You dont have javascript enabled! Please enable it! দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়ের আনন্দ-বেদনা - সংগ্রামের নোটবুক
দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়ের আনন্দ-বেদনা
এ অধ্যায়ে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সে বিষয়ে আলােচনা করা হয়েছে। আলােচনার ভিত্তি হলাে, লেখক বিভিন্ন সময়ে দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদের সঙ্গে যে কথা বলেছেন এবং সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, সেসব বিশ্লেষণ মূলত বাবা-মায়েদের দৃষ্টিকোণ থেকে করা হয়েছে। এ বই লেখার জন্য সর্বপ্রথম যে গবেষণা করা হয়েছিল তারই অংশ ঐ সাক্ষাৎকারগুলাে। আমাদের ঐ সাক্ষাৎকারগুলাে বহু বছরে করা অনেকগুলাে টুকরাে সাক্ষাৎকার জুড়ে একীভূত করা হয়েছে। বেশিরভাগ দত্তকগ্রাহী মা-বাবা কানাডাতে এমন শিশু দত্তক নিতে চান যার সঙ্গে তাদের নিজেদের জাত, ধর্ম, গােষ্ঠী ইত্যাদি নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য মেলে।
আলােচ্য গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত বাবা-মায়েরা নিজেরাই চেয়েছিলেন একটু আলাদা আচরণ করতে । তারা বিভিন্ন জাত-ধর্ম-গােষ্ঠীর ছেলেমেয়ে দত্তক নিয়ে নিজেদের পরিবারের আকার বাড়ানাের সঙ্গে সঙ্গে বৈশিষ্ট্য বাড়াতে চেয়েছিলেন। সে সাথে তারা এও চেয়েছিলেন, বিভিন্ন জাতের বৈশিষ্ট্য নিয়ে এসে কয়েকজন মানুষ মিলেমিশে এক ঋদ্ধ সমাজ গড়বেন, কানাডাতে যখন সে ধরনের প্রবণতার খুব প্রচলন ছিল না। যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে যে সাহস ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জীবনের অধিকারী হওয়া প্রয়ােজন, সেটা ঐ দম্পতিদের গভীর জীবনবােধের থেকেই উদ্ভুত হয়েছিল সন্দেহ নেই। তারা হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন আধুনিক নিউক্লিয়ার পরিবারের ধারণা ভেঙে পড়ছিল ক্রমশ। আলােচ্য দম্পতিরা পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করেন যে, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জনগােষ্ঠী তাদের মাঝে বসবাসকারী যে অনাথ শিশুটির সহায়তা প্রয়ােজন তাকে সনাক্ত করে তাকে বাঁচানাের ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন।
দরিদ্র মানুষের দেশে বেশিরভাগ পিতৃমাতৃহীন শিশুর শৈশবেই মারা যাবার কথা; অথচ সব শিশুরই বাঁচার অধিকার রয়েছে। আমাদের সাক্ষাৎকার থেকে এটা জানা যায় যে, দত্তকগ্রাহী মা-বাবা এবং তাদের শিশুরা অন্য যে কোনাে পরিবারের মতােই ছিল। তবে এটাও সত্য যে, তাদের পারিবারিক বিভিন্ন উপাদান অন্যান্য সাধারণ পরিবারে যে স্বাভাবিক উপাদান থাকে, সেরকম ছিল না। আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় অনাথ শিশুদের দত্তক নেয়ার ব্যাপারটা তাদের নিকট মা-বাবার ভূমিকা বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমরা এ অধ্যায়ে দেখতে পাবাে সক্ষম দম্পতি হয়েও কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ কানাডীয় দম্পতি ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাভাবনা নিয়ে কেমন করে “অনাকাক্ষিত যুদ্ধশিশুদের অনায়াসে আলিঙ্গন করে মা-বাবার স্নেহ-আদর দিয়ে তাদেরকে মানুষ করেন। নিজেদের পরিবার গড়তে তাদের তেমন কোনাে কষ্ট হয়নি।
এ কানাডীয় যুগলদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কারাে জন্মরহস্য বলতে কিছু নেই । জাতি, কুল বা বংশ। নিয়েও তেমন কোনাে ভাবনা নেই। বিদেশি সেনার দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে যে নারীর গর্ভধারণ, সে গর্ভস্থ সন্তান প্রসব করেই মুক্তি পেয়ে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, হয়তাে সে নিজেও জানে না । শিশু অনাথ আশ্রমে জন্ম নেয়া এবং সেখানে নিয়ে আসা অনেক যুদ্ধশিশুই শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর নানা দেশে দত্তকায়নের মাধ্যমে চলে যায়। বর্তমান ক্ষেত্রে এরকম ঘটেছিল বাংলাদেশি কয়েকটি যুদ্ধশিশুর ভাগ্যে। এখানে দত্তকগ্রাহী মা-বাবা যে লড়াইটা করেন আমলাতান্ত্রিক বাধা-নিষেধের প্রতিবাদ করে, অবশেষে ঐ কয়েকটি শিশুকে বাংলাদেশ থেকে কানাডাতে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। এটি দত্তকের বিষয়ে বলা যেতে পারে এক বিশাল মানবিক জয়। সেই যােদ্ধারা আজও তাদের সে প্রয়াসের প্রতিটি পদক্ষেপ মনে রেখেছেন, চিঠিপত্র সযত্নে রক্ষা করেছেন তাদের সে সংগ্রামকে মূর্তমান করে তােলার জন্য যে কোনাে মুহূর্তে।
আমাদের সাক্ষাৎকারগুলি সংক্ষেপিত আকারে ধারণ ও উপস্থাপন করা সম্ভব নিমবর্ণিত চার প্রধান প্রশ্নকে ঘিরেঃ (১) এই শিশুদের দত্তক নেয়া হয়েছিল কেন? তাদের দত্তক নেবার অভিজ্ঞতার স্বরূপ কী ধরনের ছিল? (২) যারা দত্তক নেন, তাদের কি যুদ্ধশিশু দত্তক নেবার মতাে দৃঢ় সংকল্প ছিল? অথবা, তাদের পছন্দমতাে দত্তক নিতে চাওয়ায় তাদের যে কষ্ট করতে হয়েছিল, তার পেছনে তাদের এ সংকল্পের কারণ কী ছিল? (৩) দত্তক নেবার আগে। ওই দম্পতিদের কতজনের জৈবিক প্রক্রিয়ায় মা-বাবা হবার সুযােগ হয়? (৪) মা-বাবা হবার প্রক্রিয়ায় তাদের যেসব কষ্টকর চাপের মুখে পড়তে হয়েছে, তার কতটুকু এখন সেগুলাে অতিক্রম করার পর মনে পড়ে? অথবা, মা-বাবা হতে গেলে যেসব সুখ-দুঃখের সঙ্গে পরিচয় হয়, সেসব কেমন ছিল? গবেষণার বছরগুলিতে দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েরা, লেখকের সঙ্গে কাজ করবার সময় সর্বদাই সহযােগিতা করেছেন, মন খুলে কথা বলেছেন, শুনেছেন; সাগ্রহে অংশগ্রহণ করেছেন।
এ অধ্যায়ের রূপরেখা বর্ণনা করতে গেলে এরকম দেখাবেঃ আমরা আলােচনা করব আমাদের। বাবা-মায়েরা দত্তক নিতে চেয়েছিলেন কেন । তারপর আমরা দেখব সেটা করতে গিয়ে শিশুর যত্ন নেবার বেলায় কোথায় তারা প্রথমে আটকে গিয়েছিলেন, যাদের কাছে শিশুর সম্পর্কে লিখিত কোনাে চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য ছিল না। অতঃপর বাবা-মায়েরা যেভাবে তাদের দত্তকায়িত শিশুর সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক গড়ে তােলার ব্যাপারটা বর্ণনা করেছেন, সেটা উপস্থাপন করব। এরপর আমরা যে বিষয়ের গভীরে ঢুকব, সেটা হলাে, কোন্ মা-বাবা কখন তাদের সন্তানকে তার দত্তক নেবার পূর্বকথা নিয়ে আলাপ করেন। উপসংহারে এ অধ্যায় বহু। সংস্কৃতির বর্ণময় জগৎ ও বৈচিত্রের ঋদ্ধি যেভাবে আমাদের এ আন্তর্দেশিক এবং আন্তবর্ণীয় দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদের মা-বাবা হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতাকে নিঃসন্দেহে মানবিক মূল্যবােধের প্রাচুর্যে ভরিয়ে তুলেছে, তারই আলােচনা দিয়ে শেষ হবে।
দত্তক নেবার প্রণােদনা। দম্পতিরা নানাভাবে পরিবার গড়ে তােলেন, যেমন- দত্তকের প্রক্রিয়ায়, প্রতিভূ (Surrogate) নিয়ােগ করে, পুনঃবিবাহ করে অথবা অন্যতর উপায়ে। দম্পতিদের পশ্চাৎপট অনুসন্ধানে যেমন বিচিত্র তথ্য মেলে, তেমনি তাদের দত্তক নেবার পেছনে কারণ খুঁজলেও নানা বিচিত্র তথ্য পাওয়া সম্ভব। যখন থেকে জন (John) আর আমি পরস্পরকে চিনি, জানি, আমরা বিবাহ, সন্তান নেয়া ইত্যাদি বিষয়ে আলােচনা করেছি, আমরা একটি ব্যাপারে দুজনে একমত হয়েছি, সে হলাে দত্তক নেয়া। আমাদের দুজনে দেখা হবার আগে থেকেই ভাবতাম, পরে জেনেছি, অন্য দেশের শিশু দত্তক নিয়ে লালন-পালন করলে ব্যাপারটা সবারই ভালাে হবে । আমরা দুজনেই ওরকম অভিজ্ঞতা চেয়েছিলাম,” ডরােথি মরিস স্মৃতির বাক্স হাতড়ে বলেন, যিনি তার স্বামী জনের সঙ্গে যুদ্ধশিশু জরিনাকে দত্তক নিয়েছেন। যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়া বাবা-মায়েরা নিশ্চিত ছিলেন যে, তারা কেবল “পরােপকারী” অথবা “অন্যের দুঃখে পরাণ কান্দে,” এরকম মানুষ ছিলেন না। তারা অনেক আগে থেকে দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে মা-বাবা। হবার মানসিকতাকে পূর্বশর্ত হিসাবে ধরে নিয়ে দম্পতিরূপে দত্তক নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিভিন্ন পটভূমির বিচিত্র সন্তান লালন-পালনের আনন্দ তারা পেতে চেয়েছিলেন। আমাদের এ দম্পতিদের জন্য দত্তক নেবার ব্যাপারটা জীবনভবের সিদ্ধান্ত, এক-দুদিনের ব্যাপার নয়।
কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুই বা কেন (এত দেশ থাকতে?) কানাডাতে দত্তক নেবার মতাে শিশুর সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, এর কারণ কী? কেন তারা ধর্ষণের ফলে যাদের জন্ম, এবং জন্মের পর যারা অনাকাক্সিক্ষত” ও পরিত্যক্ত, সেসব শিশুকে দত্তক নিতে আগ্রহী হয়েছিলেন? বাবা-মাকে এসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার পর জানতে পারলাম, তারা সেসময়ে যা। আদর্শ বলে বিবেচিত হতাে, তার দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, যেমন- ১৯৬০ এর দশক উত্তর আমেরিকায় সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের যুগ, সমাজে যত ধরনের বৈষম্য ছিল, যেমন- কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে সবাই বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন । ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ করা, হােয়াইট হাউস থেকে প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং আমেরিকার মুক্তাঙ্গন থেকে মার্টিন লুথার কিং জনগণকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। বাবামায়েরা তখন সাম্য ও সুবিচার দাবি করতেন। কোনাে কিছু পুড়িয়ে নষ্ট করার চেয়ে উপরে তুলে ধরতে চাইতেন, তারা টেলিভিশনে দেখে, খবরের কাগজ পড়ে যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে জানতে পেরেছিলেন, সান্ধ্য পত্রিকাগুলােতে বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে জেনে কানাডীয় যুগল ও আমেরিকান বাবা-মায়েরা বিষাদগ্রস্ত হন, “অধিকৃত বাংলাদেশে” নৃশংস হত্যালীলা ও অনাচার (মার্চ ১৯৭১-ডিসেম্বর ১৯৭১) তাদের ক্রুদ্ধ করে তােলে ।
বাবা-মায়েরা প্রথমে একটি শিশু দত্তক নিতে চেয়েছিলেন। তারা এটুকু বুঝতেন যে, একটি পিতৃমাতৃহীন শিশুর সবচেয়ে বেশি প্রয়ােজন একটা স্থায়ী আশ্রয় যেখানে তারা থাকবে। নিরাপদে; সেখানে যারা তাদের লালন-পালনের দায়িত্ব নেবেন তারা তাদেরকে স্নেহ, ভালােবাসা দিয়ে মানুষ করবেন। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক দত্তক ব্যবস্থার মাধ্যমে “অবাঞ্ছিত” শিশুদের সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে ভেবেই এই শিশুদের দত্তক দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের কথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে, দক্ষিণ ভিয়েতনামের শিশুদের কী করুণ অবস্থায় পড়তে হয়েছিল! পেছনে তাকালে আমরা দেখি বাংলাদেশের যুদ্ধে অনাথ শিশুদের দত্তক নেয়ার বিষয়টি পরবর্তী দক্ষিণ এশীয় অনাথদের কানাডা অভিবাসনের আগের ঘটনা। ভিয়েতনামের ঘটনার পর দেখা গেল, বিপুল সংখ্যক কানাডীয় মা-বাবা তাদের বাড়িঘর ও হৃদয়ের দুয়ার দক্ষিণ এশীয় শিশুদের জন্য খুলে দিয়েছিলেন (বিশেষত ১৯৬০ দশকের শেষে ভিয়েতনাম থেকে শিশু আসার পর)। সংকল্পে অটল বর্তমান বাবা-মায়েরা নিশ্চিত হয়েছিলেন এ ব্যাপারে যে, তারা আরও বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের জন্য স্থায়ী ভালােবাসার সম্পর্ক ও পরিবেশ উপহার দিতে সক্ষম হবেন।
আমাদের সাক্ষাৎকারের সাধারণ বিষয়বস্তু ছিল, বাবা-মায়েরা দত্তক নিয়ে দুর্ভাগ্যকবলিত শিশুদের কষ্ট দূর করবার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন। এখানে সব দম্পতিই দত্তক নিতে চেয়েছিলেন। তাদের বিবেচনা মতে, যুদ্ধশিশুরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অনাথ যাদের সহায়তা একান্ত প্রয়ােজন। বাংলাদেশ থেকে একটি শিশু দত্তক নেবার অর্থ তাদের নিকট ছিল একটি শিশুর জীবন রক্ষার মতাে উপকার। বিপন্ন জীবনের প্রতি স্বাভাবিক সাড়া দেওয়া যাকে বলে। হেলকে ফেরি, যিনি বাংলাদেশ থেকে দুটি শিশু দত্তক নিয়েছিলেন, বলেন, “তার কাছে এ কাজটি ছিল এমন যে, একটি ক্ষুধার্ত শিশুকে তার ক্ষুধার সময়ে যা সবচেয়ে বেশি দরকার, তাই দেয়া।
দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদের প্রাথমিকভাবে যে কাজটি করতে আগ্রহ জন্মাত, সেটা হলাে, শিশুটিকে বাঁচতে দেয়া । দ্বিতীয়ত, তাদের এমনভাবে বাঁচতে দেয়া যাতে তাদের জন্মসংক্রান্ত কোনাে কলঙ্ক তাদের গায়ে না লাগে। বাবা-মায়েরা অবশ্যই বুঝতে পেরেছিলেন যে, যুদ্ধশিশুকে দত্তক নেবার অর্থ এমন একটি শিশুকে লালন করা যার আহত হওয়া, রুগ্ন এবং বিকলাঙ্গ হবার ঝুঁকি অন্য শিশুর চেয়ে বেশি। সাধারণত দত্তকের বেলায় যেসব তথ্য শিশুর। সঙ্গে থাকে, এই শিশুদের দত্তক নেবার সময় বাবা-মায়েরা প্রয়ােজনীয় সে তথ্যগুলি ছাড়াই। প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যান । জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবার ইতিহাস, শিশুর চিকিত্সার ইতিহাস, যে পরিস্থিতিতে শিশুদের গর্ভে ধারণ করা হয়েছিল এবং যেভাবে গর্ভকাল অতিবাহিত হয়েছিল ইত্যাদি বিষয়ে কোনাে তথ্যই এক্ষেত্রে ছিল না।
কানাডাতে নিরাপদ আশ্রয়ে আসার পর পরও এ যুদ্ধশিশুদের জীবন এতই ঝুঁকির মুখে ছিল যে, বাবা-মায়েরা রীতিমতাে শংকিত ছিলেন যে কোনাে সময় তাদের জীবনাবসান হয়ে যেতে পারে। কিন্ত তারা মনেপ্রাণে এ শিশুদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন সব শিশুরই বাঁচার অধিকার রয়েছে, তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা যেমনই হােক, তাদের জন্মের ইতিহাস যাই থাকুক না কেন। দত্তকগ্রাহী যুদ্ধশিশু অনিলের বাবা-মা রে (Ray) এবং এলিজাবেথ মৌলিং বলেন: “আমাদের জন্য শিশুটি (যুদ্ধশিশু) কিন্তু শত্রুপক্ষের কেউ ছিল । সে ছিল একটি শিশু, যার একটি পরিবার দরকার ছিল, যার সুখী ও স্বাস্থ্যবান বড় হয়ে ওঠার জীবন ছিল সম্মুখে । পরিবারে একটি নতুন শিশু আসলে যে আনন্দ হবার কথা, অনিল আসায় তার চেয়ে ভিন্নতর মাত্রা যুক্ত হয়েছিল । মনে হয়েছিল, বৈশ্বিক পর্যায়ে আমাদের পরিবারে এসেছে নতুন ধরনের এক আনন্দের জোয়ার। আমরা বােধ করছিলাম, আমরা এক ইতিবাচক ভবিষ্যতের গর্ভে একটি ছােট্ট হলেও সম্ভাবনাময় বীজ পুঁতেছি, যার জন্ম হয়েছিল যারপরনাই প্রতিকূলতার মাঝে।
দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদের সবাই তাদের শিশুদের কানাডা নিয়ে যাবার প্রক্রিয়ায় এক  সমস্যাসঙ্কুল ও অনিশ্চয়তায় অসহনীয় অবস্থায় দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। বিশেষ করে অন্টারিও প্রদেশের দম্পতিদের জন্য প্রক্রিয়াটি দীর্ঘতর ও কঠিন করে তুলেছিল তাদের প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং কর্মকর্তাবৃন্দ, যারা বন্ধ দরজার আড়ালে এ বিষয়ে একরকম জোট বেঁধেছিলেন, বলা যায়। তারা ঠিক করেছিলেন যে, কোনাে শিশুকে দত্তক নিতে হলে সে শিশুকে প্রথম কানাডীয় হতে হবে, তারপর অন্য কথা, যেমন- কানাডীয় এবং বিকলাঙ্গ হলে আরও ভালাে। এটা ছিল অন্টেরিও সরকারের এক রকমের জবরদস্তি যে, দত্তক শিশু কিছুতেই মা-বাবার নিজের পছন্দের হলে চলবে না।
অন্টেরিও সরকাররের এ অযৌক্তিক অবস্থান আবেদনকারীদের ক্ষিপ্ত করে তােলে। ফলে এ বিষয়ে তাদের রুচি ও সিদ্ধান্তও হয়ে উঠে একরোখা । অন্টেরিও দম্পতিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই শেষ পর্যন্ত জাতীয় সংগ্রামের রূপ নেয় কানাডাতে যুদ্ধশিশু দত্তক নিতে সকল ইচ্ছুক বাবা-মায়েদের এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয় । জন ও ডরােথি মরিস, যারা জরিনাকে দত্তক নেবার লড়াইয়ে নেমেছিলেন, প্রাদেশিক সরকারের অবস্থানকে এভাবেই দেখেছিলেন। “অন্টেরিওর অধিকাংশ শিশুর বাড়ি রয়েছে। তারা পােশাক পরতে পায়, শিক্ষা পেয়ে থাকে । খেতে পায় নিয়মিত এবং অসুখে চিকিৎসাও। যেটা তারা পায় না, সেটা হচ্ছে ভালােবাসা এবং বাড়ির নিরাপত্তা, জন লিখেন প্রিমিয়ার বিল ডেভিসকে। “সাত সমুদ্রের ওপারের, এ শিশুদের অনেকেরই স্বাস্থ্য এত খারাপ ছিল যে, তারা বাঁচবে কিনা সে বিষয়েই সন্দেহ ছিল, অন্টেরিওর শিশুদের মতাে এত কিছু থাকা তাে দূরের কথা। তাই আমরা ঠিক করলাম, আমরা সেখানেই যাব, যেখানে প্রকৃত প্রয়ােজনটা সবচেয়ে বেশি,” লেখেন জন।
অন্টেরিও সরকার যুক্তি উপস্থাপন করে এটা বলেন, বিদেশ থেকে অন্যজাতের শিশু দত্তক আনলে এবং তাকে ভিনজাতের মা-বাবার সঙ্গে বসবাস করতে হলে তাদের মাঝে দূরত্বের সৃষ্টি হতে পারে। দত্তক গ্রহণে ইচ্ছুক বাবা-মায়েরা অবশ্য ভেবেছিলেন, শিশুর জীবন রক্ষা করা হলাে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে অন্য কোনাে বিবেচনার জায়গা নেই । ডেল ও ডনা উলসি কমােকা, অন্টেরিওর অধিবাসী। তারা আগেই বুঝেছিলেন যে, বাংলাদেশ থেকে শিশু দত্তক নিলে এ বিষয়ে তাদের অতিরিক্ত পরিশ্রম, মেধা ও মনােযােগ দিতে হবে, তারপরও তারা তাদের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে, তাবৎ বিশ্বের মাতৃপিতৃহীনেরা যাবতীয় বিশ্বনাগরিকের দায়িত্ব, “তা সে কানাডাতে হােক বা বিশ্বের যে কোনাে জায়গায় । আমাদের অস্তিত্বের ওপর সেটা প্রভাব ফেলবে সে যখনই হােক। কানাডীয়রা শিশুদের কাছে এগিয়ে যাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে কারণ তদের দরকার আমাদের সাহায্যের। তারা এসে একেবারে সামনের কাতারে থাকবে । আশা করি শিশুরা যেখানেই থাকুক, আমাদের সাহায্য তাদের কোনাে কাজে লাগবে ।”এ বইয়ের উপসংহারে আমরা দেখতে পাবাে এই বাবা-মায়েদের ধ্যান-ধারণা শুধু যে ঠিক ছিল তা না; বরং তাদের সংকল্পে অটল থেকে তারা সাধ্যানুযায়ী যুদ্ধশিশুদের দাযিত্ব পালনের অসাধারণ দৃষ্টান্ত রেখেছেন।
আমাদের বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই যে বর্তমানের এ কানাডীয় দম্পতিদের কেউই ছিলেন অপত্যহীন । দুএকটি পরিবার ছাড়া সবারই ঔরসজাত সন্তান ছিল । কিন্তু তারপরও সদিচ্ছা প্রণােদিত হয়ে বাংলাদেশের অসহায় ও আশ্রয়হীন যুদ্ধশিশুদের কোলে তুলে নেয়ার সংকল্পে ছিলেন বদ্ধপরিকর। সন্তান না থাকা মা-বাবার আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় শিশু দত্তক নেবার সিদ্ধান্তকে কোনােভাবে প্রভাবান্বিত করেনি। দত্তক নেবার ব্যাপারে শিশুর লিঙ্গ অথবা | জাতিগত বৈশিষ্ট্য কোনাে নিয়ামক ছিল না। বিবাহ এবং পারিবারিক জীবন সম্পর্কে দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মায়েরা মােটামুটি ঐতিহ্যবাহী ধ্যান-ধারণা পােষণ করতেন। তাদের অনেকের তখন জমজমাট পরিবার ছিল । পরিবারের মা-বাবা এবং সন্তান-সন্ততি সকলে পরস্পরের মঙ্গল বিধানের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন এবং এখনও তাই আছেন। তারা তাদের পরিবারে আরও একটি শিশু আসছে, এ খবর শুনে উত্তেজিত ও চিন্তিত। কারণ তাদের ঘিরে অনেকগুলাে অজানা বিষয় তখন কাজ করেছিল। বাবা-মা এখনও মনে রেখেছেন তারা তাদের নতুন শিশুর আগমণী নিয়ে কত কী করবেন ভেবেছিলেন অথচ কেউ জানতেন না। শিশুটি দেখতে কেমন; বাংলাদেশে জন্মেছে যে শিশু, তার বিভিন্ন প্রয়ােজন কীভাবে মিটবে; অথবা, শিশুটি ঠিক কখন, কবে বাড়ি পৌছাবে । এক পর্যায়ে শিশুর জন্য অপেক্ষা করাটা মা-বাবার কাছে বেশ অসহনীয় হয়ে গিয়েছিল । এক অর্থে, যখন যুদ্ধশিশুদের বাংলাদেশ থেকে আনার প্রক্রিয়ায় একটা দীর্ঘ সময় যাবৎ কথাবার্তা চলেছিল, সে সময়টাকে আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য দরদস্তুর চলছিল বলা যায় । মজার কথা যে, প্রত্যেক দম্পতির একটি কথা মনে আছে, তারা সকলেই যখন তাদের জীবনে একটা বড় পরিবর্তন আসবে ভেবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সে সময়ের অপেক্ষা ও অস্থিরতাটা সবার কাছেই যেমন আনন্দময়, তেমন বেদনাদায়ক মনে হয়েছে। বাবা-মায়েদের মনে আছে, কানাডীয় দল যুদ্ধশিশু নির্বাচনের জন্য যাবার পরও বাংলাদেশ থেকে কানাডাতে শিশুদের আসার ব্যাপারে অত্যন্ত কম পরিমাণে সংবাদ প্রচারিত হয় ।
দম্পতিদের ভাষ্য অনুসারে, অনাথ আশ্রমে শিশুরা কীভাবে লালিত পালিত হচ্ছিল সে বিষয়ক তথ্যাদি, যেমন- তাদের কেমনভাবে খাওয়ানাে হতাে, ঘুমনাের সময় কেমন ছিল এবং অন্যান্য অভ্যাস কেমন ইত্যাদি বিষয়ে দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মায়েরা তেমন কিছুই জানাতে পারেননি। ফলে তারা যে শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরবেন সে শিশুর ছবিও কল্পনা করতে পারছিলেন না। বলা যেতে পারে যে, তাদের বাংলাদেশ থেকে কোনাে ধরনের সংবাদ না দিয়ে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল বেশ অনেকদিন। আবার বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধশিশুদের কানাডা যাবার জন্য ছাড়পত্র দিতে পারবে কিনা সে কথা সঠিকভাবে কেউই বলতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ঐ শিশুদের জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে ঝুলিয়ে রেখেই তাদের বিদেশি মা-বাবার কাছে দত্তক শিশু হিসাবে তুলে দেবার। উদ্দেশ্যে সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কানাডীয় শিশু যাদের দত্তক নেয়া সম্ভব হয়নি তারা কোনাে না কোনাে কানাডীয় একটি সংস্থার বাসিন্দা। কানাডীয় দম্পতিদের আশংকা ছিল যে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়া সম্ভব হবে না তারা হয়তাে তাদের শৈশবও পার হতে পারবে না। শিশুদের জীবন ঝুঁকির মুখে দেখেই এসব যুগল আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন এ সিদ্বান্ত নিয়ে যে, তারা ঐ শিশুদেরকেই একবার বাঁচাতে চেষ্টা করবেন।
চিকিৎসা বিষয়ক নথিবদ্ধ তথ্যের অভাব
দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েরা শিশুর চিকিৎসা করাতে গিয়ে বুঝলেন, তাদের কাছে শিশুর চিকিৎসা বিষয়ক তথ্যের কোনাে নথি অথবা শিশুর জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবার বৃত্তান্ত লিখিত। কোনাে রেকর্ড নেই। শিশুর নথি বলতে তার নাম, তার লৈঙ্গিক চিহ্ন, তার জন্ম তারিখ ও স্থানের নাম লেখা একটি কাগজ শুধু । ঢাকার মিশনারিজ অব চ্যারিটি প্রত্যেক শিশুর জন্য একটি জন্ম সনদপত্র তৈরি করে দেয়। তাই তাদের দত্তকগ্রাহী মা-বাবার সন্তানদের সনদপত্রের জালকরণের কোনাে প্রশ্ন ওঠে না। তাদের জন্মের সনদপত্রের কোনাে পরিবর্তন ঘটিয়ে এ বাবা-মায়েরা যুদ্ধশিশুদের বুকে তুলে নেন। এ অধ্যায়ে আমরা দেখব কীভাবে। এ দম্পতিরা তাদের নিজস্ব স্থানীয় কোর্টে আনুষ্ঠানিকভাবে দত্তকায়নের মাধ্যমে এই শিশুদের সম্পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন । প্রত্যেক শিশুর জন্য শিশু ভবনের রেজিস্টার বইটি একটি খােলা নথি । যুদ্ধশিশুদের জন্মদাত্রী মা এবং দত্তকায়িত শিশুদের অনুপস্থিত জন্মদাতা পিতাদের মধ্যে কোনাে জৈবিক সম্পর্কের মায়াজাল তৈরির কোনাে অপচেষ্টা কখনাে করা হয়নি। ১৯৭২ সালে বিভিন্ন অনাথ আশ্রমে জন্মদাত্রী মায়েরা যখন যুদ্ধশিশুদের জন্ম দিয়ে সম্পর্ক ছেদ করে ঐ স্থান ত্যাগ করেছিলেন। তখন থেকে তাদের বা তাদের পরিবার সম্পর্কে কোনাে তথ্য কোথাও লিপিবদ্ধ করা হয়নি । অনেক শিশুকে অন্য জায়গা থেকে অনাথ আশ্রমে আনা হয়েছিল এ আশায় যে, কেউ না কেউ। তাদেরকে দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে বাঁচার সুযােগ দেবেন। অনাথ আশ্রমে শিশুর তথ্যাবলি। সম্বলিত দলিলে তাই ফাকা পড়ে ছিল, তাতে কেউ নতুন করে কোনাে ধরনের মিথ্যে তথ্য দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করার প্রয়ােজন দেখেননি। অবশ্য একইসঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। অজানা থেকে গিয়েছে, যেগুলি শিশুর পরবর্তী জীবনে খুবই কাজে আসতে পারত । দত্তকগ্রাহী মা-বাবা এবং দত্তকায়িত শিশুরা সকলেই ঐসব তথ্য খুঁজেছে। সাধারণ অবস্থায় যে কোনাে শিশুর সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলাে হলাে গর্ভধারণ, গর্ভধারণকাল, কী ধরনের প্রসব হয়েছিল, জন্মের ওজন, শরীরের মাপ জোক, জন্মমুহূর্তে শিশুর অবস্থা, অঙ্গবৈকল্য ছিল কিনা, সায়ানােসিস অথবা জন্ডিস ছিল কিনা; প্রথমবার খাওয়ানাের পর কী হয়েছিল, ইত্যাদি। আদর্শ অবস্থায় সাধারণত শিশুর পরিবারের কাছ । থেকে বংশগতির ইঙ্গিতবাহী প্রবণতাসমূহ উল্লেখ করে একটি পারিবারিক ইতিহাস-নির্ভর বংশ তালিকা তৈরি করিয়ে নেয়া দরকার, যাতে শিশুর উত্তরাধিকার সূত্র এবং সে সংক্রান্ত গতিপ্রকৃতি বােঝা সম্ভব হয়। যুদ্ধশিশুদের ক্ষেত্রে যে একটি মাত্র নির্দেশক বিষয়ে তথ্য হাতের নাগালে ছিল, সেটা হলাে জন্মের সময় শিশুর ওজন। গর্ভধারণকাল যা হােক, জন্মের সময় শিশুর ওজন আড়াই কেজির কম হলে তাকে সময়ের আগে জন্মানাে শিশু বলে ধরে। নেয়া হয়। যুদ্ধশিশুদের অনেকেরই ওজন যেহেতু আড়াই কেজির কম ছিল, তারা আদৌ। বাঁচবে কিনা সে বিষয়ে শঙ্কা থাকা অথবা তার স্বাস্থ্য আশানুরূপ সবল নয় এমনটি ভাবাই তাে। স্বাভাবিক ছিল। বাবা-মায়েরা বলেন, তাদের আশঙ্কার কথা ভেবে CAS (Children’s Aid Society) কর্মীরা তাদেরকে এ বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও সহায়ক উপদেশ দিয়েছিলেন। তাদের মনে।
রাখতে বলা হয়ে ছিল শিশুদের অনেকেই গর্ভধারণকাল পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তারা জন্মগ্রহণকালে আশানুরূপ স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল না। তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা। হয়েছিল এসব শিশুর যতখানি বিকশিত হয়ে জন্মগ্রহণ করার কথা ততখানি উন্নয়ন তখনও তাদের ঘটেনি। তাদের আরও জানানাে হয়েছিল যে, যতই যত্নসহকারে নবজাতকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হােক তাতে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চোখের আড়ালে বা পরীক্ষার বাইরে থেকে যায়। সে কারণে এমনও হতে পারে যে, পরবর্তী সময়ে ঐ শিশুদের মধ্যে কেউ কেউ এমন অসুস্থতার লক্ষণসহ গুরুতরভাবে রুগ্ন হয়ে পড়তে পারে যেটা তার মধ্যে আগে দেখা। যায়নি। এমনকি কখন কেউ সন্দেহও করেনি। CAS কর্মীদের সাবধানবাণীর মধ্যে আরও ছিল, “অধিকৃত বাংলাদেশ”-এ সন্তানকে ছেড়ে দেবার পর যুদ্ধশিশুর জন্মদাত্রী জননী তার সন্তানকে কোনােরকমের ইতিবাচক পারিবারিক ও ভাবাবেগাশ্রিত প্রসবপূর্ণ পরিবেশে রাখতে পারেননি। তারা গর্ভধারণের বিষয়টিকে লােকচক্ষুর ও জ্ঞানের আড়ালে রাখার প্রয়াসে এবং বেশ কয়েকবার গর্ভপাত ঘটানাের চেষ্টার পর তখন চরম ঝুঁকিগ্রস্ত ভাবছেন। তাদের মায়েরা যদি শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে তাদের যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, তারা শ্বাসকষ্টে ভােগে এবং তাদের শরীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। কানাডাতে মা-বাবার প্রধান দুশ্চিন্তা ছিল, তাদের শিশুর যে স্বাভাবিক গতিতে বড় হবার কথা, সেটা হচ্ছে কিনা তা জানার। ব্যাহত হলে সেটা কেন, কতখানি সেটা জানা; অপুষ্টি ও অসুস্থতায় শিশুর বৃদ্ধি আশানুরূপ না হলে সেখানে ব্যবস্থাপনা কী হবে, হাসপাতালে ভর্তি করে শিশুর চিকিৎসার প্রয়ােজন আছে কিনা, সেটা বােঝা। কানাডাতে প্রথম ব্যাচের যুদ্ধশিশুদের পৌছনাের তিন মাসের মধ্যে অক্টোবর ১৯৭২-এ দত্তক নেয়া বাবা-মায়েরা টরন্টোর Hospital for Sick Children-এ কর্মরত ডাঃ ওয়েইন ম্যাককিনি’র অভিজ্ঞতার কথা শুনেন । শিশুদের শল্যরােগ বিশেষজ্ঞ হেলকে ফেরির সঙ্গে কিছু সংখ্যক যুদ্ধশিশু আনতে ঢাকা গিয়েছিলেন ১৯৭২-এর অক্টোবর মাসে।
ডাঃ ম্যাককিনি’র। মতে, যুদ্ধশিশুর মধ্যে যাদেরকে ঢাকায় রেখে এসেছিলেন তাদের সবাইকে কানাডায় আনেননি। কারণ তাদের “পেট বড় ছিল” এবং “তাদের ১০০ ভাগের পেটভর্তি ক্রিমি ছিল । ভালাে স্বাস্থ্য বলতে যা বােঝায় তারা কেউই ছিল না ।””লন্ডনস্থ International Planned Parenthood Federation (PPF)-এর ডাঃ জেফ্রি ডেভিস ঢাকায় (প্রথম অধ্যায়-এ বিশদ বর্ণনা রয়েছে) যখন অন্যান্য চিকিৎসকদের সঙ্গে ধর্ষিত নারীদের চিকিৎসা শুরু করেন ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, তখন অনেক গর্ভবতীদের নিস্তেজ, নাজুক ও দুর্বল শিশু প্রসবের। দৃশ্য দেখে প্রবল আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অনুমান করে বলা হয়েছিল যে, বহুবার গর্ভনাশের চেষ্টা সত্ত্বেও দুর্দম প্রতিকূলতার মধ্যেই যেসব শিশু জন্ম নিচ্ছিল, তারা অবিশাস্যভাবে জন্মগ্রহণ করায় অদম্য মাত্রায় এক ধরনের প্রতিরােধী শক্তির প্রমাণই দিয়েছিল, ডাঃ ডেভিস চমকৃত হয়ে লক্ষ্য করেছিলেন কেমন এ সব শিশু। বাবা-মাকে এটা বােঝানাে হয়েছিল, যে পরিবেশ ও অবস্থায় ঐ শিশুরা মায়ের গর্ভে বড় হয়েছে, মরতে মরতে বেঁচেছে এবং অবশেষে জন্ম নেয়ার অপরাধে মায়ের দ্বারা সাথে সাথে পরিত্যক্ত হয়েছে, সেটা সম্পর্কে সঠিক কোনাে তথ্য সংগ্রহ করারও সুযােগ হয়নি।
এমতাবস্থায় প্রসবের পরে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপের কোনাে ব্যবস্থাই গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। মাদার্স ক্লাব, শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মাতৃমঙ্গল ও শিশু কল্যাণ। প্রভৃতি কর্মসূচির মাধ্যমে নেয়ার প্রশ্নই ওঠেনি। কাজেই সেগুলি তখন নথির আকারে পাবার প্রশ্নও ওঠে না। কানাডীয় বাবা-মাকে ওদের। জন্ম, পরিত্যক্ত হওয়ার পরিবেশ ও সময়কে বুঝতে হয়েছে। তাদেরকে ভালােভাবে উপলব্ধি করতে হয়েছে যে, কেবল করুণা ও অল্প কয়েকজনের মমতা, দোয়াই ওদের প্রাণে বাঁচিয়েছে। অন্য স্বাভাবিক শিশুর মতাে ওদের বিষয়ে কোনাে ভবিষ্যদ্বাণী দেয়া কারাে পক্ষে ঠিক হবে বলে মনে হয়নি। শিশুদের মা-বাবা কেবল শিশুদের তাৎক্ষণিক প্রয়ােজন বুঝে সে অনুসারে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন। যতটুকু পেরেছেন তারা ততটুকুই করেছেন। তারা। শিশুদের যথাসাধ্য যত্ন নিয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে আসা নবজাত শিশুদের নানা ধরনের প্রয়ােজন ছিল। বাবা-মায়েরা বলেন সাধারণ অসুস্থতা ও অপুষ্টির জন্য রােগা শিশুদের শরীরের যত্ন নেয়ার দিকে তাদের বিশেষ মনােযােগ দিতে হয়েছিল। অপুষ্ট যুদ্ধশিশুদের স্বাস্থ্য ও মঙ্গল বিষয়ে দুশ্চিন্তা করতে বসলে তাদের কেবল বাংলাদেশে যা ঘটেছিল ঐ শিশুদের জন্মের সময়ে, সেসব কথাই মনে হতাে ওদের মায়েদের ওপর যৌন নির্যাতন, যার ফলে তারা ওদের গর্ভে ধারণ করেছিল এসব “অনাকাক্ষিত” শিশুদের চরম অপমান ও গ্লানির মাঝে । দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, তারা সবাই প্রসব করেছিল একান্ত গােপনে। চিকিৎসা বিষয়ক তথ্যের অভাব, তাই বাবা-মায়েদের উক্তষ্ঠাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা অবগত ছিলেন যে, এক্ষেত্রে কেন এবং কীভাবে শিশুর ভবিষ্যৎ চিকিৎসা পর্যন্ত প্রভাবিত হতে পারে কারাে খামখেয়ালি আচরণে। তাছাড়া তারা এও জানেন যে, গর্ভকালে মায়ের শরীরে কোনাে আঘাত লেগে থাকলে, প্রসবকালে কোনাে দুর্ঘটনা ঘটলে, ভাইরাস সংক্রমণের।
কারণ হিসাবে পরিবেশের প্রভাব ইত্যাদি শিশুকে ভবিষ্যতে ভােগাতে পারে এরকম বাবামায়েদের মনে রয়েই গিয়েছিল এটা ভেবে হয়তাে এসব কারণ শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতিকুলতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। সে সময়ে কানাডীয় বাবা-মায়ের মনে রয়েছে কীভাবে তারা বাংলাদেশের তদানীন্তন সুপিরিয়র মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টার ম্যারির সঙ্গে যােগাযােগ করেছিলেন। জন্মদাত্রী। মায়েদের অনুপস্থিতিতে সিস্টার ম্যারিকে বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের মা মনে করা হতাে। শিশুরা কানাডা পেীছাবার আগ পর্যন্ত অবশ্যই ব্যাপারটার আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করা। হয়েছে । কানাডাতে দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েরা শিশু ভবন, অন্যান্য অনাথ আশ্রমে এবং আরও সব যায়গায় যেখানে যুদ্ধশিশুদের রাখা হয়েছিল দত্তক দেয়ার লক্ষ্যে, সেসব প্রতিষ্ঠানে তারা যৎসামান্য উপহারাদি ও নগদ অর্থ দান হিসাবে দিয়েছেন। বাবা-মায়েরা বলেন, তারা নিয়মমাফিক এ ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন বহুদিন পর্যন্ত। যেমনটি আগেই বলেছি, কিছু মাবাবা আরও এগিয়ে যান । বাংলাদেশ থেকে আরও অনাথ শিশু দত্তক নিয়ে আসেন এবং তাদের কানাডীয় বাড়িতে রেখে লালন পালন করেন। আবার অনেক কানাডীয় মা-বাবা কানাডা থেকে শিশু ভবনে নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছেন সেখানের অনাথ শিশুদের খরচের জন্য। বাংলাদেশ সরকার যদিও দত্তকগ্রহণের পর সে বিষয়ে তত্ত্বাবধানের কোনাে দায়িত্ব নেননি, সিস্টার ম্যারি কানাডাতে দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদের প্রথম সপ্তাহগুলিতে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, যখন শিশুদের জীবন বড় ঝুঁকির মুখে ছিল । বাবা-মায়েরা সিস্টার ম্যারির এ দুশ্চিন্তা বুঝতে পেরেছিলেন, যা তিনি ঘন ঘন চিঠি লিখে ব্যক্ত করেছিলেন। প্রথমদিকে তিনি ফ্রেড ও বনি কাপুচিনােকে চিঠি লিখে অনুরােধ করেন, তিনি যে চিঠি সকল দত্তকগ্রাহী বাবামাকে উদ্দেশ্য করে লিখেন, সেটি যেন তারা প্রত্যেককে পাঠান। তারা যেন তাদের শিশুর স্বাস্থ্যের বিশদ বিবরণ পাঠান। ক্যাপুচিনােরা সব মা-বাবার সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর সমস্যাটা কোথায় সেটা ব্যাখ্যা করে সিস্টারকে চিঠি লিখতে বলেন। সিস্টার ম্যারির মনে একটি জরুরি তাগিদ অনুভূত হয় তিনি চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যাদি যেমন- ইনঞ্জেকশন অথবা ওষুধের তালিকা (শিশুর এবং শিশুর জন্মদাত্রী মায়েদের) সংগ্রহের চেষ্টা চালান। বাবামায়েদের সঙ্গে পত্রালাপকালে সিস্টার ম্যারি তাদের মা-বাবার দায়িত্ব নেবার ব্যাপারে কোনাে ধরনের অসুবিধাই টের পাননি অথবা শিশুদের আচরণে প্রত্যাখ্যান, সন্দেহ বা কোনাে ধরনের সংঘাতের লক্ষণ ফুটে উঠতে দেখেননি ।
তুলনামূলকভাবে বলতে গেলে, অল্প কিছুদিনেই, অবিশ্বাস্য সাহস ও অদম্য বিশ্বাসে বাবামায়েরা এ সত্যগুলির সঙ্গে সহবাসে রাজি হন যে, কোনাে কার্যকরি চিকিৎসা বা বংশগতি সংক্রান্ত তথ্যাদি এ ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে না। যদিও কিছু কিছু ধূসর জায়গা ওরকমই রেখে দিয়ে তাদের ওই শিশুদের নিয়ে চলতে হবে, বাঁচতে হবে, তারা তখন বুঝলেন, যুদ্ধশিশুদের যত শীঘ্র সম্ভব বাংলাদেশ থেকে বের করে বাড়িতে (কানাডাতে) নিয়ে তুলতে হবে । ওদের বংশগতির প্রবণতা ও উত্তরাধিকার নিয়ে ভাবনা আপাতত ওপরের তাকে ভােলা রইল।
বাবা-মায়েরা সবমসয়ই মাথায় রেখেছেন যে, ছেলেমেয়েরা যদি কখনাে তাদের পূর্বসূরিদের। খুঁজে বের করতে আগ্রহী হয়, তাহলে তারা অবশ্যই উৎসাহ দেবেন এবং সমর্থন যােগাবেন। তাদের বিশ্বাস ছিল এতে শিশু নিজেকে খুঁজে ফেরার যে নেশা সেটা আরও সুনিশ্চিতভাবে। সহায়ক হবে। শিশুর জন্য বেনামী বা পরিচয়ের আড়ালে থেকে যাওয়া কোনাে কাজের কথা নয়, তারা জানেন, অনেক মা-বাবা এ রকম ভাবেন। এই যুগলদের একটি লক্ষনীয় দিক যে, তাদের সবাই তাদের নিজেদেরকে তাদের সন্তান সন্ততিদের অনুসন্ধানের একটা অংশ হিসাবে গণ্য করেন। তেমন কোনাে ভয় না থাকায় ১৯৮৯ সালে উলসি, মরাল ও গুডস দম্পতিরা তাদের দত্তক নেয়া শিশুদের নিয়ে তাদের মাতৃভুমিতে ভ্রমণ করতে যান। আমরা সপ্তম অধ্যায়ে সে বিষয়ে আরও জানতে পারব। এ কথা তারা মনে রেখেছেন যে, শিশুরা যখন বড় হচ্ছিল তাদের মধ্যে বাবা-মায়েরা কোনােরকম বিরূপতা বা ভয়ের লক্ষণ দেখেননি। তারা তাদের দত্তকায়িত ছেলেমেয়েদের সবসময়ই উৎসাহিত করেছেন বাংলাদেশে তাদের জন্মবৃত্তান্তের বিষয়ে অনুসন্ধানে যেন তারা আগ্রহী হয়। তখন তাদের একবারের জন্যও মনে হয়নি যে, যুদ্ধশিশুদের জন্মদাত্রী মা বা জন্মদাতা বাবা এসে তাদের দাবি করবে তাদের সন্তানকে। তারা অবশ্য জানতেন যে, ঐসব বাবা-মা আজ কোথায় তা করাে জানবার কোনাে উপায়ই নেই।
মা-বাবা ও শিশুদের বন্ধন
১৯৭২ সালের ২০ জুলাই তারিখে সর্বপ্রথম যুদ্ধশিশুদের সঙ্গে তাদের কানাডীয় দত্তকগ্রাহী। বাবা-মায়েদের দেখা হয়। দত্তক নেবার সময় শিশুদের বয়স ছিল বড়জোর কয়েক সপ্তাহ অথবা কয়েক মাস। কিন্তু ঐ অল্প কয়েকদিনেই তাদের ভাগ্যে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে জন্মদাত্রী মায়ের দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়া থেকে শুরু করে সমাজ থেকে অবহেলা আর মুখ ফিরিয়ে নেয়া ভিন্ন আর কিছু জোটেনি। এ কথা স্বীকার্য যে, মুজিব সরকার সতর্কতা অবলম্বন করে যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে সৃজনশীল উদ্যোগ নিয়ে সেটি বাস্তবায়নে মনােযােগ দেন। আমরা প্রথম অধ্যায় দেখেছি কীভাবে নবজাতরা জন্মের পরপরই মৃত্যুবরণ করছিল । যারা বেঁচেছিল নানা প্রতিকুল অবস্থার পরেও, তাদের মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়ন গুরুতরভাবে ব্যাহত হবার আশঙ্কা রয়ে গিয়েছিল । দত্তকগ্রহণের আগেই দত্তকগ্রাহী বাবা-মাকে তাই সাবধান করে দেয়া হয়েছিল যে, এই শিশুর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গড়ে তুলতে তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যা দেখা দিতে পারে। অবহেলা ও সামাজিক নিশ্ৰুপতা থাকলেও যেহেতু শিশুরা শিশু ভবনে অল্পদিন থেকেছিল, তাদের কানাডীয় মা-বাবা ধরে নিয়েছিলেন যে, তারা হয়তাে মৌলিক, শারীরিক ও ভাবাবেগ সম্পর্কিত যত্ন, আদর থেকে পুরােপুরি বঞ্চিত হয়নি। অল্প হলেও নিশ্চয়ই স্নেহ, আদর পেয়েছিল শিশু ভবনে সিস্টারদের কাছ থেকে। তবে এটাও ঠিক যে, বাবা-মায়েদের কিছুটা ভয় ছিল যে সত্যি সত্যিই বাংলাদেশের আশ্রমগুলােতে তারা যদি কোনাে আদর যত্ন না পেয়ে থাকে (এ সম্ভাবনা অবশ্য পুরােপুরি নাকচ করে দেয়া যায় না) তাহলে পরবর্তী সময়ে তাদের কেউ স্নেহ, আদরে আলিঙ্গন করলেও হয়তাে তারা সাড়া দেবে না। বরং এমনও হতে পারে যে তারা শক্ত হয়ে অনড়ভাবে বসে থাকবে। সিস্টার ম্যারি দত্তকগ্রাহী বাবা-মাকে চিঠিতে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, শিশু ভবনে যন্ত্রকারীদের সঙ্গে শিশুদের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল । কিন্তু সত্যি বলতে কি, কানাডাতে মা-বাবা এবং সমাজকর্মীরা একটু সন্দেহের চোখে সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকে দেখেছিলেন। সে যা হােক, সিস্টার ম্যারির কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল যখন। নবজাত যুদ্ধশিশুরা কানাডা আসার পরপরই তাদের শ্বেতকায় মা-বাবার প্রতি খুব সহজাতভাবেই অনুরক্ত হয়ে যায়। এটা তাদের সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, শিশু অবস্থায়ই তাদেরকে দত্তকগ্রহণের জন্য তারা মাতৃক্রোড়ে বড় হবার সুযােগ থেকে বঞ্চিত হয়নি। পেছনে তাকালে, ২০ জুলাই ১৯৭২ তারিখে যখন তারা বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের বুকে। জড়িয়ে ধরেছিলেন,” সে দিনের ছবি তাদের মনের দেয়ালে চিরতরে খােদাই হয়ে আছে । একটি সাধারণ প্রবচন উল্লিখিত হয় যে, প্রত্যেক শিশুই এক বিশেষ শিশু, কারণ সন্তান লালন। পালনে কোনাে একটি নির্দিষ্ট উপায় নেই যা সব মা-বাবা অনুসরণ করবেন। প্রত্যেক দম্পতি।
তাদের নিজস্ব সন্তান বড় করে তােলার ক্ষেত্রগুলাে কাজে লাগান। স্বাভাবিকভাবেই তারা সােজা কোনাে শক্ত রেখা ধরে এগােননি; যখনি শিশু বাধা পেয়েছে, তাকে সম্পূর্ণভাবে সহায়তা, মনােযােগ ও উৎসাহ দিতে এবং তাদেরকে আশ্বস্ত করতে মা-বাবা এগিয়ে। গিয়েছেন নানা ভাবে, নানা জায়গায়, নানা সময়ে। তাদের মনে হয়েছে, মা-বাবার ভূমিকা। পালন একটি সার্বক্ষণিক কাজ, এমন নয় যে উৎসাহ স্তিমিত হলে লালন-পালনের দায়িত্বভার হ্রাস পেয়ে যাবে। নিঃসন্দেহে বাবা-মা হিসাবে তারা তাদের দায়িত্বজ্ঞানে সম্পূর্ণরূপে অবগত ছিলেন। এটাই হলাে মা-বাবা হওয়া এবং মা-বাবার ভূমিকা পালন করে যাওয়ার মূলসুত্র যেটা তারা শুরুতে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন।
অল্প বয়স থেকে তাদের দত্তকায়িত শিশুদের সান্নিধ্যে থাকার ফলে বাবা-মা বিশ্বাস করেন যে, তাদের শিশুরা যে নানা ধরনের কাজে নিজেদের যুক্ত করতে পেরেছে, সেটা শুধু মাত্র তারা দুপক্ষ কাছাকাছি, পাশাপাশি থাকার ফলেই সম্ভব হয়েছে। বাবা-মায়েরা এখনও স্মরণ রেখেছেন কেমন করে তারা তাদের সন্তানের মধ্যে একের দ্বারা অপরকে উৎসাহিত করেছিলেন; কেমন করে স্পর্শ করে হাসিয়েছিলেন, আবার কখনাে বা হাসতে গিয়ে কাঁদিয়েছিলেন। এত বছর অতিবাহিত হলেও তারা ভেলেননি কীভাবে তারা শিশুর সঙ্গে, জড়াজড়ি করেছেন, ছুঁয়েছেন, স্নান করিয়েছেন, গান শুনিয়েছেন একে অন্যকে। অধিকাংশ শিশু খেতে গিয়ে নানা রকম আপত্তি করে, খেতে চায় না। কেউ বারবার সাধলে একটু খায় । কেউ খাবার মুখে নিয়ে ফেলে দেয়। মা-বাবা শিশুকে দোলনায় দুলিয়ে ভুলিয়ে রাখেন। কেমন করে লােশ্যন মাখিয়ে মালিশ করে দিতেন, সুড়সুড়ি দিতেন আনন্দে! কৌতূহলে দুজনেরই মনপ্রাণ ভরে ওঠত । তারা এখনও মনে রেখেছেন আজকের বেড়ে উঠা শিশুরা কত অসুস্থই না ছিল শিশু অবস্থায়। সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে, মা-বাবা কোনাে একটি সুনির্দিষ্ট শিশুর সাথে যখন এভাবে সম্পৃক্ত হন সে ক্ষেত্রে তখন ধরে নেয়া হয় যে তারা একে অপরের স্নেহ-মমতার বন্ধনে আবদ্ধ।” কোনাে কোনাে মা-বাবার এখনও মনে আছে, শিশুদের অঙ্গভঙ্গি দেখে তারা কীভাবে হাসতেন প্রাণ খুলে; কীভাবে যখন তাদের শিশুটি দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠল। বালিশ হাতে উকিঝুঁকি খেলবার সময় শিশু দুর্বোধ্য প্রথম শব্দ একটি দুটি উচ্চারণ করত, কেমন করে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্লক বিল্ডিং, রিং, পুতুল অথবা অন্য খেলনা নিয়ে খেলত । বেশিরভাগ সময় তখন মা-বাবাই শিশুর সঙ্গে থাকতেন যাতে শিশু নিরাপদ থাকে এবং আকস্মিক কিছু না ঘটে। এসব বাবা-মায়েরা “পরিত্যক্ত শিশুদের বাছাই করা এবং সরকারের অনুমতি পেয়ে তাদেরকে কানাডাতে নিয়ে আসার মাঝখানটুকুতে যে একটু সময় পেয়েছিলেন, সে সময়ে রওনা হবার মাঝে যে অনেকদিন সময় পেয়েছিলেন সে সময়ে নানাবিধ প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ততায় দিন কাটিয়েছেন। ডরােথি মরিস তাদের নতুন শিশু জরিনার (পরে যার নামকরণ করেন ল্যারা) কানাড়াতে এসে পৌছানাের কথা জানতে পারেন মাত্র চার দিন আগে। ডরােথির মনস্কামনা পূরণ হতে যাচ্ছে ভেবে উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মেয়ে আসছে। তাদের কোলে, সে উপলক্ষে লিখেছিলেন:
ল্যারা বড় হলে ডরােথি তাকে তার স্বরচিত এ কবিতাটি উপহার দিয়েছিলেন। এর চেয়ে স্বাভাবিক ও সুন্দর বন্ধন আর হয় কীসে? স্বাভাবিকভাবেই কানাডীয় বাবা-মায়েদের ভাষা (ইংরেজি অথবা ফরাসি) এসব দত্তকায়িত শিশুর প্রথম ভাষা হয়েছে (যাকে বলা হয়। মাতৃভাষা)। সাধারণত দেখা যায়, অনেক সময় একটু বড় শিশুরা তাদের মাতৃভাষা শিখে উঠতে পারে না। পরিবর্তে তারা একটা প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা শেখে যা সেটা একটা দুর্বোধ্য ভাষার খিচুড়ি । কানাডীয় বাবা-মায়েদের সৌভাগ্য বলতে হবে, যুদ্ধশিশুদের বেলায় ওরকম বিভ্রাট কিছু ঘটেনি। কারণ তারা স্রেফ শিশু হিসেবেই কানাডা গিয়েছিল। ওদের ইংরেজি এবং ফরাসি শিখতে কোনাে অসুবিধা হয়নি। কারণ তারা কথা বলাটা কানাডাতে তাদের কানাডীয় পরিবারে শিখেছে। নিজেদের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতে বাবা-মায়ের এ মত প্রকাশ করেন যে, মা-বাবা ও শিশুর মধ্যে লালন পালন প্রক্রিয়াটি শিশুকে দেয়নিরাপত্তার চেতনা, স্থিরতা, উষ্ণতা, ভালােবাসা এবং সন্তানােচিত আদর। তাদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তারা উল্লেখ করেন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলার স্মৃতি, আমােদ, প্রমােদের স্মৃতি এবং শিক্ষামূলক কাজকর্ম, যেমন- চার্চ কয়ার, বাউলিং লিগ, পার্টি, কনসার্ট ইত্যাদি যেগুলাে দিয়েছে তাদের পারিবারিক জীবনে সব সদস্যের জন্য অপার আনন্দের যােগান । আবার কোনাে কোনাে মাবাবা মনে রেখেছেন শিশুর বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতে নানা গ্রুপের সঙ্গে, যেমন- স্কাউট, গার্ল গাইড, ওয়াই এম সি এ/ওয়াই ডব্লিউ সি এ ইত্যাদির সাথে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ এও মনে রেখেছেন, শিশুরা যখন বড় হচ্ছিল, তারা কীভাবে পরিবারকে সামাজিক কাজকর্মে সাহায্য করত আর আস্তে আস্তে তারা নিজেরাও ক্রমশ পরিপক্ক হয়ে উঠেছিল আচারআচরণে ও সামাজিক দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে। মা ও শিশুর বাঁধন যা বাবা-মায়েরা বর্ণনা করেছেন, সেগুলােও শিশু চিকিৎসকরা যেভাবে মন্তব্য করেছেন আগাগােড়া, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বটে।
ছােট থেকে বড় হতে শিশু ক্রমশ স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরশীলতার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে কিন্তু তাকে পুষ্টি ও যত্নের জন্য মায়ের উপর নির্ভর করতে হয় অনেকখানি। এ প্রাসঙ্গিক দিকটি সম্প্রসারণ করতে গিয়ে কোনাে কোনাে মা বলেছেন যে, এটি রীতিমতাে দ্বিমুখী ও পরস্পর ক্রিয়াশীল প্রক্রিয়া, যেখানে শিশুর শৈশবে মা ও শিশু উভয়ে উভয়ের উন্নয়ন ও সুখী জীবনের জন্য ভূমিকা পালন করে থাকে। জন্মদাত্রী মাদের দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়ায় অপুষ্টিতে আক্রান্ত ও প্রাণ হারানাের মতাে মর্মান্তিক ঘটনা বেশিরভাগ যুদ্ধশিশুদেরই ঘটেছিল। কানাডাতে পৌঁছানাের পর তাদের জীবনে নবায়ন ঘটেছিল সেটাই সত্যি। কানাডাতে এসব শিশুরা কখনাে স্নেহ ও ভালােবাসার অভাববােধ করেনি।
রে এবং এলিজাবেথ মৌলিং চার দত্তক সন্তানের বাবা-মা, যাদের মধ্যে যুদ্ধশিশু অনিলও রয়েছে। এলিজাবেথের ভাষ্য অনুযায়ী, “অনাথ আশ্রমের কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা যতই থাক, যত্ন যেখানে যতই দেয়া হােক, সেখানে একটি পরিবারের মা ও শিশু অথবা বাবা ও শিশুর মাঝে যে সরাসরি সম্পর্ক তৈরির পরিস্থিতি, সেটা অন্য কোথাও সম্ভব হয় না” ।” “একটি শিশুর পক্ষে জীবনে সফল হতে হলে, এলিজাবেথ বলেন, “তার কমপক্ষে একজন প্রাপ্তবয়স্ক যত্নকারী থাকবেন যিনি তার সার্বক্ষণিক দেখাশােনা এবং ইতিবাচক মঙ্গলময়তা নিশ্চিত করবেন। তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে তিনি বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলেছিলেন যে “এমন অনেক গবেষণা হয়েছে, যেখানে দেখানাে হয়েছে যে, এ ধরনের অল্প বয়সের সম্পর্ক শিশুর বড় হওয়ার প্রক্রিয়াকে সাহায্য করে, ক্রমশ শিশু ভাবাবেগের কৌশলী নিয়ন্ত্রক, স্বাস্থ্যপ্রদ ও ভারসাম্যে ভরপুর ব্যক্তিরূপে বিকাশ লাভ করে।” ভিয়েতনাম, কোরিয়া, ভারত অথবা বাংলাদেশ থেকে নেয়া তাদের সন্তানদের নমনীয়তা ও দৃঢ়তার প্রশংসা করে এলিজাবেথ বলেন, দেখা যায় অনেক সময় ডাক্তাররা দ্রুত এক নজর ছেলেমেয়েদের দেখার পর এরকম মন্তব্য করেছেন: “এ শিশুটি এত গভীরভাবে আঘাত পেয়েছে যে একে কখনই দত্তক নেয়া ঠিক হয়নি। অথচ ৬ মাস কি ১ বছর পর ঐ শিশুকে চমৎকার উন্নতি করতে দেখা গিয়েছে। চার জন দত্তক সন্তানের মা হিসাবে এলিজাবেথ এটা ঠিকই বুঝেছিলেন যেঃ “একবার যদি শিশু বােঝে যে সে আবেগে নিরাপদ, মানুষ তাকে ভালােবাসে, তার সঙ্গে খেলে, তার কষ্ট দূর করে আরাম দেয়, তখন সে বিকশিত হয়নির্দ্বিধায়, আশ্চর্য ফুলের মতাে সৌন্দর্যে, সুগন্ধে।” ১৭ এলিজাবেথ বলেন তাদের বড় দুসন্তান নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে, পরিবারের স্নেহ, আদরের ভাগ দিতে ইচ্ছুক নয় । কিন্তু তারা মনে করেন যে, এটা ঘটেছে তাদের দত্তক নেবার বিষয়ে কোনাে প্রশ্নের কারণে, হয়তাে বা ওরা Adopted Child syndrome (ACS)-এ ভুগছে। বয়ঃসন্ধির আগে অনিল যাতে একই রকম না করে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য তারা অনিলের দত্তক বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। আসলে সব মা-বাবার জন্যই বয়ঃসন্ধি গুরুত্বপূর্ণ সময় (সাধারণত ইতিবাচক) এবং যুদ্ধশিশু ও তাদের দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদের জন্যও এটি বিশেষ লক্ষণীয়। আবার রাণীর দত্তকগ্রাহী বাবা-মা রবিন ও বারবারা মরাল তাদের স্মৃতিচারণে বলেন তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ঠিক এরকম নয়। এমন প্রচুর প্রমাণ দেবার মতাে আছে যে, মা-বাবার সঙ্গে রাণীর সম্পর্ক অত্যন্ত প্রবল ও দৃঢ় । কিন্তু শীঘ্রই তার মা-বাবার সঙ্গে গভীর সম্পর্কে একসময় ফাটল ধরে। সে বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিনিয়তই ভাবতে লাগে যে, জন্মের পর যেহেতু সে পরিত্যক্ত হয়েছিল, তাকে হয়তােবা আবারও পরিত্যাগ করা হবে। দুশ্চিন্তা করতে করতে চরমে পৌছলে, অন্যেরা যেমন করে, অন্যের ত্যাগ করার আগে সে নিজেই বাবামাকে ত্যাগ করতে চেয়েছিল। অন্য কথায়, মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে রানী আত্মহত্যা করে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা যে, যুদ্ধশিশুদের মধ্যে আর কেউ এরকমটি করেনি। কেবল রানী তার অচেনা কখনও-না-দেখা জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে এক কাল্পনিক সম্পর্ক তৈরি করেছিল মনে হয়।
পঞ্চম অধ্যায়ে রানীর একক পরিচিতিতে আমরা তার আধিক্লিষ্টতার আংশিক পরিচয় পেয়েছি । পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা রানীর আধিব্যাধির গভীরতর অনুসন্ধান চালাব । যারা বাংলাদেশ প্রকল্প-এর প্রবক্তা তারা বাংলাদেশ থেকে ১৫ টি যুদ্ধশিশুকে কানাডাতে। দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবার কাছে পৌঁছানাের উদ্দেশ্যে নিজেরাই গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। সে। সময়ের স্মৃতিচারণে তারা বলেন তাদের সে মিশনটি স্বাস্থ্যহীন ও দুর্বল শিশুদের জন্য সঙ্কটময় হলেও বলা যেতে পারে যে সেটা ছিল সফলতার একটি উল্লেখযােগ্য দৃষ্টান্ত। গবেষণায় জানা গিয়েছে, দত্তকগ্রাহী মা-বাবার এ সম্পর্ক বা বন্ধন জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবা থেকে আলাদা ধরনের হয়ে থাকে । ফ্রেড সে পার্থক্যকে বর্ণনা করেন এভাবে, গর্ভিনী মা। তার শিশুকে গর্ভকালের সম্পূর্ণ সময় গর্ভে ধারণ করলে শিশুটি ঐ নারীর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। পুরুষের বেলায়, সে তার ঐ নয় মাস সময় পিতৃত্বের ভূমিকা পালনের জন্য তৈরি হয়। এ রকম তর্ক উঠেছে যে, দত্তকগ্রাহী বাবা-মা জৈব বন্ধন কী সেটার কিছুই। বােঝেন না বা সে অভিজ্ঞতা লাভের সুযােগ তাদের ঘটে না; বিশেষ করে নারীর সে। অভিজ্ঞতা হয় না, বলা হয় । সে যা হােক, ফ্রেড এ প্রসঙ্গে বলেন, অন্ততঃপক্ষে যুদ্ধশিশুদের ক্ষেত্রে, সাধারণ দত্তক প্রক্রিয়ার তুলনায় এ শিশুদের দত্তক নেবার প্রচেষ্টা, একে ঘিরে যে অনিশ্চয়তা এবং ব্যক্তিগত ত্যাগ ও ধৈর্য্যের পরীক্ষায় একে একে উত্তীর্ণ বাবা-মা দত্তকায়িত শিশুদের অনেক নিকটে এসে পড়েছিলেন। টরন্টো ও মন্ট্রিয়লে বিমানবন্দরে সেদিন অনেকেই সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে দুফোটা অশ্রু উত্সর্গ করেছিলেন শুধু সে কৃতজ্ঞতায় যে তিনি তাদের শেষ পর্যন্ত পুরস্কৃত করলেন। ক্যাপুচিনােরা বিশ্বাস করেন বাড়িতে ২১ টি সন্তান (যাদের মধ্যে দুটি ঔরসজাত সন্তান) লালন পালনের সুযােগ থাকায় তারা অনেক কিছু শেখার সুযােগ পেয়েছিলেন। নিজেদের শিশুকে সব রকমের ভালােমন্দের ভেতর দিয়ে ভালােবাসতে ও বড় হয়ে গড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছে। তাদের অর্থাৎ সে ক্যাপুচিনাে অথবা অন্য যে কেউ হােক, দত্তক নেয়ার অর্থ হলাে শিশুকে পরিবারের একজন পূর্ণাঙ্গ সদস্যরূপে গ্রহণ করা যে অতীতে তাদের সন্তান ছিল, ভবিষ্যতেও তাদের সন্তান থাকবে।
শিশুদের বড় করে তােলার প্রক্রিয়ায় এসব মা-বাবা প্রত্যেক শিশুর প্রয়ােজনের কথা মনে রাখেন এবং সেসব প্রয়ােজনীয়তা পূরণ করতে এখােন, প্রত্যেক শিশুর সঙ্গে একক সম্পর্ক গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে। সাক্ষাঙ্কারের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, বাবা-মায়েরা। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করেছেন একান্ত স্বাভাবিক উপায়ে । তারা সেটা সম্পন্ন করেছেন নৈকট্য বজায় রেখে, আনুগত্য প্রমাণ করে, অন্তরঙ্গতা সপ্রমাণ করে, স্ব স্ব আধিপত্য ও সীমা মেনে নিয়ে। এসব মিলিয়ে প্রক্রিয়াটি সন্তানদের সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্ক। তৈরিতে সহায়তা করেছে। তাই অপত্যনির্বিশেষে ভাইবােনদের সঙ্গে যেমন করে গড়ে উঠেছে গভীর সম্পর্ক, তেমন প্রগাঢ় তাদের পিতৃমাতৃভক্তি। দত্তকগ্রাহী এসব বাবা-মায়েরা তাদের জীবনভর একটি দায়িত্ব পালন করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। তাদের মধ্যে অনেকেই এরকম কথা বলেছেন, যখন একটি শিশুর জীবন মরণের প্রশ্ন নিয়ে সকলে চারদিকে দৌড়াতে থাকেন, তখন তাদের মনে হয় যেন তাদেরও প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে । যতক্ষণ না শিশু বিপদ উত্তীর্ণ হয়ে নির্বিঘ্নে বিশ্রামে যেতে পারবে। তারাও অস্থির হয়ে থাকেন। গর্ভমােচনের আনন্দ তারা তখনই লাভ করেন যখন শিশু অক্ষত শরীরে নিরাপদে একটি পরিবারের মাঝে একটি বিপদমুক্ত বাড়িতে আশ্রয় পায় । দত্তক বিষয়ক গবেষণামূলক লেখা থেকে জানা যায়, দত্তকগ্রাহী মা-বাবার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলাে, দত্তক নেয়া শিশুর বাড়িতে আগমনের পর তাদের আর কোনাে “বিষাদ আক্রান্ত দিনরাত” থাকে না। কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে, এসব দত্তকগ্রাহী মা-বাবার ভাষ্য অনুযায়ী দত্তকায়িত শিশুর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক শিশু আসার অনেক আগে থেকেই তৈরি হতে শুরু হয়েছিল । একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এসব শিশুকে যারা দত্তক নেন তাকে কাছে পাবার অনেক আগে থেকেই তারা শিশুর অভাবজনিত বেদনা এবং আনন্দ দুই পেয়েছিলেন। “নানাভাবে,” বলেন ডরিন গুড, যুদ্ধশিশু রায়ানের দত্তকগ্রাহী মা, “সন্তান প্রসবের মতােই, দত্তক প্রক্রিয়া সফল হলাে অনেক বেদনার মাঝে যা হতাশা, সন্দেহ, উল্কণ্ঠা এবং নিজেকে নিজে নানা প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে।”৫ স্নেহশীলা ডরিন মাতৃত্বকে দেখেন “শিশুর জন্য উৎকণ্ঠায়, অপেক্ষায় থাকা জৈব প্রক্রিয়ায় শিশুর জন্ম দেয়ার বিপরীতে।”* গুডসদের জন্য, দত্তক নেবার প্রক্রিয়া হলাে একটি অনাথ ও অসহায় শিশুকে নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করা যার সম্পর্কে গ্রহীতার তেমন কিছু জানা নেই। শুধু এটুকুই জানতেন যে বাংলাদেশে পুষ্টিহীনতার অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ, সে দেশের অধিকাংশ শিশু কিশাের, কিশােরী এবং সন্তানসম্ভবা নারী সাধারণত চরম পুষ্টিহীনতার শিকার।
মনখােলা আলাপের সময় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েরা বলেন শৈশবাবস্থা থেকে তাদের ছেলেমেয়েরা যে সব শ্বেতকায় বাবা-মাকে দেখে আসছে, তাদেরকেই তারা তাদের বাবা-মা হিসাবে মনেপ্রাণে গণ্য করে আসছে। সেজন্য তাদের ভিন্ন জন্মের ইতিহাস বা জন্মদাতা বাবা ও জন্মদাত্রী মা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার কোনাে অবকাশই ছিল না। কোনাে কোনাে যুদ্ধশিশু অনেক সময় ভেবেছে যে, তাদের বাবা-মায়েরা তাদের বিশেষ শিশু হিসাবে গণ্য করতেন । ডনা উলসি’র সঙ্গে তার যে কথাবার্তা হতাে সেটা মনে করে তার দত্তকায়িত মেয়ে আমিনা খুব সুন্দরভাবে উদাহরণ হিসাবে ব্যক্ত করেঃ “মমের সঙ্গে গাড়িতে বাড়ি আসার পথে মমকে বলছিলাম, আমি নিশ্চয়ই খুব স্পেশাল, কারণ আমার জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে।”১৭ ডনা উত্তর দিয়েছিলেন, “না, তুমি বিশেষ মেয়ে, কারণ তুমি দয়ালু, চিন্তাশীল, সৎ ও মিষ্টি মেয়ে । ঐ সব মিলিয়ে তুমি বিশেষ। ওগুলাে তােমার অন্তরের ঐশ্বর্য। সময় কাটতে লাগে, দম্পতিরা উপলব্ধি করতে শুরু করেন কেমন করে আস্তে আস্তে বাবা-মা ও সন্তানের সম্পর্ক অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠে। দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েরা মনে করেন যে তাদের ছেলেমেয়ের বয়ঃসন্ধিকালে কিছু কিছু বিষয়ে জানতে পারলেও অনেকে অনেক সময় লুকিয়ে বেড়ায়। অধিকাংশ মা-বাবার মতাে তারাও জানত, মা-বাবার বংশানুগতিক নির্মাণ, গর্ভধারণকালে মায়েদের স্বাস্থ্য এবং গর্ভধারণকালের শুরুতে মায়ের যা ঘটে তার ফলে গর্ভস্থ শিশুর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার ওপর চাপ। পড়ে। এ ধরনের দুঃশ্চিন্তা করার পর স্বভাবতই তারা স্মরণে রেখেছেন তাদের বাংলাদেশি শিশুর বয়ঃসন্ধিকালের কথা। তাদের জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাব সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব ছিল, যেমন- উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া রােগবিস্তারী এবং বংশানুগতি সম্বন্ধীয় উপাদান। অধিকাংশ বাবা-মা বলেন যে, সােস্যাল সার্ভিস এজেন্সি অথবা দত্তক সংস্থার লােকজনের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ যােগাযােগ ঘটেছে, যখন তাদের সন্তানেরা বড় হয়ে উঠছিল। বিশেষ করে দত্তক নেয়া শিশুরা বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতে যে ধরনের অনুভূতি বা চিন্তাভাবনার কথা বলে, তাদের পারিবারিক চিকিৎসক যে নিয়মিত ভিত্তিতে ভৎসনা করতেন এবং পরিত্যাগ করার বিষয়ে তাদের উপদেশ দিয়ে যেসব সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন সেসব খুব কার্যকর হয়েছিল ।
সবার প্রতি উদারতা ও অনুভূতিশীল বাবা-মায়েরা তাদের মূল্যবােধের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে নিজেদের সন্তান লালনের নীতিমালা অনুসারে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা শিখেছিলেন। সে জন্য সব মা-বাবা ডাক্তারদের সাবধানবাণী সম্পর্কে সচেতন ছিলেন; শিশুরা যেন কোনােক্রমেই মা-বাবার নিকট থেকে কোনাে ধরনের অবহেলা না পায়। এ কারণে তারা সবসময়ই তাদের সন্তানদের দিকে সচেতন দৃষ্টি রেখেছেন। প্রাপ্ত বয়স্ক কোনাে দায়িত্বশীল ব্যক্তির তত্ত্বাবধানের বাইরে শিশুকে বড় হতে দিলে তার নানাবিধ সমস্যা অচিরে দেখা দেয় । মা-বাবা যে বন্ধনের কথা উল্লেখ করেছেন তার দ্বারা প্রেম, ভালােবাসা, আদর, বিশ্বাস, ভরসা এবং খােলাখুলি কথাবার্তা সবই বােঝানাে হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, এটা যে শিশুরা শুরু থেকে সব রকমের আরাম, নিরাপত্তা, বাবা-মায়ের আদর ও ভাইবােনের ভালােবাসা পেয়েছে। তারা এটা জেনেই বড় হয়েছে যে, সবাই তাদেরকে চেয়েছে যার জন্য দত্তকগ্রাহী মা-বাবা তাদের সাধ্যানুযায়ী শিক্ষা ও অন্যান্য সুযােগ সুবিধা দিয়েছেন। যার ফলে এসব যুদ্ধশিশু কখনাে নিজেদের পিতৃমাতৃহীন হিসাবে দেখেনি। জাতিগত পার্থক্যের কারণে দত্তক নেয়া একটি শিশুকে কতটুকু দত্তক হিসাবে দেখাতে হবে। সেটা শ্বেতকায় বাবা-মায়ের জন্য কোনাে ইস্যু ছিল না। কেউ কখনাে এরকম ভান করেননি। যে, তারা শিশুর জন্মদাতা বাবা জন্মদাত্রী মা । তাদের সন্তানদের নিকট খােলাখুলি তাদের দত্তক নেবার ইতিহাস ও ভূগােল বিষয়ে জানিয়েছেন। মা-বাবা হওয়ার ব্যাপারে তারা যেটা বলার চেষ্টা করেছেন সেটা অনেকটা এরকমঃ জন্ম দেয়া এক ব্যাপার এবং মা-বাবার ভূমিকা পালন করা অন্য ব্যাপার । গবেষক জয়েস ল্যাড়নার, যিনি মা-বাবার ভূমিকা বিষয়ে কাজ করছেন, এ পার্থক্যকে জৈব ও সমাজতাত্ত্বিক মা-বাবার মধ্যে যে পার্থক্য বিদ্যমান তাই বলেছেন। এখানে পরিবারবিষয়ক গবেষকা সমাজতাত্বিক মা-বাবার ভূমিকাকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। কানাডীয় বাবা-মায়েদের পােষ্য ছেলেমেয়েদের প্রতি অপত্য স্নেহ তাদেরকে আন্তবর্ণীয় দত্তকগ্রহণের বিষয়ে গভীর আগ্রহ যােগায়। এ বিষয়ে তারা যথেষ্ট পড়াশােনা। করেন এবং নানা রকমের গুরুতর প্রশ্নের জটিলতা সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব অবগত হয়েছেন।
বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের নিকট যে বিষয়টি জোর দিয়ে উপস্থাপন করেছেন, সেটি ছিল, সম্পর্ককে মজবুত করার জন্য শিশু ও তার মা-বাবার মধ্যেকার পার্থক্যকে বড় করে দেখতে হবে, বুঝতে হবে যাতে একজন অপরের জাতি ও গােষ্ঠীর চিহ্ন এবং পরিচিতি নিয়ে কোনাে বিভ্রান্তিতে না পড়ে। সবাই এক বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে একে অন্যের সঙ্গে মিশেছিল এমনভাবে যে তাদের প্রত্যেকেরই দত্তক সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল । সে জন্য প্রত্যেকে নিজের সম্পর্কে পরিচ্ছন্নভাবে দেখতে, ভাবতে ও চিনতে পারে। শুধু তাই নয়, পােষ্যরা আন্তবর্ণীয় দত্তক সম্পর্কেও জানতে পারে তাদের শ্বেতকায় বাবা-মা ও নানাবর্ণীয় ভাইবােন সম্পর্কে । সন্দেহাতীতভাবে বাস্তব ও গঠনমূলক সম্পর্ক স্থাপনে তারা সফল হয়। তাই আত্মসম্মানের ঘাটতি কোথাও পড়েনি। পেছনে তাকালে মনে হয়, বাবা-মায়েরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন যে, এ ধরনের ভাবনা বাবা-মা শিশুর বাঁধনকে শেষ পর্যন্ত আরও শক্ত করেছে বৈকি! এর কিছু অংশ আমরা ইতােমধ্যে পঞ্চম অধ্যায়ে দত্তকগ্রাহীতা ও পােষ্য শিশুর জীবনালেখ্য অংশে দেখতে পেয়েছি। পরের অধ্যায়েও (সপ্তম অধ্যায়) আমরা শিশুদের নিজ নিজ বর্ণনা পড়ব । বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে যুদ্ধশিশুরা বলে, তারা তাদের মা-বাবার নিকট কৃতজ্ঞ শুধুমাত্র এ কারণে যে, দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েরা কানাডাতে তাদের শিশু হিসাবে বুকে জড়িয়ে ধরে আপন করেনিয়েছিলেন। একটু বড় হয়ে তারা জানতে পারে তাদের জন্মবৃত্তান্ত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ের গণহত্যা, অগ্নিকান্ড আর নারী নির্যাতন। তারা এও জানতে পারে কেমন করে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ধর্ষণকারীদের হাতে তাদের জন্মদাত্রী মারা হয়েছিলেন ধর্ষণের শিকার । কৈশরে পা দিতে না দিতেই তাদের জন্মের ইতিহাসের আরেকটি বিষয়ে তারা অবগত হলাে-তাদের জন্ম বলাৎকারের ফলশ্রুতিতে। আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে দেখেছি একজন সমাজকর্মী হিসাবে ডনা উলসি কেমন করে তার হৃদয়, মন, দূরদৃষ্টি, দর্শন ও কর্ম মানবতার সেবায় নিয়ােগ করেছিলেন।
সে নিবেদন কানাডার সীমানা পেরিয়ে পরিবারের সংজ্ঞা নিরূপণ করেছে এমন এক সময়ে যখন আন্তর্জাতিক দত্তক নেয়ার বিষয় কানাডাতে ততটা জনপ্রিয় হয়নি। দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদের সকলেই তাদের শিশুদের কাছ থেকে যে ভালােবাসা, শ্রদ্ধা এবং সর্বোপরি পারিবারিক বাঁধন উপহার পেয়েছেন সে কথা তারা উষ্ণ আবেগেরভরে স্বীকার করেন । উদার দিগন্তের এ সব বাবা-মায়ের সাথে একান্তে আলাপ না হলে হয়তাে কখনাে ছেলেমেয়েদরকে ঘিরে তাদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনের বিশেষ দিকটি উন্মোচিত হতাে না। তাদের সাথে আলাপ হলে কোনােদিনও জানা যেতনা একে অন্যের প্রতি তাদের মমত্ববােধ, তাদের অনভিব্যক্ত অনুভূতির কথা, তাদের নীবিড় সম্পর্কের কথা ।
দত্তক পরিবার নেটওয়ার্ক এবং সাপোের্ট গ্রুপ, অন্টেরিও
১৯৭২ এর গ্রীষ্মকালে প্রথম যুদ্ধশিশুর দল বাংলাদেশ থেকে কানাডাতে এসে পৌছাবার। কয়েক মাসের মধ্যে ডনা ও ডেল উলসি ক্যানাডপ্ট নামে একটি সমর্থনকারী গ্রুপ গড়ে তােলেন। উলসিরা বুঝতে পেরেছিলেন মা-বাবা এবং শিশু উভয়ের জন্য এরকম সংস্থার প্রয়ােজন রয়েছে। উলসিদের জন্য একটি বড় চিন্তার বিষয় ছিল তাদের দুজনের মধ্যে কারাে যেহেতু দত্তক ও আন্তবর্ণীয় শিশু নিয়ে কাজ করার কোনাে অভিজ্ঞতা নেই, দত্তকগ্রাহী বাবামায়ের জন্য এটা একটি সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে। ডনার ভাষ্যমতে সার্পেটি গ্রুপ তৈরি করা হয়েছিল বর্ধিত পরিবারের একে অন্যকে সাহায্য করার জন্য; আন্তবর্ণীয় দত্তক নেয়া দম্পতিদের মধ্যে সম্পৃক্ততা গড়নের জন্য। একে অন্যের সঙ্গে যােগাযােগ বাড়ানাের জন্য । আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক নেয়ায় যাতে বাধা না দেয় কেউ, সে জন্য সরকারি লাল ফিতার সঙ্গে লড়াই করার জন্যও এ নেটওয়াকের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বটে।” মূল গ্রুপটি ছিল সাত সদস্যের প্রথম কবছর কেবল উলসি (ডেল ও ডনা), গুড (ডেইল ও ডরিন), ফেরি। (রবার্ট ও হেলকে), বুনস্ট্রা (টোনি ও বনি), মরিস (জন ও ডরােথি), রশফোর (ফিল ও ডায়ান) সবাই অন্টেরিওর এবং মরাল দম্পতি (রবিন ও বারবারা) সাসকাচিউয়ান-এর। ওরাই ছিল নিয়মিত যােগাযােগ রক্ষাকারী । আস্তে আস্তে ক্যানাডপ্ট অনেক বিস্তৃতি লাভ করে। আজ পর্যন্ত ডনা এ গ্রুপটির দায়িত্বে রয়েছেন। কানাডা জুড়ে দম্পতিদের জন্য এটা এক সম্পদে পরিণত হয়। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে যে, ক্যানাডপ্ট-এর মাধ্যমে বিদেশ থেকে দত্তক আনা শিশুদের প্রতি সমর্থন যােগানাের জন্য একটি অর্থবহ সিস্টেম চালু করা হয়। ডনা বিশ্বাস করতেন তাদের চতুর্দিকের জনগােষ্ঠীর আচারআচরণ স্বাভাবিকীকরণের দিকে কাজ করে যেতে হবে । দেখতে দেখতে কানাডা একসময় একটা মঞ্চে পরিণত হয় যেখান থেকে ভবিষ্যতের দম্পতিরা সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তকের পক্ষে লবি করে দত্তকের সমর্থনে জনমত তৈরি করতে সহায়তা করেন। প্রথম বছর অতিক্রান্ত না হতেই এখান থেকে জনসাধারণকে আন্তর্জাতিক দত্তক নেবার বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করেন। “বাংলাদেশি অনাথ। অন্টেরিওর বাড়িতে হাসিখুশির মধ্যে বড় হচ্ছে, স্থানীয় The London Free Press খবরটি এভাবে ছাপিয়েছিল। উলসিদের এগিয়ে আসাকে অভিনন্দন জানিয়ে স্থানীয় সংবাদ। মাধ্যমে তুলে ধরে তাদের জীবনের একটি বিশেষ দিক। প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য ছিল অনাদৃত, উপেক্ষিত ও সহায়হীন শিশুদের নিয়ে মায়ার বন্ধনে তাদের পরিবার গঠনে কানাডীয়। দম্পতিদের উৎসাহিত করা।
শুধু তাই নয়, প্রতিবেদনটিতে আরও ইঙ্গিত দেয়া হয় আন্তজাতিক দত্তক প্রক্রিয়া কানাডাতে আরও সুসার করার লক্ষ্যে মনস্তত্ত্ববিদ, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী এবং দত্তকগ্রাহী বাবা-মাকে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। উনার নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে ক্যানাডপ্ট ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ কিছু পরিবারের দলে পরিণত হয়। যেখানে বাংলাদেশ থেকে অন্তত একজন শিশুকে দত্তক আনা হয়েছিল (যদিও সে যুদ্ধশিশু ছিল না)। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেকেই বলেন, তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রায়ই একত্রিত হতেন, কুশল বিনিময়ের উদ্দেশ্যে কে কেমন আছে জানার জন্য এবং নিজ নিজ অভিজ্ঞতা। নিয়ে গ্রুপ সদস্যদের সঙ্গে আলাপের জন্য। আমাদের বাড়িতে আপনাদের সবাইকে পাওয়া পরম আনন্দের ব্যাপার ছিল, আপনাদের শিশুরা আরও মােটাসােটা হয়েছে, ওদের চেঁচানি শুনে আনন্দ পেলাম অনাবিল। ওদের ঠিকমত ডায়াপার বদল হচ্ছে দেখেও ভালাে লাগল।”২২ লিখেন হেলকে ফেরি আগস্ট ১৯৭২-এ তাদের ১ম সভা অনুষ্ঠানের পর অন্যান্য ক্যানাডপ্ট সদস্যদের, যারা একটি করে বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু দত্তক নিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, হেলকে নিজেও দুটো যুদ্ধশিশু দত্তক নিয়েছিলেন। ক্যানাডপ্ট যেসব অনুষ্ঠানের আয়ােজন করত, তার মধ্যে ছিল পটলাক ডিনার, গেট টুগেদার, অনানুষ্ঠানিক আলােচনা, পার্টি, একদিনের ক্যাম্প, পারিবারিক ক্যাম্প এবং নানারকম মনােরঞ্জনকারী বিনােদন ও খেলাধুলার অনুষ্ঠান যাতে মা-বাবা এবং তাদের শিশুরা আগ্রহ নিয়ে অংশগ্রহণ করতেন । অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে ছিল বক্তাদের আমন্ত্রণ, দত্তক বিষয়ে আরও জানার জন্য সমাজকর্মী, বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানাে । মােট কথা, দত্তক সংক্রান্ত বিষয়ে আরও জানার জন্য অংশগ্রহণের মাধ্যমে আনন্দ অনুষ্ঠান উদযাপন । এগুলাে সমমনা মানুষদের নেতৃত্বে হত, ঠিক পেশাজীবীদের নেতৃত্বে নয়, এরা একে অপরকে সহায়তায় বিশ্বাস করত, নিজ নিজ উদ্ভাবন, তত্ত্বতালাশ ও কৌশলাদি নিয়ে একে অন্যকে সহায়তা করত । আশ্চর্য হবার কিছু নেই, একে অন্যকে সাহায্য করার মাধ্যমে আবিষ্কার করে তারা। অবাক হতেন যে, এ প্রক্রিয়ায় আস্তে আস্তে তারা প্রত্যেকে নিজেরাই তথ্যের এক এক বিশাল ভান্ডারি হয়ে উঠেছিলেন । “এখানে এলে ভালােভাবে দেখা যাবে, বােঝা যাবে, পরিবারেরা কেমন মেলামেশা করছে ভাই আর বােনে আন্তঃসম্পর্ক কী রকম, মা আর বাবারা কী স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলছেন তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। অবিশ্বাস্য বাঁধন সব পরিবারের মধ্যে কাজ করছে দেখুন, পরিবারের মধ্যে কী সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে,” বলেন ডেল । নেটওয়ার্ক থাকাতে সবাই কম বেশি। সমর্থন পেয়েছিলেন।
যে কোনাে প্রশ্ন কারাে মনে উকি দিলেই সেটা মুক্ত মনে জিজ্ঞাসা করার সুযােগ ছিল। অনিশ্চয়তা না লুকিয়ে কেউ সেটা এখানে উদ্বেগের চেহারায় প্রকাশ করেছেন। সেটা আর দশজনের সাথে ভাগ করেনিয়ে বিষয়টিকে সবার দৃষ্টিগােচরে এনে কিছুটা উপদেশ পাওয়া। সময় এগুতে থাকে, আনুষ্ঠানিক ও অধিকাংশ অনানুষ্ঠানিক পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে দত্তকগ্রাহী দম্পতিরা একত্রিত হতেন সমবেত অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে একে অন্যকে সহায়তা যােগাতে । ক্যানাডপ্ট স্বেচ্ছাসেবকেরা ক্রমশ দত্তক নেয়া শিশু ও বাবা-মাকে সুযােগ সুবিধা তৈরি করে দিতেন যাতে তারা পরস্পরকে সবসময় সহায়তা যােগাতে পারেন; অভিজ্ঞতা ভাগ করেনিতে পারেন এবং আশা ও অনুভূতির পাখায় ভর করে উড়াল দিতে পারেন । শিশুরা যখন ক্রমে। বয়স্ক হতে লাগল, ক্যানাড়প্টের ফোকাসও তখন বদলাতে লাগল । ডরিন গুড (রায়ানের মা) তার স্মৃতিচারণে বলেন, দুঃখের বিষয় ছেলেমেয়েরা যখন একটু বড় হতে লাগে ১৯৮০ দশকের মাঝামাঝিতে ভিন্ন বর্ণীয় সভাসমিতি এবং সামাজিক অনুষ্ঠানাদিসহ তাদের সন্তানেরা যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করতে শুরু করেন। সে সময়ে মা-বাবা হিসাবে সবাই তাদের ছেলেমেয়েদের মিশতে দিয়েছেন অন্যবর্ণীয় ছেলেমেয়েদের সাথে কোনাে ধরনের মনােভাব সংবরণ না করেই  প্রায় ৩০ বছর আগের সময়টুকু স্মরণ করে ডরিন কথাগুলাে বলেন। আজকে ৪০ বছর পর, ক্যানাডপ্ট এখন সারা দেশে ৬০০ সদস্যের বেশিসংখ্যক সদস্য নিয়ে কাজ করছে। এখনও ওরা প্রতি বছর পটলাক ডিনার করেন, শত শত শিশুকে কানাডীয় জাতিবর্ণ নির্বিশেষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেশার ও সম্পর্ক গড়ে তােলার ক্ষেত্রে সহায়তা যােগান। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আজও ডনা নিষ্ঠার সাথে ক্যানাডণ্টের নেতৃত্বে দিয়ে যাচ্ছেন। সত্যিকার অর্থে ডনা নিজেই বাৎসরিক গেট-টুগেদার ও সদস্যদের নিয়ে গ্রীষ্মকালীন চড়ুইভাতির আয়ােজন করেন।
ক্যানাডপ্ট ছাড়া রবার্ট ও হেলকে ফেরি কুয়ান-ঈন-ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অন্টেরিও’র বালিংটন শহরে যেটা কয়েক বছর সক্রিয় থেকে পরে বন্ধ হয়ে যায় । কিউবেক ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন-এ লয়েড ও স্যাভ্রা সিমসন এবং হার্ব ও নেওমি ব্ৰনস্টাইন প্রধান। ব্যক্তি হিসাবে কাজ করেছিলেন । ঘন ঘন পটলাক ডিনার সংগঠনের মাধ্যমে দত্তকগ্রাহী বাবামায়েরা একসঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়ােজন করতেন। এ ছাড়া নিয়মিত। কফি ও প্লে টাইম (খেলাধুলার সময়) তাে ছিলই মায়েদের ও প্রাক্ স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য । গ্রুপটি সে সময়ে মন্ট্রিয়লের লেকশাের ইউনিটারিয়ান চার্চে নিয়মিত একত্রিত হতেন, সেটা ছিল বহুসংস্কৃতির ছেলেমেয়েদের চমকার সময় কাটানাের বিশেষ কর্মতৎপরতা।
কখন বলতে হবে? অধিকাংশ দত্তক বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে একমত যে, একটি দত্তকায়িত শিশুকে অল্প বয়সেই জানাতে হবে যে তাকে দত্তক নেয়া হয়েছে। অতীতে যে শিশু কোনাে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করত না, ধরে নেয়া হতাে সে তার আত্মপরিচিতি পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। যে শিশু জানতে আগ্রহী, তাকে সমস্যাকবলিত শিশু মনে করা হতাে। এখনও প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে – কখন, কীভাবে কথাটা শিশুকে বলা হবে? একই সঙ্গে এটাও দেখতে হবে, দত্তক নেবার। পেছনে যে ধরনের দুর্ভাগ্যজড়িত বিষয় থাকে, শিশুকে সে কাহিনী সম্পর্কে অবগত করা। উচিত । যদি শিশুটি বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে পারে, তাহলে সে নিজে থেকেই দৃঢ়সংকল্প নিয়ে। অনেকটা বাস্তববাদী, সাবধানী ও পরিশ্রমী হয়ে উঠতে পারে। শুধু তাই নয়, সে নিজেকে ইস্পাত চরিত্রের মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হতে পারে। কানাডীয় দম্পপতিরা জানতেন যে মনােবিজ্ঞানীদের মতে, অল্পবয়সে দত্তক গ্রহণের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে জানতে পারলে সে শিশু যখন কৈশরে পৌঁছায়, তখন সংঘাতের অভিঘাত অনেকাংশে কমে যায়। শিশু বয়সে জন্মদাতা ও জন্মদাত্রী বাবা-মা ও দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়ের পার্থক্যটুকু উপলব্ধি করার জ্ঞানও তখন তাদের হয় না। কিন্তু অভিজ্ঞতার আলােকে যুক্তিসঙ্গতভাবে বলা হয় যে দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েরা তাদের দত্তক নেয়া শিশুকে বাইরের কেউ সচেতন করার আগেই তারা নিজেরা সংলাপের মাধ্যমে যেন তার সাথে যত সংক্ষেপেই হােক না কেন, তাকে দত্তক নেয়ার বিষয়ে অবহিত করেন।
যদিও “অন্য একজনের সন্তানকে নিজেদের সন্তান বলে দেবার মধ্যে যে চ্যালেঞ্জে রয়েছে, সে চ্যালেঞ্জকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে প্রত্যেক মা-বাবা তাদের শিশুর জন্মবৃত্তান্তটি তাকে শুনিয়েছিলেন নির্জলা সত্যভাষণে। একটি সাধারণ রুল অব থাম’ যেটি দত্তক মা-বাবা অনুসরণ করেছিলেন সেটা হলাে, দিত্তকায়িত একটি শিশু কম বয়সে তার দত্তকের ইতিবৃত্ত বিষয়ে অভিহিত থাকলে সংকটকালে কাজ দেয়; বিপরীতে, এ তথ্য দেরিতে জানালে অনেক ঝামেলা একের পর এক তৈরি হতে থাকে। সময়মতাে শিশুকে বিভিন্ন তথ্য জানালে শিশুটি সততা ও সত্যের মূল্যায়ন করতে শেখে বাবা-মায়েরা যুক্তি দেন। প্রত্যেক দত্তকগ্রাহী মা-বাবা তাদের নিজস্ব বিচারবুদ্ধি প্রয়ােগ করে প্রয়ােজনমতাে দেরি করেছেন যতদিন না তাদের মনে হয়েছে শিশুর এবার বয়স হয়েছে, তার পরিপক্কতা এসেছে, তার সামাজিক বিশ্ব এখন যথেষ্ট বৃহৎ হয়েছে, সে এখন দত্তক নেবার প্রয়ােজন ও ধারণাটির বিষয়ে বুঝতে সক্ষম হবে। তাদের ভাষ্যমতে শিশুর বিদ্যা, বুদ্ধি, ভালােবাসা পাওয়া এবং দেবার অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা বিচার করে বিষয়টিকে নিয়ে সংলাপ শুরু করা যায় । বাবামায়েদের ধারণা ছিল যে, তাদের বা অন্য যে কোনাে ছেলেমেয়েরা সাধারণত বুদ্ধির তুলনায় আবেগের চর্চা বেশি করে। বাবা-মা শব্দবন্ধ ও বিশেষ বিশেষ শ্রেণিজ্ঞাপক শব্দাবলির ব্যবহার সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। তারা এও জানতেন যে, রেখে ঢেকে সাধারণ শব্দ ব্যবহার করলে ছেলেমেয়েরা সেখান থেকে নেতিবাচক কাল্পনিক গল্পকথায় চলে যাবার সম্ভাবনা থাকে – অর্থাৎ কাজের কথা হারিয়ে যাবে। তারা এ কথা বিশেষভাবে মনে রেখেছেন যে, তারা কখনাে “প্রত্যাখ্যান,” বা “দত্তক নেবার জন্য পরিত্যক্ত” এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করেননি। লক্ষণীয় যে, যখনই দত্তক নেয়া-দেয়ার বিষয়ে পরিবারে কথাবার্তা হত তারা দ্বিগুণ বেশি। সতর্ক ছিলেন । দত্তক গ্রহণের যে কাহিনী বা গল্প যুদ্ধশিশুদের বলা হয়েছিল সেটার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সবাই মনে রেখেছেন। জন্মবৃত্তান্তের কাহিনী বলার সময় শিশুটির জন্মদাত্রী মায়ের জীবনালেখ্য অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে আঁকা হয়েছিল যেহেতু তার আর কোনাে উপায় ছিল না শিশুকে পরিত্যাগ করা ভিন্ন। তাদের দত্তকায়িত শিশুর পরিচয় জানাতে বাবা-মা যে মূলবাণী। মনে রেখেছিলেন সেটা হলাে আপন দত্তক পরিচয় মেনে নিয়ে দত্তকায়িত সন্তান হিসাবে গর্ববােধ করা। দত্তক গ্রহণের ইতিবৃত্ত বলার সময়টুকুতে কেন বা কীভাবে তাদেরকে দত্তক নেয়া হয়েছিল সে বিষয়টিতে বাবা-মাকে বিশেষ নজর রাখতে হয়েছিল। যেহেতু অনেকেই ভাবেন পরিত্যক্ত শিশুরা “জন্ম থেকেই খারাপ। কারণ তাদের জন্ম হয়েছে ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে, বাবা-মায়েরা এ স্পর্শকাতর বিষয়টি মােকাবিলা করেছেন খুব সাবধানতার সাথে ।
এখনও তারা মনে রেখেছেন খন্ড খন্ড সংলাপের কথা । জন্মদাত্রী মা ও তাদের। জন্মভূমি (বাংলাদেশ) সম্পর্কে কোনাে ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য না করে শুধু বলেছিলেন যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে সে সংকটময় সময়ে দত্তক নেয়াটাই ছিল সবচেয়ে জরুরি। বাবা-মায়েদের সবসময় বিশ্বাস ছিল যে, শিশুরা আস্তে আস্তে হয়তাে এমন একটা জায়গায় নিয়ে নিজেদের অবস্থান করতে পারবে যেখানে তারা বুঝতে চেষ্টা করবে কোথা থেকে তারা এসেছে; এবং কীভাবে তাদের শ্বেতকায় বাবা-মায়েদের কাছে এসেছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এই বাবা-মায়েরা ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার অঙ্গীকার করেছিলেন প্রথম থেকেই । কেউ কেউ যুদ্ধশিশুদের সঙ্গে প্রথমদিকে যে কথা বলেছিলেন সে কথা পুনরায় মনে করতে চাইনি। তাদের কথা হলাে প্রথম থেকেই শিশুর সর্বোচ্চ স্বার্থে অতীতের কথা মনে না রাখাই ভালাে। সাধারণত দেখা যায়, অনেকেই আশঙ্কা করেন একটি শিশুর দত্তকায়নের জন্য জন্ম হলে ঘটনার অন্তত “কিছু একটা বদলে যাবে চিরকালের। জন্য।” কিন্ত এই বাবা-মায়েরা ছিলেন ব্যতিক্রমী । তারা তাদের ছেলেমেয়েদের “গােপনীয়তা” এবং “একান্ততা” এ দুবিষয়ের মধ্যে তফাৎ কী সেটা শিখিয়েছেন। তারা এও বিশ্বাস করতেন যে, শিশুর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বিচারবুদ্ধি ও বিবেচনাবােধের পরিবর্তন ঘটতে থাকবে। সে জানবে কাকে কখন কী বলতে হবে এবং কীভাবে । বাবা-মাকে কোনাে পিলেচমকানাে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হবে না। একটি বাংলাদেশি যুদ্ধশিশু এবং ১৮ টি অন্যদেশের যুদ্ধশিশু ও অনাথ শিশুকে দত্তক নেয়ার অভিজ্ঞাতার উপর ভিত্তি করে ফ্রেড ও বনি কাপুচিনাে বলেন যে, প্রত্যেক শিশুকে ব্যক্তিগত সকল তথ্য এমনকি কে তাকে জন্ম দিয়েছে সেটা পর্যন্ত জানানাে উচিত। তার অর্থ এটা নয় যে, “গল্পটা” বলা হলেই এ সুক্ষ্মবেদি বিষয়টি বেশ সহজ হয়ে যাবে। তাদেরকে ভাবতে হয়েছিল অনাকাঙ্ক্ষিত হওয়া ছাড়া, কীভাবে তারা “অধিকৃত বাংলাদেশ”-এ পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা বাঙালি নারীর উপর যৌন নিপীড়ন ও বাধ্যতামুলক গর্ভধারণের বিষয় ব্যাখ্যা করবেন? ক্যাপুচিনােদের মতে, এটা এমন একটি দুঃখের কাহিনী একটি শিশুর জন্য যে জানতে পারে যে তাকে অনেকে অবাঞ্ছিত হিসাবে দেখে । এ বিষয়ে সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই যে বাবা-মায়েরা এরকম পরিস্থিতির সম্ভাব্য বিধ্বংসী ফলাফল বিষয়ে শুরুর দিকে বেশি ভীত ছিলেন। প্রতিবারই দত্তক নেয়ার গল্পটি বলার সময় বাবা-মায়েরা নিশ্চিত হয়ে নিতেন যে, কারাে জন্মকে ঘিরে কোনাে সংঘাতমূলক কাহিনী নেই ।
তাদের কারাে বাড়িতে দত্তকের গল্প বা দত্তকবিষয়ক আলােচনা কখনই নিষিদ্ধ ছিল না। এসব বাবা-মায়েদের একটি বিচক্ষণীয় দিক। যে, তারা পরির গল্পের আকারে দত্তকের গল্প সম্পর্কে জানেন। তারই একটু এদিক-ওদিক যােগ-বিয়ােগ এবং বাছাই করা গল্পের মতাে উপযােগী করে অনেক বাবা-মাই সেটা। পরিবেশন করার চেষ্টা করেন। অথবা সে সময় ইস্যুটা একেবারে এড়িয়ে গিয়েছিলেন যখন মনে হয়েছিল যে শিশুর বয়স নিতান্তই কম। কিন্তু বর্তমানে বাবা-মায়েরা কোনাে পছন্দ করা গল্পের সঙ্গে কোনাে গােপনীয়তার মিশেল দেননি। তারা দেখেছেন বস্তুতপক্ষে অনেক সময়ই অনেক দত্তকগ্রাহী মা-বাবা মূল কাহিনীকে বাঁকিয়ে নিজেদের কল্পনাশক্তি দিয়ে মুচড়ে পরিবেশন করেন যার ফলে সত্য ঘটনাটি অনেক সময় ঢাকা পড়ে যায় । এই বাবা-মায়েরা আরও অনেক দত্তকগ্রাহী মা-বাবার সম্পর্কে জানতেন, যারা ত্যাগের যে অনুভূতি তার বিপরীত অনুভূতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে হয়তাে শিশুর ভয়ই বেড়েছে, কারণ অনেক সময় শিশুটি ভাবতে পারে যে, সে “পছন্দের শিশু” হলেও হয়তােবা একসময় তার বাবা-মায়ের কাছে আবার “অপছন্দের শিশু হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, অন্যভাবে বলা যায় যে শিশুটি ভাবতে পারে সে দ্বিতীয়বারের জন্যও সে পরিত্যক্ত হতে পারে। কাজেই এধরণের বিশ্বাসের ফলে বাবা-মায়েরা দ্বিগুণ সাবধানতা অবলম্বন করেন এবং সবসময়ই সাম্প্রতিক উপদেশাবলি মাথায় রাখার চেষ্টা করেন। স্মৃতিচারণে তারা পরিষ্কারভাবে বলেন যে, শিশুর সাথে তার বয়সােপযােগী সংলাপ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করতে হবে, এ বিষয়টি তারা মনে রেখেছেন। যে কোনাে অবস্থাতে একটি দত্তকায়িত শিশুকে বলতে হবে তার জন্মের ইতিহাস। তাদের মতে, এতে দত্তকের ধারণাটি পরিবারের দৈনন্দিন কাজকর্মের সঙ্গে মিলেমিশে স্বাভাবিকতায় বিকশিত হয়। এই আদর্শিক অবস্থান থেকেই শিশুকে সহজ সরল গল্পটা বলাটাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। দত্তকের বর্ণনায়, শিশু অনেক ক্ষেত্রে এরকম ভাবে যে, তার জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবা যেন-বা-আর-নেই। সত্যি সত্যি না হলেও অন্তত প্রতীকীভাবে।
সাধারণত দেখা যায় দত্তকগ্রাহী মা-বাবা দত্তক নেবার গল্পটি পরিবারের থেকে উদ্ভূত পূরনাে কথারূপে উপস্থাপন করতে চান। অনেক ক্ষেত্রে জৈব বাবা-মায়ের “প্রাণসংহারের ঘটনাও ঘটানাে হয় (যদিও কল্পনায়)। বর্তমান ক্ষেত্রে কানাডীয় মা-বাবা যা ঘটেছে সেসব তারা তাদের পছন্দের দত্তকায়িত ছেলেমেয়েদের তাই বলেছেন। তারা জানতেন, অনেক দম্পতিই জন্মদাতা বাবা ও জন্মদাত্রী মাকে মৃত দেখিয়ে মূল কাহিনীকে বিকৃত করে ফেলেন। তারা এও বিশ্বাস করতেন যে, যদিও ধর্ষণের ফলে জন্ম তবুও ঐ শিশুর তার জন্মবৃত্তান্ত জানবার অধিকার রয়েছে, যে বিষয়ে যতটুকু তথ্যই যেখানে থাকুক না কেন। বাবা-মায়েদের মতে, সরল সত্য কথাটা সােজাসুজি বলে ফেলার লক্ষ্য হলাে শিশুটি যাতে কোনাে কারণে বা কোনােভাবে তার জন্মগ্রহণের ভুল গল্পটি বিশ্বাস না করে। এটাও তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে জন্মবৃত্তান্তের গল্পটি যেন পুরােপুরি স্বচ্ছ হয় শিশুর মনে যাতে কোনাে ধরনের দন্দ না থেকে যায় । কানাঘুষা অনেক রকমের গল্প কাহিনী না শুনে তারা যেন অপ্রিয় হলেও বাস্তব সত্য জানতে পারে সেটা ছিল বাব-মাদের বিশ্বাস । তারা জানতেন, রূঢ় সত্যই শিশুর মনে অবিশ্বাস উৎপাদনের বিপদটাকে এড়িয়ে যেতে পারবে। তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে, শিশুর আস্থা যতদিন তাদের ওপরে থাকবে তারা পরিবার হিসাবে যে কোনাে নেতিবাচক অথবা অশান্তির কারণকে বুঝতে সক্ষম হবে। আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে দেখেছি বর্তমান মা-বাবা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, শিশুকে অন্ধকারে রাখা উচিত না। তাদের জন্মকে ঘিরে কোনাে রহস্যও থাকা উচিত না। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে তাদের সনদপত্র পাওয়া ও কানাডাতে দত্তক সন্তানরূপে গৃহীত হওয়ার মধ্যেও কোনাে রহস্য থাকা উচিত না। যতটুকু সম্ভব তারা সংলাপের মাধ্যমে শিশুদের জন্মের ইতিহাস ব্যাখা করেছেন প্রয়ােজনমত সময় নিয়েছেন তাদের সন্তানের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে। তারা নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন যে, শিশুর মনে যাতে কোনােভাবেই নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে – বিশেষ করে জন্মদাত্রী মা সম্পর্কে। তারা সহজ সরল ভাষায় বলার চেষ্টা করেছেন যে, জন্মদাত্রী মা যে অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে প্রসব করেছিলেন বাংলাদেশ সমাজ তখন ঠিক সে ধরনের শিশুদের গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। বরং তখন এক ধরনের অবহেলা সামাজিক নিপতা বিরাজ করত ১৯৭০ দশকের বাংলাদেশে। অন্যভাবে বলা যায়, তারা জানতেন যে জন্মদাত্রী মা ও তার শিশুকে সমাজ গ্রহণ করবে না। এ ধরনের শিশু লালন পালন করতে কেউই আগ্রহী। হবেন না এমন কতকগুলি কারণে যেগুলি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। তারা পরিষ্কার মনে রেখেছেন যুদ্ধশিশুদের ঐতিহাসিক কালানুক্রমের দিকে নজর রেখে তাদের বর্ণনায় কোনাে। কাটছাট করার প্রয়ােজন মনে করেননি।
বেশিরভাগ পরিবারে যেমন, ক্যাপুচিনাে (ফ্রেড ও বনি যারা ২১ জন শিশুকে লালন করেছেন), ফেরি (রবার্ট ও হেলকে যারা ১৩ টি শিশুকে বড় করেছেন), হার্ট (জোয়েল ও ট্রডি যারা নয়টি সন্তান মানুষ করেছেন) এবং সিমসনেরা (লয়েড ও স্যান্ড্রা যারা ১৯ টি শিশুকে বড় করেছেন) অনেক শিশু দত্তক নিয়েছিলেন। তাদের সবারই দত্তক নেয়া শিশু যেমন ছিল, তেমনি পরিবারে জন্ম নেয়া সন্তানও ছিল। বাবা-মায়েরা সন্তুষ্ট ছিলেন এটুকু ভেবে যে, তাদের সন্তানেরা দত্তক নেয়া ব্যাপারটা কী সেটা যেমন জানত তেমনি জানত পরিবারে জন্ম নেয়ার অর্থ। এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোনাে ভুল ধারণা ছিল না। বাবা-মায়েরা তাদের দত্তকায়িত এবং ঔরসজাত সন্তানদের একই চোখে দেখেছেন। সে অর্থে এসব পরিবারে দেখা যেত একটা তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি বাবা-মায়েদের ছিল যখন যার ইচ্ছা তাই নিয়ে খানিকক্ষণ কাজ করার জন্য সবাই প্রস্তুত থাকতেন সর্বদা। তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের এটাই শিখিয়েছিলেন যে, যখন যা মনে আসে সেটা। সামনাসামনি বলে ফেলতে, মনের গভীরতম অনুভূতির কথা নিয়ে যেন বাবা-মায়ের সাথে আলােচনা করতে কেউ দ্বিধা না করে। সিমসন দম্পতি বলেন, তারা যদি তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে কথাবার্তা মন খুলে না বলতেন তাহলে তাদের দত্তকায়িত সন্তানেরা তাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়েই বড় হয়ে উঠত। যার ফলে দেখা যেত সবাই যেন ছলনার আশ্রয়ই নিচ্ছেন। সেদিক দিয়ে তাকালে বলা যেতে পারে যে, এসব বাবা-মায়েরা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তাদের ছেলেমেয়েদের দত্তক ব্যবস্থা ও আন্তবর্ণীয় দত্তক গ্রহণের মতাে জটিল ও সংবেদনশীল বিষয়ে ছােটবেলা থেকেই অবহিত করার । বাবা-মায়েদের ভাষ্যমতে, এ ধরনের গঠনমূলক শিক্ষা যুদ্ধশিশুদের জীবনবৃত্তান্তের উপলব্ধি করতে শিখবে, সে ইতিহাস যত করুনই হক না কেন। সুদূর বাংলাদেশ থেকে এসেও যুদ্ধশিশুরা কানাডাতে তাদের বাবা-মায়েদের পরিবারে একজন অপরিহার্য সদস্য হিসাবে পরিগণিত হয়। এ কথা প্রতিনিয়ত ভেবেই তারা নিজ নিজ পরিবারে বড় হয়েছে।
আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে দেখেছি এসব পরিবারে স্নেহ-আদরের কোনাে অভাব ছিল না। অবার আমরা সপ্তম অধ্যায়ে যুদ্ধ শিশুদের মুখেই শুনতে পাবাে কীভাবে তারা তাদের মা-বাবা, ভাই-বােন, দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-চাচি ফুপা-ফুপি, মামা-মামি ও বর্ধিত পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে ছােটবেলা থেকেই তাদের স্নেহ আদর পেয়ে আসছে। স্মৃতিচারণ থেকে এও জানা গেল, কোনাে কোনাে মা-বাবা নিরিবিলি শান্ত মুহূর্ত খুঁজে নিয়ে। একসঙ্গে বসার ও কথা বলার সুযােগ করেনিতেন। আলােচনার সূত্র হিসাবে অনেকে ব্যবহার করেন সে সময়ের খবরের কাগজের কেটে রাখা অংশ, ছােটবেলার পারিবারিক ফটো, শিশুদের নিজস্ব এলবাম তাদের স্কুলের স্ক্র্যাপ বই । আবার অনেকে স্মরণ করেন যুদ্ধশিশুকে নিয়ে ভিন্নভাবে একই বিষয়ে তাদের সংলাপ ও বয়সােপােযােগি আলােচনা। প্রসঙ্গগত, সব বাবা-মায়েরা সহমত যে দত্তক কাহিনী বলার জন্য “ঠিক সময়” বলতে কিছু নেই । সন্তানের জন্মদিন, জন্মদেশ, জন্মের ইতিহাস ও অন্যান্য যাবতীয় বিষয় নিয়ে যে কোনাে সময়ই আলাপ শুরু করা যায় । একের পর আরেক শিশু পরিবারে এসেছে, তাদের কাহিনী আলােচিত হয়েছে, সবাই শুনেছে, জেনেছে, ব্যাপারটা এরকম স্বাভাবিকতার দিয়েই এগিয়েছে। ডেইল ও ডরিন গুডস রায়ানকে (যুদ্ধশিশু) দত্তক নিয়েছিলেন ১৯৭২। সালে। তার কয়েক বছর পরে রাশােনাকে ওরা দত্তক নেন; সেও বাংলাদেশের অনাথ শিশু। গুডসদের মতে, পরিবারে দত্তক বিষয়ে আন্তরিক ও যথাযথ আলােচনা হলে ভালাে হয়, যাতে দত্তক নেয়া শিশু বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার আগে সব কিছু জানতে পারে এবং কোনাে মারাত্মক অশান্তি না ঘটে। টনি এবং বনি বুনস্ট্রা সাতটি সন্তান লালন পালন করেছেন, যাদের মাঝে পাঁচজনই ছিল। দত্তকায়িত (যুদ্ধশিশু ক্রিস সহ)। মা-বাবা ক্রিসকে দত্তক নেয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন যখন। সে খুব ছােট ছিল । সব ছেলেমেয়ের কাছেই এটা দিবালােকের মতাে সত্য যে তাদের এবং মা-বাবার জৈব বংশলতিকা এক নয়, কারণ তাদের ত্বকের রং-এ পার্থক্য রয়েছে । কখন” কাকে কী বলতে হবে, সে বিষয়ে বুনস্ট্রারা নিজেদের বিচার বুদ্ধির ওপর নির্ভর করেছিলেন। পরিবার হিসাবে তারা তাদের সন্তানদের জন্মের ইতিহাস অনুসন্ধানে বেশ আনন্দ পেয়েছেন, বলেন বুনস্ট্রা দম্পতি। ডেল ও ডনা উলসি সে দিনগুলির কথা মনে করে বলেন তাদের ছেলে মেয়েরা বড় হওয়ার শুরুতেই দত্তক নেয়ার বিষয়টি সম্পর্কে যেন তাদের কোনাে ধরনের ভ্রান্ত ধারণা না থাকে, তাই তাদেরকে বােঝানাের চেষ্টা করেছেন যে তারা যেমন জন্মগ্রহণ করেছিল, তেমনি তারা দত্তকায়িত সন্তান হিসেবেও গৃহীত হয়েছে কানাডাতে। উনার ভাষ্য অনুসারে আসল কথা হলাে, কখন শিশুদের জানানাে হবে যে তারা দত্তকের মাধ্যমে পরিবারে এসেছে, এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় যতটা গুরুত্বপূর্ণ হলাে কীভাবে আপনি তাকে মূল্যবান এবং বিশেষভাবে সংবেদনশীল কথাগুলাে বলবেন । শিশুর বয়স অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সে এ বিষয়ের গুরুত্ব বুঝতে পারছে কিনা সেটা বুঝতে হবে, মা-বাবা এ বিষয়ে কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্যবােধ করেন তা জানা দরকার । সংলাপের সময় তারা কোনাে চাপ বােধ করছেন কিনা সেটাও জানা দরকার।
জন ও ডরােথি মরিস এর মতে অল্প বয়সে উপযুক্ত বিষয়ের আলােচনা শিশুদের জন্য চচ্চরি বিষয় ছিল । বহুজাতিক দত্তক পরিবারের দত্তক নেয়াটা এক অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার ছিল, যেখানে আবার দেখা যেত বাবা-মায়েরা সাধারণত কোকেশীয় জাতগােত্রের । কাজেই জাতগােত্রে ভিন্ন ছেলেমেয়েরা জেনে আশ্চর্য হতাে না যে তারা দত্তকায়িত শিশু হিসেবেই ঐ পরিবারে গৃহীত হয়েছে । সে যা হােক, বাবা-মায়েদের মতে, একজনের উৎস সন্ধান এক স্বাভাবিক তাগিদকে নিবৃত্ত করে। এটা হতে পারে এক আবেগীয় অভিযাত্রা যেটা দত্তকগ্রাহী মা-বাবার জন্য যেমন, শিশুর জন্যও তেমন। ১৯৭০-এর শুরুতে আন্তবর্ণীয় শিশুদের দত্তকগ্রাহী কানাডীয় বাবা-মায়েদের আরেকটি চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি হতে হয়েছিল। সে সময় অকেকেশীয় শিশুদের সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক মূলধারা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে একদল আমেরিকান সামাজিক বিপ্লবীরা তুমুল শশারগােল করেছিলেন। তাদের শ্লোগান ছিল, কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা শ্বেতাঙ্গ পরিবারে বড় হওয়া মানে জাতিগতভাবে তাদের নিজস্ব পরিচয় তারা কখনাে জানতে শিখবে না। মূলত এ ধরনের শিশুরা তাদের নিজ জাতীয় বা বংশীয় পরিচয় দেয়ার মতাে কোনাে জ্ঞানও তারা। অর্জন করবে না। সৌভাগ্যবশত কানাডাতে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়ার বিষয়টি প্রথম থেকেই দেখা হয়েছিল অন্য আঙ্গিকে। যেহেতু দৃশ্যমান সংখ্যালঘু যুদ্ধশিশুরা দেখতে স্পষ্টতই তাদের শ্বেতকায় বাবা-মা থেকে ভিন্ন ছিল, স্বভাবতই তাদের দত্তকায়নের বিষয়টিও পাড়া। প্রতিবেশিদের কাছে জানা ছিল। এ সব বাবা-মায়েরা কখনাে তেমন কোনাে অপ্রীতিকর। অবস্থার সম্মুখীন হননি। কয়েক যুগ পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হার্টরা (জেয়েল ও ট্রডি) মনে রেখেছেন তাদের বাংলাদেশি মেয়ে শ্যামার সঙ্গে তার জন্মদাত্রী মায়ের সম্পর্কে আলােচনা। শিশুরা যখন বড় হচ্ছিল, এ বইয়ে আলােচিত সকল দত্তকগ্রাহী মা-বাবা তাদের শিশুদের জন্মদাত্রী মায়েদের সম্পর্কে আরও খোজ খবর নেবার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, যদিও ব্যাপারটা তখন আরও দূরে হারিয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। প্রায়ােগিক দিক দিয়ে বিচার করলে বলা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের দত্তক ব্যবস্থা ছিল একটু ভিন্নতর। এ ব্যবস্থাকে ঠিক ‘উন্মুক্ত (অর্থাৎ যেখানে জন্মদাতা বাবা ও জন্মদাত্রী মার নাম উল্লেখ থাকে) দত্তক ব্যবস্থা বলা যায়। ; তেমনি “বন্ধ” বা “অগম্য” (অর্থাৎ জন্মদাতা বাবা ও জন্মদাত্রী মার নাম থাকে না) দত্তক ব্যবস্থা বলা যায় না। বরং সেটা ছিল দুটোরই মিশ্রণ । সবার জানা আছে কী পরিস্থিতিতে জন্মদাত্রী মায়েরা সন্তান গর্ভে ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং সন্তান প্রসব করতেও, সবটা তাদের ইচ্ছার বিপরীতে ।
এর ফলে যে মর্মান্তিক পরিত্যাগ ও পরবর্তী দত্তক নেবার যে ঘটনা ঘটে সে বিষয়েও সবাই কমবেশি জানেন; আবার সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই জানেন না এটাও সত্যি। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাবা-মায়েরা বলেন যে মূলত ১৯৭১ এর যুদ্ধশিশু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম একই ঐতিহাসিক সত্যের দুপিঠ । বাবা-মায়েরা যে যথাযােগ্যভাবে তাদের সন্তানদের লালন পালন করেছেন সে বিষয়টি আলাপের মাধ্যমে আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বলা যেতে পারে যে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিকের বিকাশ সাধন করে তারা তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভরশীল, কর্তব্যপরায়ণ, চরিত্রবান ও কর্মক্ষম হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সকল দত্তকায়িত শিশু তাদের দত্তক অবস্থান মেনে নেয়নি। আমরা রাণীর কথা উল্লেখ করেছি, যে মরাল পরিবারে একমাত্র দত্তক শিশু হিসাবে গিয়েছিল। রবিন ও বারবারা মরালের জৈব সন্তান জন। এক বিশেষ সময়ে মরলিরা তাদের মেয়ের সাথে তার জন্মবৃত্তান্ত আলাপ করার সীদ্ধান্ত নেন। তখন তাদের মনে হয়েছিল যে ইতােমধ্যে রাণীর দত্তক ব্যবস্থা বিষয়ে “বােঝার মতাে” বুদ্ধি ও পরিপক্কতা এসেছে । যদিও তারা সাবধানে দত্তক বিষয়ে রাণীর সঙ্গে কথােপকথনের পরিকল্পনা নেন তারা ঠিক মনে করতে পারেননি কবে ও কখন তারা প্রথম আলাপ করেছিলেন এ বিষয়ে । রানী এক সময়ে তার জন্মদাত্রী মাকে নিয়ে ঘােরের মধ্যে পড়ে যায়, সেটা আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে পড়েছি। লক্ষণীয় যে, মরালরা আরও পাঁচজন মা-বাবার মতাে রাণীকে কম বয়সে তার জন্মদাত্রী মায়ের বিষয়ে জানাতে গিয়েছিলেন যাতে সে তার জন্মদেশ বিষয়ে জানতে পারে । সব দত্তকগ্রাহী মা-বাবা এটা ধরে নিয়ে কাজ করেছিলেন যে, প্রয়ােজনবােধে অবশ্যই যেমন জানার কৌতূহল থাকবে তেমনি থাকবে প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা। আবার কিছু জটিল প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তারা শিশুর মেজাজ মর্জি, স্বভাব, অভিজ্ঞতা, বৃদ্ধির হার এবং পরিবেশ বিষয়ে খেয়াল রেখেছেন, সাবধানে কথা বলেছেন। তারা লক্ষ্য রেখেছেন, তাদের পক্ষে যদি কম। কথা বলা হয়ে থাকে, সেটা যেন মা-বাবার ইচ্ছা অথবা খামখেয়ালিপনার জন্য না হয়ে থাকে, কারণ মা-বাবা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাদের বেড়ে ওঠা শিশুর প্রশ্নের উত্তর হতে হবে।
পূর্ণাঙ্গ । কোনােক্রমে তাদের প্রশ্নের অবহেলা করা ঠিক হবে না। শুধু তাই নয়, তাদেরকে ঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে উৎসাহ যােগাতে হবে। শিশুদের বর্ণনায় আমরা সপ্তম অধ্যায়ে জানব যে এক মুহুর্তের জন্যও শিশুরা অনুভব করেনি। যে তাদের মা-বাবার সঙ্গে যােগাযােগের দরজা বন্ধ হয়ে গেয়েছে। যেহেতু দত্তকগ্রহণের বিষয়টি নিয়ে মা-বাবারা তাদের সন্তানদের একদম ছােটবেলা থেকে খুব সহজাতভাবেই অবহিত করেছিলেন, সে জন্যই তারা বেড়ে ওঠে তাদের মা-বাবা ও ভাই-বােনকে আপন পরিবারের সদস্য হিসাবে গণ্য করে। তাই সহজাতভাবেই মায়ের পক্ষে যেমন শিশুকে শর্তহীনভাবে তাদের যত্ন দেয়া সহজ হয়েছে, তেমনি শিশুর পক্ষে সেগুলি গ্রহণ করা ও প্রতিদানে আদর, সােহাগ করাও সহজ হয়েছে। বৈচিত্র্য ও বহুসাংস্কৃতিক ঋদ্ধতা যুদ্ধশিশুদের দত্তক পরিবারগুলির সবই বহুজাতিক ছিল; বহু নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল, বহুসাংস্কৃতিক বিভায় উদ্ভাসিত । ১৯৭০ দশকের শুরুতে কানাডাতে বহুজাতিক শিশু দত্তক নেওয়ার প্রচলন ঘরে ঘরে হয়নি। আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক প্রথার সমর্থক ও বিরােধীরা উভয়েই এ বিষয়ে একমত যে, জাতিবর্ণ নির্বিশেষে দত্তকায়িত প্রত্যেক ছেলেমেয়েদের অধিকার ও প্রয়ােজন রয়েছে নিজ জাতি বা গােষ্ঠীর সাথে পরিচিতির, যেটা তার জন্ম ঐতিহ্যের উপর নির্ভরশীল হবে। ১৯৭০ ও ১৯৮০ দশকে একাধিক কৃষ্ণাঙ্গ সমাজবিজ্ঞানী এবং সামাজিক কর্মতাত্ত্বিকরা যুক্তি দেন যে, আমেরিকা দত্তক নেবার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে আন্তবর্ণীয় দত্তক ব্যবস্থা সর্বোকৃষ্ট’ সমাধান নয় । কিন্তু কানাডাতে দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েরা এবং দত্তকায়িত প্রাপ্তবয়স্করা এদের সঙ্গে সহমত পােষণ করেননি। কেননা তৎকালীন কানাডীয় সমাজের প্রথা অনুযায়ী কানাডাতে আন্তবর্ণীয় দত্তক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তেমন কোনাে মতানৈক্য হয়নি। শ্বেতকায় বাবা-মা এবং দৃশ্যমান সংখ্যালঘু যুদ্ধশিশুদের মধ্যে ত্বকের রং-এর পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের এমন কোনাে সমস্যা হয়নি। আশ্চর্য হবার কিছু নেই, এসব বৃহৎ পরিবারের বাবা-মায়েরা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবারে বহুসংস্কৃতির বীজ বুনে দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে কানাডা বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল বহু সংস্কৃতি নীতির ধ্বজাধারী হিসেবে। কানাডীয় The Multiculturalism Act অনুযায়ী জাতি ও সংস্কৃতিগত সাম্য আইনের সমর্থনে উজ্জীবিত হবে।

এ কথা কারাে অজানা নেই যে, ১৯৬০ এর দশক সুশিল সমাজ ও আমেরিকান। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দশক হিসাবে উদযাপিত হয়েছিল। একদিকে যেমন হােয়াইট হাউসে অন্যদিকে তেমনি রাস্তায় রাস্তায় দ্রুত সমাজ পরিবর্তনের উে দত্তক গ্রহণে ইচ্ছুক দম্পতিদের প্রভাবান্বিত করেছিল । বাবা-মায়েরা বুঝেছিলেন, বহু সংস্কৃতি এমন এক সামাজিক বিপ্লব যা বিশাল সামুদায়িক (ইনকুসিভ) সমাজ তৈরি করবে যেখানে সব। পশ্চাদপটের কানাডীয়রা একসাথে অংশগ্রহণ করবে। সবাই মিলে তৈরি করবে এক বহু সংস্কৃতির দেশ কানাডা। যখন তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছিল, তখন The Multicultura/isni Act কানাডাতে বলবৎ। শুধু তাই নয়, ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারগুলাে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র বজায় রাখা ও তার যােগসাধন করার উদ্দেশ্যে কানাডীয়দের অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করে। একই সাথে দত্তকগ্রাহী বর্তমান বাবা-মায়েরা এটাকে কানাডীয় ঐতিহ্য ও মৌলিক পরিচিতির বৈশিষ্ট্যরূপে দেখেন। তারা আগ্রহ নিয়ে কেমন করে সরকার সকল কানাডীয়রা যেন তাদের পরিচিতি বজায় রাখেন, সে দিক দিয়ে বিশেষ নজর দিয়েছিলেন কেমন করে কানাডীয়রা তাদের পরিচিতি বজায় রাখেন। শুধু তাই নয়, কানাডীয়রা যাতে তাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যে গর্ববােধ করেন এবং অনুভব করেন যে তারাও কানাডীয় বহুসংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বজায় রাখেন সেটা নিশ্চিতকরণে বদ্ধপরিকর ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে বর্তমানের প্রতিটি বাবা-মা আশা পােষণ করে তাদের আন্তবর্ণীয় ছেলে মেয়েদেরকে কানাডীয় বহুসংস্কৃতির সাথে সম্পূর্ণভাবে পরিচিতি লাভে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে জাতি, বর্ণ, কৃষ্টি নির্বিশেষে কানাডীয়। বহুসংস্কৃতি অপরিহার্য। সেজন্য তাদের সন্তানদের ছােটবেলা থেকেই কানাডীয় সংস্কৃতিতে যে বৈচিত্রতা রয়েছে সে বিষয়ে জানা ও অন্যের কৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানাের চেষ্টা করেন।

অনেক মা-বাবা তদের সারগ্রাহী পারিবারিক জীবনকে কানাডীয় মূল্যবােধ যেমন গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবিক অধিকার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নার্সারি হিসাবে বিবেচনা করেন। তারা বলেন, নৃতাত্ত্বিক মিল এবং সাংস্কৃতিক লেনদেন, জাতিতে জাতিতে ঐক্য, বৈচিত্র্য। একতা ইত্যাদি আন্তর্জাতিক মুল্যবােধের চর্চাকে পরিবারে এগিয়ে নিয়ে যাবে। একে অন্যের সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এক কৃষ্টির সাথে অনন্য কৃষ্টির পার্থক্যালােকে অগ্রাহ্য না। করে বা হেয় চোখে না দেখে, বরং শ্রদ্ধাশীল হওয়ার উপরে তারা জোর দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাদের মতে কুষ্টির ক্ষেত্রে একে অন্যের পার্থক্যগুলােকে একসাথে উৎসবমুখর। পরিবেশে পরিবারের প্রত্যেক উদযাপন করার ঐতিহ্যে তারা যেন বিশ্বাসী হয়।
কানাডীয় বাবা-মায়ের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের নিজ নিজ পরিবারের বৈচিত্র্য ভাইবােনদের এক বিশেষ ধরনের স্পর্শকাতরতা বােধ এবং অপরিসিম ধৈৰ্য্য দিয়েছে। শুরু থেকে তারা অনুভব করেন যে, তাদের প্রত্যেক শিশু যে সংস্কৃতিতে জন্মেছে সে সংস্কৃতির সাথে পুরােপুরিভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া উচিত । সেটা ঠিকমতাে করতে গিয়ে বাবা-মাকে যথেষ্ট পড়াশােনা করতে হয়েছে তাদের দত্তককায়িত ছেলেমেয়েদের দেশ ও জাতির ইতিবৃত্ত নিয়ে । অতপর প্রত্যেক শিশুর জাত ও সংস্কৃতির মৌলিক বিষয়গুলি জেনে তাতে সড়গড় হয়ে নেয়াটাই ছিল তাদের প্রথম কাজ।
কাজেই কানাডীয় বাবা-মায়েরা এ বিষয়টি মাথায় রেখেছিলেন তাদের শিশুর জাতিগােষ্ঠীর পরিচয় তার নিজের কানাডীয় পরিচিতির থেকে আলাদা কিছু নয়। যেহেতু কানাডা নানা জাতি, জাতীয়তা ও ধর্মের অনুসারী দেশ, তাদের সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় একটি স্থায়িত্বশীল ও নিরাপদ জায়গা গড়ে তুলতে বাবা-মায়েরা এ ব্যাপারে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার লক্ষ্যে। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য প্রয়ােজনীয় তাঁবুর খুঁটি বসান। তারা এটা বিশ্বাস করে তাদের প্রত্যেক ছেলেমেয়েদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন যে, কানাডীয় বহু সংস্কৃতির অংশ হিসাবে তাদের নিজ সংস্কৃতিকে সম্পৃক্ত করে কানাডীয় মূলস্রোতের সাথে মিশতে হবে।
তাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল দেখার যে, আন্তর্জাতিকভাবে দত্তক নেয়া ছেলেমেয়েরা। তাদের ঔরসজাত সন্তানদের তুলনায় নতুনতর ইস্যুর দ্বারা চ্যালেঞ্জ-এর সম্মুখীন হয় কিনা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এমন একটা পরিচিতি তৈরি করা যার দ্বারা নৃতাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ফুটে বের হয়, জাতিগত বিদ্বেষ ও বিচারবােধে উজ্জীবিত হয়ে বিদ্বিষ্ট আচরণ করা ইত্যাদি। কোনাে কোনাে মা-বাবা এমন মত পােষণ করেন যে, বহুসংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে কানাডাতে বেড়ে ওঠা তাদের আন্তবর্ণীয় ছেলেমেয়েরা যেন সব ধনের “কানাডীয় কার্যক্রমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। তাহলে তারা সংখ্যালঘুদের নিয়ে বাঁধা ধরা রসিকতা, বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য, কুসংস্কার ও বিদ্বেস এর সম্মুখীন হলেও সে সব চ্যলেঞ্জ মােকাবিলায় দক্ষ হবে। অন্য কথায়, মৌলিক খাপ খাইয়ে নেবার সক্ষমতা অর্জনের দ্বারা তাদের সন্তানেরা প্রতিরােধে সক্ষম হবে, সম্পদশালী হবে, আত্মবিশ্বাসের অধিকারী হবে এবং সর্বোপরি কানাডীয় জীবনে। একটা রেফারেন্স পয়েন্ট থাকবে। স্মৃতিচারণের সময় আবার কোনাে কোনাে মা-বাবা অচেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হবার গল্প বলেন, যারা সে সময়ে ওদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকেছেন, বিশেষ করে যখন শ্বেতাঙ্গ দম্পতিদের সঙ্গে দেখতেন অশ্বেতাঙ্গ ছেলেমেয়ে রয়েছে। পরিবারের জাতিগত বৈচিত্র প্রায়ই একটা আমােদের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত । কারণ অনেক লােক ছেলে অথবা মেয়েকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করতেনঃ “একে আবার কোথায় পেলেন?” অথবা “ওকে কবে আনলেন?” ওরকম প্রশ্নের জবাবে বাবা-মা অনেক সময় রসিকতা করে বলতেনঃ “মেইল অর্ডার ক্যাটালগে।”২৪ তারপরই হাঃ হাঃ হিঃ হিঃ মজার হলেও ওরকম কথাবার্তা হলে তারা দ্বিগুণ সতর্ক হয়ে থাকতেন। যার ফলে, যেমনটা বছরের পর বছর পার হয়েছে, তারাও তেমনি ধৈর্যশীল হয়েছেন বেশি বেশি, আর কম কম প্রতিক্রিয়াশীল । পেছনে তাকিয়ে স্মরণ করার চেষ্টা করেন কতবার তারা এরকম প্রশ্নের জবাবে কী বলেছেনঃ “বলুন তাে কেমন করে আপনাদের এমন জাতিগত বৈচিত্রে ভরপুর পরিবার হলাে?” অবশ্য এ কথাও ঠিক যে তাদের কাছে চটপটে জবাব যেমন ছিল, যারা সাদাসিধে মজা পেতে চায় তাদের, আবার চিন্তাভাবনা করে। দেবার মতাে জবাবও অনেকেই আশা করতেন, সেও হিসাব করে বলতে হতাে বৈকি! মনখােলা আলাপে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, কোনাে কোনাে বাবা-মা আবার শিশুর। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি তাদের ভালােবাসা ও অন্য কৃষ্টির প্রতি তাদের উদার মনের উপলব্ধি, শ্রদ্ধা ও আগ্রহের দিকটা সুদৃঢ়ভাবে প্রদর্শন করার জন্য প্রায়শঃই তারা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতেন ।
নিয়মিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা চেষ্টা করেছেন ছেলেমেয়েদের মনােযােগী ও কৌতূহলী করে গড়ে তুলতে । তাদের মতে, এ ধরনের অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ, অন্য কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ততা স্থাপন ও বজায় রাখার উত্তম পন্থা। তারা খেলাধূলা, শিল্পকলা, হাতের কাজ, সংগীত ও ধর্মবিষয়ে আলাপ আলােচনাসহ যতটুকু সম্ভব সম্পৃক্ততা বজায় রাখেন। ওরকম করতে গিয়ে তারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের বলতেন, তাদের যােগাযােগ ঋদ্ধ করতে, যারা উল্লিখিত কর্মে নিযুক্ত, তাদের সঙ্গে যােগাযােগের মাধ্যমে। তারা আরও মত পােষণ করেন যে বহু জাতিকতার বহুমাত্রায় শিক্ষা নিয়ে তাদের ছেলেমেয়েরা সাম্য, সুবিচার ও অন্যের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে জীবনে আরও উৎকৃষ্টকর এবং উন্নয়নশীল দেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এটাও বেরিয়ে আসে মা-বাবা সবসময় চেয়েছিলেন যে, তাদের সন্তানেরা যেন একই দেশের অন্যান্য শিশুর সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলে। পােষ্য শিশুরা পারিবারিক বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে চলতে শিখবে, যেমন- স্থানীয় খাবার খাওয়া, ছবি দেখা, বই পড়া এবং সাংস্কৃতিক ক্যাম্পে যােগদান করবে। কিন্তু এটাও দেখা গেল যে এই যুগলদের মধ্যে অবশ্য এমন পরিবারও ছিল যারা তাদের ছেলেমেয়েরা অপ্রধান সাংস্কৃতিক কান্ডকারখানায় যােগ দিক এটা পুরােপুরিভাবে চাননি। অন্য কথায়, তারা মনে করতেন, জাতিগত তফাৎ-এর ব্যাপারটা প্রণিধানযােগ্য। এ পার্থক্যটা তাদের ছেলেমেয়েদের সমগ্র জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে। অতএব তারা একান্তই চেয়েছিলেন তাদের সন্তানেরা যেন প্রথমত তাদের নিজেরেকে কানাডীয় গণ্য করে । হয়তাে এ কারণে পরিবারের বহুজাতিক মাত্রার যে বৈশিষ্ট্য, যদিও সব মা-বাবাই এটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, সবার আলােচনা এক্ষেত্রে এক কথাতে হয়নি, অর্থাৎ একরৈখিক আলােচনার রূপ নেয়নি। কোনাে কোনাে মা-বাবা তাদের সন্তানদের যে উৎস বিষয়ে আগ্রহী এবং গর্বিত, এ ব্যাপারটাকে কম বেশি উৎসাহিত করেছেন। বনি বিশ্বাস করেন যে “দত্তকগ্রাহী মা-বাবার উচিত তাদের বহুজাতিক সন্তানদের ঐতিহ্য বিষয়ে জানতে চেষ্টা করা এবং আরও চেষ্টা করা যে তারা যেন সন্তানের উৎস ঐতিহ্যে গর্ববােধ করেন, কারণ তাতে শিশু তার নিজের ঐতিহ্যকে ভালােবাসতে শিখবে।”২৬ ফেরিরা (হেলকে এবং রবাট) তাদের দুজন বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুকে ভারতের বাের্ডিং স্কুলে পাঠিয়েছিলেন, যাতে তারা ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে ।
হেলকের মতে, “চৈনিক মুখ, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মুখ, অথবা বাদামি মুখে বাদামের মতাে তীর্যক চেড়াচক্ষুর অধিকারী একজন যদি হেসে বলে ‘আমি কানাডীয়,’ সেটা হবে বােধহয় সর্বসেরা প্রশংসনীয় মন্তব্য যা আমার দেশকে আপনি দিতে পারেন।” উলসিদের মেয়ে আমিনা প্রিমা চৌধুরীর (আমিনার মা-বাবা ফারুক ও পলিন চৌধুরীকে চিনতেন) ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিল। চৌধুরী পরিবারের মাধ্যমে আমিনা অন্টেরিওর লন্ডন এলাকায় বাঙালি জনগােষ্ঠীতে দশজনের দেখা হলেই সেখানে ডাক পেত এবং যেত । আমিনার মা-বাবা আমিনাকে বাঙালি ও ভারতীয় কানাডীয়দের সাথে মেলামেশাতে সবসময় উৎসাহ দান করছেন এবং জোর দিয়ে সেটা সমর্থন করতেন। তার কারণ, উলসিদের বিশ্বাস। যে, তাদের দত্তকায়িত মেয়ের সংস্কৃতি তাদের বহুজাতিক পরিবারের সংস্কৃতির একটা। গুরুত্বপূর্ণ ধারা যা বহমান রাখতে হবে বিভিন্ন সংস্কৃতির সম্পৃক্তত্তার মাধ্যমে। ১৯৮৯ সালে ডনা উলসি বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেয়া লন্ডন (অন্টেরিও) এলাকাবাসী। | একদল ছেলেমেয়েদের বাংলাদেশ সফরের আয়ােজন করেন (বিশদ জানতে সপ্তম অধ্যায় | দেখুন)। স্মৃতিচারণে এও জানা গেল একবার ডনা আমিনাকে বলেছিলেন, “আমরা চাইনি যে তুমি এমনভাবে বড় হয়ে উঠবে যে, ভাববে, তাহলে পৃথিবীতে সব কাজ করার একই উপায় রয়েছে (কানাডীয় পন্থা অথবা উলসিদের মতাে করে)। আমরা চেয়েছি যে তুমি বড় হবে আর স্বাভাবিকভাবে চারদিকে দেখবে, জীবন কীভাবে বিকশিত হয়, লােকে কাজ কত ভাবে। করে, খাওয়া দাওয়া করে, পােশাক পরে এবং ভাবে আরও কত রকমেই না ঐসব কাজ করা সম্ভব। তাই আমরা বিভিন্ন দেশের খাবার রান্না করতে শিখেছি, নানা স্থানীয় খাবার দোকানে খেয়েছি। নানা বর্ণের মানুষের সাথে মেলামেশা করেছি। আমাদের জন্য এ বিচিত্র আগ্রহ স্বাভাবিক ছিল। আমরা তােমাকেও এ ধরনের পৃথক পৃথক অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম,” আমিনা তার গবেষণাপত্রে এ রকম বলেছে, তার বিচিত্র পরিবারের বর্ণনায়, যে পরিবারে তারা ৬ জন আন্তবর্ণীয় ভাইবােন একসাথে মানুষ হয়েছে।
অমিনার মনে পড়ে, যখন সে বড় হয়ে ওঠছিল তখন নানা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। “আমার যতদূর মনে পড়ে, আমার বাড়ি আমার মা-বাবার ব্যক্তিগত যাদুঘরের মতাে ছিল। আমাদের বাড়ির দেয়ালগুলাে তাদের অভিযান, তাদের জীবনযাপনের জীবন্ত দলিল, সাক্ষী। তারা যেখানে যেখানে গিয়েছেন, যেসব জায়গার, যেমন- ফ্রান্স, আফ্রিকা, ভিয়েতনাম, কোরিয়া এবং জার্মানির আঁকা ছবি, অজস্র মুখােশ, কাঠের হস্তশিল্প, নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র দেয়ালগুলির শােভাবর্ধন করেছে। আপনি বাড়িতে ঢুকলে সুইজারল্যান্ডের একটি কোকিল ঘড়ি আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবে। পারিবারিক ঘরে ঢুকলে দেখবেন, দুটি কাঁচের শােকেসে আমার মায়ের পুতুলের সংগ্রহ, পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের কমপক্ষে একটি পুতুল, যেখানে আমার মা গিয়েছেন, সেখান থেকে এসেছে। মধ্য প্রাচ্য থেকে দ্য গুড সিলভার, ডিনার প্লেটগুলাে আফ্রিকার, বলিভিয়ার হস্তশিল্প, বেডরুম সেট, জুলি এবং আমার বেডরুম ফার্নিচার বাংলাদেশের । আমাদের বাড়ি অনেকটা আমাদের শিক্ষার ক্লাসরুম।” আবার বিপরীতে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রিবেইরােরা (রােবের্তো এবং মার্গো), তাদের বাংলাদেশি ছেলে মার্টিনকে বাংলাদেশের ইতিহাস জানার জন্য বেশি খোঁড়াখুঁড়ি করতে বারণ করেছেন। রােবের্তোর ভাষ্য অনুসারে, যেহেতু মাটিনকে স্কুলের শুরু থেকে শেখার ব্যাপারে একটু ধীরগতিসম্পন্ন মনে হয়েছিল তারা তাকে অতিরিক্ত পাঠ্য বিষয়ের চাপে না রাখার সিদ্ধান্ত নেন। অতিরিক্ত বিষয় সম্পর্কে হয়তাে কোনাে আগ্রহবােধই করেনি । ক্লাসের বাইরে অতিরিক্ত পড়াশােনার ব্যাপারটি বাবা-মা সম্পূর্ণ মার্টিনের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন (পঞ্চম অধ্যায়ে-এ বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে)। মার্টিন সম্পর্কে রিবেইরােদের মত ছিল এরকমঃ তাদের ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে তাদের নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে। মা-বাবার কাজ হবে কেবল তাদের সন্তানদের পটভূমিতে পরিচয় করিয়ে দেয়া, জায়গা দেখিয়ে দেয়া।” ১৯৭২ সালে যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন বাংলাদেশ থেকে একটি শিশু দত্তক নেয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল হার্ট (জোয়েল ও ট্রডি) পরিবারের জন্য। নানা দেশের শিশুদের দত্তক নিয়ে তারা যে পরিবার গড়েছেন সে পরিবারের আকর্ষণীয় বৈচিত্র্যতা শুরু থেকেই লক্ষণীয়।
পুরনাে ডায়েরি এবং নােটবই থেকে ঝাড়াই বাছাই করে প্রায় সব বাবা-মা তাদের প্রত্যেক । শিশুর বিষয়ে একটি করে স্ক্র্যাপবুক রেখেছিলেন। এর মধ্যে হয়তাে খবরের কাগজের কেটে। রাখা টুকরাে টুকরাে খবর, স্কুল রিপাের্ট কার্ড, সার্টিফিকেট, ছবি, পুরস্কার অথবা ব্যক্তিগত। বিবরণী যাতে লেখা কী ঘটেছিল । তাদের মনে আছে তারা সকলেই গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন কোলে-পিঠে মানুষ করা শিশুরা কবে বড় হবে! কবে দেখবে তারা কী ছিল আর কী হয়েছে! নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে গিয়ে, বাবা-মা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাদের ছেলেমেয়েদের পেছনে লেগে থাকতে হয়েছে। এক অর্থে তাদের পরিবারের প্রতিটি শিশু ছিল। এক একটা বিল্ডিং ব্লক, কানাডীয় মােজেইকের এক এক অংশ । সফলভাবে পরিবারকে ‘বহুজাতিক’ এবং বহুরৈখিক’ পরিবার গঠন করে তারা প্রমাণ করেছেন, বাস্তবিকপক্ষে। আন্তবর্ণীয় ও আন্তর্জাতিক দত্তক ব্যবস্থা একটা সহজাত পন্থা। কানাডীয় বাবা-মায়েরা বিশ্বাস করেন যে, তাদের বহুজাতিক পরিবার কানাডাতে উৎকৃষ্টতর। দত্তক ফলাফল অর্জনে সহায়ক হয়েছে । নিঃসন্দেহে এই যুদ্ধশিশুদের কোলে পিঠে মানুষ। করে তারা এটাই প্রমাণ করেছেন যে, চরম বৈরী পরিবেশে জন্ম নিয়েও শেষ পর্যন্ত আজ কানাডাতে সুখে স্বাচ্ছন্দে বাস করছে যথাযথ দত্তকায়নের জন্যই ।

সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী