাধানের অপেক্ষা রাখে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ভূমিকা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ তথা কাউন্সিলরগণই নির্ধারণ করিবেন। কিন্তু এখানে একটি বিষয় স্মরণ রাখা দরকার যে, বর্তমান পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতির ফলে বিরোধীদলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা প্রায় সমার্থক। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল হইতেও এই শিক্ষাই পাওয়া যায়। তদুপরি বর্তমানে জরুরী অবস্থা ও দেশরক্ষা আইন বহাল থাকায় এবং বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী কারারুদ্ধ থাকায় অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হইতে পারে না। সে যাহাই হউক, নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে দেশের বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করিয়া সকল দলের মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন বলিয়া আমরা মনে করি। নির্বাচন সম্পর্কে বিরোধীদলসমূহের যে সিদ্ধান্তই হউক না কেন, বিরোধীদলসমূহকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ কিম্বা নির্বাচন বর্জনকে কেন্দ্র করিয়া ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন সৃষ্টির দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্মসূচী লইয়া অগ্রসর হইতে হইবে।
দেশের দারুণ দুর্দিনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইতে যাইতেছে। আওয়ামী লীগ কাউন্সিল একটি সঠিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করিবেন এবং ঐক্যবদ্ধ ও জঙ্গী গণআন্দোলনের পতাকা উর্ধ্বে তুলিয়া ধরিবেন, দেশবাসী এই প্রত্যাশাই করে।
ড্রোলজি ডাইরেক্টবেটের অধীনে প্রায় ২ শত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর উপর ছাঁটাইয়ের খড়গ ঝুলিতেছে বলিয়া এক খবরে প্রকাশ। যে সকল কর্মচারীকে ছাঁটাইয়ের ধূম্রকাষ্ঠে বলিদানের ব্যবস্থা হইয়াছে তাহাদের নামের একটি তালিকাও নাকি প্রস্তুত করা হইয়াছে। কর্মচারীদের পক্ষ হইতে ছাঁটাই বন্ধ রাখা অথবা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানাইয়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষীয়গণের নিকট একটি আবেদনপত্রও ইতিমধ্যেই পেশ করা হইয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে।
উক্ত কর্মচারীদের ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্তের কারণ কি তাহা আমাদের জানা নাই। আমাদের কথা হইল ছাঁটাইয়ের কারণ যাহাই হউক, কর্মসংস্থানের বিকল্প ব্যবস্থা না করিয়া ইহাদিগকে ছাঁটাই করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক হইবে। কেননা, এই সকল স্বল্প আয়ের কর্মচারীর প্রত্যেকেরই সঞ্চয়ের ঘর শূন্য।
তদুপরি, দেশের অবস্থা এমন নয় যে, একস্থান হইতে কর্মচ্যুত হইবার সঙ্গে সঙ্গে অন্যত্র কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হইবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহের মূল্য আকাশচুম্বী। চাকুরী করিয়া যে বেতন পাওয়া যায়, তাহাতেই সংসার চলে না। সুতরাং অকস্মাৎ এই দুইশত কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হইলে পরিবারপরিজন লইয়া তাঁহাদের দাঁড়াইবার উপায় থাকিবে না।
আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করিয়া হয় ছাঁটাই বন্ধ করিবেন, নতুবা বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করিবেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ খণ্ড: ষাটের দশক ॥ তৃতীয় পৰ্ব ॥ ১৯৬৮