You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.05.19 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | ঢাকা উন্নয়ন সংস্থার নাভিশ্বাস | ইসরাইলের আগ্রাসী মানসিকতা | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৯শে মে, রোববার, ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

ঢাকা উন্নয়ন সংস্থার নাভিশ্বাস

ঢাকা সুন্দরী হবে, রূপসী হবে। অঙ্গে উঠবে তার নূতন সাজ। নূতন নূতন পরিচয়ে এই পুরনো নগরীকে বার বার নূতন সাজে সজ্জিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কোন পরিকল্পনার পরি উড়ে শুধু কল্পনাই থেকেছে, আবার কোন কোনটির বা কাজে হাত দেয়া হয়েছে। কোনটিই শেষপর্যন্ত সফল হয়নি। দিনের পর দিন বয়সের বলিরেখা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে।
দেশিক রাজধানী থাকার সময় ‘গেঁয়ো ঢাকাকে’ আধুনিকতায় রূপান্তর করার একটা পরিকল্পনা গৃহীত হয়। সে ১৯৫৬ সালের কথা । ২০ বছর ঘষামাজা চলবে। ইট চুন-সুরকির প্রলেপ পড়বে। নগরীর মাঝখান দিয়ে তৈরি হবে সড়ক। আলিশান প্রাসাদ উঠবে, গড়া হবে আরও স্কুল-কলেজ-বিদ্যাপীঠ। নগরবাসীর স্বাস্থ্যের উন্নতি কল্পে ব্যবস্থা গৃহীত হবে। নগর উন্নয়ন এর জন্য একটা সংস্থাও গঠিত হলো।
এরপর অনেক দিন, অনেক মাস, অনেক ক’টি বছর পেরিয়ে গেছে। পরিচয়ও বদলে গেছে ঢাকার। এখন আর প্রদেশ পাল বসেন না সেখানে, নূতন একটা দেশের ‘রাজা-উজির-নাজির-কোতওয়াল’ সবাই বসেন ঢাকায়। নিত্য নূতন আশ্বাসের আর পরিকল্পনার ফোয়ারা ছুটলো। কেউ বলেন ঢাকাকে এবার ‘প্যারিস’ করা হবে, আবার কেউ বলেন ‘না ওয়াশিংটন’। আইসল্যান্ড গুলোতে নগরবাসীর সৌন্দর্যচেতনা স্বাক্ষর থাকবে। ফুলে ভরে উঠবে সড়কের মধ্যখানের ঐ বিঘেত পরিমাণ জমি।
আটাশ মাস চলে গেছে স্বাধীনতার পর। কথা ফুলছড়িতে কাজ হয়নি নূতন দেশের নূতন রাজধানী। গাঁ-গঞ্জের অবস্থা উল্লেখ না করাই ভালো। সেখান থেকে ছুটে আসছে অসংখ্য মানুষ। একটু আশ্রয়ের আশা, অন্নসংস্থানের এতোটুকু উপায় যদি খুঁজে বের করা যায় সেই প্রত্যাশা। লোক বাড়ছে, বাড়ছে কর্মচঞ্চল্যতা। সারা দুনিয়ার সাথে এখন সংযোগ রক্ষা করতে হয় ঢাকাকে। নূতন পরিচয় তাই ঢাকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং কূটনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে আগের চাইতে অনেক গুণ বেশি। অথচ পরিকল্পনা আর আশ্বাসবাণী ছাড়া নির্মাণ, সম্প্রসারণ অথবা সংস্থার কোন কাজেই আগায়নি। ডিআইটি অর্থাৎ ঢাকা উন্নয়ন সংস্থা নামক যে প্রতিষ্ঠানটি জন্ম হয়েছিল সেই উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য খবরে প্রকাশ তারও নাকি মৃত্যুদশা। এ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারের খাজাঞ্চিখানা থেকে ধার করেছে ২১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ফেরত দেবার সামর্থ্য না থাকায় এবছর সরকার যে নূতন করে ১ কোটি ৩৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছিলেন তাও নাকি সেই সংস্থাটির ভাগ্যে আর জুটছে না। আয় তার বার্ষিক ৬ লক্ষ টাকা অথচ পাইক-পেয়াদা পুষতেই নাকি তার খরচ হয় বছরে ২৫ লক্ষ টাকা। ৭৫০ জন কর্মচারী অথচ যে কাজ তা নাকি দেড়শ’ লোক দিয়েই ভালোভাবে চালিয়ে নেওয়া যায়। কথা উঠেছিলো বাতি কর্মচারীদের অন্য কোন সংস্থার কাজে লাগানোর। কিন্তু কর্মচারীরা তাতে রাজি হয়নি। মোটের উপর ঢাকা উন্নয়ন তো দূরের কথা এই উন্নয়নের দায়িত্ব যাদের হাতে তারা এখন পটল তুলতে বসেছে।
ঢাকা তাই ’প্যারিস ও’ হয়নি, ‘ওয়াশিংটনও’ না। নুতন কোন রং উঠে নি, ঢংটি ছাড়া। আসলে পরী ডানা লাগিয়ে কল্পনার আকাশে বিচরণ করার চাইতে মাটিতে হাঁটাই ঢের বেশি ভালো। মাটির ধাক্কা যদি পায় থেকেই থাকে তবে এখন বাস্তব দুনিয়ায় চোখ রাখা দরকার। ঢাকার সম্প্রসারণ, উন্নয়ন ও সংস্কারে বাস্তব কিছু কাজ হাতে নেওয়া প্রয়োজন। ফুল যাক, ইট-চুন-সুরকি পড়ুক জমিনের উপর।

ইসরাইলের আগ্রাসী মানসিকতা

গত ১৫ই মে বুধবার প্যালেস্টাইনের তিনজন কমান্ডো লেবানন সীমান্তের নিকটবর্তী মালোতের স্কুলে প্রবেশ করে প্রায় ৯০ জন ছেলে মেয়েকে আটক করে। হাজার ছেলেমেয়েদের মুক্তির বিনিময়ে তারা ইসরাইলের কারাগারে আটক ২০ জন সহযোগীর মুক্তি দাবি করে। অন্যথায় তাদের হত্যা করা হবে বলেও কমান্ডোরা হুমকি দেয়। ওই বন্ধুদের মধ্যে জাপানি সন্ত্রাসবাদি কোজা ওকামোতোও আছেন। দু’বছর আগে বিমানবন্দরে ২৬ জনকে হত্যার দায়ে তিনি অভিযুক্ত হন। গেরিলাদের নিরাপদে দামেস্ক ফিরে যাওয়ার জন্য তারা একটি বিমান ও দাবি করে।
(অস্পষ্ট) প্রেক্ষিতে ইসরাইলি মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠকে বসে। তিন ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠক শেষে ইসরাইল সরকার প্যালেস্টাইনি বাহিনীর দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি জানায়। কিন্তু তারপরও অকস্মাৎ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ইসরাইলি বাহিনী স্কুল ভবনে আক্রমণ চালালে গেরিলা তিনজন উক্ত স্থানেই মারা যায়। তার সাথে ১৬ জন নিষ্পাপ শিক্ষার্থী শিশু মৃত্যুহার নির্মমভাবে নিহত হয়। এবং প্রায় ৭০ জন আহত হয় । ঘটনার পরিণতি দৃষ্টে শিশু হত্যার জন্য ইসরাইলকেই দায়ী মনে হয়।
এই প্রসঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নও মালোতের ১৬টি জিম্মি শিশু হত্যার ব্যাপারে ইসরাইলকেই দায়ী করেছে। তাদের মতে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর বিশ্বাসভঙ্গের জন্যই এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং অকালে কতগুলি সম্ভাবনাময় অমূল্য প্রাণ হারিয়েছে। তার পরদিনেই ইসরাইলি আগ্রাসী বাহিনী দক্ষিণ লেবাননের প্যালেস্টাইনী উদ্বাস্তুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৪০ জনকে হত্যা এবং ১২০ জনকে জখম করেছে।
প্রসঙ্গক্রমে গোলান রণাঙ্গনের কথা উল্লেখ করা যায়। ইসরাইলের আগ্রাসন নীতির আগুনের গোলান রণাঙ্গন আজ পুড়ছে। অবিশ্রাম গোলাগুলি বর্ষণে সেখানকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং সার্বিকভাবে জনজীবন বিপন্ন। ইসরাইলি হামলার নির্লজ্জ প্রকাশের যাতনায় সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতি ঘোলাটে। যার প্রতিফলন বিশ্বশান্তি পরিস্থিতিকে পর্যন্ত বিপুলভাবে নাড়া দিচ্ছে।
সম্প্রতি সিরিয়া ও ইসরাইলের সৈন্য বিচ্ছিন্নকরণের ব্যাপারেও ডঃ হেনরি কিসিঞ্জার আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এ ব্যাপারে শুক্রবার রাতেও কিসিঞ্জার ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদের সঙ্গে আলোচনা হয়। সিরিয়া-ইসরাইল সৈন্য বিচ্ছিন্নকরণের ব্যাপারে ডঃ কিসিঞ্জারের বর্তমান প্রয়াসের মুখে ইসরাইলের এ হেন আগ্রাসী হামলায় ১৬টি কচি তাজা প্রাণ নিধন সংবাদ বিশ্ববাসীকে উতলা করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে-শক্তিমদগর্বে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি তথা বিশ্ব পরিস্থিতিকে একটা অশান্তির কুপে নিক্ষেপ করার স্পর্ধা ইসরাইল কোথায় পায়? জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কোন সিদ্ধান্ত বা সুপারিশ তারা মানে না, যে কোন শান্তি কমিশনের কল্যাণ বাণীকে তারা চূড়ান্ত অবহেলা প্রদর্শন করে এবং স্বেচ্ছাচারী নীতিতে যাচ্ছেতাই আচরণ করে। আর তাদের স্বেচ্ছাচার মুলক আচরণের কখনো উদ্বাস্তু কখনোবা শিক্ষার্থী নিহত হচ্ছে। বিনা অপরাধে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই বিশ্বমানবতার বর্ণভেদ করে কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে। নিরীহ প্রাণ গুলো রাজনৈতিক কোন্দলের শিকার হচ্ছে। এর জন্য দায়ী কে? মানবতার প্রশ্নে বর্তমান বিশ্ব আজ সোচ্চার। ইতিহাস বলে বর্বরতা বনাম মানবতার যুদ্ধ চিরকাল বর্বরতারই হার হয়েছে। তাছাড়া ইসরাইলে আজ আভ্যন্তরীণ সমস্যাবলীও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী গোল্ডমায়ারের পদত্যাগ সংক্রান্ত ঘটনা তারই নজির। অতএব আমন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক সমস্যার প্রেক্ষিতে ইসরাইল যদি এখনো শান্তি সমঝোতা ও বিশ্ব মানবতার কল্যাণ বাণীতে উদ্ভূত না হয়, তাহলে হয়তো পৃথিবীর মানচিত্র থেকে তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতেও পারে। কারণ, ইজরাইল এত যে আচরণ করছে তারা শুধু বিশ্ব মানবতার প্রতি উদ্যত খড়গই নয়-এ আত্মহননের সামিল। বিশ্ব বিবেকের শাশ্বত সত্যবোধের কাছে তাদের আগ্রাসী নীতি কখনো সমর্থন পায়নি ভবিষ্যতেও পাবে না।
এযাবত এর প্রতিটি আক্রমণাত্মক আচরণ তাদেরকে পর্যাপ্ত ঘৃণা আর ধিক্কারই এনে দিয়েছে। জাতি হিসেবে এই কলঙ্কও বড় বেশী লজ্জার। তাই আমরা ইসরাইলের শুভবুদ্ধির উদ্বোধন চাই। একমাত্র সেই পথেই মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি আসবে এবং বিশ্বশান্তি আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হবে। নতুবা ডঃ কিসিঞ্জারের শান্তি প্রস্তাব করে ফল হবে না। ইসরাইলকে তার বর্তমান নীতি পরিত্যাগ করতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন