বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৫ই ডিসেম্বর, শনিবার, ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮০
লোক-সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও সংগ্রহ
সংস্কৃতি যদি জাতির পরিচয় বহন করে, তাহলে লোক-সংস্কৃতি সেই জাতীয় প্রাণ-সম্পদ না হয়ে পারে না। গ্রাম কেন্দ্রিক বাংলাদেশে লোক-সংস্কৃতির একটি সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের মূলেও যে আমাদের লোক সংস্কৃতির একটি ভূমিকা রয়েছে, তা অনস্বীকার্য। বাংলার লোক-সংস্কৃতি মৌলিকভাবে বিশ্ব মানবতার প্রতি বিশ্বাসী। তাই বাংলার লোক-সংস্কৃতির মূল সুর ধ্বনিত হয়েছে ‘নানান বরণ গাভীরে, একই বরণ দুধ, জগত ভরমিয়া দেখিলাম একই মায়ের পুত।, স্বাভাবিক নিয়মেই তাই এই বিশ্বজনীন লোক-সংস্কৃতিকে বিশ্বসভায় পৌঁছে দিতে হবে। বাংলাদেশ বেতারের ট্রানস্ক্রিপশন সার্ভিস আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী লোক সংস্কৃতি উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাদের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীও মুক্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, ‘বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোক সংস্কৃতিকে বিশ্বের দেশে দেশে তুলে ধরতে হবে। রাষ্ট্রপতি আরো আশ্বাস দিয়েছেন যে, সরকার জাতীয় লোক সংস্কৃতির সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যাপারেও সর্বতোরকম সাহায্য ও সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’
লোক সংস্কৃতি এ দেশের মানুষের অন্তরে গেঁথে আছে। গ্রাম বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা দুঃখ-বেদনা এবং স্বপ্ন প্রেরণায় লোক-সংস্কৃতি এক সঞ্জীবনী শক্তি। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মূলেও লোক-সংস্কৃতির অবদান কম নয়। কিন্তু পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলের সুদীর্ঘ পঁচিশ বছরে লোক-সংস্কৃতির বিকাশকে টুটি টিপে হত্যা করা হয়েছে। যে লোক-সংস্কৃতির বদৌলতে বাঙালি আপন পরিচয়ে উজ্জীবিত হতে পারতেন, পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসনামলে বাঙগালীর সে পরিচয় নানাভাবে খর্ব করা হয়েছে। লোক-সংস্কৃতি সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বিকাশকে স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী ঘৃণাভরে পদদলিত করতে দ্বিধা করেনি। অর্থাৎ বাংগালি জাতিত আত্নিক এবং সংস্কৃতির পরিচয়টি ঔপনিবেশিক শাসক সম্প্রদায়ের কল্যাণে বিশ্বসভায় পৌঁছে দেবার কোনই উদ্যোগ-আয়োজন করা হয়নি। বরং সংস্কৃতির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার গরল ঢেলে দেয়া হয়েছে সুকৌশলে।
কিন্তু বাঙালি জাতি ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য রাজপথে বুকের রক্ত বিলিয়ে দিয়েছে, তবুও ভাষা ও সংস্কৃতিকে বুকের মধ্যে পুষে রাখতে এতোটুকু দ্বিধা করেনি। এখন আমরা স্বাধীনতার অরুণালোকে সিক্ত। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষণাবেক্ষণের পবিত্র দায়িত্ব এখন আমাদেরই হাতে অর্পিত। অতএব, লোক-সংস্কৃতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে, লোক-সংস্কৃতির বিকাশের জন্য আমাদের বাস্তব কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লোক সংস্কৃতির উপাদান, লোক-শিল্পী। এই সব অবহেলিত উপেক্ষিত লোক-শিল্পীদের সংগ্রহ করে আমাদের লোক-সংস্কৃতিকে অনায়াসে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। সভ্যতা এবং সংস্কৃতির স্বার্থেই এ কাজে আমাদের অগ্রণী হতে হবে। নইলে সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে জাতি হিসেবে আমরা যে ঐতিহ্যের অধিকারী, সে পরিচয় পরিব্যাপ্ত করতে আমরা ব্যর্থতাকেই বরণ করবো।
রাষ্ট্রপতি লোক সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবনে সরকারি সহায়তায় আশ্বাস দিয়েছেন এবং সেই সাথে তিনি এ কথাও বলেছেন যে, আমাদের জাতীয় লোক সংস্কৃতিকে দেশের সীমানায় বন্দি করে রাখলে চলবে না, লোক-সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত স্বরূপটিকে বিশ্বসভায় উন্মোচন করতে হবে। বিশ্বসভায় লোক-সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে না পারলে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিশ্ববাসীর কাছে উন্মোচিত করা সম্ভব নয়। সেজন্যই আমাদের প্রাণের সম্পদ, হৃদয়ের আকুল যে লোক সংস্কৃতি ধারণ করে আছে সে লোক সংস্কৃতির সংগ্রহ যাতে সুনির্বাচিত হয় এবং তা সংরক্ষণের যেনো সুব্যবস্থা অবলম্বিত হয়, সে দিকে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। কারণ, লোক-সংস্কৃতির মাধ্যমেই আমাদের বৃহত্তর জনসমাজের আশা-নিরাশা, স্বপ্ন-কল্পনা এবং দুঃখ বেদনা প্রতিফলিত। জাতীয় জীবনে লোক সংস্কৃতির অবদান যেহেতু অপরিসীম সেহেতু লোক-সংস্কৃতির ব্যাপক চর্চা ও অনুশীলনের প্রতি আমরা সাংস্কৃতিক প্রেমিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি।
সামরিক ব্যয় হ্রাসের প্রস্তাব
সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সোভিয়েট ইউনিয়নের উদ্যোগে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবটি হচ্ছে, “নিরাপত্তা পরিষদের যতো অস্থায়ী রাষ্ট্রসমূহ আছে, তাদের সবাইকে নিজ নিজ সামরিক ব্যয়ভারের কমপক্ষে শতকরা ১০ ভাগ ব্যয় কমাতে হবে এবং এভাবে সংগৃহীত অর্থ তহবিল অংশবিশেষকে সমস্ত উন্নয়নশীল দেশসমূহের সাহায্যার্থে প্রদান করতে হবে। প্রস্তাবটির পক্ষে ছিল ৮৩ ভোট ও বিপক্ষে মাত্র ২ ভোট। প্রায় ৩৮টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। নিছক পশুশক্তি প্রতিষ্ঠায় অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও পরিণামে শত শতাব্দীর বিরচিত মানব সভ্যতা নস্যাতের বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেক বরাবরই অত্যন্ত সোচ্চার ও তীব্র প্রতিবাদ মুখর। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন কুটিল আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বার বারই বিশ্ব বিবেকের এ ন্যায্য দাবির প্রতি ঔদ্ধত্য দেখিয়ে মানব অকল্যাণে নানারকম চক্রান্ত করে এসেছে।
বেশ কয়েক বছর ধরে সোভিয়েট ইউনিয়ন বিশ্ব দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সামরিক ব্যয় হ্রাসের এমন প্রস্তাব জাতিসংঘে করে আসছে৷ ১৯৫৭ ৫৮,৬১ ও ৬৪- এমন কোন বছর নেই যে সোভিয়েট ইউনিয়ন এ ধরনের প্রস্তাব রাখেনি। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, সম্ভাব্য সমস্ত পরিণতি সহ অস্ত্র প্রতিযোগিতা সীমিতকরণের এটাই সর্বোত্তম উপায়। তাই তার কমিউনিষ্ট পার্টির ২৪তম কংগ্রেসে গৃহীত শান্তি কর্মসূচিতে দৃপ্তভাবে বলা হয়েছে যে, সোভিয়েট ইউনিয়ন সবার সঙ্গে বিশেষ করে বৃহৎ শক্তিবর্গের সঙ্গে সামরিক ব্যয় হ্রাস যে কোন আলোচনা চালাতে বা চুক্তিবদ্ধ হতে প্রস্তুত। শান্তির বাণী নিয়েই বাংলাদেশের জন্ম এবং আমরাও বিশ্বের সমস্ত উন্নয়নকামী দেশসমূহের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। আমরাও মনে-প্রাণে বাসনা রাখি যে, বিশ্বের মারাত্মক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ হোক এবং বিভিন্ন দেশের সামরিক ব্যয়ভার কমিয়ে তা’ মানব কল্যাণেই নিয়োজিত হোক।
যে জন্য, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও গত বছরে অনুষ্ঠিত এশীয় বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অত্যন্ত আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেনঃ আপনারা অস্ত্রের পেছনেও মানব অকল্যাণে এতো কোটি কোটি টাকা অহেতুক নষ্ট না করে সেই পয়সা দিয়ে বিশ্বের গরিব-ভূখা ও নাঙ্গাদের বাঁচান। বঙ্গবন্ধুর এই সামান্য কয়েকটি কথার মধ্যেই আমাদের জাতীয় মূলনীতির সংগে সোভিয়েটের বর্তমান ব্যয় হ্রাস পরিকল্পনার প্রকৃত সংযোগ বা মিল-ঐক্যের একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় যে, সোভিয়েট ইউনিয়ন এমন এক সময়ে এই ব্যয় হ্রাস প্রস্তাব উত্থাপন করেছে যখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনা হ্রাসের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মোড় পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধমূলক প্রশ্নের মীমাংসার অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠছে। এ প্রস্তাব সামরিক উত্তেজনা ও রাজনৈতিক উত্তেজনা হ্রাসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা হ্রাস প্রক্রিয়া সুগভীর ও সুদৃঢ়করণের ক্ষেত্রে বিশেষ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সামরিক ব্যয় হ্রাস প্রস্তাব সরাসরি এ লক্ষ্যে পরিচালিত। এর অর্থ হচ্ছে সামরিক শক্তির পরিমাণ হ্রাস, অথবা সম পরিমাণ অর্থ হ্রাস অথবা সম পরিমাণ অর্থ হ্রাস অথবা কয়েকটি বর্তমান সমর সজ্জা পরিকল্পনার বিলোপ সাধন। এভাবে, সোভিয়েট প্রস্তাবের বাস্তবায়ন প্রকৃত নিরস্ত্রীকরণ ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পষ্ট ব্যবস্থায় পরিণত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের ফলে মানবসমাজ দুভাবে উপকৃত হবে। প্রথমতঃ অর্থ, দ্রব্যসামগ্রী, শক্তি ও মানব শ্রমের নিষ্ফল অপবায়ে নিয়োজিত হবেনা। দ্বিতীয়তঃ সামরিক ব্যয় হ্রাসের আওতাভুক্ত সবক’টি
দেশের সর্বাপেক্ষা জরুরি শান্তিপূর্ণ চাহিদা পূরণে উক্ত সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে। যে অর্থটা বেঁচে যাবে তা উন্নয়নশীল দেশগুলো, বিশেষ করে প্রাকৃতিক বিপর্যয়গ্রস্ত দেশগুলোর শতকরা ১০ ভাগ সাহায্য বরাদ্দ পাবার সুপারিশটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আবার সোভিয়েট ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও চীনে প্রমুখ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের সমানানুপাতিক সামরিক বাজেট হ্রাস এদের কাউকেই কোনো একতরফা সুযোগ বা সুবিধা দান করবেনা। সোভিয়েট প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এর প্রকৃত বাস্তবায়নে কেবলমাত্র যথেষ্ট বৈষয়িক লাভই হবেনা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এটা একটা আস্থামূলক পরিবেশকে সুদৃঢ় করবে- এবং বিশ্ব শান্তির নিশ্চয়তা বিধানে এক নতুন দিকও উন্মোচিত করবে।
খবরে প্রকাশ, সোভিয়েট প্রস্তাবটির সমস্ত সুস্পষ্ট সুবিধা থাকা সত্ত্বেও পিকিং-এর প্রতিনিধি এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। এমন কি প্রস্তাবটি যাতে গৃহীত না হয় সেজন্য ভোটের আগে নানা রকম বাধা সৃষ্টিরও চেষ্টা করে। কিন্তু চেষ্টা খুব ফলপ্রসূ হয়নি এবং প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমেই গৃহীত হয়। অবশ্য চীনের এ বিরোধিতা থেকে একটা জিনিস খুব পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিশ্বের উত্তেজনা হ্রাসে বা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় চীনের যে মোটেই আগ্রহ নেই, কিম্বা মারাত্মক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ তার যে আন্তরিকতাও নেই, সে কথা একদম দিনের আলোর মত পরিষ্কার। উন্নয়নশীল দেশসমূহের মিলিত সাহায্য পাবার পরিকল্পনায় চীনের এ বিরোধিতা নিতান্তই হীনমন্যতারই পরিচায়ক।
যাহোক, এতো চৈনিক বিরোধিতা সত্ত্বেও সোভিয়েট প্রস্তাবের এ অভূতপূর্ব সাফল্য নিঃসন্দেহেই বিশ্বের সমস্ত শান্তিকামী মানুষের সাফল্যেরই সমান।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক