ঢাকা মুক্তির প্রথম দিন
ভি স্কোসিরেভ ও বি কালিয়াগিন
ভূমি স্পর্শ করার আগে হেলিকপ্টারটি ঢাকার ওপরে একবার বড় একটা চক্কর দিল। নিচে দেখা গেল অপসৃয়মান নিচু নিচু পাথরের বাড়ির ছাদ, সরল রেখার মতো সোজা সোজা রাস্তা আর শ্যামল বৃক্ষরাজি। আমরা জানালা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম, বুঝতে চেষ্টা করলাম—কয়েক ঘণ্টা আগে পাকিস্তানি কমান্ডের পক্ষ থেকে জেনারেল নিয়াজি যেখানে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন, বাংলাদেশের রাজধানী সেই ঢাকায় তখন কী হচ্ছে।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারটি বড় বড় গর্তে ভরা ক্ষতচিহ্ন লাঞ্ছিত বিমানক্ষেত্রে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকার এখনকার জীবন সম্পর্কে একটা ধারণা পেলাম। আনন্দে উদ্বেল এক বিরাট জনতা ছুটে এলো হেলিকপ্টারের দিকে। তাদের মুখে ধ্বনি: ‘জয় বাংলা!’ ‘জয় হিন্দ!’ পাইলটদের তাঁরা জড়িয়ে ধরলেন, তাঁদের করমর্দন করলেন। তারপর সামনে মাইক লাগানো সেনাবাহিনীর ছোট একটি ট্রাক হেলিকপ্টারের দিকে এগিয়ে এলো। তাতে দাঁড়িয়ে ছিল খাকি আর সাদা শার্ট পরা কিছু যুবক।
বিমানক্ষেত্রের চারদিকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করে শোনা গেল একটি কণ্ঠস্বর: ‘ভারতীয়রা আমাদের বন্ধু, আমাদের মুক্তভূমিতে তাঁদের স্বাগত জানাতে পেরে আমরা আনন্দিত। কিন্তু বিমানক্ষেত্রের কর্মীদের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা আমাদের উচিত নয়। তাই আসুন, অন্য কোথাও গিয়ে আমরা সভা করি।’
এ আবেদনে কাজ হলো। সবাই সরে যেতে লাগলেন। ঢাকা সফরে আমাদের সাংবাদিক দলটির সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যে অফিসারটি ছিলেন, তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিলেন যে, ট্রাকের ওপরকার ছেলে কটি হলো ‘মুক্তিবাহিনীর’ সদস্য। নতুন প্রশাসন এখনও কার্যভার গ্রহণ করেনি বলে তারাই শহরে নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করছেন।
ঢাকার পথ দিয়ে যাওয়াটাও খুব সহজ ব্যাপার নয়। বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের কথা শোনার আশায় হাজার হাজার মানুষ শহরের পথে নেমে পড়েছেন। মাঝে মাঝে চোখে পড়ছিল ট্রাক-ভর্তি তরুণ ও কিশোরের দল, তাদের অনেকের হাতেই রাইফেল অথবা মেশিনগান।
আমাদের দেশে, সংগ্রাম ও বিজয়ের প্রতীক—মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে তারা আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম আলম আমাদের ঢাকা ঘুরিয়ে দেখাতে এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, “খাস শহরে ধ্বংসের চিহ্ন খুব একটা বেশি নেই। ভারতীয় বিমানগুলো শহরের উপকণ্ঠের সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপরেই আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা যে অত্যাচার চালিয়েছিল, তার চিহ্ন রয়ে গেছে। সেদিন ট্যাংক দিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরে আক্রমণ করেছিল। আত্মসমর্পণ করার ঠিক আগেও পাকিস্তানি কমান্ড অসামরিক নাগরিকদের ওপর আরেকবার আক্রমণ চালিয়েছিল।’
‘৯ ডিসেম্বর ভোরবেলা একটি বিমানের চাপা গর্জন আমরা শুনতে পেলাম। বিমানটা ছিল সেকেলে ধরনের অদ্ভুত একটা পিস্টন-ইঞ্জিন চালিত বিমান। তার গায়ে পরিচয়সূচক কোনো চিহ্ন ছিল না। বিমানটি আসার সময়ে বিমান আক্রমণের সংকেতধ্বনি বেজে উঠেছিল। বিমানটি শহরের ওপর চক্কর খেতে লাগল, কেউই তার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিল না৷
হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণের একটা আওয়াজ শোনা গেল, তারপর আরেকটা। বসতিপূর্ণ অঞ্চলে দুটি বোমা ফেলা হলো। পরদিন সামরিক কর্তৃপক্ষ বললেন যে, ভারতীয় বিমান অসামরিক নর-নারীর ওপর বোমাবর্ষণ করেছে। কিন্তু ঢাকার কেউই সেকথা বিশ্বাস করেনি। সবাই ভালো করেই জানে যে, ভারত এ ধরনের বিমান ব্যবহারই করে না। ব্যাপারটা করা হয়েছিল ভারতের ওপর দোষারোপ করার উদ্দেশ্যে।’
ক্যান্টনমেন্টের কাছে সেনাবাহিনীর একটি চৌকিতে এসে আমাদের গাড়ি থামল। পাশ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে যাচ্ছিল একদল পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী, তাদের পিঠে ‘ন্যাপস্যাক’ মাথায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বোঝা। তাদের খুব একটা মলিন দেখাচ্ছিল না। বরং যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে এবং তারা পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে বলে অনেককেই খুশি মনে হলো। আত্মসমর্পণ করা শত্রুসৈন্যদের অস্ত্রত্যাগ করানোর কাজ তখনো শেষ হয়নি। এক জায়গায় আমরা বেশকিছু পাকিস্তানি সৈনিক দেখলাম, তাদের হাতে রাইফেল।
‘ঢাকায় সব মিলিয়ে কত পাকিস্তানি সৈন্য আছে?’ আমাদের এই প্রশ্নের উত্তরে ৩১১তম ভারতীয় পার্বত্য পদাতিক ডিভিশনের স্টাফ অফিসার ক্যাপ্টেন চক্রবর্তী জানালেন যে, ‘যুদ্ধবন্দী গণনার কাজ এখনও চলছে। মনে হয় সংখ্যাটা হবে ১৫,০০০-এর মতো।’
ক্যাপ্টেন চক্রবর্তীর ডিভিশনই সর্বপ্রথম ঢাকায় প্রবেশ করেছিল। ক্যাপ্টেন চক্রবর্তী বললেন, ‘আত্মসমর্পণের শর্ত আমরা কঠোরভাবে মেনে চলছি এবং সমস্ত যুদ্ধবন্দীর প্রতি ভদ্র ব্যবহার করছি।’
ঢাকা শহরের ছায়া-সুনিবিড় উপকণ্ঠে সোভিয়েত কনসুলেট ভবনে গেলাম। এই গোটা সময়টাতেই কনসুলেট স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করেছে। একটা সুখবর যে, অবরোধের সময়ে সোভিয়েত কর্মীদের মধ্যে কেউ হতাহত হননি, সকলেই নিরাপদ ও সুস্থ আছেন।
ঢাকা তার মুক্তির দিন উদযাপন করছে। সমস্ত ঘরবাড়ি বাংলাদেশের তিন-রঙা পতাকায় সাজানো। বেড়া আর দেওয়ালের গায় বাংলাদেশ মুক্তি আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি লাগানো। এই আন্দোৎসবে রহমান নিজে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না—২৫ মার্চ গ্রেপ্তার হবার পর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো এক স্থানে জেলখানায় দিন কাটাচ্ছেন।
মুজিবুর রহমানের ১৬ বছর বয়সের ছেলে জামাল বলল: ‘আমার বাবার ভাগ্যে কী ঘটেছে, তার কিছুই আমি জানি না। আমার মা আর বোন গৃহবন্দী দশা থেকে সবে মুক্তি পেয়েছেন। গত আগস্ট মাসের পর থেকে তাঁদের আমি দেখিনি। আগস্ট মাসে কোনোক্রমে জেল থেকে পালিয়ে আমি ভারতে চলে যাই। আমি আশা করি, আমার দেশের জনগণ আমার বাবার মুক্তি আদায় করবেন।’
ইজভেস্তিয়া, ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা