লিয়াকত আলী খান কর্তৃক উত্থাপিত অবজেকটিভ রেজ্যুলুশন ও তার উপর বক্তৃতা, পাকিস্তান গন পরিষদ মার্চ, ১৯৪৯
সংবিধানের উদ্দেশ্যসমূহ কি হবে তার উপর লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যঃ
“পরম করুনাময় ও দয়ালু আল্লাহ তায়ালার নামে শুরু করছি’।
সমগ্র মহাবিশ্বের উপর সার্বভৌমত্তেদাবি কেবল সর্বশক্তিমান আল্লাহর এবং তিনিই এই দেশ চালনার কর্তৃপক্ষ নির্ধারন করে দেন।,যে মহান আল্লাহ তায়ালা পাকিস্তান কে তাঁর জনগণের কাছে অর্পণ করেছেন, সেই পবিত্র মহামহিমের পবিত্রতার উপর ভরসা করে শুরু করছি।
এই গণপরিষদের উদ্দেশ্য হলো, একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জনগণের জন্য একটি সংবিধান প্রনয়ন করা।
যেখানে প্রতিটি রাজ্য জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রয়োগ করবেন।
যাতে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সমতা, সহনশীলতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতিসমুহ ইসলামের নিয়মানুযায়ি প্রয়োগ হবে।
প্রতিটি মুসলিম যেন কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে জীবন যাপন করতে পারে। *
তবে সংবিধানে সংখ্যালঘুদেরও অবাধে তাদের ধর্মের অনুশীলন ও তাদের র সংস্কৃতির বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে।;
পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলকে সুবিধানুযায়ি বিভিন্ন যোনভুক্তকরা হবে।কিংবা সম্মিলিত পাকিস্তানেএকটি ফেডারেশন গঠন করা যেতে পারে যেখানে বিভিন্ন জায়গা বিভিন্ন ইউনিট হিসাবে তার সীমানা, ক্ষমতা ও কতৃত্ত নির্ধারন করা থাকবে। তবে প্রতিটি অঞ্চল থাকবে সায়ত্তসাশিত।
যেই সংবিধান হবে সবার জন্য, আইন দ্বারাসিদ্ধ, নাগরিকদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংরক্ষিত থাকবে, ন্যায়বিচার, নারীপুরুষ সমমর্যাদার এবং চিন্তার, অভিব্যক্তি, বিশ্বাস,পূজাপার্বনসহ ধর্মিয় আচার অনুষ্ঠান পালন ও নানা সংগঠন করার স্বাধীনতা সমুহ নিশ্চিত হবে। আর নিশ্চিত হবে মৌলিক অধিকার, আইন এবং জনগনের নৈতিকতা। সংবিধানে সংখ্যালঘু ,অনগ্রসর ও প্রান্তিক শ্রেনির বৈধ স্বার্থ রক্ষা করতে হইবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুরোপুরি সুরক্ষিত করা হবে। সর্বোপরি পাকিস্তানের এই ফেডারেশনে , তার মাটি, সমুদ্র সীমা , স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ত সমুন্নতও সুরক্ষিত রাখতে হবে।
যেন পাকিস্তানের মানুষের উন্নতিলাভ করতে পারে এবং বিশ্বের দেশগুলি মধ্যে তাদের ন্যায়সঙ্গত এবং সম্মানিত স্থান অর্জন করে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি , অগ্রগতি এবং মানবতার জয়গান গাইতে পারে ও তাতে অবদান রাখতে পারে।
স্যার, আমার বিবেচনায়, এই সময় টি আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্তপুর্ন। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি মাত্র। আমরা শুধুমাত্র আমাদের আদর্শ মোতাবেক একটি দেশ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার সুযোগ জিতেছে। . আমি এই হাউজের সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, জাতির জনক, কায়েদ-ই-আজম এই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন অনুভূতি ও অভিব্যক্তি ব্যাক্ত করেছেন এবং তদানুসারে বিভিন্ন যুগোপযুগি সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টিরন কারন হলো এই উপ-মহাদেশের মুসলমানরা ইসলামের শিক্ষা ও ঐতিহ্য অনুযায়ী তাদের জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ।কারণ তারা সারা দুনিয়ার কাছে প্রমান করতে চেয়েছেন যে বর্তমানে সারা পৃথিবীর মধ্যে যে অসুস্থ মানবতা বিরাজ করছে, তার একমাত্র প্রতিষেধক হলো ইসলাম।এই কথা আজ সর্বজন স্বীকৃত যে বর্তমানে বিজ্ঞান যুগের সাথে তাল মিলাতে যেয়ে ফ্রাঙ্কেন্স্ইটাইনের দানবের মতো আবির্ভুত হয়েছে, ফলে মানবতা আজ হুমকির মুখে।এই ধ্বংসযজ্ঞে শুধু মানবতা নয়,পরিবেশ এবং তাতে বসত করা জীব সম্প্রদায় ও বিপর্যস্ত হয়ে পরছে। একথা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন যে, যদি মানুষ,তার জীবনের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ উপেক্ষা না করে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার বিশ্বাস যদি দুর্বল না হয়, তবে বিজ্ঞানের এই অভিশাপ কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা।একমাত্র ঈশ্বরভক্তি মানবতাকে রক্ষা করতে পারে। কাজেই বলা যায়, মানুষ তার মন্যুষত্ব, তার নৈতিকতার কথা চিন্তা করেই তার ক্ষমতা ব্যাবহার করা উচিত,যে আদর্শ আমাদের নবী রাসুল ও ধুর্মগুরুগন যুগে যুগে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধর্মের ও সমপ্রদায়ের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আমরা, পাকিস্তানিরা সিংহভাগই ধর্মভীরু মুসলিম। অতএব, ‘মহাশয়, আপনি খেয়াল করে দেখবেন যে আসলে একটি অকপট এবং দ্ব্যর্থ রেজোলিউশনের সাথে ঈশ্বরের প্রতি অনুগত হওয়ার কত মিল আছে। এটা পুরোপুরি সত্য যে এই একটি রাষ্ট্র যেখানে আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়টি গুরুত্তপুর্ন সেখানে জনগণের শাসনে কোন অংশ আসল খেলা চালিয়ে যাবে বা যাওয়া উচিত তার সাথে ম্যাকিয়াভেলিয়ান ধারণা সরাসরি সাংঘর্ষিক।
কিংবা এটা নিজেদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে এটা বাইরের লোকদের দেখানো যে রাজ্য বদান্য এবং তার মন্দ হওয়া উচিত নয়।. কিন্তু আমরা, পাকিস্তানের জনগণ, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, তিনি আরশের উপর অধিশায়িত আছেন এবং ইসলামি ছায়াতলে থেকে যেন কিছুর অপব্যাবহার না হয় বরং সব কিছুই যেন ইসলামি ভাব ধারা অনুযায়ি হয় । দায়িত্ত একেকটি বিশ্বাস,যা স্বয়ং ঈশ্বর ই ন্যাস্ত করেন, যেন তারা মানুষের সেবা করতে পারে,যেন তা স্বৈরাচারী কিঙ্গবা সার্থপরতার প্রতিনিধিত্ত না করে। অধিকন্তু আমি বলতে চাই, যে এটা রাজ রাজরা বা শাসকের মৃত্যুর পর প্রাপ্ত ঐশ্বরিক অধিকার নয়। বরং ইসলামের স্পিরিটে ও আদর্শে উদবুগ্ধ এবং জনগণের উপর বর্তানো ক্ষমতা যা আর কারো নয়।
এই কারণে এই রেজোলিউশনএটা পরিষ্কার যে, যে রাজ্য তার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সকল ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রয়োগ করবে। এটাই হলো গনতন্ত্রের মুল কথা। কারণ, জনগন ই সব কর্তৃত্ব প্রাপক হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে এবং তাদের প্রতিনিধিদের হাতেই শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে।
জনাব, আমি মাত্রই বলেছি যে, জনগনই প্রকৃত ক্ষমতার প্রাপক। স্বাভাবিকভাবেই এটি কোনো ধর্মশাসন(theocracy) প্রতিষ্ঠিত হবার ঝুঁকি দূর করে। এটা সত্য যে আক্ষরিক অর্থে, ধর্মশাসন(theocracy) বলতে সৃষ্টিকর্তার সরকার বোঝায় ; সৃষ্টিজগতের এমন কোনো কিনারা কি আছে যেখানে তার কর্তৃত্ব নেই ? এই অর্থে , অবশ্য প্রতীয়মান হয় যে সমস্ত মহাবিশ্বই ধর্মশাসন । কিন্তু বাস্তবিক অর্থে, ধর্মশাসন বলতে বোঝায় ধর্মগুরুদের পরিচালিত সরকার, যারা, ধর্মীয় পদের অবস্থা থেকে নিজেরদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী করেন এমন ব্যক্তিবর্গ দ্বারা বিশেষভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে কর্তৃত্ব পরিচালনা করেন । আমি এই বিষয়টিতে অতিমাত্রায় গুরুত্বারোপ করতে পারছি না যে, এমন ধারনা ইসলামে পুরোপুরি অপ্রচলিত। পৌরোহিত্য বা ধর্মীয় পদের অবস্থান এর কোনো স্বীকৃতি ইসলামে নেই। এবং তাই, ইসলামে সাধারণভাবেই ধর্মশাসন এর কোনো প্রশ্নই ওঠে না । পাকিস্তানের রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থা এর সাথে একই কাতারে ধর্মশাসন শব্দটি ব্যবহার করে এমন কেউ যদি থেকে থাকেন, হয়ত তারা ভুল ব্যাখ্যায় ভুল বিশ্বাসে আছেন নয়ত উদ্দেশ্যমূলক ক্ষতিকর অপপ্রচার চালাচ্ছেন।
আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন যে সমস্যা সমাধানের অলক্ষ্যে গনতন্ত্র , স্বাধীনতা ,সমতা,সহনশীলতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর জোর দিতে হবে এবং তাছাড়াও এসমস্ত নীতিমালা অবশ্যইসংবিধান অনুযায়ী পালন করতে হবে যেটা ইসলামে সুস্পষ্ট করে উল্লেখ করা আছে । এই সমস্ত শর্তাবলী অবশ্যই প্রশমিত করতে হবে কারন এগুলো সাধারনত শিথিল অর্থে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ পশ্চিমা শক্তি ও সোভিয়েত রাশিয়া দাবি করেছে তাদের সংবিধান গনতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত কিন্তু এটা স্পষ্টত তাদের মূলনীতি পুরোটাই আলাদা । তাই তাদেরকে ভালভাবে বুঝানোর জন্য হলেও শর্তাবলীকে আরো স্পষ্টত হওয়া চাই। যখন আমরা ইসলামিক দৃষ্টিতে গনতন্ত্রকে ব্যবহার করবো তখন আমাদের জীবনের সকল দিকে এর অনুপ্রবেশ ঘটবে। আর এটা আমাদের সরকার ও সমাজ ব্যবস্থার সাথে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করবে কারন –ইসলামিক ধারনার সবচেয়ে বড় অবদান হল সকল মানুষ সমান । ইসলাম কখনোই জাতি-বর্ন বা গোত্র বিশেষে আলাদা করে না ,এমনকি তার শেষ দিনেও নয় । কুসংস্কার মানুষকে অন্যান্য ধারনা থেকে কলুষিত করে যেখানে ইসলামিক সমাজ পুরোপুরিভাবে কুসংস্কারমুক্ত ।আমাদের বিশাল সুনাম আছে শুধু সরকারের অধীনে নয় , মধ্যযুগে সংখ্যালঘু দেশগুলোতেও একই রকম স্বাধীনতা ভোগ করত । যখন খ্রিষ্টান ধর্মবিরোধী ও মুসলমানদের উপর অত্যাচার করে তাদেরকে নিজ বাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হত , প্রাণীদের মত শিকার করতো এবং অগ্নিদগ্ধও করতো কিন্তু ইসলামিক সমাজে কখনোই অপরাধীদের অগ্নিদগ্ধ করা হত না । যারা নিপীড়ন ও স্বৈরাশাসন থেকে বাচতে চাইতে তাদের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল ইসলাম । এটা খুবই সুপরিচিত ইতিহাস যে যখন ইহুদী বিদ্ধেষ বিরোধিতা ইউরোপের অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়ল , তখন অটোম্যান সম্রাজ্র তাদেরকে আশ্রয় প্রদান করেছিল । মুসলিম জাতির সহনশীলতার সবচেয়ে বড় প্রমান হচ্ছে ,তাদের এমন কোন শক্তিশালী দেশ ছিল না যারা তাদের নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে পারে । তারপরেও ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের কর্তৃত্ব ছিল তবে অমুসলিমদের অধিকার সবসময়ই সুরক্ষিত ও গচ্ছিত ছিল । স্যার,এছাড়াও মুসলিমদের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেকেই বিকশিত হয়েছে ভারতে । আপনারা সবাই জানেন মুসলিম শাসকদের অনুপ্রেরনায়ই সর্বপ্রথম হিন্দুধর্ম গ্রন্থের অনুবাদ সংস্কৃত থেকে বাংলায় করা হয় । মূলত এধরনের সহনশীলতা দ্বারাই ইসলামকে বিবেচনা করা হয় যেখানে সংখ্যালঘুরা দুঃখকষ্টে বসবাস করে না বরং তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি বিকাশে যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা প্রদান করে থাকে যা সমগ্র জাতিকে গৌরান্বিত করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে । সামাজিক বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও আমি বলবো ইসলামের সতন্ত্র ভূমিকা আছে । ইসলাম এমন একটা সমাজ বিবেচনা করে যেখানে সামাজিক বিচার মানেই উদারতা বা নির্মমতা নয় ।ইসলামিক সমাজ ব্যবস্থায় বিচার মূলত মৌলিক চিন্তাধারায় ও আইনের উপর ভিত্তি করে করা যা মানুষকে মুক্তজীবন ও স্বাধীনতায় সমৃদ্ধশালী করে । ঠিক এই কারনেই গনতন্ত্র , স্বাধীনতা , সমতা , সহনশীলতা এবং সামাজিক ন্যায়-বিচারের সংজ্ঞা আলাদাভাবে দেয়া যেতে পারে যা গভীর ও বিস্তর অর্থবহ ।
পরবর্তী দফায় ইসলামের নিয়মানুসারে সকল মুসলিমকে আলাদা ও সমষ্টিগতভাবে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর দেখানো পথ অনুসারে জীবনযাপান করতে হবে । এটা স্পষ্ট যে মুসলমানেরা যদি তাদের ধর্মের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে তাহলে ননমুসলিমদের কোন সমস্যা হবার কথা না ।এছাড়াও স্যার আপনি লক্ষ্য করবেন রাষ্ট্র এখন আর নিরপেক্ষ নাই , যেখানে মুসলমানরা তাদের স্বাভাবিক ধর্মকর্ম পালন করছে, আর এধরনের মনোভাব রাষ্ট্রের আদর্শকে অসীকৃতি জানায় যা পাকিস্থানের জোর দাবি করে ,এমন ধরনের আদর্শ আমরা রাষ্ট্রে দেখতে চাই যা আমরা করতে চাচ্ছি । রাষ্ট্রে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে যেন সত্যিকারের ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার সহায়ক হয় । যার অর্থ হল রাষ্ট্রকে সবসময় একটি ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহন করতে হবে । আমার মনে হয় স্যার কায়েদ-ই-আজম সহ অন্যান্য নেতারা স্পষ্ট ভাবষায় দাবি করে পাকিস্থানে মুসলমানদের চাও্যা-পাওয়া মূলত মুসলমানদের জীবনধারা ও আচরনবিধির উপর ভিত্তি করে তৈরী। শুধু তাই নয় তারা বলে ইসলাম শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি ও তার ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় , রাষ্ট্রের কাজেও প্রভাবিত করতে পারে । প্রকৃতপক্ষে ইসলামে সামাজিক আচরণের জন্য নির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা রয়েছে এবং দিনের পর দিন যে সমস্যা গুলোর মুখোমুখি হচ্ছি তা সমাধানের জন্য বিভিন্ন কৌশল আলোচনা করা হয়েছে । ইসলাম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আচরন বা বিশ্বাস নয়। ভালভাবে জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে ইসলাম সবসময় তার অনুসারীদের নিকট সমাজ গড়ে তোলার প্রত্যাশা করে । যেমন গ্রীকরা একটু আলাদা করে বলত ভালভাবে জীবনযাপন মুলত আধ্যাত্বিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি । এজন্য অবশ্য ইসলামের মান ও বৈধতার উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে ,এটা সবসময় রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর এবং মুসলমানদের কার্যক্রম এমন হবে পরিচালনা করতে হবে যেন যেন ইসলামসহ গণতন্ত্র , স্বাধীনতা ,সহনশীলতা ,সামাজিক ন্যায়বিচারের অপরিহার্য নীতির উপর ভিত্তি করে একটি নতুন সামাজিক অনুশাসন বয়ে আনতে পারে । এগুলোই কেবলই উদাহরন হিসাবে সংযুক্ত করলাম কারন এগুলো কোরআন হাদিসের বাইরে নয় ।এমন কোন মুসলিম পাওয়া যাবে না যে আল্লাহকে অবিশ্বাস করে কিংবা রাসুল(সঃ) কে অনুপ্রেরণা হিসাবে মানে না । এই বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে কোন মতবিভেদ নেই , তাছাড়া এমন কোন সম্প্রদায় নেই যে আল্লাহর অস্থিত্বকে অস্বীকার করে। তাই কোন সম্প্রদায় পাকিস্থানে সংখ্যালঘু হবে এমন ধারনা মনের মধ্যে পেষণ করা ঠিক না আর এটা রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যও নয় । রাষ্ট্র সংঘর্ষ এড়াতে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে তার মানে এই নয় যে অমুসলিমদের বিশ্বাস ও স্বাধীনতার উপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে । সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু যেকোন সম্প্রদায়কে অনুমতি প্রদান করা হবে তাদের অভ্যন্তরীণ বা আংশিক বিশ্বাসে অন্যদের নির্দেশ । সকল সম্প্রদায়কে সর্ব্বোচ্চ সম্ভব সকল সুবিধা ও স্বাধীনতা দেয়া হবে । মূলত আমরা আশা করছি বিভিন্ন সম্প্রদায় রাসুল(সঃ) এর চাওয়া অনুসারে কাজ করবে যিনি বলেছিলেন –
“মতপার্থক্য হল তোমাদের জন্য আর্শীবাদসরূপ”। স্বল্প স্বার্থের জন্য যারা ইসলাম ও পাকিস্থানকে উভয়কে দুর্বল করে তাদেরকে কাজে লাগানো যাবে না কারন এটা আমাদেরকে পাকিস্থান ও ইসলামের শক্তির উৎসের পার্থক্য তৈরী করে দিবে । অবশ্য মাঝেমধ্যে মতবিভেদও চিন্তাভাবনার উন্নতি ঘটায় তবে এটা তখনই ঘটবে যখন আমাদের চিন্তাভাবনা বাস্তব লক্ষ্যের দিকে চালিত হবে ,যা ইসলামের সেবা ও উন্নতিবিধানই মূল লক্ষ্য ।তাই এটা স্পষ্ট যে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে অবক্ষয় ও পরাধীনতা খুজে বের করার পরে এই দফায় মুসলমানদের যে সুযোগ দিতে তারা সচেষ্ট হয়েছে তা এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে হবে যা সারাবিশ্বের নিকট ইসলাম শুধুমাত্র একটি প্রগতিশীল শক্তিই নয় , এটা মানবজাতিকে অনেক খারাপি থেকে প্রতিকার দেয় ।
আমাদের চাহিদামত ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে অমুসলিমদের অধিকার উপেক্ষা করা যাবেনা , যদি আমরা সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতায় আঘাত করি তাহলে এটা হবে অনৈসলামিক কর্মকান্ড এবং ধর্মের নির্দেশনা অনুসারে দোষী সাব্যস্ত হবে । কোনভাবেই তাদের ধর্মীয় কাজে বাধা প্রদান করা যাবেনা । ইসলামী সংস্কৃতি নিজেই নিজের বিকাশের ইতিহাসের স্বাক্ষ্য দেয় – সংখ্যালঘুদের সংস্কৃতি সবসময় মুসলিম রাষ্ট্রের সুরক্ষায় হয়ে আসছে এবং রাষ্ট্রের অবদানেই মুসলিমরা নিজেদের ঐতিহ্যে ঐশ্বর্য বাড়িয়ে তুলে। যদি সংখ্যালঘুরা সম্মিলিতভাবে জ্ঞানে ও চিন্তাধারায় অবদান রাখতে পারে তাহলে পাকিস্থানের জন্য এর চেয়ে ভাল কিছু আর হতে পারে না বলে আমি মনে করি যা গোটা জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। আর এটা সংখ্যালঘুদের উপর আমার বিশ্বাস । তাই শুধু পূর্ন স্বাধীনতা দিয়ে নয় তাদেরকে বুঝাতে হবে তারাও সংখ্যাগরিষ্টদের মত একটা বড় অংশ যা মুসমানদের ইতিহাসে সবসময় বিশেষ চরিত্র হিসাবে উপাস্থাপিত হয়েছে। আর এজন্যই তাদেরকে সামনে এফগিয়ে নিয়ে যেতে হবে ।
স্যার , সরকারকেই সরকার গঠনের সমাধান হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে মূলত ভৌগলিক কারনেই ।যেখানে আমাদের দেশের দুইটা অংশ আলাদা যা হাজার মাইলেরও বেশি দূরে, তাই দুই অংশকে একত্রিত করে একটি সরকার গঠন করার চিন্তা করাই হবে আমাদের মূল ভাবনা ।আমি আশা করছি প্রয়োজনীয় জনসমাবেশ আমাদেরকে একীভূত করতে সহয়তা করবে এবং একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিনত করবে । সবসময় কিছুটা হলেও আমি অনুভব করতাম তবে আমি কখনোই অসামাঞ্জস্যতা চাইতাম না। আমি বিশ্বাস করি আমাদের জাতীয় জীবনে পাকিস্থানের ঐশ্বর্যে সকলের অবদান রাখা উচিত ।এছাড়াও আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই এমন কিছুর অনুমতি প্রদান করা উচিত হবে না যা আমাদের জাতীয় ঐক্যকে দুর্বল থেকে আরো দুর্বলতর করে এবং পরস্পরের সাথে সম্পর্ক যেন আরো দৃঢ় হয় সেজন্য নিয়ম করে দিতে হবে ।এই ক্ষেত্রে নিয়মিত গণসংযোগ হল সবচেয়ে উত্তম পন্থা যা কেন্দ্র ও ইউনিটের মধ্যে মুল বিষয়বস্তু বন্টন করে এবং নতুন ইউনিট কেমন হবে সেটা নির্ধারন করে দিতে হবে ।
জনাব প্রেসিডেন্ট , এটা মুলত মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য একটা ফ্যাশনে পরিনত হয়েছে কিন্তু আমি আপনাকে নিশিন্ত করতে পারি এক পাক্ষিক অধিকার বা অন্যদের সাথে দুর্ত্ব সৃষ্টি করা মাদের উদ্দেশ্য নয় । আমি অনেকবার বলেছি যে আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক সরকার গঠন করতে চাই যেখানে প্রতিটি সদস্যকে সর্ব্বোচ্চ পরিমাণে স্বাধীনতা দেয়া হবে ।
আইনের চোখে সকলেই সমান বলে গন্য হবেন,কিন্তু তার মানে এই না যে কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত আইন সুরক্ষা পাবে না।আমরা বিচারের সাম্যতায় বিশ্বাসী। এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এবং বিভিন্ন কর্মসূচি থেকেই আমরা বলেছি যে পাকিস্তান কায়েমি স্বার্থবাদী বা ধনী শ্রেণীর জন্য তৈরি নয়।ইসলামের মূলনীতিগুলোর উপর ভিত্তি করে এমন অর্থনীতি গড়ে তোলা আমাদের উদ্দেশ্য,যা সম্পদের শ্রেয়তর বণ্টন ও অভাব দূর নিশ্চিত করতে চায়।একজন মানুষের সর্বোচ্চ মর্যাদা অর্জনের ক্ষেত্রে দারিদ্রতা ও পশ্চাৎপদতা প্রধান অন্তরায়,যা পাকিস্তান থেকে অবশ্যই নির্মূল করতে হবে।বর্তমানে আমাদের অধিকাংশ জনগণ দরিদ্র ও অশিক্ষিত।আমাদেরকে অবশ্যই তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে হবে,দারিদ্রতা ও অজ্ঞানতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হবে।রাজনৈতিক অধিকারের ব্যাপারে,সরকার কর্তৃক অনুসৃত নীতি নির্ধারন ও রাষ্ট্র পরিচালনাকারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সকলের মত প্রকাশের অধিকার থাকবে যাতে করে তারা জনগণের স্বার্থে কাজ করেন।আমরা মনে করি চিন্তা কে শৃঙ্খলিত করা সম্ভব নয় এবং সেইজন্যে কোন ব্যক্তিকে তার মতামত প্রকাশে বাঁধা দেয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়।কোন ব্যক্তির সকল আইনগত ভাবে বৈধ ও নৈতিক কারণে সংগঠন করার যে অধিকার সেটা থেকেও তাকে আমরা বঞ্চিত করতে চাই না।সংক্ষেপে মুক্তি,প্রগতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচার কে আমরা আমাদের রাষ্ট্রের ভিত্তি করতে চাইছি।আমরা সামাজিক বিভেদ দূর করতে চাই,কিন্তু আমরা সেটা কোন সমস্যা সৃষ্টি বা মানুষের মনন ও বৈধ ইচ্ছার উপর বাঁধা আরোপ করে অর্জন করতে চাই না।
স্যার,অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যার জন্য বৈধ ভাবেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সুরক্ষা চান।এই প্রস্তাব সেই সুরক্ষা দিতে চাইছে।পশ্চাৎপদ ও বঞ্চিত শ্রেণীর প্রতি আমাদের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।তারা যে নিজেদের কোন ত্রুটির কারণে বর্তমানের দুরবস্থায় পতিত না সেই সত্যের বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ সচেতন।সেই সাথে এটাও সত্য যে তাদের বর্তমান অবস্থার জন্যে আমরাও কোন ভাবেই দায়ী নই।কিন্তু এখন তারা আমাদের নাগরিক,তাদেরকে অন্যান্য নাগরিকদের কাতারে নিয়ে আসার জন্য আমাদের বিশেষ চেষ্টা করতে হবে যাতে করে একটি স্বাধীন এবং প্রগতিশীল রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাদের যে দায়িত্ব,তারা সেটা পালন করতে এবং তাদের থেকে বেশী ভাগ্যবানদের সাথে ভাগাভাগি করতে পারেন।আমরা জানি যে আমাদের জনগণের মধ্যে কোন শ্রেণী যতদিন পশ্চাৎপদ থাকবে ততদিন তারা সমাজের জন্য বোঝা হয়ে থাকবে এবং সেইজন্যে আমাদের রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে আমাদের অবশ্যই এই শ্রেণীসমূহের স্বার্থের দিকে নজর দিতে হবে।
মহামান্য রাস্ত্রপতি,পরিশেষে আমরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি যে এই সিদ্ধান্তে উল্লেখিত নীতিগুলোর উপর আমাদের সংবিধানের ভিত্তি স্থাপনের মাধ্যমে পাকিস্তানকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে আমরা সক্ষম হব এবং সেই দিন খুব দূরে নয় যখন পাকিস্তান এমন একটি দেশে পরিণত হবে যার জন্য এর নাগরিকগণ শ্রেণী বা ধর্মের কোন বিভাজন ছাড়াই গর্বিত হবে।আমি আত্মবিশ্বাসী যে আমাদের জনগণের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।ভয়াবহ দুর্যোগ ও সঙ্কটের মূহুর্তে অতুলনীয় আত্মত্যাগ এবং প্রশংসনীয় শৃঙ্খলাবোধের প্রদর্শনের মাধ্যমে তারা সারা বিশ্বের প্রশংসা অর্জন করেছে।আমি বিশ্বাস করি এমন জনগণ শুধুমাত্র বেঁচে থাকা নয় বরং মানবতার উন্নতি ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখার জন্য ভাগ্যনির্ধারিত।এটি প্রয়োজনীয় যে একে তার আত্মত্যাগের মানসিকতা এবং মহৎ আদর্শগুলো অনুসরণ অব্যাহত রাখতে হবে এবং ভাগ্য নিজেই একে বিশ্ব ব্যবস্থার গৌরবজনক অবস্থানে নিয়ে যাবে এবং মানবতার ইতিবৃত্তে অমর করে রাখবে।স্যার,এই জনগণের অসাধারণ অর্জনের ঐতিহ্য রয়েছে;এর ইতিহাস গৌরবজনক কাজে পরিপূর্ণ;জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এটি এর অর্জনের পুরোটা দিয়ে অবদান রেখেছে;এর বীরত্ব সামরিক ঘটনাপঞ্জির পাতা শোভিত করেছে;এর প্রশাসকগন এমন প্রথা সৃষ্টি করেছেন যা সময়ের ধ্বংসযজ্ঞ সহ্য করে টিকে আছে;সৃজনশীল শিল্পে এর কবিতা,স্থাপত্য এবং সৌন্দর্যের অনুভূতি প্রশংসা অর্জন করেছে;আধ্যাত্মিক মহত্ত্বের ক্ষেত্রে এর খুব কম সমকক্ষ রয়েছে।
এই জনগণ পুনরায় দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ পেলে পূর্বের গৌরবজনক অর্জনের ইতিহাস ছাড়িয়ে যাবে।এই অবজেক্টিভ রিজোলিউসন হচ্ছে এমন পরিবেশ তৈরির প্রথম পদক্ষেপ যা পুনরায় এই জাতির মানসিকতা জাগিয়ে তুলবে।আমরা,যাদেরকে জাতীয় পুনরুত্থানের এই মহান ঘটনা প্রবাহে অংশ নেবার জন্য তা যতই তুচ্ছ এবং অগুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন ভাগ্য নির্বাচিত করেছে,আমাদের সামনে থাকা সুযোগের বিশালতা দেখে অভিভূত।চলুন এই সুযোগগুলো জ্ঞান ও দূরদর্শিতার সাথে ব্যবহার করি এবং আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে নিয়তির সাহায্যে যা পাকিস্তান কে অস্তিত্বশীল করেছে, এই অতি সাধারণ চেষ্টা আমাদের চরম প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে যাবে।প্রত্যহ এটা ঘটে না যে মহান জাতিগুলো স্বনির্ভর হয়ে ওঠে;প্রত্যহ এটা ঘটে না যে জনগণ নবজাগরণের প্রবেশদ্বারে অবস্থান করে;প্রত্যহ এটা ঘটে না যে ভাগ্য নিপীড়িত এবং শাসিত জনগণ কে উঠে দাঁড়াতে মহান ভবিষ্যৎ কে স্বাগত জানাতে ইশারা করে।আলোর সরু রেখা যা পূর্ণ দিনের প্রভার পূর্বাভাস দিচ্ছে তাকে আমরা স্যালুট করি এই রিজোলিউসনের মাধ্যমে।
————