You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.24 | গঙ্গাতীরে ট্রাজেডি - আই শ্চেন্দ্রোভ - সংগ্রামের নোটবুক

গঙ্গাতীরে ট্রাজেডি
আই শ্চেন্দ্রোভ

সম্প্রতি আমি পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের জন্য কলকাতার কাছে স্থাপিত একটি শিবির পরিদর্শন করেছি। এরূপ ৮৮৮টি শিবিরের মধ্যে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে প্রায় ৫৬০টি। মার্চ মাসের পর থেকে এই রাজ্যে ৭০ লক্ষের বেশি শরণার্থী চলে এসেছেন। আমি যে শিবিরটি পরিদর্শন করেছিলাম ওর কাছেই দমদম বিমানবন্দর। মাঝে মাঝে বিমান ছাড়ছে আর এই বিশাল শিবিরের হাজার হাজার ঝুপড়ির হালকা দেয়াল কেঁপে উঠছে ও ছাদ মড়মড় করছে। সীমাহীন কাঁটাতারের সারি এই শিবিরের বিভিন্ন অংশের সাময়িক ‘প্রাচীর’ ও সীমানা। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে নারকেলপাতা ও হোগলা ছাওয়া ব্যারাকে, সাধারণ তাঁবুতে, নিচু কুটিরে (ভেতরে সোজা হয়ে দাঁড়ানো অসম্ভব) এবং এমনকি চারটি খুঁটির ওপর অয়েলক্লথ চাপিয়ে তাতেও অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন। আর সর্বত্রই স্রোতের মতো মানুষের আনাগোনা।
একটি ব্যারাকের সামনে শরণার্থীদের সঙ্গে আমি কথাবার্তা শুরু করলাম। ওখানে শীর্ণকায় ও দুর্বল শিশুদের অতিরিক্ত খিচুড়ি দেওয়া হচ্ছিল। শরণার্থীরা কিরূপ কঠিন অবস্থায় ভারতে এসে পৌঁছেছেন তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। দু’ সপ্তাহ তিন সপ্তাহও লেগেছে অনেকের ভারতে এসে পৌছাতে। খুলনার একজন প্রাক্তন কলেজের ছাত্র আমায় বললেন, ওঁরা সাত হাজার মানুষ একত্রে ভারতের সীমান্ত অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। পৌঁছুতে লেগেছিল চারদিন চাররাত। কুড়িজনেরও বেশি সঙ্গী পথেই মারা যান। অপর কিছু ব্যক্তিকে শিবির হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তাঁদের ওপর শারীরিক, মানসিক চাপ পড়েছিল প্রচণ্ড।
বহু শরণার্থীকে প্রশ্ন করেছি: ‘আপনারা কি জন্মভূমিতে ফিরে যেতে চান?’ জবাব পেয়েছি মোটামুটি একই রকম— ‘হ্যাঁ, যদি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারি যে আবার আমরা দমন-পীড়নের শিকার হব না, আমাদের জীবন ও স্বাধীনতা বিপন্ন হবে না।’
শিবির হাসপাতালের ব্যারাকগুলোর দৃশ্য ভয়াবহ। ধোঁয়া ও আবর্জনার দুর্গন্ধের সঙ্গে মিশেছে কার্বলিক এসিডের কড়া গন্ধ। অস্থিচর্মসার শিশুরা ও মায়েরা শুয়ে রয়েছে বাঁশের শয্যার ওপর। হাসপাতালটি ঘুরে ঘুরে দেখার সময় সেবিকা বললেন, ‘এই ব্যারাকে সংক্রামক পেটের রোগের, প্রধানত আমাশয়ের রোগীরা রয়েছে। এই রোগটিই আজকে পয়লা নম্বরের শত্রু। এখন পর্যন্ত এই মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা পারিনি।’
পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য শরণার্থী শিবিরে একই পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছি। বস্তুত এ এক নৈরাশ্যব্যঞ্জক দৃশ্য। গৃহহীন এই নিযুত নিযুত মানুষ ভারতের উদার সাহায্য না পেলে অনাহার ও মহামারীর শিকারের সংখ্যা আরও বেশি হত।
এই নিঃস্বার্থ প্রয়াসের ফল ফলেছে। মাত্র সাতমাস সময়ের মধ্যে সংগঠিত চিকিৎসাব্যবস্থা এবং নিযুত নিযুত দুর্গত মানুষকে বিনা পয়সায় খাদ্য, পোশাক থেকে ঔষধপত্র পর্যন্ত জীবনধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ সত্যিই এক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব।
কলেরা মহামারী বিপজ্জনক দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করা মোটেই সহজ ছিল না।
কলকাতায় ফিরে শুনেছিলাম যে, জুন মাসের গোড়ায় শরণার্থীদের জন্য স্থাপিত মেডিকেল ব্যারাকগুলোতে ছিল প্রায় ৫০ হাজার কলেরা রোগী। যদিও প্রায় ৬ হাজার নর- নারী মারা গিয়েছে তবুও কলেরার বিরুদ্ধে লড়াই মধ্য- গ্রীষ্মেই জয়যুক্ত হয়েছিল।
গণ দুর্ভিক্ষ এড়াবার ন্যায় একটি জটিল সমস্যার সমাধান হয়েছে খুব অল্প সময়ের মধ্যে। আমি একাধিক শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছি এবং সর্বত্রই দেখেছি তাঁরা প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র ও ঔষধ পাচ্ছেন। বৃহত্তম শিবির লবণ হ্রদ শিবিরের ভারপ্রাপ্ত অফিসার আমায় জানিয়েছেন, প্রতি শরণার্থীকে দিনে ৪০০ গ্রাম চাল ও অন্যান্য খাবার দেওয়া হচ্ছে।
যে কারণে পাঠকদের এসব কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, তা হলো, কিছু কিছু পশ্চিমী সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের শোকাবহ দুর্দশাকে বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। কোনোরূপ নীতির বালাইহীন এদের চেষ্টা হলো অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়া, যে ভারত নিযুত নিযুত পূর্ব পাকিস্তানিকে তাদের দুর্গতির দিনে সাহায্যের উদার হস্ত বাড়িয়ে দিয়েছে, সেই ভারতকে শরণার্থীদের সকল দুঃখ- কষ্টের দায়ে অভিযুক্ত করা।
সোভিয়েত ইউনিয়নের নীতিনিষ্ঠ এবং সুসঙ্গত নীতি সম্পর্কে ভারতের জনগণ ভালোভাবেই অবহিত। সোভিয়েত ইউনিয়ন যে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক দখলদার রাজের নিন্দা করেছে এবং নিজ নিজ গৃহে ফিরে যাবার সকল সুবিধা শরণার্থীদের দিতে হবে বলে যে দাবি করেছে, তাঁরা তাকে স্বাগত জানান।
লবণ হৃদ ও বনগাঁ শিবিরগুলোতে এবং কলকাতায় রিলিফের ভারপ্রাপ্ত সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তার সময় তাঁরা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে চাল ও ঔষধপত্র প্রেরণের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
রিলিফের কাজে যাঁরা লিপ্ত রয়েছেন, তাঁরা ৯০ লক্ষ শরণার্থীকে দেখাশোনার ব্যাপারে অবিশ্বাস্য অসুবিধা সম্পর্কে অবহিত আছেন। এঁদের একজন হলেন কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম, কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসন দপ্তরের সহকারী সচিব বি কে সিং। তিনি বললেন যে, শরণার্থী আগমন বন্ধ না হলে আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে শরণার্থীদের সংখ্যা ১.২-১.৩ কোটিতে দাঁড়াতে পারে। তিনি জানালেন, অধিকন্তু আমরা জানি না কতদিন আমাদের এই শরণার্থী সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। সাত মাসে একটা গোটা দেশের যে বিরাট জনসমষ্টি চলে এসেছে, তাদের পুরো দায়িত্ব নেওয়ার মতো অবস্থা ভারতের নেই।
…পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকা থেকে সবে আমি কলকাতায় ফিরে এসেছি। যেসব পূর্ব পাকিস্তানি এখনো শিবিরে আশ্রয় পায়নি, তাঁদের সারি সারি ঝুপড়ি ছড়িয়ে রয়েছে ৯০ কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে। এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে কলকাতা থেকে বনগাঁ যাবার রাস্তা। এখানে রয়েছে হাজার হাজার ঝুপড়ি, সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারে না। এইসব শোচনীয় আশ্রয়ের কাছেই ছেলেমেয়েরা খেলা করছে, গরুও চরছে। বনগাঁ শহরটি লোকে উপচে পড়ছে। মার্চের আগে পর্যন্ত এখানকার জনসংখ্যা ছিল ১ লাখেরও কম, এখন তা চারগুণ। চালের জন্য শরণার্থীদের দীর্ঘ কিউ, কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে আকাশপানে, সর্বত্রই নোংরা, এখনো পর্যন্ত উঠোন থেকে বন্যার জল সরে যায়নি।
ফেরার পথে আবার চোখে পড়ল পথের দুপাশে সেই শোচনীয় চেহারার ঝুপড়ির সারি, রাস্তায় সীমাহীন লোক চলাচল।
প্রাভদা, ২৪ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা