সংবাদ
২৬শে মার্চ ১৯৬৮
ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সভায় গৃহীত প্রস্তাবাবলী
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সভায় নিম্নোক্ত প্রস্তাবাবলী গ্রহণ করা হয়ঃ
শোক প্রস্তাব
স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সেনানী শ্রী অমর সেনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করিয়া গৃহীত তার প্রথম প্রস্তাবে বলা হয় যে, শ্রী অমর সেন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে এক বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন। স্বাধীনতার পর হইতে এই দেশের সাধারণ মানুষকে শোষণের হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য তিনি সংগ্রামের পথে অগ্রসর হইয়াছিলেন এবং মৃত্যুর পূর্ব মূহূর্ত্ত পর্যন্ত নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দিয়া এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন।
অদ্যকার এই সভা শ্রী অমর সেনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রস্তাব করিতেছে এবং তাহার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছে।
এই সভা গভীর ক্ষোভের সহিত লক্ষ্য করিতেছে যে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশিষ্ট সৈনিক শ্রী অমর সেনের উপর স্বাধীনতার পরও সরকার গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী করিয়া রাখিয়াছিলেন এবং মৃত্যুর পূর্ব মুহূৰ্ত্ত পর্যন্ত এই গ্রেফতারী পরওয়ানা প্রত্যাহার করা হয় নাই। এই সভা অবিলম্বে সকল রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দের উপর হইতে গ্রেফতারী পরওয়ানা প্রত্যাহারের জোর দাবী জানাইতেছে এবং ছাত্রসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবী করিতেছে।
সভায় গৃহীত অপর এক শোক প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ঠাকুরগাঁও মহকুমা শাখার বিশিষ্ট কর্মী খলিলুর রহমান এবং ইকবাল হল শাখার বিশিষ্ট কর্মী আবদুল খালেকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করা হয় এবং তাহাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়।
শিক্ষানীতি
এই সভা গভীর উদ্বেগের সহিত লক্ষ্য করিতেছে যে, সরকার বর্তমানে সুকৌশলে ছাত্রসমাজের শিক্ষাজীবনকে পঙ্গু করিবার জন্য বিভিন্ন পন্থা গ্রহণ করিতেছেন। উচ্চশিক্ষার দ্বার রুদ্ধ করিবার জন্য সম্প্রতি তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ ছাত্রদের কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বন্ধ করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। অন্যদিকে কারিগরী শিক্ষা প্রসারের কোন সুষ্ঠু বন্দোবস্ত গ্রহণ করা হইতেছে না। পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করিবার জন্য এবং সাম্প্রদায়িকতার ধারায় ছাত্রসমাজের জীবনকে কলুষিত করিবার জন্য পাঠ্যপুস্তকসমূহে বিকৃত ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা হইতেছে। রবীন্দ্র সাহিত্যসহ আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য সাহিত্য ক্রমেই বন্ধ করিয়া দেওয়া হইতেছে। ১৯৬২ সালে আন্দোলনের চাপে সাময়িকভাবে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট স্থগিত রাখিলেও সরকার বর্তমানে পুনরায় ধীরে ধীরে এ রিপোর্ট এবং পরবর্তীকালে রচিত কুখ্যাত হামদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট কার্যকরী করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করিতেছেন। এই সভা সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতির তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করিতেছে এবং অবিলম্বে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট বাতিল করিয়া ছাত্রসমাজের ২২-দফা শিক্ষাগত দাবী মানিয়া লইবার জোর দাবী জানাইতেছে।
তৃতীয় বিভাগ
সম্প্রতি সরকার তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ ছাত্রদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বন্ধ করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। কারিগরি শিক্ষার সঠিক ব্যবস্থা না করিয়া এই সিদ্ধান্ত সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। এই সভা অনতিবিলম্বে সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাতিল ঘোষণার দাবী জানাইতেছে। গুণ্ডামির নিন্দা
এই সভা গভীর ক্ষোভের সহিত লক্ষ্য করিতেছে যে, সরকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ছাত্রসমাজের ন্যায্য আন্দোলনসমূহকে বানচাল করিবার জন্য এবং ছাত্রস্বার্থ বিরোধী ও গণবিরোধী নীতিসমূহ কার্যকরী করিবার জন্য ফ্যাসিষ্ট পদ্ধতি গ্রহণ করিয়াছে। বিশেষ কিছু ছাত্রনামধারী গুণ্ডা বাহিনীর সহায়তায় ও বাহির হইতে গুণ্ডা ভাড়া করিয়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করিতেছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে, জগন্নাথ কলেজ, পীরগঞ্জে, দেবীগঞ্জ ও জামালপুরে অনুষ্ঠিত ঘটনা ইহারই সাক্ষ্য বহন করে। এই সভা সরকার ও কর্তৃপক্ষের ফ্যাসিষ্ট নীতির বিরুদ্ধে এবং সর্বপ্রকার গুণ্ডামির বিরুদ্ধে আগাইয়া আসিবার জন্য ছাত্রসমাজ, অভিভাবকবৃন্দ এবং সমগ্র জনসাধারণের নিকট আহ্বান জানাইতেছে।
জগন্নাথ কলেজ সংক্রান্ত
এই সভা গভীর ক্ষোভের সহিত লক্ষ্য করিতেছে যে, কর্তৃপক্ষ প্রদেশের বৃহত্তর কলেজ জগন্নাথ কলেজকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করিয়াছেন। গত ২৮শে ফেব্রুয়ারী কিছু সংখ্যক ছাত্রনামধারী গুপ্তার সহায়তায় বহিরাগত বিপুল সংখ্যক গুণ্ডাবাহিনী সাধারণ ছাত্রদের উপর হামলা চালায় এবং আসবাবপত্র ভাঙ্গিয়া ফেলে। সাধারণ ছাত্ররা এই হামলা প্রতিহত করে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ ঘোষণা করিয়াছেন এবং প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান না করিয়া নিরীহ ছাত্রদের গ্রেফতার করিতেছেন এবং অনেককে বাধ্যতামূলক টিসি প্রদান করারও খবর শোনা যাইতেছে। এই সভা অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তি, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান, বাধ্যতামূলক টিসি দেওয়া বন্ধ এবং অবিলম্বে কলেজ খুলিয়া শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরাইয়া আনার দাবী জানাইতেছে।
জয়পুরহাটের ঘটনা
এই সভা জয়পুরহাটের সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া পুলিসের গুলীবর্ষণের তীব্র নিন্দা প্রকাশ করিতেছে এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করিতেছে। এই সভা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পবিত্র শহীদ মিনার নির্মাণে বাধা প্রদান ও নির্মিত শহীদ মিনার ভাঙ্গার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করিতেছে।
রাজবন্দীদের মুক্তি দাবী
এই সভা অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সহ- সভাপতি আলী হায়দর খান, প্রাক্তন সভানেত্রী ও বর্তমান কেন্দ্রীয় সংসদ সদস্যা মিসেস মতিয়া চৌধুরী, প্রাক্তন সহ-সভাপতি শ্রী পংকজ কুমার ভট্টাচার্য্য, ডাকসুর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শফী আহমদ, কেন্দ্রীয় সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র বটব্যাল, ছাত্র ইউনিয়নের বিশিষ্ট নেতা যশোরের এনামুল হক, ময়মনসিংহের আবদুল কুদ্দুস, বন্ধু প্রতিষ্ঠানের জনাব আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, রাশেদ খান মেননসহ সকল ছাত্র, সম্মানিত ভাইস প্রিন্সিপাল আবদুল হাই, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত এবং জননেতা শ্রী মনি সিংহ, তাজউদ্দিনসহ সকল রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর অবিলম্বে মুক্তি দাবী করিতেছে এবং মুক্তি সাপেক্ষে রাজবন্দীদের দৈনিক ভাতা বৃদ্ধি ও পরিবার-পরিজনকে মাসিক ভাতা প্রদানের দাবী জানাইতেছে।
শেখ মুজিব
এই সভায় অবিলম্বে শেখ মুজিবকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়া প্ৰচলিত আইন অনুযায়ী সাধারণ আদালতে বিচারের ব্যবস্থার জোর দাবী জানাইতেছে। এই সভা সাথে সাথে তাঁহার বর্তমান অবস্থান ও শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে প্রেসনোট প্রকাশ ও তাঁহার আত্মীয়-পরিজনদের সহিত নিয়মিত সাক্ষাৎকারেরও ব্যবস্থা করার দাবী জানাইতেছেন।
মামলা প্রত্যাহারের দাবী
সম্প্রতি পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ছাত্রদের উপর হইতে জারীকৃত মামলাসমূহ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তান সরকার সারা প্রদেশব্যাপী ছাত্রসমাজকে মিথ্যা মামলায় জড়িত করিয়া অযথা হয়রানি করিতেছে। এই সভা অবিলম্বে সকল প্রকার মামলা প্রত্যাহারের দাবী জানাইতেছে।
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন
এই সভা গভীর ক্ষোভের সহিত লক্ষ্য করিতেছে যে, দেশের জনগণ যখন স্বৈরাচারী সরকারের ষ্টিম রোলারে নিষ্পেষিত ও নানাপ্রকার সমস্যা জর্জরিত এবং সরকারের দমননীতি যখন দিনে দিনে চরমাকার ধারণ করিতেছে তখন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অনৈক্যের ফলে কোন ব্যাপক আন্দোলন দানা বাধিয়া উঠিতেছে না। এই সভা নিম্নতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হইয়া সংগ্রামী আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার জন্য দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক ও বিশেষ করিয়া রাজনৈতিক সংগঠনগুলিকে আহ্বান জানাইতেছে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ খণ্ড: ষাটের দশক ॥ তৃতীয় পৰ্ব ॥ ১৯৬৮