একটি মর্মন্তুদ চিঠি
কলকাতার সদর স্ট্রিটের মেথোডিস্ট চার্চের দু’ জন যাজক জন হেস্টিংস এবং জন ক্ল্যাপহাম মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজে অবদান রেখেছিলেন। লন্ডনের দি গার্ডিয়ান এ তাঁরা একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন মে মাসের মাঝামাঝি। খোলা চিঠিও বলা যায় তাঁদের বক্তব্যকে-
আমরা রিপোর্টার নই যে কাগজের জন্য ভালো প্রতিবেদনের গল্প খুঁজব। আমরা দু’ জনই কুড়ি বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করছি। শরণার্থীদের ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। পূর্ববঙ্গের সামগ্রিক চিত্রটা আমাদের কাছে স্পষ্ট। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
ফায়ারিং স্কোয়াডে যাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁদের মধ্যে অনেকে বেঁচে ফিরেছেন। রাজনৈতিক নেতা, ডাক্তার, শিক্ষক এবং ছাত্রদের মেশিনগান দিয়ে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তারও শত শত সাক্ষী আছে।
দিনে রাতে যেকোনো সময় গ্রামের পর গ্রাম ঘিরে ফেলা হয়েছে, গ্রামবাসীরা পারলে পালিয়েছে, অথবা তাঁদের যেখানে পাওয়া গেছে সেখানেই হত্যা করা হয়েছে, অথবা তাঁদের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তারপর গুলি করা হয়েছে। মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়েছে, মেয়েদের ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, হাজার হাজার নিরস্ত্র কৃষককে বেয়নেটে বা গুলিতে হত্যা করা হয়েছে।
সাত সপ্তাহ পরও এই ধারা [প্যাটার্ন] অব্যাহত। অনেক কাহিনি অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে, যেমন শিশুকে ওপরে ছুঁড়ে ফেলে বেয়নেটে বিদ্ধ করা, মহিলাদের উলঙ্গ করে যোনিতে বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো, বা শিশুদের মাংসের মতো খণ্ড বিখণ্ড করা। কিন্তু, সেগুলো অতিরঞ্জিত নয়, কারণ, যাঁরা এগুলো বলছে রাজনৈতিক কারণে গল্প বানানোর মতো দক্ষতা তাদের নেই কেটে ফেলা মায়ের হাত, শিশুর পা আমরা দেখেছি। সীমান্ত থেকে অনেক দূরে এসব ঘটনা ঘটেছে। গুলির ক্ষতের কারণে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছে [সে কারণে কেটে ফেলতে হয়েছে]। অনেকে তাদের কন্যাকে ধর্ষিত হতে দেখেছেন, সন্তানদের মাথা গুড়িয়ে দিয়েছে তাও দেখেছেন। অনেকে দেখেছেন তাঁদের স্বামী, সন্তান, নাতিদের হাত বেধে কীভাবে গুলি করা হয়েছে।
বনগাঁয় একটি মেয়ে খালি চিৎকার করে বলছে “তারা আমাদের সবাইকে হত্যা করবে, তারা আমাদের সবাইকে হত্যা করবে।” কোনো অষুধই তাকে শান্ত করতে পারছে না। তার আরেকটি মেয়ে কাঁপছে। সারাদিন তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং যোনিতে বেয়নেটের ক্ষত।
বনাউডাঙ্গায় তারা ৪০০ জনকে হত্যা করেছে। সেখানে তারা জমায়েত হয়েছিল সীমান্ত পেরুবার জন্য? কেন? যাতে নিষ্ঠুরতার কাহিনি ভারতে না পৌঁছে? বা “Choosing a certain democratic system under Sheikh Mujib means forfeiting the right to live in any country?”
সবচেয়ে ভয়ংকর হলো ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলা। বহুদিন ধরে তারা ঘৃণা করেছে বাঙালিদের। বৈষম্য চিরকালীন। পশ্চিম প্রদেশে চালের দামের দ্বিগুণ ছিল পূর্বে। গণতান্ত্রিকভাবে ও শান্তিপূর্ণ মুজিব অনুসারীরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। গত ডিসেম্বরে নির্বাচনে তারা মানুষের প্রচণ্ড সমর্থন পেয়েছিল। ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন তারা পেয়েছিল। এই অপমান ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ও ভূট্টো মেনে নিতে পারেনি।
এটাকে ভারতের সমস্যা বলা হবে? “It should be no more here than any other countries.” পাশ্চাত্য কি করছে?
সবশেষে তারা বিশ্ববাসীর কাছে যে আবেদন করেছে তা অনুবাদে বোঝা যাবে না। যে প্যাশান তারা দেখিয়েছিলেন তাতে কোনো খাদ ছিল না। লিখেছেন— “Are the political complexities so much a gang ? Has no government or people the voice that can sound out with the authentic ring of passion in support of the victims? Is there no consensus out of which can be heard a creative answer?
সূত্র: দলিলপত্র: খন্ড ১৩
একাত্তরের বন্ধু যাঁরা- মুনতাসীর মামুন