You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশ থেকে কানাডা যুদ্ধশিশুর দুঃসাহসিক অভিযাত্রা - সংগ্রামের নোটবুক
বাংলাদেশ থেকে কানাডা যুদ্ধশিশুর দুঃসাহসিক অভিযাত্রা
আমলাতান্ত্রিক যাবতীয় জটিলতা এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে লাল ফিতার দৌরাত্ম এড়িয়ে ১৫ জন যুদ্ধশিশুর প্রথম দলটি কানাডার উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করে ১৯৭২ এর ১৯ জুলাই । এ প্রচেষ্টার পেছনে ছিল বাংলাদেশ প্রকল্প, যার প্রবক্তা ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন (এফ এফ সি)। কানাডীয় সরকারের বিশ্ব বাস্তুহারা সাল ১৯৬০-এ গৃহীত এক নীতির আওতায় এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন করে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যুদ্ধশিশুদের যাত্রাটি মনে হবে একদল সাধারণ কানাডীয় অনানুষ্ঠানিকভাবে কয়েকটি নবজাতককে সুরক্ষা দেবার প্রয়াসে ব্রতী হয়েছিলেন। পেছনে তাকালে মনে হবে, যুদ্ধশিশুদের কানাডাতে আগমন ওই অত দূরদেশ থেকে, সেও ইতিহাসের নির্মীয়মান একটি টুকরাে তাে বটেই! একদল নিবেদিতপ্রাণ কানাডীয় নাগরিক এক বছর যাবৎ আশা ও পরিকল্পনা করেছেন। শুধু তাই নয়, তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন – তার সফল সমাপ্তি হলাে বাংলাদেশ প্রকল্প। সেদিক দিয়ে দেখলে স্বাস্থ্যহীন ও দুর্বল যুদ্ধশিশুদের মােটামুটি সুস্থ অবস্থায় কানাডা পৌছনাের ঘটনাকে স্বাধীনতা অর্জন করা হিসাবে দেখা যেতে পারে। আবার একইসাথে এ সফলতাকে এক উল্লেখযােগ্য মানবিক বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের কাহিনী হিসেবেও বর্ণনা করা যাবে। ঢাকাস্থ কানাডীয় হাই কমিশনের কর্মীদের মতে, এ কর্মউদ্যোগে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের সকলের জন্যই ওটা এক উদযাপনযােগ্য উৎসব ছিল বটে।

সরকারি পর্যায়ে নেপথ্যে যে প্রস্তুতি চলেছিল এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, কানাডীয় ফেডারেল সরকার প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । দুটি ফেডারেল ডিপার্টমেন্ট, ম্যানপাওয়ার এবং ইমিগ্রেশন এবং এক্সটার্নাল এফেয়ার্স বাংলাদেশ প্রকল্প-এর বিষয়ে শুরু থেকেই অবগত ছিলেন এবং তাদের এতে পূর্ণ সম্মতি ছিল। ১৯৭২-এর জুন মাসের শেষে কানাডীয় দল যখন বাংলাদেশে যায়, তখন থেকেই তাদের টিমের সকল অগ্রগতি ও অসুবিধা বিষয়ে দুটি মন্ত্রণালয়কে জানানাে হতাে। বাংলাদেশ থেকে ফেরার আগের যত কাজ, সুনির্দিষ্টভাবে। বলতে গেলে সনাক্তকরণের প্রক্রিয়া, যুদ্ধশিশুদের ছাড়পত্র বের করা, আসার সময় বিমানে নিয়ােজিত নির্দিষ্ট চিকিৎসকের দেখাশােনা, স্বেচ্ছাসেবক এবং সহযাত্রী রক্ষীর নথিপত্র, সরকারি যােগাযােগ ইত্যাদি সব কিছু সমম্বয় ও সুসম্পন্ন করার দায়িত্ব ছিল এদের । আমরা এ অধ্যায়ে-এ দেখতে পাবাে কীভাবে পর্দার আড়ালে, অটোয়ায় ইমিগ্রেশন এবং নয়া দিল্লি ও ঢাকাস্থ কানাডীয় হাই কমিশনের কর্মকর্তারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছিলেন। যাতে শিশুরা কোনাে বিঘ্ন ছাড়াই নয়া দিল্পি ও নিউ ইয়র্ক হয়ে ঢাকা থেকে টরন্টো এবং মন্ট্রিয়ল পৌছাতে পারে। যেহেতু নিউ ইয়র্কে বিমান থামার কথা, টিমের জন্য সে ব্যবস্থাও করা হয়েছিল যাতে নিউ ইয়র্কে তারা সহজেই দুটো গ্রুপে ভাগ হয়ে যেতে পারেন। “বড় রকমের হৈ চৈ না করেনিউ ইয়র্কে বিমান বদলের ব্যাপারটা যেন সারা যায়” বলে তারা যে ১৫টি ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাস্থ্যের শিশুকে যে নিয়ে আসছিলেন সে বিষয়ে এক্সটারনাল এফেয়ার্স এর মন্ত্রী মিচেল শার্পকে জানানাে হয়েছিল।

ফেডারেল সরকারের আগ্রহ এ ব্যাপারে এত বেশি ছিল যে, জন মানরাে, তদানীন্তন স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রী প্রথমদিকে যুদ্ধশিশুদের বাংলাদেশ থেকে আসার উপযােগী বিমান খোজার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। অটোয়া কর্মকর্তারা এটা জানতেন যে, সময়ের আগে ওজন কম নিয়ে জন্মানাের ফলে এ ধরনের শিশুরা পুষ্টির অভাবে ভােগে এবং সার্বিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। টিমের আগমন যখন ধীরে ধীরে কাছে এসে পড়ে নয়াদিল্লির ও কানাডীয়। হাই কমিশন উভয় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাদের মন্ত্রীদের এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণীর প্যাকেজ তৈরি করতে। সেখানে কানাডীয় টিমটি কখন ও কীভাবে টরন্টো। এবং মন্ট্রিয়লে পৌছাবে দুটিম লিডারের নেতৃত্বে তার বিশদ খুঁটিনাটি তথ্য ছিল। মিনিস্টার। শার্পকে কানাডীয় নয়া দিল্লিস্থ অফিস থেকে শিশুদের আগমন বার্তাটি জানানাে হয়েছিল এভাবে: “কানাডাতে প্রথমবারের মতাে আসছে ১৫ জনের একটি অনাথ গ্রুপের কয়েকজন, যাদের বয়স তিন সপ্তাহ থেকে আট মাস, আলাদা আলাদা গ্রুপে বৃহস্পতিবার নামছে টরন্টো এবং মন্ট্রিয়লে।
বাংলাদেশ থেকে কানাডাতে বিমানে করে আসার আয়ােজন কতে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল উত্তর। আমেরিকার বিমান চলাচল আইন অনুসারে, অত ছােট শিশুর সঙ্গে প্রয়ােজনীয় সংখ্যক প্রাপ্তবয়স্ক বা সহযাত্রী রক্ষী থাকতে হবে । ফ্রেড শেষ বাধা পার হওয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবক খোজা শুরু করেন। অবাক হবার কিছু নেই, টিম সদস্য পাঁচজনকে এয়ার ইন্ডিয়া এবং এয়ার কানাডার কর্মকর্তাবৃন্দ সহায়তা দেবার জন্য পুরােপুরিভাবে তৈরি ছিলেন। বিমানটি ঢাকা। থেকে নয়া দিল্লি আসবে এয়ার ইন্ডিয়া বিমানযােগে। সেখানে ইমিগ্রেশন কাজকর্ম শেষ হলে টিম নিউ ইয়র্কের পথে রওয়ানা দেবে। এয়ার কানাডা কর্মীদের অনেকে তাদের সময় এবং অর্থ ব্যয় করেনিউ ইয়র্ক থেকে টরন্টো এবং মন্ট্রিয়লে টিমের সঙ্গে আসতে সম্মত ছিলেন। স্বেচ্ছাসেবকদের আগ্রহ ও মনােবল দেখে ফ্রেড এবং অন্যান্য সদস্যরা উল্লাসে যেন ফেটে  পড়েন।
অবিলম্বে এমন বিশেষ ব্যবস্থা হয়ে গেল যে এয়ার ইন্ডিয়া জাম্বাে জেট ভ্রমণ যাত্রার সব ধরনের রীতিনীতি অনুসারে শিশুযাত্রীদের নিয়ে নয়া দিল্লি থেকে নিউ ইয়র্ক হয়ে কানাডার টরন্টো এবং মন্ট্রিয়লে পৌঁছে দেবে। দুজন বিমানবালা পালা করে শিশুদের দেখাশােনা করবেন। নয়া দিল্লি থেকে নিউ ইয়র্ক এর পথে শিশু যাত্রীদের বিমান উড্ডয়নকালে খাবার সরবরাহ, শিশু ভ্রমণের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজগুলাে কানাডীয় কর্মকর্তারা নয়া দিল্লি ও ঢাকার
সব টেলেক্স বার্তা নিউ ইয়র্ক ও কানাডাতে তাদের নিজস্ব প্রতিনিধির মাধ্যমে সমন্বয় করেন। আবার কানাডীয় টিমকে নির্বাচিত দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবার সঙ্গে ইতােমধ্যে যােগাযােগ করিয়ে দিয়েছিলেন মন্ট্রিয়লস্থ স্যান্ড্রা সিম্পসন-এর মাধ্যমে। তিনি টিমের অনুপস্থিতিতে অনেক আগ্রহভরে এফ এফ সি’র সব কাজ সম্পাদন করেছেন।
কানাডীয় টিমের ঢাকা ছাড়ার ঠিক আগে পাঠানাে অফিসিয়াল টেলিগ্রামে তাদের পুরাে ভ্রমণ। পরিকল্পনার রূপরেখা দেয়া হয়। সর্বমােট কতজন শিশু ভ্রমণ করছে এবং কতজন সঙ্গী তাদের দেখাশােনা করবে, একই সঙ্গে বিমানে উড়ন্ত অবস্থায় থাকাকালীন টিমকে কীভাবে কোন্ দায়িত্বে থাকবে এবং কখন টরন্টো এবং মন্ট্রিয়লে এসে পৌছাচ্ছে, এ বিষয়ে তথ্য দিয়ে তাদেরকে অবহিত রেখেছে। আর্কাইভস-এ সংরক্ষিত দলিলাদি থেকে দেখা যায় যে নয়াদিল্লির হাই কমিশনের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন মন্ত্রণালয়ে একটি টেলিগ্রাম অবিলম্বে পাঠানাে হয়েছিল যে, ১৫ জন যুদ্ধশিশুর সকলেই ফ্রেড ও বনি কাপুচিনাে, রবার্ট ও হেলকে ফেরি এবং এলিজাবেথ মৌলিং-এর সঙ্গে (১৫ জনের মধ্যে ৪ টি শিশুকে টিমের সদস্যরা পালনের জন্য দত্তক নির্বাচন করেছিলেন) বাংলাদেশ থেকে কানাডার পথে রওয়ানা হতে যাচ্ছে । এখানে আরও তথ্য ছিল যে, ন্যাশনাল হেলথ এবং ওয়েলফেয়ার কানাডার একজন চিকিৎসক। বিমানে সার্বক্ষণিক ওদের সঙ্গে থাকবেন, যদি প্রয়ােজন হয় ।
টেলিগ্রামে বলা হয়েছে, কীভাবে নিউ ইয়র্কে গ্রুপটি দুভাগে বিভক্ত হবে, এক গ্রুপ যাবে মন্ট্রিয়ল (সাতজন যুদ্ধশিশু সঙ্গে নিয়ে) এবং আরেক গ্রুপ যাবে টরন্টো (আটজন যুদ্ধশিশু সঙ্গে নিয়ে)। এটাও ঘােষণা করা হয় যে, ব্রাইস ম্যাকাসে, ম্যানপাওয়ার এবং ইমিগ্রেশন মন্ত্রী। ডরভাল বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে দত্তক দম্পতিদের অভ্যর্থনা জানাবেন । এ তথ্যের ওপর নির্ভর করে এবং এ কথা জেনে যে যুদ্ধশিশুদের আগমন দেখার মধ্যে একটা আনন্দের ব্যাপার নিহিত রয়েছে, জনগণকে গােচরীভূত করার উদ্দেশ্যে এক্সটার্নাল এফেয়ার্স সঙ্গে সঙ্গে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ছাপায় । কানাডীয় টিমের সদস্যদের জন্য সে মুহূর্তগুলাে যে ছিল। হর্ষোল্লাস ও বিজয়ের মুহূর্ত। ফ্রেড এত উত্তেজিত ছিলেন যে, তিনি কেবল সরকারি টেলিগ্রামের ওপর তাদের আগমন বার্তার বিষয়টির জন্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভর না করে তার সার্বক্ষণিক যােগাযােগের ব্যক্তি স্যান্ড্রা সিমসন-এর কাছে একটি টেলিগ্রাম পাঠান তাতে লেখা ছিল: “নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫ টি শিশুকে নিয়ে আসছি, জুলাই ২০, হ্যালেলুইয়া” ।” টেলিগ্রামটি স্যাজ্জ্বার হস্তগত হতেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে কানাডাব্যাপী দত্তক কমিউনিটিতে খবরটা প্রচার করতে শুরু করেন।
ঢাকা থেকে প্রস্থান
ঢাকা প্রস্থানের সে মুহূর্তগুলাে সত্যিকারভাবেই নাটকীয় মুহূর্ত ছিল। আশ্রমের শিশুদের যখন তাদের যন্ত্রকারীদের থেকে আলাদা করে নেয়া হয়, সে দৃশ্য দেখে তক্ষণি সবাই বিষগ্নে কাতর হয়ে পড়েন। কয়েকজন সন্ন্যাসিনী ছিলেন, কয়েকজন দাই, এবং আয়া যারা জন্ম থেকে শিশুদের যত্ন নিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তারা নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলেন, চোখে অশ্রু । জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন কেউ কেউ যখন শিশুদের একে একে বের করে এনে বাইরে দুটো ভ্যানে তােলা হচ্ছিল। দৃশ্যত বেশ উত্তেজনা অনুভূত হচ্ছিল। কেননা শিশুদের গাড়িতে তােলার আগে ধাই/আয়া শিশুকে সমস্ত অস্তিত্বের ভালােবাসা ও আনন্দের অশ্রু চোখে নিয়ে চুমু খেয়েছিল। তার পরপরই শিশুদের টিম সদস্যদের কোলে তুলে দিয়ে আবার সবাই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল পাথরের মতাে মুখ করে । “অনাথ আশ্রমেও অশ্রুপূর্ণ বিদায় জানানাের পালা ছিল যখন সিস্টার এবং তাদের সাহায্যকারিণীরা শিশুদের বিদায় জানিয়েছিলেন। সেটা ছিল আনন্দ, অশ্রু, ভয় এবং কী হতে চলেছে সে অজানাকে ভেবে আগাম শঙ্কায় ভােগার সময়, ফ্রেড লিখেছিলেন, তাদের বিদায় বেলার কথা স্মরণ করে । ভ্যান দুটি বিমানবন্দরের পথে রওয়ানা হয় সাথে সাথে । শিশু ভবনের কর্মীবৃন্দরা একদিকে আনন্দিত আবার অন্যদিকে ব্যথিত হৃদয়ে ভ্যান দুটির দিকে তাকিয়ে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত সে দুটি চোখের আড়ালে চলে যায় ।
আশ্রম থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়তেই ঠাসা ঢাকা ট্রাফিকের ভিড়ে ভ্যানের গতি কমে যায় । শীঘ্রই টিমের সদস্যরা ভ্যানের ভিতরে শিশুদের জন্য প্রয়ােজনীয় ফোটানাে পানির অভাব কী করে মেটানাে হবে, সে দুর্ভাবনার মুখােমুখি হন । ভ্যানের ভেতরে যা গরম তাতে শিশুদের শরীরে পানির অভাব দেখা দিতে পারে এরকম ভয় হয় । আরও চিন্তার বিষয়, বিমানবন্দরের রাস্তাটুকুতে ছিল প্রচন্ড ভিড়। ফ্রেডের মনে আছে, কিছুক্ষণ ভ্যানের ভেতর বসে থাকার পর তাদের মনে হয়েছিল, গাড়ি যেন নড়ছেই না । ভ্যান এবং অন্যান্য ট্রাফিক কে কার সঙ্গে লড়ে আগে যাবে সে চেষ্টা হচ্ছিল যেন।
বিমানবন্দরের বহিৰ্ধারে গাড়ি পৌছানাে মাত্র টিম সদস্যরা কালক্ষেপণ না করে সক্রিয়ভাবে বিমানবন্দরের কর্মীদের সহায়তায়, একে একে সব শিশুকে সাবধানে নামাতে লাগেন । স্বভাবতই টিমের সদস্যরা কিছুটা বিচলিত এবং স্নায়ুবিকভাবে দুর্বল । অনেকটা ঘাবড়ে গিয়ে ভেবেছিলেন তাদের বিমান ঠিক সময়ে ছেড়ে যাবে কিনা। নাকি আবার কোনাে অভাবিতপূর্ণ ঝামেলা দেখা দেবে! টিমের আরও কোনাে ভুল হলে বা শিশুদের কোনাে সঙ্গী কোনাে ভুল। করলে ১৫ জন শিশুর দেখাশােনা ও যত্ন নেবার ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে হয়ে যেতে পারে ভেবে তারা সবাই সত্যিকারভাবে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিন তিনটে ফ্লাইট আর ১৫ জন একেবারে বাচ্চা শিশু! তাদের বিমানবন্দরে আনার পর থেকেই স্বেচ্ছাসেবক এবং সমাজকর্মীরা অভিভাবকের কাজ শেষ করে শিশুদের বিমানে তুলে দেয়ার জন্য। সাহায্যের হাত বাড়ান। শুধু তারা নন, দেখা গেল সহরক্ষী যাত্রী এবং বিমানে সেবারত সঙ্গীরাও শিশু যাত্রীদের বিমানে তুলে নিয়ে তাদেরকে তাদের নির্দিষ্ট আসনে অবস্থান করতে সাহায্য করেন। ফ্রেডের কাছে মনে হয়েছিল ওরা শিশুদের সব প্রয়ােজনের কথাই জানেন। কাউকে কোনাে কিছু নির্দেশ দেয়ার দরকরা হয়নি।
ঢাকা থেকে শুরু করে প্রতিবারই বিমানে ওঠার আগে, যেমন- নয়া দিল্লি থেকে নিউ ইয়র্ক, নিউ ইয়র্ক থেকে মন্ট্রিয়ল এবং টরেন্টো, টিম সদস্যদের দায়িত্ব ছিল বিমানে যথেষ্ট সংখ্যক ডায়াপার, ফর্মুলা দুধ, প্ল্যাস্টিক ময়লা ফেলানাের থলে ভর্তি করে রাখার নিশ্চয়তা প্রদান। সবার সহযােগিতা ও আগ্রহভরে কাজের জন্য সবাই বিমানে ঠিকমতাে অবস্থান করেন।
তারপর বিমানে সেবারত সঙ্গীরা যার যার নির্ধারিত আসনে অবস্থান সঠিকভাবে পরীক্ষা করে। বিমান ঠিক সময়মতাে ছাড়ার বিষয়ে বৈমানিক ও তার সহকর্মীদের সাহায্য করেন। ফ্রেড বলেন, টিম যদি এরকম সমর্থন না পেত হৈচৈ লেগে থাকত চারদিকে। সহকারীরা। শিশুদের খাওয়ানাে এবং ডায়াপার বদল করতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল । প্রকৃতপক্ষে সবাই প্রয়ােজনবােধে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। শিশু যাত্রীদের যত্ন নিতে তৈরি হয়ে সহরক্ষী যাত্রীরা বিভিন্ন সারি ভাগ করেনিয়েছিলেন এবং পালা করে তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ ভাগের শিশুদের যত্ন নেন। এ দৃশ্যটি ফ্রেড স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করেন। যে মুহূর্তে বিমান উপরে উঠে পড়ে, ঠিক তখনই সবাই আনন্দে আপ্লুত হয়ে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলেন। ফ্রেড আর বনি প্রথমেই তাদের হাতের মাস্টার তালিকার সঙ্গে একটি একটি করে প্রত্যেকটি শিশুর পরিচিতি ট্যাগ মেলান। তারা নিশ্চিত হলেন যে সবাই বিমানে উঠেছে এবং ঠিকঠাক আছে। স্নায়ুবিকভাবে দুর্বল এবং স্বভাবতই শঙ্কিত বনির এখনও মনে আছে সে সময়ের কথা। বনি এবং ফ্রেড শিশুদের বারবার শুনছিলেন নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে তাদের ১৫ জন শিশু সবাই বিমানের ভেতর সহরক্ষী যাত্রীদের সাথে যার যার নির্দিষ্ট জায়গায় শুয়ে আছে।
সংখ্যার দিক থেকে, বিমানের ভেতরে প্রকল্পের সাথে জড়িতদের মধ্যে ছিলেন ১৫ জন শিশু যাত্রী, ১৪ জন সদস্য কু শিশুদের জন্য, দু’সেট মা-বাবা (বনি ও ফ্রেড ক্যাপুচিনাে এবং রবার্ট ও হেলকে ফেরি) যারা ১৫ জন যুদ্ধশিশুর মধ্যে ৩ জনকে ইতােমধ্যে পছন্দ করেনিজেদের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ; তারপরও ছিলেন আরেকজন দত্তকে ইচ্ছুক মা এলিজাবেথ মৌলিং। এলিজাবেথ নিজেও একটি শিশু ছেলেকে পছন্দ করে নিয়েছেন তার জন্য। এলিজাবেথের মনে আছে, বিমানের সহরক্ষী যাত্রী বিমানে সেবারত সঙ্গীরা এবং টিম সদস্যদের জন্য নীতিমালা তৈরি করার কথা – সে এক বিরাট কাজ ছিল বটে! সময়সূচি অনুযায়ী এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট সময়মতাে বুধবার বিকেলে ১৯ জুলাই ১৯৭২ তারিখে ছেড়ে নয়া দিল্লিতে নামে সন্ধে ৬টায় । ভ্রমণ নিঝঞাট ও আরামদায়ক করার জন্য ঝােলানাে শিশুদের খাটসহ একটি বিশেষ অভ্যন্তরীণ বায়ুচাপে নিয়ন্ত্রিত, যা স্বাভাবিক রাখা যায়, তেমনি একটি প্রকোষ্ট বিমানের কেবিনে সংস্থাপন করা হয় । বিমানের গতি শিশুদের নির্বিঘ্নে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে সাহায্য করেছিল সেদিন। ফ্রেডের এখনও স্মরণে আছে, ডাঃ ফেরি বৈমানিককে বলেছিলেন বায়ুনিয়ন্ত্রণের যন্ত্রটি বন্ধ করে দিতে, বৈমানিক তাই করেন। এতে ভেতরটা বেশ আরামদায়ক হয়েছিল, যা টিম সদস্যরা মনে রেখেছেন। ভাগ্যক্রমে ভ্রমণের এ পর্যায়ে আর। কোনাে অসুবিধা হয়নি। তখনও সামনে আরও দুবার বিমান বদল করতে হবে নয়া দিল্পি ও নিউইয়র্কে বাড়ি (কানাডাতে) পৌছাতে।
নয়া দিল্লিতে
নয়া দিল্লিতে কানাডীয় টিমকে অভ্যর্থনা জানান নয়া দিল্লিস্থ কানাডীয় হাই কমিশনার জেমস জর্জ, তার স্ত্রী এবং হাই কমিশনের কর্মকর্তাদের স্ত্রী বা স্বামী এবং ফেডারেল সরকারের স্বাস্থ্য এবং কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মেডিক্যাল কর্মকর্তা এবং তার সহযােগীরা। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে টিম সদস্যদের যাতে কারাে কোনাে ঝামেলা না হয় ব্যক্তিগতভাবে এটা নিশ্চিত করে হাই কমিশনার নয়া দিল্লিস্থ ইমিগ্রেশন অ্যাটাশে ভ্যান ষ্ট্যালডুইনেনকে জরুরিভিত্তিতে কানাডীয় টিমের নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমনে সহযােগিতা করার নির্দেশ আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। হাই কমিশন কর্মীরা শিশুদের জন্য প্রয়ােজনীয় দলিলপত্র তৈরি। করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন, যাতে তারা নিউ ইয়র্ক হয়ে কানাডা পর্যন্ত কোনাে রকমের ঝামেলা ছাড়াই ভ্রমণ করতে সক্ষম হয়।
ইমিগ্রেশণ কর্মকর্তাদের আগ্রহ ও স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে টিমের সাহস ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় । কানাডীয় ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা সব কাগজপত্র ঠিক করে দেন, যেমন- জন্ম সনদপত্র, ছাড়পত্র, সরকার প্রদত্ত ভ্রমণ পারমিট ইত্যাদি । ডাঃ রবার্ট ফেরি ও হেলকে ফেরির দুটি শিশুর ইমিগ্রেশনের কাজ বাকি ছিল। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি কেমন করে, অন্টেরিও সরকার নানা বাধা তৈরি করছিলেন। বিশেষ করে ফেরিদের জন্য ওটা প্রযােজ্য যদিও প্রকাশ্যে আশ্বাস বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল যে সহযােগিতা করা হবে এবং দ্রুত সেবা দেয়া হবে। ফেরি দম্পতিদের সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, জর্জ (হাই কমিশনার) তাদের জন্য ইমিগ্রেশন মন্ত্রীর বিশেষ ক্ষমতাবলে পারমিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন যাতে নির্বাচিত দুটি শিশুর বর্তমান প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়ে একসাথে সঙ্গে কানাডাতে প্রবেশ করতে পারে।
এমনকি ৪৩ বছর পরও, এলিজাবেথ মনে রেখেছেন, কীভাবে বিমানের সহযােগী ও স্বেচ্ছাসেবক বাবা-মায়েরা তাদের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে শিশুদের কখন কী দরকার সেদিকে সদা জাগ্রত ছিলেন। সবারই চেষ্টা ছিল, কীভাবে ওটাকে শিশুদের জন্য যত্ন ও আরামের ভ্রমণে রূপান্তরিত করা যায় । টিমের সদস্যদের স্বস্তির কথা, কয়েক ঘন্টা বিশ্রামের পর ঐ একই রাতে ১৯৭২-এর ১৯ জুলাই টিম এয়ার ইন্ডিয়ার বিশাল বােয়িং ৭৪৭-এ ওঠেন। পরবর্তী ১৪ ঘন্টার নিউইয়র্কগামী বিমানে। নয়া দিল্লিস্থ কানাডীয় কর্মকর্তাবৃন্দ টিমের সকলকে আন্তরিকভাবে কোলাকুলি করে বিদায় সম্ভাষণ জানান।
নয়া দিল্লি থেকে নিউ ইয়র্ক জন এফ কেনেডি বিমান বন্দরে লম্বা রাত কাটতে লাগে কানাডীয় টিমের সবাই নিরন্তর খাওয়ানাে, ডায়াপার বদলানাে এবং শিশু্যাত্রীদের কান্না সামলানােসহ নানাবিধ ব্যস্ততার মাধ্যমে। টরন্টো টিম লিডার ডাঃ রবার্ট ফেরিকে চিকিৎসকের দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে বিমানে ওঠার পর । সুখের বিষয়, তিনি। শিশুদের ভালাে অবস্থায় দেখেছেন, অর্থাৎ দুর্বল হলেও ভ্রমণােপযােগী । তিনি তার ডাক্তারি ব্যাগ সাথে নিয়ে তৈরি, কখন কোথায় তার ডাক পড়ে। তিনি কড়া নজর রাখেন পুরােটা পথ। কোন্ শিশু কম্বল মুড়ে ঘুমায়, কে কাঁদে, কে গম্ভীরভাবে বিমানে দেহরক্ষী যাত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্থির শিশুদের অনেকে আবার কারাে কাঁধে চেপে বিমানের আসনের সামনে থেকে পেছনে পায়চারি করছিলেন। আবার সেদিনের সে সময়টুকুর কথা স্মরণ করে ফ্রেড বলেন, তার কাছে যেন মনে হয়েছিল ১৫ টি শিশুর সকলেই যেন কোনাে একসময় জেগে ছিল; আবার একসময় সবাই একসঙ্গে কান্না জুড়ে ঐ প্রচন্ড গরমের ভেতর । এলিজাবেথ বলেন, যেহেতু নবজাতকদের বিরক্তির সীমা, মাংসপেশির টান এবং কান্নার সময় বিভিন্ন মাত্রার হতে পারে, তাই ওরা টিমের প্রত্যেকটি সদস্যদের অতিরিক্ত মনােযােগের দাবি করেছিল।
অনেক সময় এলিজাবেথ এত চাপে ছিলেন যে, তার মনে হয়েছে যেন তার পায়ের নিচে মেঝেও যেন সরে যাচ্ছে, যেন রীতিমতাে “ভূমিকম্প হচ্ছে। তিনি লক্ষ্য করেন, কোনাে কোনাে নাজুক শিশু তখন সহরক্ষী যাত্রীর হাতের ওপর ঘুমােচ্ছে। আবার কেউবা কাদছে, চেচাচ্ছে অথবা নিজের হাত-পা নাড়াচাড়া করছে। ওরা এতই ছােট শিশু যে জানতও না যে ওরা এ ঐতিহাসিক বিমান অভিযানের কুশীলব। এলিজাবেথ শিশযাত্রীদের হাস্যকর দৃশ্য তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ উপলব্ধি করেন তার রক্তে চিনির পরিমাণ কমে গিয়েছে । তিনি দ্রুত একটি কোক এবং একটু চিনি খেয়ে রক্তে চিনির মাত্রা উপরে তুলে নেন। পুরাে সময়টা শিশুরা যা করার তাই করেছে। দেখা গেল, কয়েকজনের পরিধেয় ভেজা, কারাে ক্ষিদে পেয়েছে অথবা কেউ মনােযােগ চাচ্ছে; আবার কেউ চাচ্ছে ওকে একটু কোলে তুলে নিতে ইত্যাদি। এ সময়ে আবার কোনাে কোনাে সেবারত সঙ্গীরা তাদের দুপা এক করে শিশু যাত্রীদের সেখানে বসিয়ে শিশুদের খাওয়াবার চেষ্টা চালিয়ে যান। কোনাে শিশু হয়তাে সঙ্গে সঙ্গে ফর্মুলা পান করে বােতল ফেরত দিচ্ছে, কেউবা চাচ্ছে তাকে আবার পুনরায় দেওয়া হােক অথবা তাকে আদর করা হােক ।
ক্যাপুচিনােরা এখনও মনে রেখেছেন সে সময়ে খেতে দিলে কোনাে কোনাে শিশু কান্না থামিয়ে দিয়েছিল, কেউ কেউ আবার হেসে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। অনেক সময় আবার অনবরত কান্নার শব্দের মাঝে হাসির উদ্রেককারী মন্তব্য কারাে কারাে দুশ্চিন্তাকে দূর করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে সবাই যখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলেন। সে অভিযানের কথা স্মরণ করে এলিজাবেথ বলেন: “আমরা অত্যন্ত খুশি হয়েছিলাম যখন দেখি কেউ কেউ ওদের মাঝে এত দুর্বল আর ক্ষুদে ছিল যে ওদের দুঘন্টা পরপর খাবার দিতে হয়েছিল। বিমানের সহরক্ষী যাত্রীরা ভুলে যাননি ডাক্তার এবং নার্সদের সতর্কবাণী । তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল শিশুদের জলশূন্যতা হলাে কিনা পরীক্ষা করে দেখতে এবং স্বাসকষ্টে শিশু কষ্ট পাচ্ছে কিনা তার লক্ষণ খুঁজতে । মজার কথা হলাে, ভয় এবং ঘাবড়ে যাওয়ার ব্যাপার। থাকলেও টিম শিশুদের ক্লান্তিকর এ অভিযানেও বেশ মজা পেয়েছিল। বিমানের যাত্রীদের। | নিকট এরা খুব কমিয়ে বললেও বলতে হয়, রীতিমতাে দর্শনীয় হয়ে উঠেছিল। সবসময়ই কিছু না কিছু ঘটছিল বা হচ্ছিল, যেমন- কোনাে শিশু ডায়াপার ময়লা করে ফেলা বা বমি করে পরণের জামা নষ্ট করে দেয়া ইত্যাদি। বিমানের ভিতর থাকাকালীন সময় সহরক্ষী। যাত্রীরা যতবার দরকার ততবারই খুব দক্ষতার সঙ্গে শিশুদের ডায়াপার বদলে পরিষ্কার পােশাক পরিয়ে দিয়েছেন।
ভ্রমণকালে সারা রাস্তা এলিজাবেথ বেশ উত্তেজিত ছিলেন। উত্তেজনার বশে কিঞ্চিত বেসামাল হয়ে হঠাৎ তিনি এক সহযাত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি কি শিশুদের কাউকে কোলে নিতে চান? জিজ্ঞাসা করার সঙ্গে সঙ্গে বয়স্ক যাত্রীদের একটি লাইন দাড়িয়ে গেলেন যারা এই শিশু যাত্রীদের কোলে নিতে চেয়েছিলেন। অনেকে বিড়াল ছানার মতাে অত ছােট বাচ্চাদের দেখেনিজেদের ভাবাবেগ দমন করতে পারেননি। হৈ চৈ না করে বনি তাদের এক একজনকে একটি শিশু দিয়ে বলেন, “পােশাক পাল্টাতে হলে আমার কাছে নিয়ে আসবেন।”” ফ্রেড ওটাকে মােবাইল শিশু লাইব্রেরি” বলে আখ্যা দেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে সফরসঙ্গীরা। অপেক্ষাকৃত শক্তপােক্ত শিশুদের এগিয়ে দিতে লাগেন, আর দুর্বলদের তখন দেহরক্ষী যাত্রীরা। সেবাযত্ন করতে লাগেন । একসময় ফ্রেড খেয়াল করেন যে, শিশুরা বিমানের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে । আগ্রহী যাত্রীদের কেউ বা তাদের কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে, কেউ বা বসে। এসব যখন ঘটছিল তখন পুরাে বিমান জুড়ে ব্যবহৃত ডায়াপার ও বমির গন্ধ ছড়িয়ে ছিল । তবুও কেউ কোনাে অভিযােগ করেননি। ফ্রেড লাইব্রেরিয়ানের কাজ করছিলেন। কোন্ শিশু কাকে ধার দেয়া হলাে, কে ফেরত এলাে সব নিখুঁতভাবে হিসাব রাখেন। বিমান চলাকালে ঠিক নিউ ইয়র্ক পৌছার আগেই বিমানবালারা যাত্রীদের নাম, ঠিকানা ও যাত্রার গন্তব্যস্থল ইত্যাদি পূরণের ফরম (এম্বারকেশন কার্ড) বিলি করেন । ফ্রেড সাথে সাথে প্রত্যেকটি শিশুর ফর্মগুলাে পূরণ করতে লেগে যান । তখন বিমানের সহরক্ষী যাত্রীরা শিশুদের উপর নজর রাখেন।
নিউ ইয়র্ক বিমানবন্দরে কোনাে ধরনের ঝামেলা ছাড়াই সব কাজ খুব কম সময়ে হয়ে যায় । নয়া দিল্লি অফিস ইউ এস কনস্যুলেটকে শিশুদের আসার ব্যাপারে আগে থেকে অবহিত করে রেখেছিল। প্রায় সাথে সাথেই কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয়ে যায় এবং ছাড়পত্র দিতেও কোনাে দেরি হয়নি। আগে যেমন ঠিক করা ছিল, টিম এখানে দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে গেল । এয়ার কানাডার স্বেচ্ছাসেবক যারা টরন্টো এবং মন্ট্রিয়ল থেকে সহায়তা করার জন্য এসেছিলেন, তারা দুটি গ্রুপের সঙ্গে শিশুর জিনিসপত্র এগিয়ে দেয়ার হাত বাড়ালেন। সবাই এখন খুব উত্তেজিত ছিলেন শুধু এটা ভেবে যে, শীঘ্রই তারা যথারীতি টরন্টো এবং মন্ট্রিয়ল উড়ে যাবেন।
টরন্টো ও মন্ট্রিয়ল বিমানবন্দরে আগমন
ঢাকা থেকে নয়া দিল্লি হয়ে নিউইয়র্কের দীর্ঘ ক্লান্তিকর শেষ করে দুটি দল আলাদাভাবে টরন্টো ও ডরভ্যাল বিমানবন্দরে নামে ২০ জুলাই ১৯৭২ তারিখে। ক্যাপুচিনাে যুগল এবং এলিজাবেথ মৌলিং সাতজন যুদ্ধশিশুকে নিয়ে মন্ট্রিয়ল, কিউবেক যাবেন। আবার ডাঃ রবার্ট ফেরি ও হেলকে ফেরি আটজন যুদ্ধশিশুকে নিয়ে এয়ার কানাডার বিমানে টরন্টো, অন্টেরিও যাবেন। বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের প্রথম দলের ১৫ জন কানাডার মন্ট্রিয়ল ও টরন্টো বিমানবন্দরে পৌঁছে টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের আলােকচিত্র গ্রাহক, অগণিত ক্যামেরাম্যান, উজ্জ্বল ও আলােময় পরিবেশে এবং জনতার অবাক হওয়া ভিড়ের মাঝে। কানাডার মাটিতে পা দেয়ার পরক্ষণেই পরিষ্কার দেখা গেল যে বাংলাদেশে অবহেলিত যুদ্ধশিশুদের কানাডীয়রা পরম আগ্রহ ও মমতায় বুকে টেনে নেয় ওদের বাড়ি ও পরিবার দিয়ে। দুটি বিমান বন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে বিমানের সহরক্ষী যাত্রীরা শিশুদের সুন্দর পােশাক পরিয়ে কপালে বিন্দি দিয়ে, সুন্দর আর শুভকে ওদের জীবনে আহবান করেন। তারপর আবার উপমহাদেশে যেমনটি করা হয়, শিশুদের কপালে কাল বিন্দি দিয়ে দিলেন। ওদের জীবন থেকে যাবতীয় অশুভ প্রভাবকে দূর করে দেয়ার লক্ষ্যে।
ঐ সময় কয়েকটি শিশু্যত্রীর ঘুম ভেঙে যায় আবার তাদের কেউ কেউ কাঁদতে থাকে। তৈরি হবার তাড়াহুড়ােয় তারা আরও ভয় পায় । দুটি বিমানবন্দরেই অপেক্ষমান জনতা যেন অধৈৰ্য্য হয়ে ওঠেছিলেন শিশুদের এক নজর দেখার জন্য। কয়েক মাসে তারা এদের সম্পর্কে এতভাবে শুনেছিলেন যে, দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মায়েরা এবং পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনেরা টরন্টো ও মন্ট্রিয়ল বিমানবন্দরের ভি আই পি কক্ষে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন।
টরন্টো ইন্টারন্যাশন্যাল বিমানবন্দরে (বর্তমান পিয়ারসন) অপেক্ষমান নির্বাচিত অন্টারিও দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মায়েদের মধ্যে ছিলেন জন ও ডরােথি মরিস, ব্র্যান্টফোর্ড; ডেইল ও ডরিন গুড, কেপটাউন; ডেল ও ডনা উলসি, কোমােকা; টনি ও বনি বুনস্ট্রা, সেন্ট টমাস; ফিল ও ডায়ান রশফোর, এসপানােলা এবং বারবারা মরাল, সাসকাটুন, সাসক্যাচিউয়ান। টরন্টোতে বিমান পৌছার কথা ছিল রাত ৯:৩০ মি । যখন দম্পতিরা বিমানবন্দরে পৌঁছান, তারা জানতে পারেন বিমানটি আরও দুই ঘন্টা দেরিতে আসবে। তাদের বলা হয়, স্বাস্থ্য ও কল্যাণমন্ত্রী জন মানরাের সঙ্গে তারা সৌজন্য সাক্ষাৎকার করতে পারবেন যেহেতু মন্ত্রী নিজে বিমানবন্দরে থাকবেন। তা ছাড়া সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপাের্টার যাদের সাথেও তারা সাক্ষাৎ করতে পারেন । রিপাের্টাররা ইতােমধ্যে কানাডীয় বাবা-মায়ের সাথে কথা বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পরে জানা যায়, মিনিস্টার সময় করে উঠতে পারেননি বলে অপারগতা জানিয়েছিলেন।
সমবেত দম্পতিরা যে কেবল সঙ্গে করে তাদের হবু পুত্র ও কন্যাদের এক কপি ফটো নিয়ে গিয়েছিলেন তা নয়; আরও নিয়েছিলেন অনেকগুলাে মাইপােষ, ডায়াপার ও অন্যান্য শিশুতােষ সরঞ্জাম। শিশুর আগমনের প্রতীক্ষায় অনেক মা-বাবা চুপ করে বসে ছিলেন। কারণ দুশ্চিন্তা তখনও তাদের কাটেনি, সন্তানকে তাদের কোলে না পাওয়া পর্যন্ত ওটা কাটবে। না তারা জানতেন। কখন টিমের সদস্যরা শিশুদের নিয়ে বিমান থেকে নেমে আসবেন সেজন্য দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষা করছিলেন। তাদের মনপ্রাণ উত্তেজনায় থরথর করছিল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে তারা রবার্ট ও হেলকে ফেরির আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন, যে দম্পতি। শিশুদের কানাডাতে নিয়ে আসার দায়িত্বে ছিলেন।
সকল পারিবারিক সদস্যদের একটি বড় কক্ষে যেতে বলা হয়েছিল, যেখানে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বড় টেবিলে স্যান্ডউইচ, ডােনাট, ফলের রস এবং চা ও কফি সাজিয়ে রেখেছিলেন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের আতিথেয়তা, অনুরাগ এবং আকর্ষণ বাবা-মায়েদের মনে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয়। তারা নিজেদেরকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ” ভেবে স্বস্তি ও তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবারও অপেক্ষা করতে লাগেন। সুদীর্ঘ তিন ঘন্টা অপেক্ষা করার পর সকলেই যখন। উত্তেজিত, বিমান অবশেষে রাত ১১ টায় এসে নামে। বিমানের দরজা খােলার সাথে সাথেই, ফেরি দম্পতি এবং সহরক্ষী যাত্রীরা শিশুদের কোলে নিয়ে নেমে এলেন। প্রত্যেক শিশুর হাতের কব্ধিতে বাঁধা ছিল ব্রেসলেট যাতে নির্ধারিত ও নির্বাচিত দত্তকে অঙ্গীকারবদ্ধ ইচ্ছুক মা-বাবার নাম লেখা। আবার প্রত্যেক মেয়ে শিশুর জন্য দুটি করে চুড়ি ব্রেসলেট যাতে প্রত্যেককে আলাদা করে চেনা যায়। মুহূর্তের মধ্যেই সমস্ত আলােই যেন শিশু যাত্রীদের ওপর
এসে পড়ে। তারাই তখন সবার কেন্দ্রবিন্দু। তখন অপেক্ষমান দম্পতিরা তাদের না-দেখাশিশু সন্তানদের সাথে নিয়ে বাড়ি যাবার জন্য ছিলেন উদগ্রিব। বিমান বন্দরে সবাই অধীর। আগ্রহে শিশুদের এক নজর দেখবার আশায় উকিঝুঁকি মারতে লাগেন।
সব শিশু একটি খাটো শার্ট, রাত পােশাক ও ডায়াপার পরনে ভ্রমণ করে। যখন ইমিগ্রেশন কাউন্টারে ইমিগ্রেশনের যাবতীয় কাগজ সেরে নিস্পাপ ও দেবশিশুদের নিয়ে অপেক্ষমান দম্পতি এবং তাদের পরিবারবর্গের কাছে নিয়ে আসা হয়নির্ধারিত অপেক্ষা-ঘরে, সাথে সাথে সেখানকার নাসারি এলাকা যেন পাগলা গারদে পরিণত হয়। রবার্ট ও হেলকের সমর্থনে বহু লােক সমবেত হয়েছিলেন যারা মাত্র একমাস আগে প্রচন্ডভাবে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন যখন অন্টেরিও কর্মকর্তারা তার দত্তক আবেদনের দ্রুত নিষ্পত্তি না করার জন্য সরকারের প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করেছিলেন ।
সংবাদপত্র প্রতিবেদক যারা কয়েক সপ্তাহ আগে তার কাহিনী লিখেছেন, বিমান বন্দরের দরজায় অধৈর্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের মনে ছিল হেলকের দাবি, আবেদনপত্রের দ্রুত প্রক্রিয়াকরণ না হলে ভারতবর্ষে বর্ষা শুরু হবে, তার সঙ্গে শুরু হবে মারাত্মক সব মরণব্যাধি । তাতে যে শিশুদের কানাডীয়রা তাদের নিজ বাড়িতে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন, তারা সব আক্রান্ত হয়ে জীবন হারাবে। স্বাভাবিকভাবেই হেলকের প্রতিবাদের রকম দেখে সাংবাদিকরা চমকৃত এবং তারা এরকম স্থিরপ্রতিজ্ঞ আন্দোলনকারীর শক্ত ও অনড় ইচ্ছা এবং সাফল্যের কাহিনী লিখতে সাগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। তখন সকল দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মাকে ইমিগ্রেশন। কাউন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তাদের আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় শিশুদের ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতার কাজ আগে শেষ করার জন্য।
আজ পর্যন্ত দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদের মনের ভেতর সেদিনের আনন্দ ও উল্লাসে পরিপূর্ণ ঘটনাটি গাঁথা রয়েছে। যখন হেলকে ও রবার্ট সাবিত্রী এবং অরুণকে নিয়ে নামেন, বিমান বন্দরের পাবলিক এনাউন্সম্যান্ট সিস্টেমে শিশু্যাত্রীদের নাম তখন একে একে ঘােষণা করা হয় – আমিনা, ওমর, জরিনা, রুফিয়া, রিতা, রানী এবং বাথল। একজন বিমানের সহরক্ষীযাত্রী শিশুর নামের ট্যাগ এবং মা-বাবার নামের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার পর একে একে প্রতি শিশুকে মা-বাবার হাতে তুলে দিতে শুরু করেন। চোখে অশ্রু নিয়ে যখন তারা তাদের হালকা ওজনের শিশুকে বুকে তুলে নেন, তারা বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের জীবনে পরিপূর্ণতা এনে দিল বুঝি ঐ কয়েকটি মুহূর্ত। কিন্তু ফেরিদের অবস্থা তখন সত্যিই সঙ্কটজনক । রুগ্ন দশ দিন বয়সী মেয়ে শিশু সাবিত্রীর (যুদ্ধশিশুদের একজন শিশু) শরীর এত খারাপ ছিল যেন মনে হয়েছিল ওর হাড় কয়েকটি পাতলা ত্বকে ঢাকা কোনােমতে । সাবিত্রীর খুব জ্বর হওয়ায় তার তখন ডাক্তারি চিকিৎসার প্রয়ােজন হয়েছিল । টরন্টো বিমান বন্দর ছেড়ে হেলকে সােজা স্থানীয় একটি হাসপাতালে উপস্থিত হলেন, আর তার স্বামী তাদের ছেলে সন্তান অরুণকে বাড়ি নিয়ে গেলেন।
ডেল ও ডনা উলসির জন্য, বিশেষ করেনাির জন্য এটা ছিল “যেন স্বপ্ন হলাে সত্যি”-র মতাে। এক মুহূর্ত। যখন তারা তাদের কন্যা সন্তানকে ছুঁতে পারলেন, যার জন্য তারা মাসের পর মাস অপেক্ষা করেছিলেন, তখন তারা আনন্দে আত্মহারা । বিমানবন্দরে অপেক্ষা করার সময়, ডনা মনে মনে পেছনে তাকিয়ে দেখেন, শৈশব থেকে তিনি স্বপ্ন দেখতেন যমজ সন্তান দত্তক নেবেন, যখন তিনি জীবন সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। বাড়ি থেকে দুঘন্টা গাড়ি চালিয়ে টরন্টো বিমানবন্দরে তাদের প্রথম সন্তান সাড়ে তিনমাস বয়সের আমিনাকে অভ্যর্থনা জানাতে আসা তাদের জন্য যেমন ভীতিকর, তেমনি উত্তেজনাকর মনে হয়েছিল। ভয়, উত্তেজনা এবং মেয়েটাকে তুলে নেবার তাগিদ ডনাকে এক অজানা, অবর্ণনীয় অনুভবে ভরিয়ে এক শিহরণ যা জীবনে তিনি অনুভব করেননি আগে। ১৯৮৯ সালে ষােলাে বছর পরে ডনা সেদিনের (১৯৭২ সালের) অনুভূতির কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, “ভয় করছিল, বিমান যদি অবতরণ না করে, তারপর যখন সে বেরিয়ে এলাে, কী আনন্দ! অবিশ্বাস্য! আমি একটা ছবি ও নামের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম, তার পরেই তাে সে আমার কোলে।” উলসিরা আর দেরি করতে চাইনি। তাদের মেয়েকে আঁকড়ে উল্লাসে উত্তেজিত দম্পতি কালবিলম্ব না করে বিমান বন্দর ছেড়ে বাড়ির পথে রওয়ানা হয়ে যান।
টনি এবং বনি বুনস্ট্রার মনে পড়ে, তাদের আড়াই মাস বয়সের ছেলে ওমরকে আনতে তারা বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন বেশ কয়েক ঘন্টা আগে । “সেদিনের সন্ধ্যায় বেশ গরম ছিল। সরকারি কর্মকর্তারা একটা অপেক্ষা করার মত জায়গা আমাদের দিয়েছিলন। পেছনে তাকালে মনে হয়, সেখানে বেশ ছবি তােলার মতাে একটা পরিবেশও তৈরি হয়েছিল। প্রায় এক বছরের “তীব্র রােলার স্কেটিং রাইড” এর শেষে শিশুদের যে আগমন নিঃসন্দেহে সে আগমনে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। তার স্ত্রী বনির হয়ে টনি, ঠাট্টার সুরে বলেন, “হয়তাে আগে কষ্টটা ছিল যেন গর্ভধারণের মতাে, আশা তাে ছিলই, আবার নতুন জীবনের আরম্ভ যেমন নতুন জীবন সংগ্রামের কথা মনে করায়।” যে রােগাটে ছেলেটাকে তারা কোলে তুলে নিয়েছিলেন, বনির কাছে মনে হয়েছিল, যে খুব খুশি ছিল না। বাড়ি যাবার সমস্ত পথটা সে কেঁদেছিল । বনিকে কিন্তু ঠিক বাড়িতে পৌছানাের পরপরই শিশুটি জড়িয়ে ধরেছিল। তার নতুন মাকে যেন অনেককালের চেনা, টনি বলেন । বুনস্টা দম্পতি এখনও সে দৃশ্যটি মনে রেখেছেন।
যুদ্ধশিশুদের আগমনের কথা জন এবং ডরােথি মরিসের পরিষ্কার মনে আছে, তাদের মনে হয় এটা তাে সেদিনের ঘটনা মাত্র, যদিও মাঝে এতগুলাে বছর কেটে গিয়েছে। তাদের পরিষ্কার মনে পড়ছে, বিমানবালা ডরােথি ইয়াংকে, যিনি নয় মাস বয়সী মেয়ে জরিনাকে তাদের কোলে তুলে দিয়েছিলেন । “এত সুন্দর ছিল শিশুটি। ঘুমন্ত মেয়ের পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু পড়েছিল। সে তাকাল তার বড় বড় কালাে কাজলে ঘেরা চোখে, দেখল নতুন বাবাকে, আবার ঘুমিয়ে পড়ল, ডরােথি সেদিনের কথা রােমন্থন করতে গিয়ে বলেন। আজও ডরােথির খুঁটিনাটি সব মনে আছে, সেদিন কী কী ঘটেছিল সে এবং তার স্বামী বিমান বন্দরে পৌছাবার পর। তখন সব দত্তক নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ বাবা-মাকে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, শিশুদের কাগজপত্র পরীক্ষা করার জন্য। ছােট্ট শিশুটি কাছে পেয়ে তারা এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে চাইনি। মরিস দম্পতির কাছে মনে হয়েছিল যেন কখন বাড়িতে ফিরে ওকে নার্সারিতে দেবেন তার অপেক্ষা করছিলেন অধীর আগ্রহে। মরিস দম্পতির কাছে মনে হয়েছিল যেন অন্যান্য যুদ্ধশিশুদের সঙ্গে জরিনার আগমন একটি পরাবাস্তব ঘটনা। বাংলাদেশ থেকে আসা তাদের মেয়ের জন্যে অনেকদিনের অপেক্ষা করতে হয়েছিল যেন তাদের। এ কথা ভেবে তারা উপলব্ধি করেন যে তাদের কন্যার সঙ্গে সময় কাটানাে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা বটে । বাড়ি ফেরার পথে তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন এজন্যে যে তাদের জীবনের সেরা উপহার তারা পেয়ে গিয়েছেন ঐ শিশুর মাধ্যমে ।
ফিল এবং ডায়ান রশফোর একটু আগেই বিমানবন্দরে পৌছেছিলেন, যাতে অন্য বাবামায়েদের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন। যদিও নিউ ইয়র্ক থেকে টরন্টোগামী বিমানটি দুঘন্টা। পিছিয়ে পড়েছিল, তবুও বিমানবন্দরে রশফোরদের সময় ভালােই কেটেছিল । শীঘ্রই আরও। পাঁচজন মা-বাবার সঙ্গে ওদের দেখা হয় যারা টরন্টোগামী বিমান কখন পৌছায় সে অপেক্ষায় ছিলেন। দম্পতিটির মনে আছে এগারােটার দিকে বিমান অবতরণের একটি আগে যেন তারা। একটু ঘাবড়ে গিয়ে অস্বস্তিবােধ করেছিলেন। তাদের মনে হয়েছিল যেন শরীরে তাদের আর কোনাে শক্তি নেই। তাদের শিশু আসবার আগে থেকে কয়েক মাসব্যাপী তারা চাপের মুখে। ছিলেন। আর কোনাে বাধা যখন ছিল না, তখনও তারা একটু অস্থির হয়ে পড়ছিলেন কী জানি কী হয় ভেবে।
তাদের নাম ঘােষণার মুহূর্তেই ডায়ান শ্বাস ফেলে তাদের মেয়েকে কোলে তুলে নিতে সামনে। এগিয়ে গেলেন। চারদিকে তখন হৈ চৈপূর্ণ ও আনন্দোচ্ছল চেচামেচি উজ্জ্বল আলাে, মাইক্রোফোন, ক্যামেরা, সংবাদ প্রতিবেদক এবং জনসাধারণ কিছুই উত্তেজিত বাবা-মায়েদের প্রশমিত করতে পারছিল না। পাঁচ মাস বয়সী রুফিয়া রিতাকে ডায়ানের কোলে দেয়া হলেই তিনি মেয়েটিকে জাপটে ধরেন। তাকে বলা হয়, শিশুটির বয়স মােটে পাঁচ মাস এবং সে কম ওজন নিয়ে জন্মেছে । ওকে আদর করতে করতে আনন্দ উৎফুল্ল ডায়ান মিডিয়া। রিপাের্টারদের সাথে সানন্দে কথা বলতে গিয়ে ডায়ান ও ফিল জানান, তাদের আরও দুটি সন্তান রয়েছে – একটি সহজাত আর আরেকটি দত্তকের মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, উল্লসিত যুগলবৃন্দ আরও জানালেন ক্রিসমাস নাগাদ তারা বাড়িতে আরও দুজন ভিয়েতনামী শিশু এনে পরিবার সম্প্রসারণ করছেন। “আমরা বড় পরিবার চাই। এটা মজার, আবার একটু ভয়েরও।”৯৫ খুশিতে ডগােমগাে ডায়ান জানালেন তার স্বামীর সঙ্গে তাদের মােটর গাড়ির যেখানে পার্ক করা ছিল সেদিক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ।
রবিন এবং বারবারা মরাল বলেন, যেহেতু স্বভাবে তারা একটু সন্দেহপ্রবণ তারা নিজেদের উৎসাহকে বেশি ফুলে ফেঁপে উঠতে দেননি, একটু ঢেকে ঢুকেই রেখেছিলেন। এজন্য যে, যদি ব্যাপারটা থেকে বড় ধরনের আশাব্যঞ্জক কিছু না ঘটে তারা একেবারে হতােদ্যম নিরাশার পুঁটুলিতে পরিণত না হন। সাড়ে তিন মাস বয়সী রানীকে কোলে তুলে নিতে নিতে তার যা মনে হয়েছিল: “বিমান বন্দরে দেরি করাটা খারাপ লাগছিল, কিন্তু ঐ সুযােগে আরও কয়েকজন মা-বাবার সঙ্গে আলাপের সুযােগ পেয়েছিলাম । আমার জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ আন্তর্জাতিক দত্তক নিয়েছেন, এমন কাউকে আমি জানতাম না। আগে ।” তারা বনির কাছ থেকে ঢাকা থেকে পাঠানাে একটা কার্ড পেয়েছিলেন তারা।
তখন জেনেছিলেন যে তিনি ওদের জন্য একটি কন্যা শিশু বেছে রেখেছেন। তারা তারপর থেকে আনন্দে ছিলেন । “আমরা আমাদের সে ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারিনি। বারবারা বলেন, ঐ সময়টা স্মরণীয় মনে হয় যেদিন তাদের মেয়ে এলাে, বারবারা সাসকাটুন থেকে টরন্টো বিমানে করে এসেছিলেন মেয়েকে তুলে নিতে । সে সময়ে তার স্বামী রবিন ওদিকে ওদের ছেলেকে দেখাশােনা করছিলেন। বারবারা ফেরিদের কাছ থেকে তার মেয়েকে নিয়ে নামের ট্যাগ পরীক্ষা করেন, তিনি তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। “সত্যিই যাদুর মতাে,” বারবারা তার রােমন্থনে বলেন।
বারবারা বলেন, “প্রথমবারের মতাে রানীকে ধরার কথা মনে আছে। সে এক অদ্ভূত অনুভূতি । ওর কালাে কোঁকড়ানাে চুল ছিল, কালাে বড় বড় চোখ, ফোলা ফোলা গাল । ওকে আমি যখন হােটেলে আমার রুমে নিয়ে গেলাম, কম্বল সরাতে দেখতে পেলাম ওর পা জোড়া কী রােগা এবং খাটো দেখাচ্ছিল। আমি সে রাতে ঘুমাতে পারিনি। আমি আশঙ্কা করছিলাম, ওর শরীরে জলের অভাব না ঘটে”১৮।
যদিও বারবারা সঙ্গে রবিনকে নিয়ে রানীকে আনতে যেতে পারেননি, উনি জানতেন, তিনি এটা ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বারবারা হােটেলে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তার স্বামীকে টেলিফোন করেছিলেন । রবিনের মনে আছে, বারবারা তাকে ছােট মেয়েটির কথা কী বলেছিলেন, যদিও অপেক্ষা করার খুঁটিনাটি বর্ণনা এখন আর তেমন মনে নাই। “রানী এত সুন্দর যে আমি না। কেঁদে পারিনি। বিমানবন্দরে জয় থাকাতে (বারবারার যে বন্ধু টরন্টোতে থাকত) আমার খুব। সুবিধা হয়েছিল। সে আমাকে খুব সাহায্য করেছিল, আমি ভাবিনি আমি অত ভাবাবেগে ভেঙে পড়ব।””” “জনের নানি (বারবারার মা, যিনি সাসকাটুন-এ থাকতেন) যেদিন খুব। সাহায্য করেছিলেন। যে দিন বারবারা টরন্টো গেলেন সেদিন আমি জনের সঙ্গে বাড়ির কাছাকাছি অনেক হেঁটে বেড়িয়েছি। আমি তাকে বললাম একটি বােন থাকলে এবং সে দত্তক নিলে সেটা কেমন লাগবে,”২০ সেদিনের স্মৃতিচারণ করে রবিন কথাটি বলেন। সেদিনের কথা ভেবে তারা বলেন কেমন করে সারাটা দিন অজানা শঙ্কায় তাদের মন উত্তষ্ঠিত ছিল ।
আরেক দেশের একটি শিশুকে দত্তক নিতে তাদের যত দেরি এবং আমলাতান্ত্রিক দেয়ালে মাথা খোঁড়াখুঁড়ি চলেছিল, ডেইল ও ডরিন আশঙ্কা করছিলেন তাদের স্বপ্ন সত্যিই বাস্তবায়িত হবে কিনা। সেদিন ওদের তিন সপ্তাহ বয়সী বাথল-এর কানাডা আসার কথা। উত্তেজনার সঙ্গে ভয় ও আগ্রহ মিলেমিশে তাদের ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল। বিমানবন্দরে পৌছেই তারা নির্ধারিত এয়ার লাইনের নির্দিষ্ট বিমান অবতরণের সময়টি সাথে সাথেই স্বচক্ষে উপরে ঝােলানাে পর্দাটিতে দেখেনিশ্চিত হন। তারা তখন আনন্দে খুবই উৎফুল্ল তাদের সন্তান সত্যিই আসছে তাহলে! ডেইলের মনে আছে তারা আরও সব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দম্পতির দেখা পেয়েছিলেন, একটি আলাদা করে ঘেরা জায়গায়, যেখানে গণযােগাযােগ মাধ্যমের কর্মীরা ছিলেন আর বিস্তর খাবার দাবার (স্যান্ডইউচ ও তরল পানীয়, ইত্যাদি)। সেদিন তারা প্রথমবারের মতাে ডনা ও ডেল উলসির সঙ্গে পরিচিত হন। যখন তারা পাবলিক এনাউন্সমেন্ট সিস্টেমে শােনন শিশুদের হস্তান্তর করার জন্য মা-বাবার নাম ঘােষণা করা হবে, অধিক উত্তেজিত গুড দম্পতি সঙ্গে সঙ্গে সহরক্ষীযাত্রীদের উপর ঝাপিয়ে পড়েন তাদের আদরের শিশুটিকে” তৃড়িৎগতিতে খুঁজে নেন।
এদিকে কলক্ষেপণ না করে ডরিন গুড ও ডনা উলসি দুজনে ভাবাবেগে অস্থির হয়ে উঠে। বিমানের সহরক্ষীযাত্রীর কাউন্টার-এর দিকে দৌড়ে যান। ডরিনের এখনও মনে আছে, যখন সুন্দর দুটো শিশু, বাথল এবং আমিনা দুজন দেহরক্ষীর কোলে চড়ে ওদের অপেক্ষমান মাবাবার সঙ্গে এগিয়ে আসছিলেন। তিনি অস্বস্তিতে কথা বলতে পারছিলেন না। ডরিন স্বীকার করেন, ঐ সময়ের বিশেষ অনুভূতি তিনি ভাষায় প্রকাশ করতে অপারগ । যদিও এর মধ্যে বহু বছর পার হয়েছে, দম্পতির মনে আছে সে রাতের বিমানবন্দরের পুরাে ঘটনাটি। মজার কথা, বাথল (ছেলেটি) কীভাবে একটি গােলাপী শিশু ক্যারিয়ারে চড়ে এসেছিল এবং আমিনা (মেয়ে) একটি নীল গাড়িতে। তাদের স্বামীরা, ডেল এবং ডেইল হাস্যোচ্ছলে বলাবলি করছিলেন, তারা তাদের শিশু সন্তান বদল করবেন কিনা। “ডনা আর আমি যেন আকাশ থেকে পড়েছিলাম! শিশু অদল বদল? কিছুতেই না!” আসলে ডেল এবং ডেইল ভেবেছিলেন, শিশুদের বহনকারী গাড়ি বদলাবেন কিনা, শিশুদের নয় । ডরিন সে সময়ের তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিয়ে সেদিন যা ভেবেছিলেন সেটার টুকরাে টুকরাে স্মৃতি স্মরণ করে বলেন “কেমন সহজাত প্রতিক্রিয়া দেখেন যেন মা ভালুকের মতাে আমরা দুহাত তুলে ‘না’ বলে চিৎকার করে উঠেছিলাম তখন সবে আমরা ৫-১০ মিনিটের জন্য মা হতে পেরেছি সবশুদ্ধ!”২৩
সেখানে আরও কিছু দম্পতি ছিলেন, যাদের সন্তান পাবার আশা আর কিছু ছিল না। এফ এফ সি’র প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ থেকে অন্তত ২৪ জন যুদ্ধশিশু আনার । দেখা গেল প্রথম দিকে এসব দম্পতিরা একটু নিরাশ হলেও শেষ পর্যন্ত তারা অতটা অসুখী ছিলেন না। একদিকে তারা বিমর্ষ ছিলেন কারণ তালিকাভুক্ত সবার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক শিশু কানাডীয় টিমটি পাননি। অন্যদিকে তারা খুশি হয়েছিলেন সচক্ষে দেখে যে, টিমের সদস্যরা যাদের পছন্দ করেনিয়ে এসেছিলেন, তাদের ঠিকঠাক মা-বাবার হাতে পৌছে দেয়া হয়েছে।
ডরভ্যাল (বর্তমান পিয়ের এলিয়ট ট্রাে) বিমানবন্দর
এয়ার কানাডার মন্ট্রিয়লগামী বিমানটি যখন ডরভ্যাল বিমান বন্দরে অবতরণ করতে যাচ্ছিল, ফ্রেড, বনি এবং এলিজাবেথ বিজয়ানন্দে উৎফুল্ল। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তা নিয়ে শিশুদের গুছিয়ে নিলেন। অস্থিরভাবে অপেক্ষমান দম্পতিদের মধ্যে ছিলেন বিকনসফিল্ড, কিউবেক-এর জোয়েল এবং টুডি হার্ট; পয়েন্ট ক্লেয়ার, কিউবেক-এর লয়েড এবং স্যান্ড্রা সিমসন; হাল, কিউবেক-এর মার্গো কার এবং রােবের্তো রিবেইরাে; আরভিডা, কিউবেক-এর পিয়ের এবং লিজ হােগ; হ্যালিফ্যাক্স, নােভা স্কোশিয়া-র, মিটজি ম্যাককালা; বিকনসফিল্ড, কিউবেক-এর মি. রে মৌলিং (এলিজাবেথ মৌলিং-এর স্বামী) এবং ক্যাপুচিনাে। পরিবারের অনেক সদস্য। উত্তেজনার পারদ সবচেয়ে উপরে উঠল যখন শিশুদের বাবামায়েরা তাদের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য তৈরি হয়ে বিমানবন্দরে অপেক্ষায় ছিলেন। যেসব ছেলেমেয়েদের তারা জীবনে দেখেননি আগে, তাদের ছবি সঙ্গে নিয়ে তাদের অপেক্ষা যেন আর বাধ মানছিল না। যখন জানা গেল নিউ ইয়র্ক থেকে মন্ট্রিয়লগামী বিমানটি দেরিতে অবতরণ করবে, সে সময়ে অপেক্ষমান দম্পতিদের মনে মনে হচ্ছিল যেন, তারা অনন্তকাল যাবত ৪০১নং কক্ষে বসে আছেন। মনে হচ্ছিল, প্রত্যেক দম্পতি তাদের শ্বাস আটকে ধরে আছেন, প্রতিটি সেকেন্ড মনে হচ্ছিল আশায় আশায় ঘন্টার পর ঘন্টা কাটছিল। ওখানে পৌছে আবেগে আনন্দে উত্তেজিত বাবা-মায়েরা আরও জানতে পারেন, ব্রাইস ম্যাকাসি, তদানীন্তন ম্যানপাওয়ার ও ইমিগ্রেশন মন্ত্রী যার বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকার কথা ছিল, তিনি কোনাে বিশেষ কারণে বিমান বন্দরে আসতে পারবেন না। এদিকে সময় যখন ঘনিয়ে আসে এবং নিউ ইয়র্ক থেকে মন্ট্রিয়লগামী বিমানের অবতরণের কথা ঘােষিত হয় । হবু বাবা-মায়েরা যেন আরও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেন। যেসকল আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সময়মতাে বিমানবন্দরে আসতে পারেননি, তারা সময় পেয়ে সে সুযােগে এ ঐতিহাসিক অভিযান যাত্রার ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য বিমানবন্দরে ছুটে আসেন। এয়ার কানাডা বিমানটি শেষ পর্যন্ত যখন এসে ডরভ্যাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে, তখন বিশাল জনতার ঢেউ ভেঙে পড়ে অবিশ্বাস্যভাবে।
যাত্রীরা ধীরে সুস্থে বিমান থেকে সামনের দরজা দিয়ে নেমে আসতে না আসতেই অভ্যর্থনা এলাকায় বাবা-মায়েরা একত্রিত হয়ে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানান। দ্বিতীয় দরজা খুলে দিলে শিশুযাত্রীরা এবং তাদের সঙ্গীরা, দীর্ঘ ক্লান্তিকর সফর শেষে যাত্রীদের ধীরে ধীরে নামতে বলা হয়। এদিকে বিমানবন্দরের ভিতরে শিযাত্রীদের বাবা-মায়েরা অধৈৰ্য্য হয়ে উঠেন, কখন তাদের নয়নের মনিরা নামবে এ ভেবে । মুখে দাঁত বের করা হাসি, আর চোখ ঝাপসা অশ্রুতে, আস্তে আস্তে নেমে এলেন ফ্রেড, বনি, এলিজাবেথ এবং এয়ার কানাডার সেবার সঙ্গীরা সঙ্গে সাতটি শিশু নিয়ে । Royal Canadian Mounted Police (RCMP)-এর একটি গাড়ি লাল-নীল এবং হলুদ বাতি জ্বেলে তিনটি পৃথিককৃত বিলাশবহুল মােটরগাড়ি ওদের বিমানবন্দর লাউঞ্জে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি। চারদিকে খবরের কাগজের রিপাের্টার, স্পটলাইট টিভি ক্যামেরা ক্রু এবং ভিডিও ক্যামেরা বিমানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সবার কেন্দ্রবিন্দু শিশু্যাত্রীদের দিকে। তখন RCMP-এর কয়েকজন প্রতিনিধিও সেখানে অপেক্ষমান ছিলেন। সবারই নজর ছিল সে সময়ের মধ্যমনি যুদ্ধশিশুদের দিকে । প্রধানমন্ত্রী পিয়ের এলিয়ট ট্রুডাে একটি পৃথককৃত বিলাসবহুল মােটরগাড়ি তাদের পাঠিয়েছিলেন শিশু এবং তাদের সহরক্ষী যাত্রীদের টার্মিনালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ।
সবাই তখন বিজয়ানন্দে উৎফুল্ল । হৈ চৈ এর মধ্যে বাবা-মায়েদের নাম ঘােষিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ভীত সন্ত্রস্ত, উত্তেজিত হবু বাবা-মায়েরা দ্রুত সামনে এগিয়ে এসে তাদের সন্তানকে নামের ট্যাগ পুনরায় মিলিয়ে সানন্দে কোলে তুলে নেন। মুহূর্তের মধ্যে ভিড়ে আনন্দের অশ্রুর মাঝে, অনেকে হাত বাড়িয়ে দেন শিশুদের দিকে তাদেরকে কোলে তুলে নেবার জন্য । সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সৃষ্টিকর্তাকে জানান যে শিশুরা নিরাপদে পৌঁছেছে। দর্শকরা শিশুদের শারীরিক সক্ষমতা দেখে অবাক, ওদের দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না, এত দুর্বল শরীরে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এলাে কী করে! বাবা-মায়েরা এত খুশি যে শিশুদের কোলে নিয়ে তারা মুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে রইলেন যেন! এত ধরনের ভাবাবেগের আসা-যাওয়ায় তারা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কোনটা কতটুকু সত্যি। বাইরে যাবার সময় সব পথে গর্বিত দম্পতি তাদের শিশুদের জড়িয়ে ধরে বারবার তাকিয়ে থাকেন; তারপর, আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে হর্ষোঙ্কুল্লে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তাদের জন্য, টরন্টোর দম্পতিদের মতে, সেদিন অনেক মাস অপেক্ষার পর এটা যেন ছিল সে স্বপ্ন হলাে সত্যি” মুহূর্ত; সৃষ্টিকর্তা যেন তাদের কর্ণকুহরে স্বস্তি আর আরামের বাণী পশিয়ে দিলেন পরম সমতাভরে। মন্ট্রিয়ল রে মৌলিং-এর স্ত্রী এলিজাবেথ বাংলাদেশ গিয়েছিলেন শিশুদের সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন বলে । মি. রে মােটামুটিভাবে তৈরি হয়ে ছিলেন প্রয়ােজনের চেয়ে দীর্ঘতর সময় বিমানের অবতরণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ভেবে। তার মনে পড়ে, তিনি অনেক বাবামায়েদের চেয়ে আগেই বিমানবন্দরে পৌছে ছিলেন, যাতে বাকি মা-বাবার সঙ্গে সাক্ষাতের পর্ব আগেই সেরে নিতে পারেন। যদিও তিনি বেশ কয়েকটি দম্পতির সঙ্গে দেখা করে কুশল বিনিময় করেন, তিনি তাদের সাত সপ্তাহ বয়সের ছেলে অনিল যে শীঘ্রই আসছে, তার কথা মনে মনে ভাবছিলেন এবং তার স্ত্রী এলিজাবেথ আর অনিলকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে। উঠেছিলেন। তিনি বলেন: “আমার মনে হয়, এরকম প্রকল্প আরও বেশি বেশি হওয়া দরকার। আমি আশা করব এটা হবে অনেকগুলাের মধ্যে প্রথম।” আজ পর্যন্ত মি. রে সেদিনের তীব্র আনন্দ ও সুখের অনুভূতি তিনি ভুলতে পারেননি; বিমানবন্দরে যখন তিনি সাত জন শিশুর সবাইকে একসঙ্গে দেখতে পান, সে অবিস্মরণীয় মুহুর্তটির কথা তিনি মনে রেখেছেন। ক্যামেরা ক্রু এবং সাংবাদিকেরা তাদের অনুসরণ করছিলেন, তাদের ভাবনা, চিন্তা, অনুভূতি ও আবেগ সবকিছু ধরে রাখার চেষ্টায় । মি. রে এখনও মনে রেখেছেন তার স্ত্রী ও তিনি এতই উত্তেজিত ছিলেন যে খবরের কাগজের রিপােটারদের থেকে দ্রুত দূরে চলে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। পুরাে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ফ্রেড এবং বনি তাদের ধৈর্য্যের দড়ির শেষ প্রান্তে ছিলেন যখন বিমানটি অবতরণ করে। চার মাস বয়সী শিখাকে (তারা যে মেয়েটিকে দত্তক নিয়েছিলেন) কোলে নিয়ে বনি ব্যস্ত হয়ে খোজ করছিলেন, কোনাে বিশৃঙ্খলা এবং বিভ্রান্তি ছাড়া সব নির্ধারিত মা-বাবা তাদের নিজ নিজ শিশুকে কোলে নিয়েছেন কিনা।
ফ্রেডের মনােযােগ ছিল প্রত্যেক দম্পতি যেন ঠিক শিশুকে তুলে নেন, যাতে তিনি তার তালিকার থেকে চেক করে বাদ দিতে পারেন। তারা এত ব্যস্ত ছিলেন যে, প্রথম কয়েক মিনিটের জন্য তারা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি, যারা প্রবল আবেগে শিখাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শিশুদেরকে তাদের মা-বাবার হাতে হস্তান্তর করার পর ক্যাপুচিনােরা তাদের ছেলেমেয়ে এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। ততক্ষণে কর্মশক্তিসম্পন্ন যুগলটি এত নিঃশেষিত অবস্থায় ছিলেন যে কারাে সাথে সংলাপের আর কোনাে উদ্যমতা ছিল । তারা অবিলম্বে চুপি চুপি বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। কারণ তারা জানতেন গণমাধ্যমের লােকেরা তাদের খুঁজছিল, কিন্তু তখন রিপাের্টারদের সাথে কথা বলার কোনাে ক্ষমতা তাদের ছিল না। তারা রিপাের্টারদের এড়িয়ে যান, যে কাজটি তারা কখনাে করেন না।
বাকি দম্পতিদের মধ্যে একটু ব্যতিক্রমী ছিলেন রােবের্তো এবং মার্গো কার-রিবেইরাে। তারা এমন এক দম্পতি যারা তাদের গল্পটি আর পাঁচজনে জানুক, এটা কখনাে চান না। কাজেই তারা তাদের তিন মাসের ছেলে সমর যখন আসে, সে সময় তাদের মানসিক অবস্থার কথা কাউকে বলতে চাইনি এবং এখনও চান না। তাদের স্বপ্নের শিশু যখন এলাে, ‘তারা সে ব্যাপারে চুপ করে থাকাই শ্রেয় বিবেচনা করেছিলেন। বিশেষ করে মার্গো দত্তক নেবার বিষয়ে বাইরের কারাে সঙ্গে কিছু না বলেনিজেদের পরিবারের মধ্যেই ওসব থাক, এরকম মতাবলম্বন করেন। অনেক বছর পরে কথা প্রসঙ্গে মার্গো বলেন বাংলাদেশ থেকে সমরের আবির্ভাব তাদের জীবনে “মনে রাখার মতাে ঘটনা ছিল। মার্গো সে দিনের মনের অবস্থা বর্ণনা করতে চান না, তবুও অনেক অনুরােধের পর তিনি শুধু বলেছিলেন, “প্রকাশ্যে সন্তান প্রসবের বেদনার বিষয়ে আলাপ করতে অনিচ্ছুক । উল্লেখ্য যে, মার্গো’র স্বামী রােবের্তো অনেকটা অস্তচারী মানুষ। যেহেতু তিনি অন্যের আড়ালে থাকা পছন্দ করেন, লেখকের প্রকল্পে অংশগ্রহণে অসম্মতি জানান। তবুও সেদিনের কথা বলতে গিয়ে তিনি তার স্ত্রীর উক্তির পুনরুক্তি করে এটুক বলেছিলেন যে তাদের ছেলের আগমন “তাদের জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।”২৮
জোয়েল এবং টুডি হার্ট সেদিন ব্যস্ত দিন কাটিয়েছেন, বাড়িতে তাদের আরও তিনটি সন্তান থাকায় কাজের অভাব ছিল না । টুডির বাবা-মা বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন সব ছেলেমেয়ের। সঙ্গে যারা সবাই ওদের নতুন বােনকে অভ্যর্থনা জানানাের অপেক্ষায় ছিলেন। নানা-নানি নাতি-নাতনিদের সবাইকে সামাল দিচ্ছিলেন যখন হার্ট দম্পতি ইমিগ্রেশনের কাগজপত্র স্বাক্ষর করা নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন । টুডি ছােট্ট মলিকে জাপটে ধররার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে উদ্ভাসিত হয়ে বলেছিলেন; “আমার মনে হয়েছিল অত সুন্দর কাউকে আমি আগে কখনাে দেখিনি। আমি কৃতজ্ঞবােধ করছিলাম, আগে কখনাে বুঝি নি, এমনি সব অনুভূতির প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলাম আমি সে মুহূর্তে,” টুডি এভাবে লেখেন লেখককে। জোয়েল এবং টুডি মলির পানে তাকিয়ে ছিলেন এক দৃষ্টে, কয়েক মিনিট শুধু ভেবে মেয়েটি যে, “এত ছােট আর এত সুন্দর!” লােকের ভিড় বলে মলির দিকে তাকাতে তাকাতে তারা লবিতে গিয়ে ছবি তুলেন অনেক । তারপর মলিকে নিয়ে তারা লােকের ভিড় এড়িয়ে নানানানির সঙ্গে মলিকে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলেন, সেখানে মলির ভাইবােনেরাও অপেক্ষায় ছিল “ক্ষুদে আশ্চর্য শিশুটিকে দেখার জন্য।” মিটজি ম্যাককালা মন্ট্রিয়লে এসেছিলেন একা হ্যালিফ্যাক্স, নােভা স্কোশিয়া থেকে, তার স্বামী বাড়িতে রয়ে গিয়েছিলেন। কারণ তারা দুজনের বিমান ভাড়া যােগাড় করতে পারেনি । মিটজি তখন ছিলেন ২৩ বছরের তরুণী। চতুর্দিকে বিমানবন্দরের ভিড়, আলাের মাঝে নিকি দাঁড়িয়ে তাদের সাড়ে তিন মাস বয়সের ছেলে প্রদীপের জন্য অপেক্ষা করছিলেন আর ভাবছিলেন, দত্তকের আবেদনপত্র সই করবার দিন থেকে অবশেষে ছেলে আসার দিন পর্যন্ত । এক তীব্র অনুভূতিতে তিনি তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন শুধু মনে মনে ভেবে যে তাদের -দেখা-শিশুসন্তান শীঘ্রই এসে নামবে কানাডার মাটিতে । দত্তক নেবার প্রক্রিয়ায় নানা জটিলতা রয়েছে সত্যি, অনেক কিছু করে মিটজি এবং তার স্বামী এতদিন পর্যন্ত কেন কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারেননি। শেষে ক্যাপুচিনাের টিম তাদের জন্য একটি শিশু নির্বাচন। করে শেষ পর্যন্ত শিশুটিকে আনতে পারবে কিনা, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত ছিলেন না।
যদি পারে, শিশুটি দেখতে কেমন হবে? ঠিক সময়ে প্রদীপকে যখন তার কাছে নিয়ে আসা। হলাে মিটজি দুহাতে ধরে আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিলেন; “এ নিয়ে দ্বিতীয়বার আমি কোনাে শিশুকে ধরেছি, আমি ভয় পাচ্ছি।”৩২ প্রদীপ ওই দম্পতির প্রথম সন্তান। মিটজি তাকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে অত্যাশ্চর্যভাবে তিনি অনুভব করেন তার সাথে যেন তার সন্তানের এক অদ্ভুত যােগাযােগ স্থাপন হয়ে গিয়েছে ইতােমধ্যে । তার যত ভয় আর অজানা ভাবনা ছিল শিশুকে ঘিরে, সব যেন মুহূর্তের মধ্যেই গলে জল হয়ে গেল মাতৃস্নেহের প্রবাল তরঙ্গে। যখন মিটজি গর্বিত মায়ের ভঙ্গি করে প্রদীপকে কোলে তুলে নিলেন, একজন সাংবাদিক তার দিকে এগিয়ে গেলে তিনি বলেছিলেন: “আমরা যে কোনাে সময় একটি শিশু নিতে পারি, কিন্তু এরকম একটা বিশেষ শিশু পাবাে না।”৩৩ মিটজি সাংবাদিককে একথা বলতে বলতে হ্যালিফ্যাক্স যাবার জন্য বিমান ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
লয়েড এবং স্যান্ড্রা সিমসন-এর বেলায় একটু ব্যতিক্রম ছিল । বাড়িতে আরেকটি সন্তান আসার জন্য যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবার কথা, অভিজ্ঞ মা-বাবা হওয়ার কারণে সেটা অনেক স্তিমিত ছিল । যােগাযােগ মাধ্যমের সবাই এ দম্পতিদের বেশ ভালােভাবে চিনতেন । অনেকে আগে থেকে দেশের অভ্যন্তরে দত্তক নেয়া এবং আন্তর্জাতিক দত্তক নেবার ক্ষেত্রে তারা। সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে আসছেন অনেক বছর থেকে। কুড়ি দিন বয়সের শিশু রাজিবকে বুকে জড়িয়ে ধরে সিমসন দম্পতি তাদের পরিবারের আরও ছেলেমেয়েদের নিয়ে হঠাৎ যেন বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ক্যাপুচিনােদের ঢাকা সফরের সময় স্যান্ড্রা সর্বক্ষণ তাদের সঙ্গে যােগাযােগ রেখেছিলেন। শিশু খোঁজা শেষ করে ওদের নিয়ে ফিরতে পদে পদে যত বাধা, যত প্রতিবন্ধকতা তার খবর তিনি রাখতেন। স্বাভাবিকভাবে স্যান্ড্রী এবং তার স্বামী শঙ্কিত ছিলেন, কানাডীয় টিম যথাসময়ে ঢাকা ত্যাগ করতে পারবে কিনা। “এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে, তারা এত তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন!”* অনেকটা অবাক হয়ে স্যান্ড্রা সেটা বলেছিলেন। তাদের কখনাে না-দেখা-সন্তান-এর উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরের দিকে যাত্রার সময়, আরভিডা, কিউবেক-এর পিয়ের ও লিজ হােগ নিজেদের সামলাতে পারছিলেন না। আমরা একটা গাড়িতে এবং মেয়েটা (রাজিনা) বিমানে। এক নতুন ভাগ্যের দিকে ভ্রমণ করছিলাম,”৩৫ লেখেন পিয়ের সেদিনের কথা মনে করে। যখন তারা বিমানবন্দরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন তাদের চারদিকে তখন মানুষের ঢেউ। খবরের কাগজের রিপাের্টার তাদেরকে ঘিরে রেখেছিলেন। আমরা আশায় উদগ্রিব এবং উত্তেজিত ছিলাম; আমি অনেকটা অনুভব করেছিলাম আমাদের ছেলে জন্ম নেয়ার সময়টুকু, অবশ্য শারিরিক কষ্ট ছাড়া আরও অন্যান্য অদ্ভুত অনুভূতি আমাকে ঘিরে রেখেছিল,” বলেন লিজ সেদিনের স্মৃতিচারণে তার মেয়ের আগমনের সময়টি বর্ণনা করতে গিয়ে। “বিমানবালা আমার কোলে শিশুটি দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমি টের পেলাম, রাজিনা ইতােমধ্যেই যেন আমার মেয়ে হয়ে গিয়েছিল,” বলেন লিজ ।
আনন্দে কাঁপতে কাঁপতে তারা তাদের শিশুটিকে দুহাতে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন। যদুর মনে পড়ে তার পরপরই তারা নিঃশব্দে বিমানবন্দরের সন্নিকটে পার্ক করা গাড়ির দিকে এগিয়ে। গিয়েছিলেন। তারা সানন্দে এবং আবেগে এত আপুত ছিলেন যে, সে সময়ে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য তারা তাদের চার বছরের ছেলে বেনওয়াকে ভুলে গিয়েছিলেন – যে বাড়িতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, কখন মা-বাবা তার ছােট বােনকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন । দুদিন ভ্রমণের শেষে শিশুরা যার যার মা-বাবার কাছে যাওয়া, হৈচৈপূর্ণ এবং হর্ষোৎকল্প মিলনের মধ্যে অনেক আশঙ্কা আর দুর্ভাবনার ইতি ঘটে। ছেলেমেয়েদের বুঝে পাবার পর, বাবা-মায়েরা স্বাভাবিকভাবেই আগে বাড়ি পৌঁছতে চেয়েছিলেন। কোথাও দু-দন্ড দাঁড়িয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসার কোনাে অবকাশ ছিল না। বিমানবন্দর থেকে বের হবার পথে সাংবাদিকেরা বাবা-মায়েদের থামানাের চেষ্টা করেন অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য থেমে ফটো তােলার অনুরােধ করেন। একটি দুটি ছবি তুলে এবং মন্তব্য রেকর্ড করেই অতিমাত্রায় উত্তেজিত বাবা-মায়েরা ভিড় ঠেলে কোনােমতে সামনের দিকে নিজ নিজ শিশুকে নিয়ে তাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে যান।
যে আনন্দ হতভম্ভতা বাবা-মায়েদের মুখমন্ডলে প্রতিফলিত হয়েছিল সেটা নাটকীয়ভাবে তীক্ষ্ম ও মর্মভেদী ছিল। তাদের নিজ পছন্দের অন্তত একটি যুদ্ধশিশুকেও বাঁচাতে পেরে তারা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করেন । আস্তে আস্তে তারা সবাই যখন নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেলেন তখন থেকে আশা করেছিলেন যে তাদের শিশুরা কানাডাতে এসেছে একটি নতুন স্বপ্ন নিয়ে। তাদের জীবনে প্রতিদিনই নতুনতর সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে এটাই ছিল বাবামায়েদের স্বপ্ন। পরের তিন অধ্যায়ে আমরা যুদ্ধশিশুদের জীবনে মােড়ে মােড়ে কার কী। অভিজ্ঞতা হলাে সেটা অনুসন্ধান করেছি। বর্তমান অধ্যায়ে আমরা বাংলাদেশ ও ক্যনাডাতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া যেরকম হয়েছিল সে সম্পর্কে ধারণা দিতে চেয়েছি।
কানাডাতে মিডিয়া কভারেজ
কানাডাতে আন্তর্জাতিক দত্তকের ইতিহাসে যুদ্ধশিশুদের নিরাপদে এসে পৌছনােকে এক মাইলফলক ঘটনা বলা যায় । এটাকে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে, যখন এ সত্য বিবেচনা করা হয় যে ঐ সব শিশুরা তাদের জন্মদেশে “কাঙ্ক্ষিত ছিল না। যেহেতু পরিত্যক্ত বাংলাদেশে তাদের কেউ দত্তক নিতে কখনই আগ্রহী ছিলেন না, দত্তকের অভিধানে ঐ শিশুদের সাধারণত “দত্তক দেয়া কঠিন” হিসাবে ধরে নেয়া হয়। এ ধরনের সন্তানদের দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবা না পাওয়ার জন্যে তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক পর্যন্ত। বাংলাদেশে বিভিন্ন আশ্রমে জীবন কাটাতে হয় । তবে সাধারণত দেখা যায়, পরিণত বয়সে পৌছানাের সাথে সাথে আশ্রম থেকে অনেক ছেলেমেয়ে পালিয়ে যায়। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি হৃদয়বান, উপকারী ও মানবতাবাদী একদল কানাডীয় নাগরিকদের সমবেত স্বার্থহীন প্রয়াসে কয়েকটি যুদ্ধশিশুর কানাডাতে আগমন ঘটেছিল। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে দেখতে পাবাে কেমন করে এই শিশুদের ‘নৈরাশ্যের শিশু” আখ্যায় আখ্যায়িত করে কানাডীয় সংবাদ মাধ্যম কানাডীয়বাসীর সমীপে এদের উপস্থাপন করে এক গভীর আগ্রহের আধাররূপে।
২০ জুলাই ১৯৭২ সালে যেদিন যুদ্ধশিশুরা কানাডাতে আসে, বিমানবন্দরের বাইরে এমনকি আগমনী এলাকায় কেউ কেউ গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে রেখেছিলেন, কেউ বা জোরে জোরে করতালি দেন সে সব দৃশ্য দেখে। সেদিন ছিল অনেকেরই চোখে আনন্দের অশ্রু, আবার অনেকের চোখে তাদের প্রার্থিত শিশু না পাওয়ার অশ্রু। কানাডার মাটিতে পা দেয়া হতে না হতেই তাদের সব অতীত যেন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। আমরা ইতােমধ্যে দেখেছি কেমন করে দত্তকে ইচ্ছুক পরিবারগুলাের আত্মীয়স্বজনরা কানাডীয় দলের সদস্য ও নবজাতকদের সাদরে আলিঙ্গন করে সে সময়টিকে আনন্দোচ্ছল সময়ে রূপান্তরিত করেন। বাস্তবিকপক্ষে এভাবে তাদের আমন্ত্রণ আর অভ্যর্থনা কানাডার মাটিতে এই শিশুদের যেন পুনর্জন্ম হয়েছিল। পরদিন ২১ জুলাই ১৯৭২ তারিখে প্রধান সংবাদপত্রগুলাে, বিশেষ করে অন্টেরিও ও কিউবেক-এর সংবাদপত্রগুলাে কানাডাতে শিশুদের অভ্যর্থনা জানিয়ে সংবাদ শিরােনাম ছেপেছিল শিশুদের আগমনী এবং তাদের অঙ্গীকারবদ্ধ বাবা-মায়েদের অভিনন্দন জানিয়ে ।
কানাডাতে সেদিন যুদ্ধশিশুদের আগমনটি ছিল সবচেয়ে কৌতূহলােদ্দীপক এবং খবরােপযােগী” সংবাদ ছিল। একটি বা দুটি শিশু হলে হয়তাে ওটা অন্যরকম ব্যাপার হতাে । কিন্তু বিমান ভর্তি শিশুর এ আগমণ সাধারণ মানুষ এবং সংবাদ মাধ্যম উভয়ের জন্য এক দর্শনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই যেহেতু ঘটনার প্রতিবেদন প্রচার ছিল ব্যাপক, এটা ধরে নেয়া হয়েছিল যে সবাই প্রকাশিত খবরটি পড়েছে, শুনেছে অথবা দেখেছে ঘটনাবলির কিছু না কিছু অংশ।
কয়েকদিন যাবৎ জনসাধারণ ঐ বিষয়ে আলাপ করেছে, সে সাবওয়েতে হােক বা পার্কে হােক; অথবা রাস্তার ধারের কফি শপের টেবিলে, যেখানেই কিছু লােক একত্রিত হয়েছে। সেখানে একই বিষয়ে আলাপ হয়েছে। দত্তক নেয়ার ঘটনাগুলাে কানাডীয়দের মানুষজনের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের তাৎপর্য বয়ে নিয়ে এসেছিল, বিশেষ করে, যখন তারা নিজের চোখে দেখেন কেমন করে টেলিভিশন ক্যামেরা আর ডজন ডজন স্টিল আলােকচিত্রগ্রাহক। ঐতিহাসিক ঘটনাটি ক্যামেরাবন্দি করাতে ব্যস্ত ছিলেন। প্রধান দৈনিকগুলাে পুরাে পৃষ্ঠা জুড়ে বিস্তারিত ছাপিয়েছিল । কীভাবে উৎসাহী এবং অপেক্ষমান মা-বাবা ও জনসাধারণ ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেছিলেন বিমান মাটি ছোঁয়ার অপেক্ষায়। দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবার সঙ্গে তাদের শিশুদের প্রথম সাক্ষাৎকারের দৃশ্য ছিল সত্যি মনকে ছুঁয়ে দেবার মতাে।
আশ্চর্য হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুদের বিদায় ছিল নিতান্ত সাধারণ একটা ঘটনা মাত্র যার কোনাে ঐতিহাসিক মূল্য ছিল না। কিন্তু কানাডাতে তাদের আগমন ছিল একেবারে উল্টো ব্যাপার। বাংলাদেশি অনাথ শিশুরা কানাডার পথে” – প্রথম কয়েকদিন এটা ছিল খবরের কাগজের প্রধান খবর । কানাডীয়রা জানতে পারেন কীভাবে গুটিকয়েক কানাডীয় বাবা-মায়েরা পনেরােজন যুদ্ধশিশুকে উদ্ধার করেছিলেন – শুধুমাত্র নিজেদের পরিবারে নিজের ছেলেমেয়ের মতাে করে লালন পালন করার লক্ষ্যে। এবার সেদিনের কয়েকটি সংবাদপত্রের। শিরােনাম উদ্ধৃতি করা যাক: “রায়ানকে তার নিজের দেশেই কেমন খাপছাড়া মনে হতাে; যখন হাজার হাজার মেয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন, তার
লশ্রুতিতে যুদ্ধের পরপরই ওর জন্ম হয়েছিল।” Mennonite Reporter, ১৪
এপ্রিল ১৯৭৫। লক্ষী যে, কানাডাতে যুদ্ধশিশুদের আগমনের পর সেখানে যুদ্ধশিশুদের দত্তক সংক্রান্তকা। বিতর্কের সূত্রপাত হয়নি; যেমনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামী অনাথ শিশুদের নাটকীয়ভাবে বিমানে করে তুলে আনা ও দত্তক নেয়াকে কেন্দ্র করে হয়েছিল । সকলেই জানেন, অপারেশন বেবি লিফট-এর সময়ে ২০০০ এর বেশি শিশুকে দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে সামরিক ও ব্যক্তিগত বিমানে করে দত্তক নেবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। নিয়ে আসা হয়েছিল । ১৯৭৫-এর ঘটনার তিন বছর আগে যুদ্ধশিশুদের কানাডা নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অনেকটাই চুপি চুপি, তেমন ঢাক ঢােল না বাজিয়ে, যদিও সংবাদ মাধ্যম খবরটা ভালােভাবে প্রচার করেছিল । কানাডীয় কর্মযজ্ঞে শিশুদের সংখ্যা ও ছিল। অতি নগণ্য।
যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবার ব্যাপারে একটি বিষয়ে কোনাে বিতর্ক নেই যে, কোনাে যুদ্ধশিশুকে তার মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দত্তক দেয়া হয়নি, কারণ ওদের মায়েরা ওদের প্রসবকালে পরিত্যাগ করেছিলেন। এর আগে সংবাদ মাধ্যম বর্ণনা করেছিল, কীভাবে জন্মদাত্রী মায়েরা। তাদের নারীত্ব হারিয়েছিলেন; জবরদস্তিমূলকভাবে তারা গর্ভে সন্তান ধারণ করেছিলেন; এবং কী পরিস্থিতিতে জন্মদাত্রী মায়েরা তাদের অপ্রার্থিত সন্তানদের প্রসব করে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এটা ভিয়েতনামের যুদ্ধশিশুদের মতাে ব্যাপার ছিল না। আমরা জানি, অপারেশন বেবি লিফট-এর মাধ্যমে অনেক শিশুকে দক্ষিণ ভিয়েতনামে জন্মদাত্রী মা অথবা। মা-বাবার কাছ থেকে জোর করে আলাদা এবং দূর দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
কানাডাতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
কানাডাতে আগমনের পর সে সময়ে FFC টিম সকলকে ধন্যবাদ জানান যাদের সহযােগিতায় বাংলাদেশ প্রকল্প সফল হয়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই FFC প্রচুর অভিনন্দন লাভ করে। সর্বপ্রথম অভিনন্দন যারা জানান, তাদের মধ্যে প্রথম ছিলেন আব্দুল মােমিন, তখন কানাডাতে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাই কমিশনার। তারপরই একটি নােট পাঠান ব্রাইস ম্যাকাসি, তদানীন্তন ম্যানপাওয়ার ও ইমিগ্রেশন মিনিস্টার-এর কাছে এবং তারপর পিয়ের এলিয়ট ট্রুডাে, কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী । (তৃতীয় অধ্যায়ে যেমন বলা হয়েছে) মােমিন আগে TFC টিমের সঙ্গে কাজ করেছেন এবং কানাডীয় টিমের সদস্যদের সবসময় উৎসাহিত করেছেন। তিনি তার সরকারের প্রধান বার্তাটি কানাডীয়দের মধ্যে প্রচার করার চেষ্টা করেন। এটা বলে যে, মুজিব প্রশাসন বিশ্বাস করেন কানাডীয় গৃহে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়া হলে তাদের সুযােগ হবে একটি চমৎকার জীবনযাপনের, যেটা তাদের জন্মদেশে সম্ভব হবে না । সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক শিশু দত্তকগ্রহণের ব্যাপারে যে স্পর্শকাতরতা ছিল তিনি সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন। সেজন্য তিনি ক্যাপুচিনােদের নিকট ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে, মােমিন। দত্তক মা-বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী। তিনি বাংলাদেশি শিশুদের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা বিষয়ে জানতে উৎসুক ছিলেন, অবশ্য যদি তাদের তাতে আপত্তি না থাকে।
কানাডীয় নথিপত্র থেকে খুব সহজেই প্রমাণিত হয় যে, ব্রাইস ম্যাকাসে কাপুচিনােদের দুদুবার শুভেচ্ছা জানান। এপ্রিল মাসে অভিবাসন প্রক্রিয়া এবং দায়িত্ব ও ভূমিকা ব্যাখ্যা করার সময় উনি তাদের প্রচেষ্টায়” ‘সব রকমের সফলতা আশা করে লেখেন: “আমি এ সুযােগে বাংলাদেশের গৃহহীন শিশুদের কল্যাণে আপনাদের মানবিক ও মমতাময় প্রচেষ্টা সফল হােক, এ কামনা করি। আবার শিশুরা কানাডা পৌছলে ম্যাকাসে ক্যাপুচিনােদের। উদ্যোগ সফলতার সঙ্গে শেষ করাতেও তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে লিখেছিলেন যে, তিনি জানেন তারা বাংলাদেশ থেকে দুর্ভাগা শিশুদের কানাডা নিয়ে এসেছেন, কিন্তু এত স্বল্প। সময়ের প্রস্তুতিতে তিনি বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকতে পারেননি। যুদ্ধশিশুদের কানাডাতে আগমনে অভ্যর্থনা ও অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডাে একটি চিঠি লিখেন FFC টিমের দলপতিকে। একই চিঠিতে টিমের স্বেচ্ছাসেবকদের তাদের দীর্ঘ। ভ্রমণকে “হৃদয় উষ্ণ করা এক অভিযান” বলে আখ্যায়িত করে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। অজস্র ধন্যবাদ জানিয়ে ট্রুডাে তার চিঠিটি শেষ করেন এভাবে: “শিশুদের কানাডীয় পরিবারে। এনে তাদেরকে সন্তান হিসাবে গ্রহণ করার জন্য দেশবাসী সবাই আনন্দিত।”৮০।
সে সময়ে সরকার এবং সংবাদ মাধ্যমের মূল বার্তাটি ছিল যে, আন্তর্জাতিক দত্তক কর্মসূচি এমন একটি মানবহিতৈষী উদ্যোগ যেটাকে বহু সংস্কৃতির ও পটভূমির চ্যাম্পিয়ন কানাডীয়রা অবশ্যই স্বাগত জানাবে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে যদিও বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেয়াকে কমবেশী কানাডীয়রা সমর্থন করেছিলেন, কেউ কেউ যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়ার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছিলেন। শীঘ্রই জানা গেল, দেশব্যাপী বাংলাদেশ থেকে দত্তক নিতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সংস্কৃতি, জাতীয়তা ও জাতিগােষ্ঠী নির্বিশেষে অনেকেই বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে চেয়েছিলেন। তবে এটাও সত্য যে, সে সময়ে যুদ্ধশিশুদের কানাডাতে আগমন উপলক্ষে কানাডার বাইরে থেকে শিশু দত্তক নেবার ব্যাপারে নানা বিতর্কের ঢেউ ওঠে । (তৃতীয় অধায়ে আমরা দেখেছি) অন্টেরিও সরকারের। কর্মকর্তারা FFC-এর উদ্যোগের বিরােধিতা করেন শুরু থেকে। তারা এ যুক্তি দেখান যে কানাডা সর্বপ্রথম নিজের দেশের শিশুর প্রয়ােজন মেটানাের কথা চিন্তা করা উচিত। অর্থাৎ বিদেশ থেকে দত্তক গ্রহণের আগে কানাডাতে যে সব অনাথ শিশু রয়েছে তারা দত্তকের প্রাধিকারে পড়বে প্রথম।
ঐ মুহূর্তের প্রয়ােজন মেটানাের লক্ষ্যে সরকারের নিকট সবচেয়ে কড়া ভাষায় দৈনিক কাগজ। The Toronto Star অবশ্য আবেদন জানিয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন যতজন যুদ্ধশিশু। মারা যাচ্ছিল প্রতিদিন, ঠিক সে হারে তাদের জন্ম হচ্ছিল। বিষয়টি অন্যভাবে পর্যবেক্ষণ। করলে এভাবে বলা যায় যে, যে হারে যুদ্ধশিশুরা জন্ম নিচ্ছিল ঠিক সে হারে তারা সাথে সাথে পরিত্যক্ত হচ্ছিল তাদের জন্মদাত্রী মায়ের দ্বারা । FFC-কে তার উদ্যোগের জন্য অভিনন্দন
জানিয়ে দৈনিক খবরের কাগজের মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: “এ শিশুদের রক্ষা করার পা কেন সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত দায়িত্বের মধ্যে পড়বে?” কানাডাতে যে দত্তক নেশার মতাে শিশুর চাহিদা অত তাড়াতাড়ি মেটার নয়, সে কথা জানিয়ে দিয়ে কাগজটি পরামর্শ দেয়, নাগরিকেরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে প্রতিক্রিয়া দ্রুতকরণের দায়িত্ব নিজেরা নিয়ে নিয়েছেন, তার প্রশংসা করে: “বাংলাদেশে আরও শিশু মারা যাবার আগে চিলড্রেন’স এইড সােসাইটিজ এগিয়ে আসুক না কেন। সক্রিয়ভাবে এখানে থেকে ঐ বিপন্ন শিশুদের জন্য মা বা নির্বাচন করুক।” আবার এটাকে মানবিক সুখ বিলানাের একটা সুযােগ” বলে ঐ একই সংবাদপত্র আরও যুক্তি তুলে ধরে: “এখানে যখন যােগ্য প্রাপ্তবয়স্করা রয়েছেন, যারা শিশু লালন করতে চাচ্ছেন। আবার আমরা জানি, বাংলাদেশের শিশুর মা-বাবাও বাঁচার জন্য। একটু সহায়তা চাচ্ছেন, এদের একত্রিত করে দেয়া দরকার।” সে সময়ে ফেরি দম্পতি আলাদা সংস্থা তৈরি করার পর সাধারণ মানুষ কিছু সময়ের জন্য যেন ওদের দিকে ঝেকে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেবার সময় ডাঃ রবার্ট ফেরি আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, “মঙ্গলবার যে ১৫ জন যুদ্ধশিশু কানাডা এসে পৌছেছে, তাদের মাধ্যমে আন্তসরকার সহযােগিতার একটা জায়গা তৈরি হবে আশা। করি । অন্টেরিও শিশু কল্যাণ কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করতে পারি যে, বাংলাদেশ দত্তক কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন করা যাবে। একই সুরে আরও কথা বলে ফেরিরা যুক্তি দেন যে, যুদ্ধশিশুদের নিজ জন্মদেশে কোনাে সামাজিক বা অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ ছিল না। অনেকেই এ প্রকল্পে ফেরিদের সংশ্লিষ্টতা একটি মানবিক প্রচেষ্টা” হিসাবে দেখেন। ফেরি দম্পতি তখনও আশা করেছিলেন যে, “প্রকল্পের আওতায় আরও কয়েকজন যুদ্ধশিশুকে কানাডা নিয়ে এসে তাদের এক নতুন জীবনের স্বাদ পাইয়ে দেয়ার সুযােগ রয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে সংবাদ মাধ্যমের ইতিবাচক প্রচারণা কানাডীয়দেরকে দত্তক বিষয়ে বেশ প্রভাবান্বিত করে। সম্মিলিতভাবে সংবাদ মাধ্যম এফ এফ সি’র উদ্যোগকে কেবল “মৌলিক মানবিক কাজ” বলে আখ্যা দেয়নি বরং এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করে লিখেন যে “কানাডা যেসব। মূল্যবােধের পক্ষে দাঁড়িয়েছে এফ এফ সি সেসব আদর্শের চ্যাম্পিয়ন।” লক্ষণীয় যে, এফ এফ সি’র নানা কর্মপ্রয়াসের বিবরণ সংবাদপত্রে যেভাবে প্রচার হয়েছিল, তাতে ওদের সুনাম কেবল জনসাধারণের মধ্যে নয়, প্রধান প্রধান ধর্মীয় গ্রুপে প্রবল উৎসাহ সৃষ্টি করে। রেভারেন্ড আর ডি ম্যাকরে, তদানীন্তন সচিব, অংলিক্যান চার্চ অব কানাডা, দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদের অভিবাদন জ্ঞাপন করে ক্যাপুচিনাে যুগলকে লিখে অন্যান্য শিশুদের সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন: “শিশুদের প্রকৃত অবস্থা ঐ মুহূর্তে কেমন।” সে বিষয়ে তিনি। গভীর আগ্রহ প্রকাশ করে নতুন দত্তক নেয়া শিশুদের সর্বোচ্চ মঙ্গল কামনা করেন। তিনি ক্যাপুচিনােদেরকে অনুরােধ করেন তারা যেন তাকে এসব শিশু এবং তাদের মা-বাবার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানান। একই সঙ্গে তিনি মা-বাবার আন্তর্জাতিক দত্তক” সম্পর্কে নিজস্ব চিন্তাভাবনা বিষয়েও জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। রেভারেন্ড ম্যাকরে আরও কিছু গভীর প্রশ্ন তুলেছিলেন যুদ্ধশিশুদের জন্মকে ঘিরে সে সময়ের ঘটনাবলি এবং জন্মদাত্রী। মায়েদের সামাজিক অবস্থান সংক্রান্ত বিষয়ে: “বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মায়ের অবস্থান কী রকম? শিশুর জন্য সম্ভাব্য প্রাতিষ্ঠানিক যত্নের স্বরূপ কেমন? বিকল্প কী আছে?
কানাডাতে শিশু দত্তক নেবার ব্যাপারে কানাডীয় পাকিস্তানি অথবা বাংলাদেশি জনগােষ্ঠী এ বিষয়ে। কীভাবে? ধর্ষণের ফলে যে শিশুর জন্ম তার অতীত সম্পর্কে যাতে লােকে বলাবলি না করে সে রকম কোনাে সুরক্ষা শিশুকে দেবার কথা কেউ ভেবেছে কি?”
কানাডীয় আর্কাইভস এ রক্ষিত দলিলাদি পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, ব্যাপক প্রচারণা সত্ত্বেও কানাডাতে বসবাসকারী কোনাে পাকিস্তানি অথবা বাংলাদেশি এই শিশুদের দত্তক নিতে চাইনি। প্রকৃতপক্ষে এর উল্টোটাই ঘটেছে। আমাদের গবেষণা ইঙ্গিত করে যে, অন্ততপক্ষে একটি ক্ষেত্রে উল্টো অভিজ্ঞতার কথা রেকর্ড করা হয়েছে। মনােচিকিৎসক ডাঃ আরশাদ মজিদ যিনি সে সময় অন্টেরিও প্রদেশের বার্লিংটন শহরে বাস করতেন, তার ব্যক্তিগত মতামত জানিয়েছিলেন এক প্রকাশনার মধ্য দিয়ে। এ পাকিস্তানি কানাডীয় আন্তর্জাতিক দত্তক প্রথা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন: “যে কোনাে স্থানে কোনাে ব্যক্তির কি সে অধিকার থাকে যার দ্বারা একটি শিশুর সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারে? যে সিদ্ধান্ত শিশুটির আপাত জীবনকে পুরােপুরি বদলে দিতে পারে যখন শিশুটির কোনাে কিছু বলার থাকে না?” সুস্পষ্টভাবে কুদ্ধ ডাঃ মজিদ জিজ্ঞাসা করেছিলেন: “মান মর্যাদা সমুন্নত রেখে খানিকটা খর্বটে জীবনযাপন। করা কি সহজতর নয়? শুধুমাত্র একটু সুবিধা ও আরামের জীবনযাপনের চেয়ে?”” ডাঃ মজিদ ওখানেই থেমে যাননি । আর একটু এগিয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন: “বাংলাদেশের লােকজন ভেবেছিল তাদের দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, তাদের মনে হয়েছিল তাদের সঙ্গে আগ্রাসী আচরণ করা হচ্ছে।” ডাঃ মজিদের উক্তির সত্যতা যাচাইয়ের বিষয়ে কোনাে ধরনের তথ্য নেই। শুধু এ কথা নিঃশন্দেহে বলা যেতে পারে যে, গবেষণা চলাকালে বাংলাদেশ অথবা বাংলাদেশের বাইরে কোথাও দত্তকায়নের বিরুদ্ধে কোনাে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে কোনাে তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারি ও বেসরকারি দলিলাদি থেকে যা পরিষ্কার উপলব্ধি করা যায় সেটা হলাে যে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে সরকার ছাড়া কেউ কোনাে মাথা ঘামাননি।
আরও শিশুর জন্য আগ্রহ ইতিবাচক গণমাধ্যমে প্রচারের সুফল হিসাবে কানাডীয় জনসাধারণ দত্তক নেবার জন্য আরও অধিক সংখ্যক যুদ্ধশিশুদের খোজ করা শুরু করেন। সংবাদ মাধ্যম জনগণের চাহিদা জাগরুক রেখে বিষয়টিকে আরও জোরদার করার জন্য প্রচারণা চালিয়ে ছিলেন কয়েকদিনব্যাপী । FFC-তে স্বেচ্ছাসেবকেরা টেলিফোনের আধিক্যে অস্থির হয়ে পড়েন, সারা কানাডা থেকে লােকে দত্তক নেবার জন্য বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের প্রাপ্যতা বিষয়ে জানতে চান। কানাডীয়দের অনেকে আতঙ্কিত ছিলেন এ ভেবে যে, যুদ্ধশিশুদের অনাথ আশ্রম এবং অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র থেকে সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে না নিলে শিশুরা ঐ গুদামজাতকরণ প্রক্রিয়ায়। মারা যেতে থাকবে । ১৯৭২-এর হেমন্তকাল পর্যন্ত ক্যাপুচিনােরা এক বিশাল সংখ্যক দম্পতির সঙ্গে যােগাযােগ প্রতিষ্ঠায় সফল হন। কমবেশি তারা সবাই সরাসরি সংবাদপত্র রিপাের্ট পড়ে এ ব্যাপারে আকৃষ্ট হয়েছিলেন । অতঃপর তাদের কাছে পরামর্শও চেয়েছিলেন।
ইতােমধ্যে চেয়ারপার্সন, এশিয়ান অ্যাডাপশন এবং সচিব-কোষাধ্যক্ষ, অন্টেরিও চ্যাপ্টার, ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন হেলকে ফিরি-এর সুনাম দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭২ এর জুলাই নাগাদ যদিও তিনি নিজে দুটি শিশুকে দত্তক নেন, তিনি এবং তার স্বামী ঐ সময়ে। তাদের নিজস্ব দত্তক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন, যার ঘােষিত উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের অনাথ। শিশুদের জন্য আশ্রয়ের সন্ধান করা।
১৯৭২-এর জুলাই থেকে আগষ্টের মধ্যে ফেরি দম্পতি অন্টেরিও দম্পতিদের নিকট থেকে ১০০ টির বেশি আবেদনপত্র পান। তারা এত আগ্রহী হন যে, চুয়ান্নটি পরিবার ইতােমধ্যে “সাত প্রাদেশিক সরকারের আওতাধীন চাইল্ড ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রয়ােজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন এবং প্রাদেশিক অনুমােদন লাভের কাজ শেষ করেন।” কানাডীয়রা। যুদ্ধশিশুর বিষয়ে আগ্রহাম্বিত হওয়ায় কানাডাস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনার মােমিন এফ এফ সি সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ রেখেছিলেন। তিনি তার যােগাযােগের সূত্রগুলি কাজে লাগিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে নিজেই যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। তাদের প্রথম অভিযানে শত বাধা অতিক্রম করে সফল হওয়ার আনন্দে প্রশংসা করে তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে লেখেন: “আমরা আপনাদের বাংলাদেশে ভ্রমণের বিষয়ে পড়েছি, আরও পড়েছি আপনারা দুহাত ভরে যুদ্ধে অনাথ শিশুদের এখানে নিয়ে এসেছেন, যাদের কানাডীয়রা অনুগ্রহ করে। আপন গৃহে স্থান দিয়েছেন।”৫৪
আরও অনেক বাঙালি কর্মকর্তার মতাে মােমিন বিশ্বাস করতেন যে, বাংলাদেশ প্রকল্প তেমন প্রচারণা না পেলে স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক মাসে মুজিব সরকারের এটি অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মোদ্যোগ ছিল যা সফলতার মুখ দেখেছে । মােমন তার চিঠিতে ফেরি দম্পতিকে লিখেন: “আপনারা যা করেছেন সেটা কেবল মহৎ হৃদয়ের মানুষেরাই পারে। শিশুর জন্য। ভালােবাসা, বাংলাদেশের আশ্রয়হীন, স্বজনহীন, যুদ্ধশিশুদের জন্য আপনারা কানাডীয়রা পরম আত্মীয়ের মতাে কাজ করেছেন, তাদের গৃহ দিয়েছেন।
এক অর্থে আন্তজাতিক দত্তক নেবার বিভিন্ন কাহিনী পুনরায় প্রচার করে সংবাদ মাধ্যম কানাডীয় জনসাধারণের মনকে বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে সহানুভূতিশীল করে তােলে। যুদ্ধশিশুদের জন্য আগ্রহ যখন নানা দেশ থেকে প্রকাশ করা হয়, অনেকে বাজারে গুজব রটাচ্ছিল। একটা গুজব ছিল যে, মুজিব প্রশাসন আর যুদ্ধশিশুদের বিদেশে দত্তক দেবার অনুমােদন দেবেন না। নিন্দুকদের ভাষ্যমতে সরকার শিশুদের অনাথ আশ্রমে রেখে অভ্যন্তরীণ দত্তকের জন্য চেষ্টা করবেন। ইতােমধ্যে ক্যাপুচিনােদের টেলিফোন অবিরাম বাজতেই থাকে । এত বেশি দম্পতি বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেবার জন্য অনুরােধ আসতে থাকে যে, ক্যাপুচিনােরা তার হিসাব রাখতে পারেননি। ক্যাপুচিনােদের এটা জানার প্রয়ােজন ছিল যে গুজবটা সত্যি কিনা।
ফ্রেড বাংলাদেশ কোয়েকার্স সার্ভিস (বি কিউ এস) এবং মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে তার বন্ধুদের নিকট চিঠি লিখে এ বিষয়ে খােলাখুলি মত জানতে চান। নবজাত যুদ্ধশিশুদের অবস্থা জানা ছাড়া এ বিষয়ে বন্ধুদের ব্যক্তিগত মতামত জানতে তারা আগ্রহ প্রকাশ করেন যদিও তিনি এ কথা জানতেন যে, বি কিউ এস কর্মীরা অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটান। তবুও ক্যাপুচিনাে রা লিখেছিলেন যে “জবাব হিসাবে দুটো লাইন লিখলেও তারা (ক্যাপুচিনাে] খুশি হবেন।” কোয়েকার্স এবং সিস্টার ম্যারি তখন নানা ব্যস্ততা সত্ত্বেও চিঠি লিখে জানান যে, গুজব যা রটেছে তা সত্যি। আবার তিনি শিশুদের প্রাপ্যতা বিষয়ে লেখেন। সরকারের কার্যক্রম ভালােভাবে চলছে এবং তারা প্রায় ১৬০০০ শিশুর (অনাথ) তখন খাবার দেবার দায়িত্বে ছিলেন” এবং “পুনর্বাসনের কাজ অনেকদূর এগিয়েছে।”ই” তারপর তিনি আরও বলেন, “আপনি আরেকবার আসার কথা লিখেছেন, আরও শিশু দত্তক নেবার জন্য এবং এ ব্যাপারে আপনার নৈরাশ্যজনক অনুভূতির কথাও বলেছেন। আমিও আপনার মতাে সন্দেহ। পােষণ করি সত্য, কিন্তু সেটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কারন বাংলাদেশে বর্তমানে আন্তর্দেশিক প্রক্রিয়া কাজ করছে।”৫৮
আরও বিশদ করতে গিয়ে কোয়েকারের প্রতিনিধি বলেছিলেন, তারা আশা করছেন যে, Bangladesh Abandoned Children (Special Provision) Order 1972 (CT বিষয়ে আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলােচনা করেছি) অভ্যন্তরীণ দত্তকের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হবে এবং এর উদ্দেশ্যাবলি সিদ্ধ হবে। ক্যাপুচিনোেরা অবশ্য অবগত ছিলেন কিছু দিন আগে সিস্টার ম্যারি বলেছিলেন সে বিষয়ে তাদেরকে কথা দেয়া হয়েছিল যে, দত্তক নেবার মতাে যথেষ্ট সংখ্যক যুদ্ধশিশু তাদের কাছে নেই। ক্যাপুচিনােদের মাধ্যমে হেলকে ফেরিদের বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের দত্তকের জন্য চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সিস্টার ম্যারি ইতােমধ্যেই জানিয়েছিলেন যে, আর এরকম কারাে জন্যই যুদ্ধশিশু মিলবে না। ঐ সময়ে হেলকে আরও ৫০ বা ততধিক যুদ্ধশিশু আনার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আরেকবার যাবার জন্য তৈরি ছিলেন।
তখন সিস্টার ম্যারি ফ্রেডকে একটি চিঠি লেখেন এরকম: “অনুগ্রহ করে ডাঃ ফেরি এবং অন্যান্যদের বলবেন, এ মুহূর্তে দত্তক নেবার জন্য আর কোনাে যুদ্ধশিশু পাওয়া যাবে না । আমাদের কাছে নয়টি শিশু রয়েছে, যারা ইতােমধ্যে নির্ধারিত পরিবারে যাবার পরিকল্পনাধীন। আমাদের কাছে কিছু সংখ্যক বয়স্ক শিশু রয়েছে, কিন্তু ওদের নেবার আগে দত্তকগ্রহণের ব্যবস্থায় আইনসিদ্ধ হওয়া প্রয়ােজন। একই চিঠিতে সিস্টার ম্যারি আরও ইঙ্গিত করেন যে, তিনি সারা পৃথিবী থেকে দত্তকের উদ্দেশ্যে অনুরােধের স্তুপের নিচে প্রায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছেন যারা তার কাছে যুদ্ধশিশু চাচ্ছেন কিন্তু তিনি তাদের প্রত্যাখ্যান” ও করেছেন। কারণ আর যুদ্ধশিশু অবশিষ্ট নেই, মাত্র নয়টি শিশু ছিল, যাদের দত্তক নেয়া ব্যবস্থা। চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে।
যাদের তখন পাওয়া যাচ্ছিল, তাদের বয়স বেশি। তাদের নিরাপদ বাড়ি এবং অভিভাবক প্রয়ােজন ঠিকই, কিন্তু তারা যুদ্ধশিশু নয়, যাদের নেবার জন্য অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ আগ্রহী ছিলেন । Bangladesh Abandoned Children (Special Provision) Order 1972 অনুযায়ী পরিত্যক্ত শিশুদের “Statutory Guardian” হিসাবে সিস্টার ম্যারি তখন। “যুদ্ধশিশু,” “বেবি অরফ্যান,” এবং “বয়স্ক অনাথ”-দের নিয়ে কাজ করছিলেন। তখন সিস্টার ম্যারির ব্যাখ্যা অনুযায়ী বাস্তবিকপক্ষে, যুদ্ধশিশুরা ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে অনবরত মারা যাচ্ছিল। তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবগত করেন এটা বলে যে, আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধকালীন সময়ের পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রস্থানের দরুণ ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বরের পরে আর কোনাে যুদ্ধশিশু জন্মগ্রহণ করবে না ।
বাংলাদেশে অনাথদের নিয়ে নতুন কর্মসূচি যা বাস্তবায়িত হচ্ছিল, সেদিকে বেশি না তাকিয়ে হুজুগে হেলকে ফেরি তার নতুন প্রতিষ্ঠিত সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অনাথ শিশুদের আনার চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৯৭২ সালের হেমন্তে (অক্টোবর মাসে) হেলকে দ্বিতীয় ট্রিপে ঢাকায় আসেন। এ সময়ে তিনি তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি সে সময়ে আরও কয়েকজন শীর্ষ ব্যক্তিত্বের সঙ্গেও দেখা করেন যারা তাকে শিশু ভবন থেকে ৮ জন শিশু যােগাড় করে দেন। শিশুদের বয়স ছিল ছ’মাস থেকে দু’বছর। এবারে তিনি কেবল যুদ্ধশিশু নয়, গৃহহীন, অনাথ ও দরিদ্র এবং পরিত্যক্ত শিশুদেরও খোজ নেন।
বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমের প্রচারণা
যদিও বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধশিশুদের কানাডীয় পরিবারের জন্য কানাডাতে নিয়ে যাওয়াটা বাংলাদেশ ও কানাডীয়দের জন্য এক অভূতপূর্ণ অভিজ্ঞতা ছিল, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ঐ ঘটনার পূর্ণ বা কার্যকর প্রচার হয়নি । অবাক হবার কিছু নেই, যুদ্ধশিশুদের নিজ দেশ থেকে যাওয়াটা তেমন কোনাে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বা সমাচার হিসাবে দেখা হয়নি। যার জন্য একটি সংবাদপত্র ছাড়া অন্য কোনাে কাগজে এ বার্তাটি স্থান পায়নি। কিন্তু আমরা ইতােমধ্যে লক্ষ্য। করেছি, কানাডাতে তাদের আগমনের ধ্বনি পূর্ণতার সঙ্গে বেজেছিল, উদযাপিত হয়েছিল। (আমরা বর্তমান অধ্যায়ের শুরুতে সেটা জেনেছি)। অদৃষ্টের পরিহাস যে, বাংলাদেশের নিজের বাড়ির পেছনের আঙিনায় বলতে গেলে যখন এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছিল, অধিকাংশ বাংলাদেশি সেটা তখন জানতে পারেনি সংবাদ মাধ্যমে । শিশু যাত্রীর এক বড় দল কানাডায় যখন পাড়ি দিচ্ছিল, তখন কেউ ফিরেও তাকায়নি এসব অনাথ শিশুদের দিকে।
১৯৭২-এ প্রায় ২০টি দৈনিক সংবাদপত্রের মধ্যে মাত্র একটি The Bangladesh Observer (20 July 1972) যুদ্ধশিশুদের কানাডা যাওয়ার খবরটি ছেপেছিল। প্রথম পাতায় খবরটা ছেপেছিল “যুদ্ধশিশুরা নতুন বাড়িতে যাচ্ছে” শিরােনাম দিয়ে। কাগজের নিয়মিত সংবাদদাতা বিস্তারিত লিখেছিলেন যুদ্ধশিশুদের নিয়ে। সে সাথে তিনি মন্ট্রিয়লস্থ ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন (এফ এফ সি)-এর ভূমিকা উল্লেখ করেন। তাদের অনুমতিপত্রে। ১৫টি শিশুর নাম, জন্মের তারিখ, লৈঙ্গিক চিহ্ন এবং নির্বাচিত দত্তকে ইচ্ছুক যুগলদের নাম ঠিকানা । আরও লেখা ছিল ১৫টির মধ্যে ১২টি শিশুর জন্ম হয়েছিল ঢাকার মাদার তেরেসার শিশু ভবনে এবং বাকি তিনজনকে ভিন্ন জায়গায় থেকে শিশু ভবনে নিয়ে আসা হয়েছিল দত্তক দেবার লক্ষ্যে । প্রতিবেদনে এফ এফ সি’কে অভিনন্দন জানানাে হয় এ জন্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশে ওরা প্রথম একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা নিয়ে এসেছিল, যা সফল হয়েছে। অনেক। প্রতিষ্ঠানই কেবল কথা বলার জন্যই বলেছে; এ কথা স্বীকার্য যে, এফ এফ সি কথা বলাকে কাজে পরিণত করেছে।
সাধারণ বাঙালির জন্য কানাডা তখন বিশাল তুষারাবৃত দূরের এক দেশ। এস্কিমােদের ইগলু থেকে বেরিয়ে আসা আর পােলার ভালুকের গল্পের দেশ। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর আগে বাঙালি তেমন ঐ শীতের দেশে যেত না; বর্তমানে বহু বাঙালির বাস কানাডাতে। দম্পতিরা অবশ্য মনে রেখেছেন সে ১৯৭২ সালে তারা রেভারেন্ড পালিনাস কস্টা, তদানীন্তন ন্যাশন্যাল ডিরেক্টর, ক্রিশ্চিয়ান অর্গানাইজেশন ফর রিলিফ এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন (সি ও আর আর)-এর নিকট থেকে অভিনন্দনপত্র পেয়েছিলেন। কানাডীয় হােলি ক্রস ফাদার বেঞ্জামিন লাবে ঢাকায় কানাডীয় দলকে অনেকভাবে সাহায্য করেছিলেন (যেটা আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি)। রেভারেন্ড কস্টা কানাডীয় হােলি ক্রস ফাদারের পক্ষ থেকে তাদেরকে অভিনন্দনের সাথে তার নিজের আশাও ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে: “শিশুরা শীঘ্রই বুঝতে পারবে যে নতুন বাবা-মায়ের কাছে ওরা আর নতুন নয়।
তত্ত্ববধান ও সতর্কীকরণের দায়িত্ব
স্বভাবতই শিশুরা শীঘই নতুন পরিবেশে খুব তাড়াতাড়িই খাপ খাইয়ে নেয়; এদিকে বাংলাদেশে যারা তাদের দেখাশােনার দায়িত্বে ছিলেন তারা তাদের নিরাপদে কানাডা পৌছনাের পর বিস্তারিত কিছু জানতে পারেননি। যদিও বাংলাদেশের জনসাধারণ যুদ্ধশিশুদের জন্ম, মৃত্যু এবং বিদেশে পাড়ি দেয়ার বিষয়ে কিছু মাত্র মাথা ঘামায়নি। বাংলাদেশ সরকার। এবং সিস্টার ম্যারি, শিশুদের “সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক তাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে উৎসুক ছিলেন। তারা দত্তক নেয়া দম্পতিদের নিকট থেকে শিশুদের সম্পর্কে খবর জানার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাড়িতে পৌঁছনাের পর ক্যাপুচিনােরা তাদের কাজকর্ম নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, তারা সিস্টার ম্যারির সঙ্গে যােগাযােগ করে বলতে পারেননি। দত্তক ব্যবস্থা অনুযায়ী দত্তকগ্রাহী মা-বাবার হাতে সােপর্দ করার পর শিশুরা এখন কেমন আছে সেটা তাদেরকে আবার ঢাকায় জানানাে বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু সিস্টার ম্যারি তাদের। সঙ্গে কোনাে যােগাযােগ স্থাপন করতে পারেননি।
Bangladesh Abandoned Children (Special Provision) Order, 1972 অনুযায়ী। যুদ্ধশিশুদের “সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক” সিস্টার ম্যারির দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে যুদ্ধশিশুদের তত্ত্বাবধানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকায় তিনি যে যুদ্ধশিশুদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হবেন। তাতে আর বিস্ময়ের কী! অথচ কানাডীয় টিমের লিডার তাকে প্রতি মাসে দুটি পাক্ষিক হালনাগাদকৃত প্রতিবেদন পাঠাবার কথা। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে দেখা গেল প্রত্যেক দত্তকগ্রাহী। পরিবার আগের তুলনায় বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন নতুন পারিবারিক সদস্যকে নিয়ে, যে কারণে তাদের পুরাে সময়টুকু ব্যয় করেছেন। আবার এদিকে আবদুল আউয়াল, নির্বাহী সচিব, বি ডাব্লিউ আর পি, তাকে প্রতি দুসপ্তাহে একটি সর্বশেষ তথ্যবিবরণী সরবরাহ করবার। জন্য চাপ দিচ্ছিলেন।
এফ এফ সি’র নিকট থেকে কোনাে খবর না পেয়ে যখন সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলে যাচ্ছিল, সরকারি কর্মকর্তারা তখন স্বভাবতই বেশ বিচলিত হয়ে উঠেন। “আপনারা যে শিশুদের যত্ন, ভালােবাসা ও সহানুভূতির সাথে লালন পালন করেন, আমি উদ্বিগ্নভাবে সে খবর জানার জন্য অপেক্ষা করে আছি । ওরা কি সবাই ভালাে আছে? ওদের সম্পর্কে অনুগ্রহ করে দুই চার লাইন লিখবেন। আমার শুভেচ্ছা জানাবেন মিসেস ক্যাপুচিনাে এবং মিসেস মৌলিংকে।” কে এম ইসলাম, সহকারী পরিচালক, কো অর্ডিনেশন ডিভিশন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, সরাসরি ঢাকাস্থ এফ এফ সি টিম লিডারকে চিঠিটা লিখে তাদের সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে চেয়েছিলেন।
শিশুদের জন্য সিস্টার মেরির উদ্বেগ আরও যেন বেড়ে যায়, যখন ইউরােপ থেকে ১৩২ জন শিশুর নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছনাের খবর এসে পৌছাল। সিস্টারের মনে ছিল যে তারা ক্যাপুচিনােদের সবসময়ই ইউরােপ যাত্রা করেছিল। সিস্টার আরেকটি গুজব শুনেছিলেন যে, কানাডীয় যাত্রীদের মাঝে কয়েকটি শিশু পথিমধ্যে অসুখে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে, সেটা তার দুশ্চিন্তার আরেকটি উৎস। যেহেতু কানাডাতে পাঠানাে শিশুদের মধ্যে অনেকেই খুব দুর্বল স্বাস্থ্যের ছিল, সিস্টারের ক্রোধ এবং উদ্বেগ তাতে আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি ফ্রেডকে আবার চিঠি লিখতে বাধ্য হলেন। তিনি ফ্রেডকে মনে করিয়ে দিলেন যে দত্তকগ্রাহী পরিবারেরা দত্তক নেবার পর দত্তক পরবর্তী শর্তাবলি অনুসারে কাজ করার কথা ভুলে যেতে পারেন না; প্রতি দুসপ্তাহে বাংলাদেশের অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নেয়া শিশুদের সম্পর্কে। প্রয়ােজনীয় সব তথ্য-উৎস সংস্থাকে লিখে জানাতে হবে। আমি অত্যন্ত বােকার মতাে কাজ করেছি ১৫ জন শিশুকে কানাডাতে দত্তক নিতে দিয়েছিলাম, যেখানে অনেক ব্যক্তিগত পরিবার তাদের নিতে চেয়েছিলেন। আমি শুনেছি তাদের কয়েকজন যাবার পথে মারা গিয়েছে। কী ভুলই আমি করেছি। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। যদি ওদের কেউ কেউ মারা গিয়ে থাকে তাহলে তারা নিশ্চয়ই স্বর্গে আছে। আমার সেটা জানা উচিত,”৬৩ ভয়ঙ্করভাবে রেগে গিয়ে সিস্টার ফ্রেডকে লিখেছিলেন ।
কানাডা এবং বাংলাদেশের মধ্যে দূরত্ব যতই থাক, সিস্টার ম্যারি আরও বেশি যােগাযােগ রক্ষার প্রয়াস ও যৌথ প্রচেষ্টা বাস্তবায়নের নমুনা দেখবেন আশা করেছিলেন। ক্রুদ্ধ সিস্টার আবার মনে মনে ভাবেন: “হয়তাে সবাই বেঁচে আছে; কানাডীয় পরিবারে হয়তাে ওরা সাদরে গৃহীত হয়নি। হয়তাে কানাডীয় পরিবারেরা তাদের পুঁটুলির মতাে রেখেছে অথবা মানুষ হিসাবে যে শিশুদের জন্য আমরা সময় দিয়েছি, আমাদের সব আনন্দ দিয়েছি, ওদের সেবা করার জন্য, ওদের মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরত নিয়ে আসার জন্য, পরিবারের মাঝে রেখে ভালােবাসার জন্য।”৬৪ নতুন বাড়িতে শিশুরা কেমন করে নিজেদের একীভবন ঘটাচ্ছে, প্রতিদিনের কাজকর্মে, খেলাধুলায় অংশ নিয়ে কীভাবে নিজের ভূমিকা চালিয়ে নিচ্ছে, এসব। ভেবে সিস্টার রীতিমতাে উদ্বিগ্ন । তিনি দত্তকগ্রাহী বাবা-মাকে মনে করিয়ে দেন যে, তারা শিশুর ভরণপােষণ ও নিরাপত্তার জন্য দায়ী হলে সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক হিসাবে তিনি এখনও। তাদের অভিভাবক যতদিন না শিশু কানাডীয় নাগরিকত্ব পাবে।
তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়ে বলতে গিয়ে সিস্টার ম্যারি একটি সহজ বিষয়ে জোর দিয়ে বলেন, প্রথমটা ঠান্ডা হােক বা গরম হােক, মা-বাবা নতুন শিশুর সব কিছুর জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী থাকবেন, কানাডীয় আইন ও রীতিনীতি অনুসারে শিশুর সব প্রয়ােজনীয় ভূমিকা এবং কাজে সহায়তা যােগাবেন। স্বাভাবিকভাবেই ক্যাপুচিনােদের নিকট থেকে চিঠি না পাওয়ায় সিস্টার ম্যারি বিচলিত হয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি তাদের সঙ্গে যােগাযােগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর তিনি আবার পত্র মারফত জানান যে তিনি শুনেছেন যুদ্ধশিশুদের কয়েক জন কানাডা যাবার পথে মৃত্যুবরণ করেছে, তিনি চেয়েছিলেন কানাডীয়রা যেন এসব গুজবের নিরসন করেন। তিনি জানালেন, ঐ শিশুরা তার নিজের সন্তানের মতাে। তিনি ক্যাপুচিনােদের এটা লিখে বােঝাতে চেষ্টা করেন যে, যে কোনাে মা তার সন্তানের জন্য উদ্বিগ্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক।
তার চিঠি পেয়ে ক্যাপুচিনোেরা প্রত্যেক দত্তকগ্রাহী বাবা-মাকে তৎক্ষণাৎ লিখে জানান, তারা যেন সিস্টার ম্যারিকে প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে লিখেন এবং তাদের সন্তান কেমন আছে এবং কী উন্নতি হয়েছে ইত্যাদি জানিয়ে। তারপর ক্যাপুচিনােরা তাকে একটি টেলিগ্রাম পাঠান: “সব শিশু নিরাপদে পৌছেছে যেমন কথা ছিল তেমনি এবং বিমানবন্দরে সুখী বাবা-মায়েরা তাদের নিতে এসেছিলেন। আপনাকে এবং আপনার সহকারীদের ধন্যবাদ সকল পরিবারের পক্ষ থেকে । চিঠি যাচ্ছে । ফ্রেড ও বনি কাপুচিনাে।”
ক্যাপুচিনােদের তাৎক্ষণিক উত্তর যেন সিস্টারকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযােগ দেয়। আবেগে উদ্বেলিত হয়ে তিনি আবার সঙ্গে সঙ্গে লিখেন: “আপনার চিঠি ও টেলিগ্রামের জন্য অনেক ধন্যবাদ । আমি ঐসব পরিবারকে লিখছি যারা আমাদের তাদের নতুন শিশু সম্পর্কে লিখে জানিয়েছেন। আমার এ চিঠি সবার উদ্দেশ্যে । সবাইকে দেখাবেন যে এটা আমি সবার জন্য লিখেছি। আমরা শিশুদের সম্পর্কে সত্যি উদ্বিগ্ন ছিলাম ।”
স্বাভাবিকভাবেই কানাডীয় বাবা-মায়েদের প্রতি সিস্টারের মনােভঙ্গি ও আচরণ যেন সাথে সাথে বদলে যায়। বাবা-মায়েদের একনিষ্ঠতা ও নিবেদনের প্রতি হঠাৎ তার বিশ্বাস জন্মে। গেল। তিনি তাদের উপদেশ দিলেন যে, ঐ শিশুদের অতিরিক্ত মনােযােগ এবং যত্ন দরকার হবেঃ “মেয়াদের আগে জন্মগ্রহণ করা শিশু অন্যদের তুলনায় ধীরে সব কিছু শিখবে, তাদের ভগ্নস্বাস্থ্য হবে হয়তাে। একটি স্বাভাবিক শিশু দেখতে ক্ষুদে হলেও ভালাে স্বাস্থ্যের অধিকারী। হবে।”” উপসংহারে তিনি দত্তকগ্রাহী বাবা-মাকে অনুরােধ করেন তারা যেন তাদের শিশুদের সম্পর্কে তাকে লিখে জানান। কারণ ঐ শিশুরা তখনও তার হৃদয়ের অত্যন্ত নিকটে অবস্থান করছিল।
১৯৭২-এর জুলাই এবং সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সিস্টার ম্যারি, ক্যাপুচিনাে দম্পতি এবং দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদেরমধ্যে বেশ কয়েকবার চিঠি বিনিময় হয়। উদ্দেশ্য ছিল, যুদ্ধশিশুদের কানাডা আসার পর থেকে যা ঘটেছে, সে সম্পর্কে পরস্পরকে অবহিত রাখা। রাজিনা তাদের পরিবারে আসার চার সপ্তাহের মধ্যেই তাদের মন্ট্রিয়ল থেকে আরভিডা স্থানান্তরিত হওয়ার কাহিনী এবং রাজিনার বেড়ে ওঠার খবর দিয়ে পিয়ের ও লিজ হােগ সিস্টার ম্যারির উদ্দেশ্যে ক্যাপুচিনােদের লিখেন: “রাজিনা এক আশ্চর্য মেয়ে, সে খুব সহজেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। সে সবসময় হাসছে, মাত্র কয়েকদিন আগে সে উঠে। দাঁড়াল (আমাদের সাহায্য নিয়ে অবশ্যই)। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই উল্লেখযােগ্য উন্নতি। কারণ যখন সে এলাে, তখন কেবল একটু বসতে পারত নিজে নিজে, তাও মিনিট দুই-একের। জন্য। সে খাচ্ছে, খাচ্ছে আর খাচ্ছে । ওর ওজন এখন ১৮ পাউন্ড (আসার পর ৪ পাউন্ড বেড়েছে)। সে যেমন আমাদের নিয়ে খুশি, আমরা তাকে নিয়ে খুশি।”” অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষ শিশুদের মা-বাবার সঙ্গে ছবি দেখে এবং তাদের চিঠি পেয়ে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। কানাডীয় বাবা-মায়ের সাথে যােগাযােগ স্থাপন এবং তাদের সম্পর্কে অবগত হওয়াতে সিস্টার ম্যারি এবং বাংলাদেশি কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেছিলেন যে, একটা সময় আসবে, যখন প্রত্যেক পরিবার নিজের প্রয়ােজনমতাে এদিক সেদিক নড়েচড়ে সবার অবস্থান ঠিক করে নেবে। স্বভাবতই সিস্টার ম্যারি তার বিষাদ কাটিয়ে উঠেন এবং সে সাথে তার ক্রোধ ও অস্থিরতা দূর হয়ে যায় । সত্যি বলতে কি, তারপর থেকে দত্তক পরিবারদের সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে নেন।
ইতােমধ্যে সিস্টার ম্যারির মতাে ফ্রেডও তার মনােযােগ দেন পিছিয়ে পড়ার কাজে। তখন ঢাকায় যারা তাকে সহায়তা করেছিলেন, তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে চিঠি লিখতে শুরু করেন। ক্যাপুচিনােরা কানাডীয় হাই কমিশনের এমিল ব্যারন এবং তার কর্মীদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে চিঠি লিখেন। তিনি যুদ্ধশিশু ও তাদের পরিবারের সর্বশেষ খবরাদি দিয়ে তাদেরকে অবহিত করেন। তারা নিশ্চয় “খুশি হবেন জেনে” যে, ক্যাপুচিনােরা। লিখেন, “১৫ জন শিশুর সবাই সুস্থ দেহে ভ্রমণ শেষে কানাডায় পৌছেছে এবং কানাডাতে তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলে মিশে আছে।” আরও কথা হলাে, ক্যাপুচিনােরা লেখেন “ওরা এখন মােটাসােটা গােলগাল শিশুর চেহারা নিচ্ছে। বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। এখন।” বাংলাদেশে জনসাধারণের “খােলাখুলি আচরণ” “ইছুক” ও সহায়ক মনােভাব এবং সর্বোপরি “উৎসাহ ছাড়া যুদ্ধশিশুদের ছাড়পত্র পাওয়া তখন সম্ভব হতাে না, বিশেষ করে কানাডীয় হাই কমিশনের সার্বিক সহযােগিতা ছাড়া আমাদের এ “মিশন সফল হতে ,” বলে ফ্রেড কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
ফ্রেড এবং বনি আবার বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও সর্বশেষ খবরাদিসহ চিঠি লিখেন। তখন নির্বাহি সচিব, ন্যাশন্যাল বাের্ড অব বাংলাদেশ উইমেন্স রিহ্যাবিলিটেশন প্রােগ্রাম (বি ডাব্লিউ আর পি) আব্দুল আওয়ালকে। খুব সহজ সরল ভাষায় ফ্রেড কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে লিখেন: “আপনি জেনে সুখি হবেন যে, সব। শিশু ভালাে স্বাস্থ্য ভােগ করে কানাডা এসে পৌছেছে এবং মন্ট্রিয়ল ও টরন্টোতে হাসিখুশি ও উত্তেজিত মা-বাবার দ্বারা অভ্যর্থিত হয়েছে। ঐ সন্ধ্যায় তাদের বাবা-মা তাদের নিজ নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। আমরা প্রত্যেক দম্পতির নিকট থেকে তাদের শিশু যে ভালাে আছে চমক্কার সব কাজ করছে এরকম শুনতে পাচ্ছি। তারা বড় হচ্ছে এবং দ্রুত শিখছে। প্রত্যেক মা-বাবা ভাবেন তাদের শিশুটিই সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার অধিকারী।
ইতােমধ্যে দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদের চঞ্চল ও রমরমা অবস্থা কেটে যাবার পর হঠাৎ তারা উপলব্ধি করেন যে তাদের বাংলাদেশি শিশুর স্বাস্থ্য পরিক্ষার জন্য স্বাস্থ্য সম্পর্কযুক্ত তথ্যের প্রয়ােজন। যদিও শিশুরা তেমনভাবে অসুস্থ হয়নি, বেশ কিছু চিকিৎসাবিষয়ক চিন্তার উদ্রেক
হয় তাদের মনের মধ্যে। তাদের পারিবারিক ডাক্তার পরামর্শ লেখার প্রয়ােজন হয়। যদিও বাবা-মাকে বলা হয়েছিল, যে মেডিক্যাল কোনাে তথ্য ওদের ফাইলে নেই, তারপরও তারা বনির মাধ্যমে শিশু ভবন কর্তৃপক্ষের সাথে যােগাযােগ করেছিলেন, যদি ভাগ্যক্রমে কোনাে শিশুর সম্পর্কে সূত্র বা তথ্য থেকে থাকে এ আশায়। সিস্টার ম্যারি ছাড়াও কমপক্ষে আরও দুজন নার্সের সঙ্গে তারা চিঠি লেখালেখি করেন । শিশু ভবনে সিস্টার শােভার কাছ থেকে জেনেছিলেন তাদের শিশু আগে ডি পি টি টীকা নিয়েছিল কিনা। সিস্টার শােভা ছাড়া সেখানে সে সময়ে ছিলেন সিস্টার ভিনসেনশিয়া, যিনি ভারত থেকে শিশু ভবনে এসেছিলেন; তার সঙ্গে কয়েকজন দত্তকগ্রাহী মা-বাবার চিঠি লেখার সম্পর্ক ছিল। তাদের সঙ্গে আগে শিশু ভবনে নার্সদের সঙ্গে যােগাযােগ থাকায় তারা আবার চিঠি লিখতে উৎসাহিত হয়েছিলেন।
বাবা-মায়ের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এটা জানা যায় যে প্রথম কয়েক বছর দত্তকগ্রাহী বাবামায়েরা অনাথ আশ্রমের সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রেখেছিলেন। শিশুরা যেহেতু গােড়ায় দুর্বল স্বাস্থ্যের ছিল, অনাথ আশ্রমের কেউ কানাডা থেকে ছবি পেলে তারা অত্যন্ত খুশি হতেন। কখনাে কখনাে তারা কানাডা থেকে ছবি পাঠান,” সিস্টার ভিনসেনশিয়া তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাদের শিশুরা তাদের কানাডীয় বাড়িতে বসে ছবি তুলেছে, কত বড় আর সুন্দর না হয়েছে। নিয়মিত চিঠিপত্র লেখার ফলে অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষ এবং কানাডীয় মা-বাবার মধ্যে সম্পর্ক বেশ গভীর হয়ে ওঠে। এসব মিলে অনাথ আশ্রমের কর্মীদের মনে বিশ্বাস জন্মে যে সময়ের আগে জন্মানাে ঐসব শিশু কানাডাতে দত্তক নেবার ফলে স্বাস্থ্যপ্রদভাবে বড় হয়ে উঠবে। আমরা বাকি অধ্যাগুলােতে পড়বে প্রাপ্তবয়স্ক যুদ্ধশিশুদের নিজ নিজ বিবরণী।
প্রকৃত দত্তক প্রক্রিয়াকরণের অসুবিধাসমূহ
কানাডাতে শিশুরা যার যার দত্তকগ্রাহী মা-বাবার বাড়িতে পৌছানাের পর বাবা-মাকে নিজ এলাকার পারিবারিক আদালতে গিয়ে দত্তক প্রক্রিয়ার শেষ অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। অন্য কথায়, শিশুকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবারের অঙ্গীভূত করে নেয়া হয়। এটা সাধারণত একজন বিচারকের উপস্থিতিতে শপথ গ্রহণ করার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। অন্টেরিওর দত্তকগ্রাহী বাবামায়েরা আরভিং কোপল্যান্ডকে তাদের আনুষ্ঠানিক দত্তকায়নের সময় শপথ গ্রহণের বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। তখন এটা একটি পিটিশন বা আইনি কাগজে ফাইল করার মাধ্যমে করতে হতাে। সাধারণত: ঐ কাগজে আইনি ভিত্তিস্বরূপ, শিশুর প্রয়ােজনীয় বৃত্তান্ত লেখা থাকে তার জন্মদাত্রী মায়ের বিষয়ে তথ্য থাকে, দত্তকগ্রাহী মা-বাবার সম্পর্কেও তথ্য থাকে এবং আদালতের নিকট দত্তকের আদেশ জারি করার জন্য আনুষ্ঠানিক দাবিনামা থাকে। বর্তমান ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এম শারাফাতউল্লাহ স্বাক্ষরিত মাদার তেরেসাকে সম্বােধন করে ১৯৭২ এর ১৭ জুলাই এর লেখা চিঠি দত্তকের ডিক্রির মর্যাদা পেয়েছে। সে ডিক্রিটি প্রমানিক দলিলে সংযােজন করা হয়েছে। এর দ্বারা সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক হিসাবে সিস্টার ম্যারি এবং যুদ্ধশিশুদের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল, সেটা বাতিল করে শিশুকে কানাডাতে প্রাদেশিক সরকার অনুমােদিত অঙ্গীকারবদ্ধ দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মাকে শিশুর বাবা-মা হিসাবে গ্রাহ্য করে একটি সনদ দেয়া হয়। এ সনদের ভিত্তিতে আইনত দত্তকগ্রহণের যথার্থতা প্রমাণিত ও গ্রহণযােগ্য হয়।
মা-বাবার নিকট প্রয়ােজনীয় সব দত্তকায়নের কাগজপত্র ছিল, যেমন- শিশুর জন্ম সনদপত্রের ফটোকপি, দত্তক নেবার বিষয়ে অনাথ আশ্রমের অনাপত্তি পত্র ও ছাড়পত্র, বাংলাদেশ ছেড়ে দত্তক শিশু হিসাবে কানাডা যাবার জন্য বাংলাদেশে সরকারের চিঠিপত্র ইত্যাদি। সংশ্লিষ্ট তথ্যের প্যাকেজ (অথবা একটু আগে আলােচিত দত্তকের ডিক্রি) অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক হলে শিশুকে ঐ দেশের নাগরিকত্ব দেয়া হবে: তাতে ঐ শিশুদের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের আর কোনাে দায়িত্ব থাকবে না। যেমন বলা হয়েছে, তাতে আরও থাকবে বাংলাদেশ সরকারের ইস্যু করা ঐ শিশুর কানাডীয় দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবার নাম ও ঠিকানার ফটোকপি। কিউবেক, সাসক্যাচিউয়্যন ও নােভা স্কোশিয়া একই স্ট্যান্ডার্ড তথ্য প্যাকেজ-এ সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু অন্টেরিও সরকার আরও তথ্যের জন্য দাবি করে। যুদ্ধশিশুদের জন্ম, বেঁচে থাকা ও কানাডাতে আইনত নিয়ে আসা সম্পর্কিত দলিল পরীক্ষার পর বৃত্তান্ত শােনার পর হ্যালিফ্যাক্স, মন্ট্রিয়ল এবং সাসকাটুনের প্রাদেশিক আদালত ঐ শিশুদের দত্তক শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন।
অন্টেরিওর দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মায়েরা পুনরায় আগের মতােই ঘাটে ঘাটে আটকে যেতে থাকেন, যেরকম আগের অধ্যায়ে আমরা পড়েছি। অন্টেরিও বাবা-মায়েদের প্রতিবন্ধকতার কথা শুনে নানা দত্তক সমর্থক আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং একক ব্যক্তিত্ব একত্রিত হয়ে একসঙ্গে তাদের কণ্ঠ মিলিয়ে সমস্বরে প্রতিবাদ আরম্ভ করেন। অন্টেরিও দম্পতিদের সমর্থনে WICHTIC c a Canadian Anglican Church of Primates, World Relief and Development Fund and Ottawa Unitarian Congregession fercieca: আমলাতান্ত্রিক ও আন্তসরকার সম্পর্ক রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য আমাদের মনে হয় ন্যূনতম আমলাতান্ত্রিক জটিলতার একটি মাত্রা নির্ধারণ আজ প্রায় প্রাধিকার আরােপ করবার দাবি জানায়, যেখানে আপনারা কারাে জীবন-মরণের প্রশ্নের ধারে এসে দাড়াবেন।” সমস্যাটি নিয়ে যৌথ স্বাক্ষরসহ একটি চিঠি রাজনীতিবিদ ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের (এম পি) নিকট পাঠানাে হয়েছিল ।
বাস্তবিকপক্ষে দেখা গেল, অন্টেরিও সরকার নিজেই নিজের প্রয়ােজন নির্ধারণ করে নিজেরাই অতিরিক্ত সমস্যার সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের পছন্দের শিশুকে সুদূর বাংলাদেশ থেকে কানাডা নিয়ে আসার পর তাদেরকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল। আবেদনকারীরা কিংকর্তব্যবিমূড়, হতাশ ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে হেলকে ফেরি ততদিনে আরেক দফা বাংলাদেশ থেকে কয়েকটি অনাথ শিশু (যাদের মধ্যে যুদ্ধশিশুও ছিল) নিয়ে সফলভাবে কানাডা পৌছেন। তিনি যে কেবল শিশুদের জন্ম সনদপত্র ইস্যুর জটিলতা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পেরেছিলেন তা নয়, তিনি পুরাে প্রক্রিয়াটার আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্মকে পাশ কাটাতে পেরেছিলেন।
অন্টেরিও’র আবেদনকারীরা তাই হেলকের শরণাপন্ন হন। জন্ম সনদপত্র ইস্যুর সমস্যাটা তাই হেলকে নিজে ব্যাখ্যা করে সাবইকে জানিয়েছিলেন: যে বাংলাদেশ সরকার শিশু ভবন। কর্তৃপক্ষ (যেখানে অনাথ আশ্রমের কর্মীদের তত্ত্বাবধানে শিশুদের জন্ম হতাে ) কর্তৃক ইস্যু। করা সকল শিশুর জন্মসনদ সত্যায়িত করতে কোনােক্রমেই পারবে না কারণ: “এ রকম জন্ম সনদ একজন ডাক্তার সত্যায়িত করতে তখন পারবেন যদি তিনি একজন লাইসেন্সধারী সরকারি ডাক্তার হােন। তিনি একটি শিশুকে দেখে শিশুটির জন্ম, আনুমানিক বয়স এবং অনাথ আশ্রমের পরিচালক সে শিশুটির যে বয়স লিখেছেন সেটা যদি আপাতদৃষ্টিতে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, তাহলে তিনি জন্ম সনদ দিতে পারবেন।” এ কথা স্বীকার্য, যুদ্ধশিশুদের জন্ম এবং মায়ের দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়ার দুটো ঘটনাই ঘটেছিল গােপনে, সেজন্য তাদের জন্মের সরকারি সনদপত্র সরকার দিতে চাইনি। অতঃপর হেলকে অন্টারিও’র বাবা-মায়েদের। অটোয়ায় বাংলাদেশ হাই কমিশনারের সঙ্গে আলাপ করে এ ব্যাপারে উপদেশ নেয়ার অনুরােধ করেন।
আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে দেখব যে, এ শিশুদের অনাথ আশ্রয় থেকে কোনাে জন্ম সনদপত্র ছাড়াই ছেড়ে দেয়া হয়েছিল যদিও ওদের সঙ্গে যে কাগজ ছিল, তাতে কোনাে রকমের একটি নাম ও তারিখ ছিল । পেছনের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে তখন বাংলাদেশ সরকারের এতই দুরবস্থা যে, অনাথ আশ্রমে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের জন্য জন্ম সনদপত্র দেয়া সম্ভব ছিল । কয়েকটি শিশুর বেলায়, যেমন- জরিনা এবং আরও কয়েকজনের জন্ম সনদপত্রে সিস্টার ম্যারি স্বাক্ষর করেন যাতে ঐ যুদ্ধশিশুদের ছাড়পত্র পাওয়া সহজ হয়।
বিষয়বস্তু ও স্পর্শকাতরতা বিচার করে, বাংলাদেশ সরকার জন্মদাত্রী মায়েদের একটি ইচ্ছাকে মর্যাদা দেবার সিদ্ধান্ত নেন। যেমন, যদি কোনাে জন্মদাত্রী মা চান তার কোনাে পরিচয় কোথাও লিপিবদ্ধ না করা হােক, সরকার সে অনুরােধ মেনে নিয়ে অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, “সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে শিশুর জন্ম হয়েছে সে মর্মে তারিখ দিয়ে জন্ম সনদপত্র যেন ইস্যু করেন। সরকার এতে নিশ্চিতবােধ করেন যে, শিশুরা যথাশীঘ্র সম্ভব ছাড়পত্র পাবে, সঙ্গে থাকবে তাদের জন্মের তারিখসহ সনদপত্র, যার ফলে বেশি সংখ্যক শিশুর জীবন বাঁচানাে সম্ভব হবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই দত্তকায়নের লক্ষ্যে যেসব তথ্য প্রত্যেক মা-বাবার কাছে পাঠানাে হয়েছিল সেগুলাে সব ছিল একই ধরনের।
শেষ পর্যন্ত আমরা দেখতে পাবাে, অন্টেরি দম্পতিদের কোনাে বাধা দমিয়ে রাখতে পারেনি। অন্টেরিওর দম্পতি যারা এ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন, তারা একসময় তাদের এম পি পি, অন্টেরিওর প্রিমিয়ার এবং ফেডারেল এম পি-দের সহায়তা চেয়েছিলেন। চার মাস আগে হােমস্টাডি করানাের জন্য তারা যেমনটি করতে চেয়েছিলেন, মােটামুটি নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশ থেকে আনা শিশুদের দত্তক প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে জন ও ডরােথি অন্টেরিওর প্রিমিয়ার উইলিয়াম ডেভিস-এর শরণাপন্ন হন। প্রিমিয়ারকে লেখা চিঠি মরিস ফেডারেল ম্যানপাওয়ার এন্ড ইমিগ্রেশন মন্ত্রীর কাছে পৌছে দেন।
লাল ফিতার জটিলতায় আটকে গিয়ে, বের হবার কোনাে রাস্তা না পেয়ে দম্পতি আন্টেরিওর প্রিমিয়ারকে লেখেন: “মিঃ ডেভিস, এবারে একটি অনাথ মেয়েকে নিয়ে পড়েছি, যে শিশু ভবনে বেশি দিন কাটানাের ফলে সিস্টারদের ভালােবাসা বােধ হয় বেশি পেয়েছিল, কিন্তু আর কারাে ভালােবাসা না পেয়ে বর্তমানে কানাডা এসে পৌঁছেছে। এখন সে যাদের সঙ্গে আছে তারা তাকে ভালােবাসে, তাকে চায় । আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার অত্যাচারে আমরা যেন মেয়েটাকে না হারাই ।” মরিস জানালেন যে কাগজপত্র সবই ঠিকমতাে জমা দেয়া হয়েছিল, “আইনে যেভাবে বলা ছিল, সেভাবেই মানবিকতার স্বার্থে তাে আমরা অনেক সময়ই সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হই ।” দাঁড়াবার জায়গা এবং একটি জন্মগ্রহণ করার জায়গা । “যে মেয়েটাকে তার জন্মের দেশে কেউ চায়নি, আমরা তাকে সবই দিতে চাচ্ছি যা আমাদের। আমাদের সে প্রয়াস যেন লাল ফিতায় না বাঁধা পড়ে,” হতাশ দম্পতি চরম পর্যুদস্ত অবস্থায় প্রিমিয়ার বিল ডেভিসকে লিখেছিলেন।
প্রিমিয়ারের নিকট তাদের ব্যক্তিগত আপিলে মরিসেরা আরও বলেন যে অন্টেরিওতে তাদের প্রাইভেট হােমস্টাডির জন্য যে কেবল ফি দিতে হয়েছিল তা নয় (সাধারণত স্থানীয় চিলড্রেনস এইড সােসাইটি এটা কোনাে টাকাকড়ি না নিয়ে এমনি করে থাকে)। আরও অতিরিক্ত কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছিল, যেখানে সাসক্যাচিউয়্যন, নােভা স্কোশিয়া বা কিউবেক-এ কোনাে অতিরিক্ত কাগজ চাওয়া হয়নি । “মানবিকতার নামে আমরা আরেকজন মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি মাত্র এবং মানবিকতার নামে আমরা আপনার মাধ্যমে, মি: ডেভিস, অন্টেরিও প্রদেশ কর্তৃপক্ষকে অনুরােধ করছি আরেকজন মানুষকে সাহায্য করতে।” এ। ভাবে আবেদন করেন জন এবং ডরােথি মরিস।
যত একগুয়েমি এবং দুর্দমনীয় দেখাক না যে, অন্টেরিও কর্মকর্তারা তখনও বলতে থাকেন যে দত্তক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হলে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রের দরকার হবে। “দত্তক প্রক্রিয়ার সমর্থনে লিখে জানান, চিকিৎসকের পরীক্ষার সম্মতি দান, এবং জন্ম সনদপত্র এখনও হাতে আসেনি,” এরকম লিখেছিলেন বেটি গ্রাহাম, তদানীন্তন ডিরেক্টর চাইন্ড। ওয়েলফেয়ার অন্টেরিও দম্পতিদের। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে তার অসঙ্গতিপূর্ণ যুক্তি কার্যকলাপের বৃত্তান্ত দেখেছি।
পরে জানা গেল, যদিও তিনি বারবার আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তিনি একই নীতিতে চলেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি সব রকমের সহমর্মিতা ও সংবেদনশীলতা বর্জন করেন, যখন ওগুলাের খুব প্রয়ােজন ছিল। তিনি একের পর এক নানা অজুহাতে প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত করছিলেন। “আমরা জেনেছি যে বাংলাদেশে ডিরেক্টর অব সােস্যাল ওয়েলফেয়ার হবেন এ বিষয়ে নির্দিষ্ট সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক। আমরা বুঝতে পারছি আইন এ মুহূর্তে কেবল সেসব শিশুর ছাড়পত্র দিচ্ছে যাদের মায়েরা পাকিস্তানিদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলেন। অন্টেরিওতে। এই শিশুদের উপর আরও তথ্য যখন পাওয়া যাবে আমারা তখন আপনাদের উপদেষ্টাকে এ বিষয়ে জানাব। ইতােমধ্যে এ ধরনের দত্তকের বিষয়ে আমরা আপনাদের নিকট থেকে প্রতিবেদন পেলে সেগুলাে গ্রহণ করব।” এ সুরে পাঠানাে তথ্য দম্পতির নিকট মােটেই সাহায্যকারী কিছু মনে হয়নি। স্পষ্টত দত্তকায়নের কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রস্তুতি নেবার পরিবর্তে, বরং বিরক্তিকর অতিরিক্ত কিছু অপ্রয়ােজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করার বিষয়েই অন্টেরিও সরকার জোর দিয়ে বিলম্ব করার ফন্দি কৌশল খুঁজেছিলেন।
অনেক হয়রানির পর আবশ্য শেষ পর্যন্ত অন্টেরিও কর্মকর্তারা জনসাধারণ যা চেয়েছিলেন সেদিকে মনােযােগ দেন। বেশ কয়েক মাস পরে আবেদনকারীদের পছন্দমতাে শিশুকে দত্তক নেবার সরকারি অনুমােদন ও সহায়তা দেয়া হয়। লক্ষ্য করার মতাে ব্যাপার হলাে, আন্তর্জাতিক দত্তকের ব্যাপার যেহেতু ফেডারেল ইমিগ্রেশনের কাজ, অভিযােগ ওঠে যে গ্রাহাম তার এখতিয়ারের বাইরে কাজ করেছেন। অন্টেরিওতে ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক পার্টির বিরােধী দলের নেতা স্টিফেন লিউয়িসের মনােযােগ যখন এ বিষয়ে আকর্ষণ করা হয়, বিষয়টির অন্টেরিওর বিধানসভাতে দুদিনব্যাপী ব্যাখ্যাদান (Exposition)-এ আরও অনেকগুলাে রেকর্ডকৃত নীতিগহিত এবং পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ও কাজের জন্য একত্রে শুনানি হয় (দেখুন হ্যানসার্ড ২২ ও ২৬ অক্টোবর ১৯৭৩)। একই বছর বেটি গ্রাহাম চাকুরিচ্যুত হয়েছিলেন।
যুদ্ধশিশুদের আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণের মাধ্যমে দত্তক নিতে গিয়ে মা-বাবা দত্তক অর্ডারের সাধারণ তাৎপর্য এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে, এর মাধ্যমে শিশুর জন্মদাতা বাবা ও জন্মদাত্রী। মা এবং সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক”-এর সঙ্গে সব সম্পর্কের ইতি ঘটে। শুধু তাই নয়, শপথ নেবার পর থেকে কেবল দত্তকগ্রাহী মা-বাবাই উক্ত শিশুর আইনসম্মত মা-বাবা হিসাবে পরিগণিত হন। এখন থেকে দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েরা হবেন দত্তকায়িত শিশুটির বাবা-মা এবং সে শিশুটি হবে তাদের শিশু – as-if-begotten.
যেহেতু যুদ্ধশিশুর জন্ম সনদে একটি নাম ছাড়া অন্য আর কোনাে তথ্য ছিল না, এমনকি সেই নামও প্রথম না শেষ নাম সেটাও কেউ জানে না, তাই কানাডীয় বাবা-মায়েরা সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম অথবা মাঝের নাম বদলে বা একটু এদিক-ওদিক উচ্চারণ করে সুবিধামতাে রেজিস্ট্রি করার । পঞ্চম অধ্যায়ে প্রত্যেক যুদ্ধশিশুর পরিচিতি এ সমস্যার সমাধান নিয়ে সংক্ষেপে আলােচনা করা হয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দত্তকগ্রাহী মা-বাবার কাছে সরাসরি শুনব তাদের আন্তবর্ণীয় দত্তকায়িত সন্তান বড় করে তুলতে কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল!

সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী