যাত্রীরা ধীরে সুস্থে বিমান থেকে সামনের দরজা দিয়ে নেমে আসতে না আসতেই অভ্যর্থনা এলাকায় বাবা-মায়েরা একত্রিত হয়ে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানান। দ্বিতীয় দরজা খুলে দিলে শিশুযাত্রীরা এবং তাদের সঙ্গীরা, দীর্ঘ ক্লান্তিকর সফর শেষে যাত্রীদের ধীরে ধীরে নামতে বলা হয়। এদিকে বিমানবন্দরের ভিতরে শিযাত্রীদের বাবা-মায়েরা অধৈৰ্য্য হয়ে উঠেন, কখন তাদের নয়নের মনিরা নামবে এ ভেবে । মুখে দাঁত বের করা হাসি, আর চোখ ঝাপসা অশ্রুতে, আস্তে আস্তে নেমে এলেন ফ্রেড, বনি, এলিজাবেথ এবং এয়ার কানাডার সেবার সঙ্গীরা সঙ্গে সাতটি শিশু নিয়ে । Royal Canadian Mounted Police (RCMP)-এর একটি গাড়ি লাল-নীল এবং হলুদ বাতি জ্বেলে তিনটি পৃথিককৃত বিলাশবহুল মােটরগাড়ি ওদের বিমানবন্দর লাউঞ্জে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি। চারদিকে খবরের কাগজের রিপাের্টার, স্পটলাইট টিভি ক্যামেরা ক্রু এবং ভিডিও ক্যামেরা বিমানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সবার কেন্দ্রবিন্দু শিশু্যাত্রীদের দিকে। তখন RCMP-এর কয়েকজন প্রতিনিধিও সেখানে অপেক্ষমান ছিলেন। সবারই নজর ছিল সে সময়ের মধ্যমনি যুদ্ধশিশুদের দিকে । প্রধানমন্ত্রী পিয়ের এলিয়ট ট্রুডাে একটি পৃথককৃত বিলাসবহুল মােটরগাড়ি তাদের পাঠিয়েছিলেন শিশু এবং তাদের সহরক্ষী যাত্রীদের টার্মিনালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ।
সবাই তখন বিজয়ানন্দে উৎফুল্ল । হৈ চৈ এর মধ্যে বাবা-মায়েদের নাম ঘােষিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ভীত সন্ত্রস্ত, উত্তেজিত হবু বাবা-মায়েরা দ্রুত সামনে এগিয়ে এসে তাদের সন্তানকে নামের ট্যাগ পুনরায় মিলিয়ে সানন্দে কোলে তুলে নেন। মুহূর্তের মধ্যে ভিড়ে আনন্দের অশ্রুর মাঝে, অনেকে হাত বাড়িয়ে দেন শিশুদের দিকে তাদেরকে কোলে তুলে নেবার জন্য । সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সৃষ্টিকর্তাকে জানান যে শিশুরা নিরাপদে পৌঁছেছে। দর্শকরা শিশুদের শারীরিক সক্ষমতা দেখে অবাক, ওদের দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না, এত দুর্বল শরীরে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এলাে কী করে! বাবা-মায়েরা এত খুশি যে শিশুদের কোলে নিয়ে তারা মুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে রইলেন যেন! এত ধরনের ভাবাবেগের আসা-যাওয়ায় তারা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কোনটা কতটুকু সত্যি। বাইরে যাবার সময় সব পথে গর্বিত দম্পতি তাদের শিশুদের জড়িয়ে ধরে বারবার তাকিয়ে থাকেন; তারপর, আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে হর্ষোঙ্কুল্লে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তাদের জন্য, টরন্টোর দম্পতিদের মতে, সেদিন অনেক মাস অপেক্ষার পর এটা যেন ছিল সে স্বপ্ন হলাে সত্যি” মুহূর্ত; সৃষ্টিকর্তা যেন তাদের কর্ণকুহরে স্বস্তি আর আরামের বাণী পশিয়ে দিলেন পরম সমতাভরে। মন্ট্রিয়ল রে মৌলিং-এর স্ত্রী এলিজাবেথ বাংলাদেশ গিয়েছিলেন শিশুদের সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন বলে । মি. রে মােটামুটিভাবে তৈরি হয়ে ছিলেন প্রয়ােজনের চেয়ে দীর্ঘতর সময় বিমানের অবতরণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ভেবে। তার মনে পড়ে, তিনি অনেক বাবামায়েদের চেয়ে আগেই বিমানবন্দরে পৌছে ছিলেন, যাতে বাকি মা-বাবার সঙ্গে সাক্ষাতের পর্ব আগেই সেরে নিতে পারেন। যদিও তিনি বেশ কয়েকটি দম্পতির সঙ্গে দেখা করে কুশল বিনিময় করেন, তিনি তাদের সাত সপ্তাহ বয়সের ছেলে অনিল যে শীঘ্রই আসছে, তার কথা মনে মনে ভাবছিলেন এবং তার স্ত্রী এলিজাবেথ আর অনিলকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে। উঠেছিলেন। তিনি বলেন: “আমার মনে হয়, এরকম প্রকল্প আরও বেশি বেশি হওয়া দরকার। আমি আশা করব এটা হবে অনেকগুলাের মধ্যে প্রথম।” আজ পর্যন্ত মি. রে সেদিনের তীব্র আনন্দ ও সুখের অনুভূতি তিনি ভুলতে পারেননি; বিমানবন্দরে যখন তিনি সাত জন শিশুর সবাইকে একসঙ্গে দেখতে পান, সে অবিস্মরণীয় মুহুর্তটির কথা তিনি মনে রেখেছেন। ক্যামেরা ক্রু এবং সাংবাদিকেরা তাদের অনুসরণ করছিলেন, তাদের ভাবনা, চিন্তা, অনুভূতি ও আবেগ সবকিছু ধরে রাখার চেষ্টায় । মি. রে এখনও মনে রেখেছেন তার স্ত্রী ও তিনি এতই উত্তেজিত ছিলেন যে খবরের কাগজের রিপােটারদের থেকে দ্রুত দূরে চলে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। পুরাে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ফ্রেড এবং বনি তাদের ধৈর্য্যের দড়ির শেষ প্রান্তে ছিলেন যখন বিমানটি অবতরণ করে। চার মাস বয়সী শিখাকে (তারা যে মেয়েটিকে দত্তক নিয়েছিলেন) কোলে নিয়ে বনি ব্যস্ত হয়ে খোজ করছিলেন, কোনাে বিশৃঙ্খলা এবং বিভ্রান্তি ছাড়া সব নির্ধারিত মা-বাবা তাদের নিজ নিজ শিশুকে কোলে নিয়েছেন কিনা।
ফ্রেডের মনােযােগ ছিল প্রত্যেক দম্পতি যেন ঠিক শিশুকে তুলে নেন, যাতে তিনি তার তালিকার থেকে চেক করে বাদ দিতে পারেন। তারা এত ব্যস্ত ছিলেন যে, প্রথম কয়েক মিনিটের জন্য তারা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি, যারা প্রবল আবেগে শিখাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শিশুদেরকে তাদের মা-বাবার হাতে হস্তান্তর করার পর ক্যাপুচিনােরা তাদের ছেলেমেয়ে এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। ততক্ষণে কর্মশক্তিসম্পন্ন যুগলটি এত নিঃশেষিত অবস্থায় ছিলেন যে কারাে সাথে সংলাপের আর কোনাে উদ্যমতা ছিল । তারা অবিলম্বে চুপি চুপি বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। কারণ তারা জানতেন গণমাধ্যমের লােকেরা তাদের খুঁজছিল, কিন্তু তখন রিপাের্টারদের সাথে কথা বলার কোনাে ক্ষমতা তাদের ছিল না। তারা রিপাের্টারদের এড়িয়ে যান, যে কাজটি তারা কখনাে করেন না।
বাকি দম্পতিদের মধ্যে একটু ব্যতিক্রমী ছিলেন রােবের্তো এবং মার্গো কার-রিবেইরাে। তারা এমন এক দম্পতি যারা তাদের গল্পটি আর পাঁচজনে জানুক, এটা কখনাে চান না। কাজেই তারা তাদের তিন মাসের ছেলে সমর যখন আসে, সে সময় তাদের মানসিক অবস্থার কথা কাউকে বলতে চাইনি এবং এখনও চান না। তাদের স্বপ্নের শিশু যখন এলাে, ‘তারা সে ব্যাপারে চুপ করে থাকাই শ্রেয় বিবেচনা করেছিলেন। বিশেষ করে মার্গো দত্তক নেবার বিষয়ে বাইরের কারাে সঙ্গে কিছু না বলেনিজেদের পরিবারের মধ্যেই ওসব থাক, এরকম মতাবলম্বন করেন। অনেক বছর পরে কথা প্রসঙ্গে মার্গো বলেন বাংলাদেশ থেকে সমরের আবির্ভাব তাদের জীবনে “মনে রাখার মতাে ঘটনা ছিল। মার্গো সে দিনের মনের অবস্থা বর্ণনা করতে চান না, তবুও অনেক অনুরােধের পর তিনি শুধু বলেছিলেন, “প্রকাশ্যে সন্তান প্রসবের বেদনার বিষয়ে আলাপ করতে অনিচ্ছুক । উল্লেখ্য যে, মার্গো’র স্বামী রােবের্তো অনেকটা অস্তচারী মানুষ। যেহেতু তিনি অন্যের আড়ালে থাকা পছন্দ করেন, লেখকের প্রকল্পে অংশগ্রহণে অসম্মতি জানান। তবুও সেদিনের কথা বলতে গিয়ে তিনি তার স্ত্রীর উক্তির পুনরুক্তি করে এটুক বলেছিলেন যে তাদের ছেলের আগমন “তাদের জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।”২৮
জোয়েল এবং টুডি হার্ট সেদিন ব্যস্ত দিন কাটিয়েছেন, বাড়িতে তাদের আরও তিনটি সন্তান থাকায় কাজের অভাব ছিল না । টুডির বাবা-মা বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন সব ছেলেমেয়ের। সঙ্গে যারা সবাই ওদের নতুন বােনকে অভ্যর্থনা জানানাের অপেক্ষায় ছিলেন। নানা-নানি নাতি-নাতনিদের সবাইকে সামাল দিচ্ছিলেন যখন হার্ট দম্পতি ইমিগ্রেশনের কাগজপত্র স্বাক্ষর করা নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন । টুডি ছােট্ট মলিকে জাপটে ধররার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে উদ্ভাসিত হয়ে বলেছিলেন; “আমার মনে হয়েছিল অত সুন্দর কাউকে আমি আগে কখনাে দেখিনি। আমি কৃতজ্ঞবােধ করছিলাম, আগে কখনাে বুঝি নি, এমনি সব অনুভূতির প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলাম আমি সে মুহূর্তে,” টুডি এভাবে লেখেন লেখককে। জোয়েল এবং টুডি মলির পানে তাকিয়ে ছিলেন এক দৃষ্টে, কয়েক মিনিট শুধু ভেবে মেয়েটি যে, “এত ছােট আর এত সুন্দর!” লােকের ভিড় বলে মলির দিকে তাকাতে তাকাতে তারা লবিতে গিয়ে ছবি তুলেন অনেক । তারপর মলিকে নিয়ে তারা লােকের ভিড় এড়িয়ে নানানানির সঙ্গে মলিকে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলেন, সেখানে মলির ভাইবােনেরাও অপেক্ষায় ছিল “ক্ষুদে আশ্চর্য শিশুটিকে দেখার জন্য।” মিটজি ম্যাককালা মন্ট্রিয়লে এসেছিলেন একা হ্যালিফ্যাক্স, নােভা স্কোশিয়া থেকে, তার স্বামী বাড়িতে রয়ে গিয়েছিলেন। কারণ তারা দুজনের বিমান ভাড়া যােগাড় করতে পারেনি । মিটজি তখন ছিলেন ২৩ বছরের তরুণী। চতুর্দিকে বিমানবন্দরের ভিড়, আলাের মাঝে নিকি দাঁড়িয়ে তাদের সাড়ে তিন মাস বয়সের ছেলে প্রদীপের জন্য অপেক্ষা করছিলেন আর ভাবছিলেন, দত্তকের আবেদনপত্র সই করবার দিন থেকে অবশেষে ছেলে আসার দিন পর্যন্ত । এক তীব্র অনুভূতিতে তিনি তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন শুধু মনে মনে ভেবে যে তাদের -দেখা-শিশুসন্তান শীঘ্রই এসে নামবে কানাডার মাটিতে । দত্তক নেবার প্রক্রিয়ায় নানা জটিলতা রয়েছে সত্যি, অনেক কিছু করে মিটজি এবং তার স্বামী এতদিন পর্যন্ত কেন কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারেননি। শেষে ক্যাপুচিনাের টিম তাদের জন্য একটি শিশু নির্বাচন। করে শেষ পর্যন্ত শিশুটিকে আনতে পারবে কিনা, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত ছিলেন না।
যদি পারে, শিশুটি দেখতে কেমন হবে? ঠিক সময়ে প্রদীপকে যখন তার কাছে নিয়ে আসা। হলাে মিটজি দুহাতে ধরে আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিলেন; “এ নিয়ে দ্বিতীয়বার আমি কোনাে শিশুকে ধরেছি, আমি ভয় পাচ্ছি।”৩২ প্রদীপ ওই দম্পতির প্রথম সন্তান। মিটজি তাকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে অত্যাশ্চর্যভাবে তিনি অনুভব করেন তার সাথে যেন তার সন্তানের এক অদ্ভুত যােগাযােগ স্থাপন হয়ে গিয়েছে ইতােমধ্যে । তার যত ভয় আর অজানা ভাবনা ছিল শিশুকে ঘিরে, সব যেন মুহূর্তের মধ্যেই গলে জল হয়ে গেল মাতৃস্নেহের প্রবাল তরঙ্গে। যখন মিটজি গর্বিত মায়ের ভঙ্গি করে প্রদীপকে কোলে তুলে নিলেন, একজন সাংবাদিক তার দিকে এগিয়ে গেলে তিনি বলেছিলেন: “আমরা যে কোনাে সময় একটি শিশু নিতে পারি, কিন্তু এরকম একটা বিশেষ শিশু পাবাে না।”৩৩ মিটজি সাংবাদিককে একথা বলতে বলতে হ্যালিফ্যাক্স যাবার জন্য বিমান ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
লয়েড এবং স্যান্ড্রা সিমসন-এর বেলায় একটু ব্যতিক্রম ছিল । বাড়িতে আরেকটি সন্তান আসার জন্য যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবার কথা, অভিজ্ঞ মা-বাবা হওয়ার কারণে সেটা অনেক স্তিমিত ছিল । যােগাযােগ মাধ্যমের সবাই এ দম্পতিদের বেশ ভালােভাবে চিনতেন । অনেকে আগে থেকে দেশের অভ্যন্তরে দত্তক নেয়া এবং আন্তর্জাতিক দত্তক নেবার ক্ষেত্রে তারা। সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে আসছেন অনেক বছর থেকে। কুড়ি দিন বয়সের শিশু রাজিবকে বুকে জড়িয়ে ধরে সিমসন দম্পতি তাদের পরিবারের আরও ছেলেমেয়েদের নিয়ে হঠাৎ যেন বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ক্যাপুচিনােদের ঢাকা সফরের সময় স্যান্ড্রা সর্বক্ষণ তাদের সঙ্গে যােগাযােগ রেখেছিলেন। শিশু খোঁজা শেষ করে ওদের নিয়ে ফিরতে পদে পদে যত বাধা, যত প্রতিবন্ধকতা তার খবর তিনি রাখতেন। স্বাভাবিকভাবে স্যান্ড্রী এবং তার স্বামী শঙ্কিত ছিলেন, কানাডীয় টিম যথাসময়ে ঢাকা ত্যাগ করতে পারবে কিনা। “এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে, তারা এত তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন!”* অনেকটা অবাক হয়ে স্যান্ড্রা সেটা বলেছিলেন। তাদের কখনাে না-দেখা-সন্তান-এর উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরের দিকে যাত্রার সময়, আরভিডা, কিউবেক-এর পিয়ের ও লিজ হােগ নিজেদের সামলাতে পারছিলেন না। আমরা একটা গাড়িতে এবং মেয়েটা (রাজিনা) বিমানে। এক নতুন ভাগ্যের দিকে ভ্রমণ করছিলাম,”৩৫ লেখেন পিয়ের সেদিনের কথা মনে করে। যখন তারা বিমানবন্দরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন তাদের চারদিকে তখন মানুষের ঢেউ। খবরের কাগজের রিপাের্টার তাদেরকে ঘিরে রেখেছিলেন। আমরা আশায় উদগ্রিব এবং উত্তেজিত ছিলাম; আমি অনেকটা অনুভব করেছিলাম আমাদের ছেলে জন্ম নেয়ার সময়টুকু, অবশ্য শারিরিক কষ্ট ছাড়া আরও অন্যান্য অদ্ভুত অনুভূতি আমাকে ঘিরে রেখেছিল,” বলেন লিজ সেদিনের স্মৃতিচারণে তার মেয়ের আগমনের সময়টি বর্ণনা করতে গিয়ে। “বিমানবালা আমার কোলে শিশুটি দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমি টের পেলাম, রাজিনা ইতােমধ্যেই যেন আমার মেয়ে হয়ে গিয়েছিল,” বলেন লিজ ।
আনন্দে কাঁপতে কাঁপতে তারা তাদের শিশুটিকে দুহাতে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন। যদুর মনে পড়ে তার পরপরই তারা নিঃশব্দে বিমানবন্দরের সন্নিকটে পার্ক করা গাড়ির দিকে এগিয়ে। গিয়েছিলেন। তারা সানন্দে এবং আবেগে এত আপুত ছিলেন যে, সে সময়ে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য তারা তাদের চার বছরের ছেলে বেনওয়াকে ভুলে গিয়েছিলেন – যে বাড়িতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, কখন মা-বাবা তার ছােট বােনকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন । দুদিন ভ্রমণের শেষে শিশুরা যার যার মা-বাবার কাছে যাওয়া, হৈচৈপূর্ণ এবং হর্ষোৎকল্প মিলনের মধ্যে অনেক আশঙ্কা আর দুর্ভাবনার ইতি ঘটে। ছেলেমেয়েদের বুঝে পাবার পর, বাবা-মায়েরা স্বাভাবিকভাবেই আগে বাড়ি পৌঁছতে চেয়েছিলেন। কোথাও দু-দন্ড দাঁড়িয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসার কোনাে অবকাশ ছিল না। বিমানবন্দর থেকে বের হবার পথে সাংবাদিকেরা বাবা-মায়েদের থামানাের চেষ্টা করেন অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য থেমে ফটো তােলার অনুরােধ করেন। একটি দুটি ছবি তুলে এবং মন্তব্য রেকর্ড করেই অতিমাত্রায় উত্তেজিত বাবা-মায়েরা ভিড় ঠেলে কোনােমতে সামনের দিকে নিজ নিজ শিশুকে নিয়ে তাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে যান।
যে আনন্দ হতভম্ভতা বাবা-মায়েদের মুখমন্ডলে প্রতিফলিত হয়েছিল সেটা নাটকীয়ভাবে তীক্ষ্ম ও মর্মভেদী ছিল। তাদের নিজ পছন্দের অন্তত একটি যুদ্ধশিশুকেও বাঁচাতে পেরে তারা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করেন । আস্তে আস্তে তারা সবাই যখন নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেলেন তখন থেকে আশা করেছিলেন যে তাদের শিশুরা কানাডাতে এসেছে একটি নতুন স্বপ্ন নিয়ে। তাদের জীবনে প্রতিদিনই নতুনতর সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে এটাই ছিল বাবামায়েদের স্বপ্ন। পরের তিন অধ্যায়ে আমরা যুদ্ধশিশুদের জীবনে মােড়ে মােড়ে কার কী। অভিজ্ঞতা হলাে সেটা অনুসন্ধান করেছি। বর্তমান অধ্যায়ে আমরা বাংলাদেশ ও ক্যনাডাতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া যেরকম হয়েছিল সে সম্পর্কে ধারণা দিতে চেয়েছি।
কানাডাতে আন্তর্জাতিক দত্তকের ইতিহাসে যুদ্ধশিশুদের নিরাপদে এসে পৌছনােকে এক মাইলফলক ঘটনা বলা যায় । এটাকে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে, যখন এ সত্য বিবেচনা করা হয় যে ঐ সব শিশুরা তাদের জন্মদেশে “কাঙ্ক্ষিত ছিল না। যেহেতু পরিত্যক্ত বাংলাদেশে তাদের কেউ দত্তক নিতে কখনই আগ্রহী ছিলেন না, দত্তকের অভিধানে ঐ শিশুদের সাধারণত “দত্তক দেয়া কঠিন” হিসাবে ধরে নেয়া হয়। এ ধরনের সন্তানদের দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবা না পাওয়ার জন্যে তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক পর্যন্ত। বাংলাদেশে বিভিন্ন আশ্রমে জীবন কাটাতে হয় । তবে সাধারণত দেখা যায়, পরিণত বয়সে পৌছানাের সাথে সাথে আশ্রম থেকে অনেক ছেলেমেয়ে পালিয়ে যায়। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি হৃদয়বান, উপকারী ও মানবতাবাদী একদল কানাডীয় নাগরিকদের সমবেত স্বার্থহীন প্রয়াসে কয়েকটি যুদ্ধশিশুর কানাডাতে আগমন ঘটেছিল। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে দেখতে পাবাে কেমন করে এই শিশুদের ‘নৈরাশ্যের শিশু” আখ্যায় আখ্যায়িত করে কানাডীয় সংবাদ মাধ্যম কানাডীয়বাসীর সমীপে এদের উপস্থাপন করে এক গভীর আগ্রহের আধাররূপে।