তাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল দেখার যে, আন্তর্জাতিকভাবে দত্তক নেয়া ছেলেমেয়েরা। তাদের ঔরসজাত সন্তানদের তুলনায় নতুনতর ইস্যুর দ্বারা চ্যালেঞ্জ-এর সম্মুখীন হয় কিনা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এমন একটা পরিচিতি তৈরি করা যার দ্বারা নৃতাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ফুটে বের হয়, জাতিগত বিদ্বেষ ও বিচারবােধে উজ্জীবিত হয়ে বিদ্বিষ্ট আচরণ করা ইত্যাদি। কোনাে কোনাে মা-বাবা এমন মত পােষণ করেন যে, বহুসংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে কানাডাতে বেড়ে ওঠা তাদের আন্তবর্ণীয় ছেলেমেয়েরা যেন সব ধনের “কানাডীয় কার্যক্রমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। তাহলে তারা সংখ্যালঘুদের নিয়ে বাঁধা ধরা রসিকতা, বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য, কুসংস্কার ও বিদ্বেস এর সম্মুখীন হলেও সে সব চ্যলেঞ্জ মােকাবিলায় দক্ষ হবে। অন্য কথায়, মৌলিক খাপ খাইয়ে নেবার সক্ষমতা অর্জনের দ্বারা তাদের সন্তানেরা প্রতিরােধে সক্ষম হবে, সম্পদশালী হবে, আত্মবিশ্বাসের অধিকারী হবে এবং সর্বোপরি কানাডীয় জীবনে। একটা রেফারেন্স পয়েন্ট থাকবে। স্মৃতিচারণের সময় আবার কোনাে কোনাে মা-বাবা অচেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হবার গল্প বলেন, যারা সে সময়ে ওদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকেছেন, বিশেষ করে যখন শ্বেতাঙ্গ দম্পতিদের সঙ্গে দেখতেন অশ্বেতাঙ্গ ছেলেমেয়ে রয়েছে। পরিবারের জাতিগত বৈচিত্র প্রায়ই একটা আমােদের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত । কারণ অনেক লােক ছেলে অথবা মেয়েকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করতেনঃ “একে আবার কোথায় পেলেন?” অথবা “ওকে কবে আনলেন?” ওরকম প্রশ্নের জবাবে বাবা-মা অনেক সময় রসিকতা করে বলতেনঃ “মেইল অর্ডার ক্যাটালগে।”২৪ তারপরই হাঃ হাঃ হিঃ হিঃ মজার হলেও ওরকম কথাবার্তা হলে তারা দ্বিগুণ সতর্ক হয়ে থাকতেন। যার ফলে, যেমনটা বছরের পর বছর পার হয়েছে, তারাও তেমনি ধৈর্যশীল হয়েছেন বেশি বেশি, আর কম কম প্রতিক্রিয়াশীল । পেছনে তাকিয়ে স্মরণ করার চেষ্টা করেন কতবার তারা এরকম প্রশ্নের জবাবে কী বলেছেনঃ “বলুন তাে কেমন করে আপনাদের এমন জাতিগত বৈচিত্রে ভরপুর পরিবার হলাে?” অবশ্য এ কথাও ঠিক যে তাদের কাছে চটপটে জবাব যেমন ছিল, যারা সাদাসিধে মজা পেতে চায় তাদের, আবার চিন্তাভাবনা করে। দেবার মতাে জবাবও অনেকেই আশা করতেন, সেও হিসাব করে বলতে হতাে বৈকি! মনখােলা আলাপে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, কোনাে কোনাে বাবা-মা আবার শিশুর। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি তাদের ভালােবাসা ও অন্য কৃষ্টির প্রতি তাদের উদার মনের উপলব্ধি, শ্রদ্ধা ও আগ্রহের দিকটা সুদৃঢ়ভাবে প্রদর্শন করার জন্য প্রায়শঃই তারা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতেন ।
নিয়মিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা চেষ্টা করেছেন ছেলেমেয়েদের মনােযােগী ও কৌতূহলী করে গড়ে তুলতে । তাদের মতে, এ ধরনের অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ, অন্য কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ততা স্থাপন ও বজায় রাখার উত্তম পন্থা। তারা খেলাধূলা, শিল্পকলা, হাতের কাজ, সংগীত ও ধর্মবিষয়ে আলাপ আলােচনাসহ যতটুকু সম্ভব সম্পৃক্ততা বজায় রাখেন। ওরকম করতে গিয়ে তারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের বলতেন, তাদের যােগাযােগ ঋদ্ধ করতে, যারা উল্লিখিত কর্মে নিযুক্ত, তাদের সঙ্গে যােগাযােগের মাধ্যমে। তারা আরও মত পােষণ করেন যে বহু জাতিকতার বহুমাত্রায় শিক্ষা নিয়ে তাদের ছেলেমেয়েরা সাম্য, সুবিচার ও অন্যের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে জীবনে আরও উৎকৃষ্টকর এবং উন্নয়নশীল দেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এটাও বেরিয়ে আসে মা-বাবা সবসময় চেয়েছিলেন যে, তাদের সন্তানেরা যেন একই দেশের অন্যান্য শিশুর সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলে। পােষ্য শিশুরা পারিবারিক বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে চলতে শিখবে, যেমন- স্থানীয় খাবার খাওয়া, ছবি দেখা, বই পড়া এবং সাংস্কৃতিক ক্যাম্পে যােগদান করবে। কিন্তু এটাও দেখা গেল যে এই যুগলদের মধ্যে অবশ্য এমন পরিবারও ছিল যারা তাদের ছেলেমেয়েরা অপ্রধান সাংস্কৃতিক কান্ডকারখানায় যােগ দিক এটা পুরােপুরিভাবে চাননি। অন্য কথায়, তারা মনে করতেন, জাতিগত তফাৎ-এর ব্যাপারটা প্রণিধানযােগ্য। এ পার্থক্যটা তাদের ছেলেমেয়েদের সমগ্র জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে। অতএব তারা একান্তই চেয়েছিলেন তাদের সন্তানেরা যেন প্রথমত তাদের নিজেরেকে কানাডীয় গণ্য করে । হয়তাে এ কারণে পরিবারের বহুজাতিক মাত্রার যে বৈশিষ্ট্য, যদিও সব মা-বাবাই এটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, সবার আলােচনা এক্ষেত্রে এক কথাতে হয়নি, অর্থাৎ একরৈখিক আলােচনার রূপ নেয়নি। কোনাে কোনাে মা-বাবা তাদের সন্তানদের যে উৎস বিষয়ে আগ্রহী এবং গর্বিত, এ ব্যাপারটাকে কম বেশি উৎসাহিত করেছেন। বনি বিশ্বাস করেন যে “দত্তকগ্রাহী মা-বাবার উচিত তাদের বহুজাতিক সন্তানদের ঐতিহ্য বিষয়ে জানতে চেষ্টা করা এবং আরও চেষ্টা করা যে তারা যেন সন্তানের উৎস ঐতিহ্যে গর্ববােধ করেন, কারণ তাতে শিশু তার নিজের ঐতিহ্যকে ভালােবাসতে শিখবে।”২৬ ফেরিরা (হেলকে এবং রবাট) তাদের দুজন বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুকে ভারতের বাের্ডিং স্কুলে পাঠিয়েছিলেন, যাতে তারা ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে ।
হেলকের মতে, “চৈনিক মুখ, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মুখ, অথবা বাদামি মুখে বাদামের মতাে তীর্যক চেড়াচক্ষুর অধিকারী একজন যদি হেসে বলে ‘আমি কানাডীয়,’ সেটা হবে বােধহয় সর্বসেরা প্রশংসনীয় মন্তব্য যা আমার দেশকে আপনি দিতে পারেন।” উলসিদের মেয়ে আমিনা প্রিমা চৌধুরীর (আমিনার মা-বাবা ফারুক ও পলিন চৌধুরীকে চিনতেন) ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিল। চৌধুরী পরিবারের মাধ্যমে আমিনা অন্টেরিওর লন্ডন এলাকায় বাঙালি জনগােষ্ঠীতে দশজনের দেখা হলেই সেখানে ডাক পেত এবং যেত । আমিনার মা-বাবা আমিনাকে বাঙালি ও ভারতীয় কানাডীয়দের সাথে মেলামেশাতে সবসময় উৎসাহ দান করছেন এবং জোর দিয়ে সেটা সমর্থন করতেন। তার কারণ, উলসিদের বিশ্বাস। যে, তাদের দত্তকায়িত মেয়ের সংস্কৃতি তাদের বহুজাতিক পরিবারের সংস্কৃতির একটা। গুরুত্বপূর্ণ ধারা যা বহমান রাখতে হবে বিভিন্ন সংস্কৃতির সম্পৃক্তত্তার মাধ্যমে। ১৯৮৯ সালে ডনা উলসি বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেয়া লন্ডন (অন্টেরিও) এলাকাবাসী। | একদল ছেলেমেয়েদের বাংলাদেশ সফরের আয়ােজন করেন (বিশদ জানতে সপ্তম অধ্যায় | দেখুন)। স্মৃতিচারণে এও জানা গেল একবার ডনা আমিনাকে বলেছিলেন, “আমরা চাইনি যে তুমি এমনভাবে বড় হয়ে উঠবে যে, ভাববে, তাহলে পৃথিবীতে সব কাজ করার একই উপায় রয়েছে (কানাডীয় পন্থা অথবা উলসিদের মতাে করে)। আমরা চেয়েছি যে তুমি বড় হবে আর স্বাভাবিকভাবে চারদিকে দেখবে, জীবন কীভাবে বিকশিত হয়, লােকে কাজ কত ভাবে। করে, খাওয়া দাওয়া করে, পােশাক পরে এবং ভাবে আরও কত রকমেই না ঐসব কাজ করা সম্ভব। তাই আমরা বিভিন্ন দেশের খাবার রান্না করতে শিখেছি, নানা স্থানীয় খাবার দোকানে খেয়েছি। নানা বর্ণের মানুষের সাথে মেলামেশা করেছি। আমাদের জন্য এ বিচিত্র আগ্রহ স্বাভাবিক ছিল। আমরা তােমাকেও এ ধরনের পৃথক পৃথক অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম,” আমিনা তার গবেষণাপত্রে এ রকম বলেছে, তার বিচিত্র পরিবারের বর্ণনায়, যে পরিবারে তারা ৬ জন আন্তবর্ণীয় ভাইবােন একসাথে মানুষ হয়েছে।
অমিনার মনে পড়ে, যখন সে বড় হয়ে ওঠছিল তখন নানা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। “আমার যতদূর মনে পড়ে, আমার বাড়ি আমার মা-বাবার ব্যক্তিগত যাদুঘরের মতাে ছিল। আমাদের বাড়ির দেয়ালগুলাে তাদের অভিযান, তাদের জীবনযাপনের জীবন্ত দলিল, সাক্ষী। তারা যেখানে যেখানে গিয়েছেন, যেসব জায়গার, যেমন- ফ্রান্স, আফ্রিকা, ভিয়েতনাম, কোরিয়া এবং জার্মানির আঁকা ছবি, অজস্র মুখােশ, কাঠের হস্তশিল্প, নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র দেয়ালগুলির শােভাবর্ধন করেছে। আপনি বাড়িতে ঢুকলে সুইজারল্যান্ডের একটি কোকিল ঘড়ি আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবে। পারিবারিক ঘরে ঢুকলে দেখবেন, দুটি কাঁচের শােকেসে আমার মায়ের পুতুলের সংগ্রহ, পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের কমপক্ষে একটি পুতুল, যেখানে আমার মা গিয়েছেন, সেখান থেকে এসেছে। মধ্য প্রাচ্য থেকে দ্য গুড সিলভার, ডিনার প্লেটগুলাে আফ্রিকার, বলিভিয়ার হস্তশিল্প, বেডরুম সেট, জুলি এবং আমার বেডরুম ফার্নিচার বাংলাদেশের । আমাদের বাড়ি অনেকটা আমাদের শিক্ষার ক্লাসরুম।” আবার বিপরীতে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রিবেইরােরা (রােবের্তো এবং মার্গো), তাদের বাংলাদেশি ছেলে মার্টিনকে বাংলাদেশের ইতিহাস জানার জন্য বেশি খোঁড়াখুঁড়ি করতে বারণ করেছেন। রােবের্তোর ভাষ্য অনুসারে, যেহেতু মাটিনকে স্কুলের শুরু থেকে শেখার ব্যাপারে একটু ধীরগতিসম্পন্ন মনে হয়েছিল তারা তাকে অতিরিক্ত পাঠ্য বিষয়ের চাপে না রাখার সিদ্ধান্ত নেন। অতিরিক্ত বিষয় সম্পর্কে হয়তাে কোনাে আগ্রহবােধই করেনি । ক্লাসের বাইরে অতিরিক্ত পড়াশােনার ব্যাপারটি বাবা-মা সম্পূর্ণ মার্টিনের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন (পঞ্চম অধ্যায়ে-এ বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে)। মার্টিন সম্পর্কে রিবেইরােদের মত ছিল এরকমঃ তাদের ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে তাদের নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে। মা-বাবার কাজ হবে কেবল তাদের সন্তানদের পটভূমিতে পরিচয় করিয়ে দেয়া, জায়গা দেখিয়ে দেয়া।” ১৯৭২ সালে যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন বাংলাদেশ থেকে একটি শিশু দত্তক নেয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল হার্ট (জোয়েল ও ট্রডি) পরিবারের জন্য। নানা দেশের শিশুদের দত্তক নিয়ে তারা যে পরিবার গড়েছেন সে পরিবারের আকর্ষণীয় বৈচিত্র্যতা শুরু থেকেই লক্ষণীয়।