You dont have javascript enabled! Please enable it! ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধ- বলাৎকার ফলাফল- যুদ্ধশিশুদের জন্ম - সংগ্রামের নোটবুক
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধ, বলাৎকার ফলাফল এবং যুদ্ধশিশুদের জন্ম
“অধিকৃত বাংলাদেশ” (মার্চ-ডিসেম্বর ১৯৭১) গত শতাব্দীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ব্যাপক মাত্রার মানবিক সংকট দেখা দেয়। সে সময় অগণিত নারীর ওপর অত্যাচার, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ চলে, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টায় খুন, লুটতরাজ ইত্যাদি অনাচার যেভাবে মানুষের বিপুল ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তার তুলনা মেলা ভার। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা শহরে ও গ্রামে লুটপাট, ডাকাতি ও হত্যার যে তান্ডব চালিয়েছিল তার হিসেবও রাখা সম্ভবপর হয়নি। দুরাচারেরা তাদের ইচ্ছামতাে একটি শস্যশ্যামলিমা সুন্দর কৃষক সমাজে ঢুকে তছনছ করে। সে সময় তারা হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল বাঙালি জাতির সর্বনাশে। বাঙালি নারীদের ইচ্ছামতাে আটকে রাখা হয়েছে মিলিটারি ক্যাম্পে মাসের পর মাস, তাদের ওপর নির্যাতন চলেছে অবিশ্রাম, দেশের স্বাধীনতা লাভের দিন পর্যন্ত এ অনাচার চলেছিল অবাধে ।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যারা পূর্ব পাকিস্তানকে অমুসলমানের দেশ মনে করত, তারা অত্যাচারের বেলায় যে আরও এগিয়ে যাবে, এতে আর সন্দেহ কি! যথেষ্ট দালিলিক প্রমাণাদি থাকায় সমস্যাদির জটিলতা ও যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে গবেষণাতেও খুব সুবিধা হয়নি। যুদ্ধশিশুদের বিষয়টি বােঝার জন্য প্রথমেই ধর্ষণ ও যৌন অত্যাচারের ব্যাপকতা হৃদয়ঙ্গম করার প্রয়ােজন। অর্থাৎ পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা “অধিকৃত বাংলাদেশে কোনাে ধরনের কতগুলি পরিবারে ঐ জঘন্য অপরাধমূলক তৎপরতা চালু রাখতে পেরেছিল, সেটা জানাও দরকার। ফলাফল হিসাবে “অনাকাক্ষিত” শিশুর জন্ম ও সমাজের অবাঞ্ছিত” সদস্যরূপে বড় হয়ে ওঠার নির্মম নিয়তিকে মেনে নেবার কথাও থেকে যায়। কে না জানে, যুদ্ধশিশুর জন্ম কীভাবে? আর কীভাবেই না তারা বড় হয়েছে বাংলাদেশে?
আরও প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না; যেমন, বাংলাদেশি প্রেক্ষিতে ধর্ষিত হবার অর্থ কী? গণধর্ষণের ফলাফলরূপে জন্ম নেয়া শিশুর পিতৃত্বের দায় কার ওপর বর্তাবে? প্রাক স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্ষণ ও ধর্ষণের শিকার যেসব নারী সােনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সমাজে তাদের অবস্থান কী হবে? অসম্মানিত বাঙালি নারীরা কোথায় লুকিয়ে আছেন? অবাঞ্ছিত যুদ্ধশিশুদের মায়েরা কোথায় ঠাই নিয়েছেন? পরিত্যক্ত শিশুরাই বা কোথায়? কতজন দেশের বাইরে দত্তক হিসাবে গৃহীত হয়েছে? বাংলাদেশে কি কেউ ওদের দত্তক নিয়েছে? আমরা তাদের সম্পর্কে কতটুকু জানি?
স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করতে নিযুক্ত পাকিস্তানি সেনা অফিসার ও সৈন্যরা যখন বাঙালি নারীকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হয়, তাদের যৌন লালসা, একাকিত্ব ও জবরদস্তি গর্ভধারণের বিষয়গুলাে নিয়ে কি কেউ ঠান্ডা মাথায় ভেবেছিলেন? গেরিলা যুদ্ধের টেনশন তাে ধর্ষণ, সমকাম ও যাবতীয় যৌন অনাচারকে সমাজের চোখে গ্রাহ্য করেনিতে পারে না! যেভাবে পাকিস্তানি সেনাদল যৌন অনাচার চালিয়েছিল, তাতে কেবল পাশবিক ব্যাপারই বিকট বিশালতা পেয়েছে । “হাজার হাজার নারী পাকিস্তানি দমননীতির কারণে নির্যাতিত হয়েছেন । বসনিয়ায় সার্ব সেনারা যেমনটি পরে করেছিল যাদের অনেকে গর্ভবতী হয়ে পড়েন, লিখেছেন জেম্স বার্টলম্যান, বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রথম কানাডীয় হাই কমিশনার। খুব সাবধানে এ স্পর্শকাতর বিষয়টাকে নিয়ে এগুতে হয়। অসাবধান হলে ধর্ষণ ও যৌন অত্যাচারের মধ্যে তফাৎ গুলিয়ে যাবে। এ সংক্রান্ত নানা কুকর্ম, যেমন অপহরণ, আটক রাখা, ধর্ষণ, হত্যা, জবরদস্তি গর্ভধারণ, জন্ম ও গণধর্ষণের সংখ্যা নিরূপণ না করতে পারলে এসবের ফলশ্রুতিতে যেসব যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়েছিল সেগুলাের প্রকৃত পরিসংখ্যান কখনাে পাওয়া যাবে না। স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধশিশুর ইস্যু হারিয়ে যেতে বসেছে ।
অতএব, ইত্যাকার ঘটনাকে সঠিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে, বুঝতে হবে, কাজে লাগাতে হবে। এর অর্থ হলাে, স্বাধীনতার যুদ্ধ ও যৌন সহিংসতার বিষয়টি সর্বাগ্রে আলােচনা। করতে হবে, যদিও উপযুক্ত গুণাগুণসম্পন্ন তথ্যাদি আমাদের হাতে কখনই ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই এটা জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় কারণ ধর্ষণ, যৌন অত্যাচার ও যৌনবন্দীরূপে ব্যবহারের দালিলিক প্রমাণ পর্যাপ্ত নয়, প্রমাণ রাখাটাও সম্ভব ছিল না। সামরিক কর্তৃপক্ষ যে এগুলাে নিখুঁতভাবে রক্ষা করবে না, যাতে সকলে দেখতে পায়, এটা। ততা সহজেই বােধগম্য । যে যুদ্ধশিশুদের জন্ম, মৃত্যু ও পরিত্যাগের ঘটনা সরকারি সেবা সদন (সরকার প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিক ও মাতৃ সদন যেগুলি ধর্ষণের শিকার নারীদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল), শিশু হােমস ও অন্যান্য অনাথ আশ্রমে ঘটেছিল, সেগুলাে থেকে বেশ কিছুটা জানা সম্ভব হয়েছে।
এ ধরনের ব্যাপক গবেষণায় কল্পনার কোনাে জায়গা না রেখে বস্তুনিষ্ঠতা ও প্রায়ােগিক অভিজ্ঞতাবাদকে যথাসাধ্য কাজে লাগানােই যে কোনাে গবেষকের প্রথম কাজ । সে দিক। দিয়ে বিচার করলে বলা যেতে পারে যে, ধর্ষিতাদের গর্ভধারণ, গর্ভনাশ ও আত্মহত্যার ঘটনাগুলাের দিকে তাকালে এবং যুদ্ধশিশুদের জন্ম ও পরিত্যাগের ঘটনা হিসাব করলেই ১৯৭১ সালে বাঙালি নারীদের ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের প্রকৃত ঘটনাবলি ও ফলাফল ভিত্তিক সামগ্রিক চিত্র নির্মাণ অসম্ভব নয়।
আজ বাংলাদেশে যেমনটি প্রচারিত হয়েছে এবং বহির্দেশীয় নানা সূত্রে যা জানা গেছে, ৩০ লক্ষ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে নিহত অথবা অত্যাচারে ভুগে জীবনদান করেছেন; ২০০,০০০ নারীকে বিভিন্ন সেনা ক্যাম্পে ধর্ষণের পর নানা প্রতিষ্ঠানে আটক রেখে ধর্ষণ ও অন্যবিধ যৌন অত্যাচার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে একটা বড় সংখ্যার নারীকে গর্ভধারণে বাধ্য করা হয়েছিল; ১ কোটির উপর দেশবাসীকে দেশত্যাগ করে ভারতে পালাতে হয়েছিল। এ বইএর ফোকাস যেহেতু কানাডীয় পরিবারে গৃহীত যুদ্ধশিশু কয়েকজন, এখানে ধর্ষণের বিষয়টি অতি সংক্ষেপে দ্রুত সেরে নেয়া হয়েছে। সে বিবরণর পরে সেটা আসছে, সেটা শুধু যৌন সহিংসতা ও তার ফলাফল কী ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে, সেদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করার জন্যই কেবল করা হয়েছে। এ অধ্যায় অথবা অন্য যে কোনাে অধ্যায়ে বইয়ে উল্লিখিত সংখ্যার যাথার্থ চ্যালেঞ্জ করিনি, যা অনেকেই করেছেন। যেমন, তাদের মধ্যে রয়েছেন শর্মিলা বােস যার বহুল পঠিত গবেষণা গ্রন্থ Dead Reckoning: Memories of the 1971 Bangladesh War বইটিতে তিনি নানা বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। আমার বইয়ের লক্ষ্যবিন্দু পরিসর যেহেতু প্রথম বাংলাদেশি ১৫ জন যুদ্ধশিশুর যে অনিশ্চিত সম্ভাবনা নিয়ে ১৯৭২ সালে যে কানাডাতে নিয়ে আসা হয়েছিল, তাদেরকে নিয়েই (এবং অন্য কাউকে নয়) একই সাথে ব্যাপকভাবে আলােচনা করা হয়েছে – তার মধ্যে রয়েছে সেসব দত্তক নেয়া ছেলেমেয়েদের কানাডীয় জীবনবৃত্তান্ত অর্থাৎ দত্তক প্রক্রিয়ার পূর্ণঙ্গি ফলাফল । এ প্রক্রিয়ার ফলাফল আলােচ্য অধ্যায়ের বর্ণিত উপশিরােনামগুলাে পাঠককে পরিচিত করবে নৈপথ্য কাহিনী হিসাবে বাংলাদেশের সেই ধর্ষণ, জন্মদাত্রী মায়েদের জবরদস্তিমূলক গর্ভধারণ, যুদ্ধশিশুদের জন্ম, পরিত্যাগ ও দত্তকগ্রহণ কী নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পারে ও এনেছিল সে বিষয়ে আলােকপাতের মাধ্যমে।
ধর্ষণ, খুন, আত্মহত্যা, মৃত্যু, গর্ভধারণ ও গর্ভনাশের ঘটনা
ধর্ষণ
১৯৭১ সালে “অধিকৃত বাংলাদেশে বাঙালি নারীর ধর্ষণের বিরুদ্ধে উচ্চারণ শােনা গেলেও যুদ্ধের পরও এ বিষয়ে তথ্যাদি সংগ্রহের কাজে তেমন কেউ অগ্রসর হননি । ফলশ্রুতিতে সামনে এগুনাের জন্য ভরসা দেবার উপযােগী তথ্যের অত্যন্ত অভাব রয়ে গিয়েছে। বারবার যে জায়গায় গবেষকরা এখানে বাধা পাচ্ছেন, তা হলাে সঠিকভাবে সংখ্যা নিরুপণ করা । সাধারণত দেখা যায় যে এ বিষয়ে অনেকেরই নানা ধরনের মন্তব্য (যাদের পেছনে নানা উদ্দেশ্য কাজ করে) রয়েছে এবং তারা বিভিন্ন রকমারি সংখ্যার উল্লেখ করে থাকেন। পাকিস্ত নি সেনারা কতজন বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেছিল, এমনকি সে সংখ্যাও ব্যাপকভাবে ভুল পথে নিয়ে যায় গবেষককে ।
অল্পসংখ্যক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দখলদার সেনাবাহিনী মানুষজনের উচ্ছেদ, অত্যাচার, হত্যা, ধর্ষণ, গণহত্যা, বাঙালি নারীদের ওপর যৌন অত্যাচার, এগুলাে দেশব্যাপী পুরাে নয় মাস চালিয়েছে। অত্যাচার যেমন ব্যাপক হয়েছে, সেগুলির বিষয়ে তথ্য সংরক্ষণও অবহেলিত হয়েছে, ফলে ঐতিহাসিক একটা ব্যাপক শূন্যতাও রয়ে গিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের ১৭টি জেলা থেকে নিয়মিতভাবে তথ্যাদির স্রোত কোথাও এসে জমা হয়নি ঐ সঙ্কটকালে । যে সংখ্যাগুলি বাজারে চালু হয়ে গিয়েছিল, সেগুলি সকলেই উচ্চারণ করতেন, কেউ যাচাই করতেন না। ফলে সকলেই মনে মনে বলেন যে, সংখ্যাগুলাে বাড়িয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়ে কেউ এগুচ্ছিলেন না, এ ছিল তখনকার অবস্থা । বলা যেতে পারে, ধর্ষণের শিকার কত নারী, এটা নিরূপণ করা আর খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজা তাে একই। রকমের দুঃসাধ্য কাজ!
ইতালীয় এক চিকিৎসক দল নির্যাতিতের সংখ্যা ৪,০০,০০০ হবে বলেছিলেন অবশ্য নির্দিষ্টভাবে কোনাে উদ্ধৃত্তি ছাড়া । তখন খবরের কাগজগুলাে অবশ্য বলেছিল প্রকৃত সংখ্যা। তারও ওপরে। লন্ডনস্থ International Planned Parenthood Federation (IPPF)এর মতে, নির্যাতিতের সংখ্যা ছিল ২,০০,০০০। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বাের্ড (ন্যাশন্যাল বাের্ড অব বাংলাদেশ উইমেন্স রিহ্যাবিলিটেশন প্রােগ্রাম) স্থাপন করেন। এ বাের্ডের কাজ ছিল ধর্ষণের শিকার ও অন্যান্য অসুবিধাগ্রস্ত নারীদের দেখাশােনা করা । বাের্ডের আরও একটি কাজ ছিল মার্চ ১৯৭১ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশে যত নারী পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা ধর্ষিত ও নিগৃহীত হন, তার একটি তালিকা তৈরি করা।
প্রথমদিকে বাের্ডের সদস্যরা ব্যাপকভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ওপারের গ্রামে যেতেন এবং তারা একটা হিসাব দেন ২৬৮,২০০ নারীর । তারপর, যথোপযুক্ত সংস্থার সঙ্গে অনেকগুলাে মিটিং হবার পর, যারা বিপন্ন নারীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে কাজ করেছিলেন, সেসব হিসাব। মিলিয়ে দেখার জন্য বাের্ড আরেকবার পৃথকভাবে হিসাব করে । এভাবে হিসাব শেষে বলা হয়েছিল যে “অধিকৃত বাংলাদেশে” ৪৮০টি থানায় প্রতিদিন ২টি নারী ও অল্পবয়সী মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিল বা হারিয়ে গিয়েছিল । দখলদার বাহিনী ২৭০ দিন। গ্রামবাংলা দখল করে অবস্থান করেছিল । বাের্ড তখন একটি ফর্মুলা তৈরি করে যে ফর্মুলাটির বর্ণনা ছিল এরকম: ৪৮০ থানা x ২৭০ দিন x ২ নারী =২৬৮,২০০ জন নারী । কিছু নারী। অন্যান্য কারণে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে থাকলেও বাের্ড ২০০,০০০-কে সরকারি হিসাব মতে নির্যাতিতা নারীর সংখ্যা বলে ঘােষণা করে। বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত এ সংখ্যা আদৌ গ্রহণযােগ্য কিনা; বা কতটুকু গ্রহণযােগ্য, সে বিষয়ে বিতর্কের সুযােগ থাকলেও গবেষণার খাতিরে এ সংখ্যার ভিত্তিতেই আমাদেরকে এগুতে হবে । ১৯৭২ সালে শুরুতেই ডাঃ জেফ্রি ডেভিস, অস্ট্রেলীয় সার্জন, পরিচালক, International Planned Parenthood Federation (IPPF) ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের অবস্থা দেখে অত্যন্ত দুঃখ পান। তিনি শঙ্কিত হয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে তারা সারা জীবন বন্ধ্যাত্ব ও দীর্ঘস্থায়ী অসুখে ভুগবে।”* নানা সূত্র থেকে অনুমাননির্ভর সর্বোত্তম গড় হিসাব করে ঐ ক্ষেত্রে তার নিজের অভিজ্ঞতার ফলাফল নিয়ে কাজ করে বলেছিলেন, আসল সংখ্যাটি বাংলাদেশ সরকার যে হিসাব দিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি হতে পারে। ধর্ষণের শিকার নারীদের সঙ্গে এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কাজ করে ডাঃ ডেভিস ওরকম ধারণা পােষণ করেছিলেন । তিনি যে বাংলাদেশি ও ভারতীয় চিকিৎসকদের সঙ্গে কাজ করেন, তারা সবাই মিলে এরকম ধারণা করেছিলেন যে, বাের্ডের হিসাব করা সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় হয়তাে কমই মনে হচ্ছিল। ডাঃ ডেভিস যে তার চিকিৎসকদের নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় গ্রামে কাজ করেছেন, তাতে তার মনে হয়েছে, তিন থেকে চার লক্ষ বাঙালি নারী ১৯৭১-এ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
তার দল ১৯৭১-এ ধর্ষিতাদের সংখ্যা নিরূপণে বিশেষ মনােযােগী ছিলেন। ১৯৭২-এ তারা যাদের চিকিৎসা করেন, তাদের সংখ্যাও তারা নথিবদ্ধ করেন। তার সহকর্মীদের নিকট থেকে গৃহীত মাঠভিত্তিক প্রতিবেদনের তিনি নিজে বিশ্লেষণ করেন; অতঃপর তিনি তার যুক্তি সাজান এভাবে: (ক) যারা নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন, কেবল তাদের বিবেচনা করা হয়েছে, আবার যারা ঠিকঠাক আছেন, তাদের এ হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে যেহেতু অনেক পরিবার নির্যাতনের ভয়ে নিরুদ্দিষ্ট কেউ হয়ে থাকলেও সেটা বলেননি; (খ) হিসাবে সেনাবাহিনী গ্রামের দখল নেবার প্রক্রিয়ায় যে নারীদের ধর্ষণ করেছিল তাদের সংখ্যা অনুপস্থিত।
ডাঃ ডেভিস এর মতে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ গ্রাম যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত, সেখানে সেনাবাহিনীর কুকর্মের মধ্যে নারীর বিরুদ্ধে যৌনাপরাধ সংঘটন, যেমন, ধর্ষণ, অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের সংখ্যা সেক্ষেত্রে বিশাল নাও হতে পারে। অনেক ভারতগামী নারী সেনাবাহিনী ও রাজাকার সদস্যদের দ্বারা গৃহত্যাগীদের থেকে পৃথক হয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়ে পড়ে। এক কোটি বাংলাদেশি ভারতে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন ১৯৭১ সালে, যাদের মধ্যে ১.৫ মিলিয়ন ছিলেন প্রাপ্তবয়স্ক নারী (পরিবার প্রতি সন্তানের সংখ্যা ৪)। ডাঃ ডেভিস আরও বলেন, ‘সরকারের দাবি অনুযায়ী অধিকৃত বাংলাদেশে লােকসংখ্যা ৭৫ মিলিয়ন হলেও প্রকৃতপক্ষে সেটা ৯০ মিলিয়নও হতে পারে।
আমরা আবারও ডেভিস-এর পর্যবেক্ষণে যখন ফিরে আসি, যেমন যে ১০ মিলিয়ন বাঙালি যে। ভারতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন, সেটা বাদ দিলেও “অধিকৃত বাংলাদেশ”-এ জনসংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৬৫ মিলিয়ন। ঐ সংখ্যার ১.১ মিলিয়ন ছিলেন সন্তান উৎপাদনক্ষম নারী। ডাঃ ডেভিস এর মতে যদি ধরে নেয়া হয় তার এক-তৃতীয়াংশ ধর্ষিত হয়েছিলেন, তাহলে ধর্ষণের শিকার হতাে ৩০০,০০০ জন। বিচারপতি কে এম সােবহান, সভাপতি, ন্যাশন্যাল বাের্ড অব বাংলাদেশ উইমেন্স রিহ্যাবিলিটেশন প্রােগ্রাম (সেটাকে সাধারণতঃ বলা। হয়ে থাকে বাের্ড) ডাঃ ডেভিস-এর হিসাবের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। অবশ্য সে সংকটময় সময়ে সরকার এ ধরনের প্রকল্পে সময় ও অর্থ বরাদ্দ করা সম্ভব ছিল না কারণ যুদ্ধবিধ্বস্ত নতুন দেশের পুণনির্মাণের কাজে প্রাধিকার দেয়াটা বিশেষ জরুরি বণে গণ্য করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞ এবং সমাজকর্মী, যেমন- ডা. জাহাঙ্গীর হায়দার, বাের্ডের পরিচালক, ফাতেমা কালাম, হােসনে আরা কাসেম, রাজিয়া হক, যারা ধর্ষণের শিকার নারীদের বাঁচবার পরামর্শ যােগাতেন, তাদের সাক্ষাকারও নেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ ধষিতা ও যৌনদাসী হিসাবে আটক নারীদের ব্যবহার করা হয়েছে যেসব (সামরিক) প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সেগুলাে সর্বসমক্ষে তুলে ধরার উপযােগী অনুসন্ধানী গবেষণা কাজে উল্লেখযােগ্যভাবে অগ্রসর হয়েছিলেন। ডা. হায়দার ৪,০০,০০০ নারী সম্রম। হারিয়েছেন এ ভিত্তির উপর কাজ করে বলেন: “প্রায় চার লক্ষ নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন চালানাে হয়েছে, যাদের মধ্যে অন্তত শতকরা ২০ জন আজ সমাজের অন্ধকারে নিপতিত হয়েছেন, কারণ তাদের সম্পত্তি বেহাত হয়েছে অথবা তাদের পরিবারের রােজগেরে পুরুষ পারিবারিক সদস্য মৃত অথবা নিখোজ ।
প্রথম আত্মপরিচয় দানকারী ধর্ষণের শিকার বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে যিনি নিজেকে প্রথম প্রকাশ করেন, তিনি হলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী । ১৯৯৯-এর নভেম্বরে স্বাধীনতা যুদ্ধের ২৮ বৎসর পরে তার দুঃস্বপ্নের কাহিনী দেশের সবাইকে অকপটে খােলাখুলিভাবে বলেন।
তিনি জানান, দিনের পর দিন, বহু বাঙালি নারীকে কতকগুলি চিহ্নিত সেনা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশের মানুষ ক্রোধে-ক্ষোভে পাথর হয়ে ফেরদৌসীর কাছে শােনেন, কীভাবে আটক নারীদের নগ্নদেহে থাকতে হতাে, যাতে তারা পালাবার কথা না ভাবেন, আত্মহত্যা করার ভাবনাও তাদের না থাকে। শুধু তারা নয়, দেশের মানুষ প্রথমবারের মতাে শুনতে পায় একজন ধর্ষণের প্রত্যক্ষ শিকার নারীর বাচনিক। পাকিস্তানি সেনারা কীভাবে বাঙালি নারীদের দলবদ্ধ ধর্ষণে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল, ইচ্ছামতাে হত্যা করেছিল ।
১৯৯০ দশকের শুরু থেকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত, অত্যাচারিত নারীদের বেরিয়ে এসে অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে উৎসাহ দেবার পর, কেউ কেউ এসে পাকিস্তানিদের যারা সহায়তা করেছিলেন, তাদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে মামলা। দায়ের করেন। দূর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্যি, যে অসম্মানিতা নারীরা দেশের মানুষের ডাকে লজ্জা বিসর্জন দিয়ে সন্ত্রমহানির বিষয়ে কথা বলে তারা যখন জনতার মঞ্চ থেকে বাড়ি ফিরে যান, দেখতে পান তাদের আপনজন ও জনগােষ্ঠী তাদের নিষ্ঠুরভাবে রাতারাতি বর্জন করে। যারা অপরাধী ছিল, আজও তাদের অনিষ্ট করবার ক্ষমতা যেহেতু বর্তমান, অনাচারের শিকার যারা, তারা তুলনামূলকভাবে দুর্বল – সৎ প্রতিষ্ঠানের আর কি করেইবা সাহস হয়, ঘুরে দাঁড়াবার? আমাদের হিসাবে তাই গরমিল থেকেই যায় বরাবরের মতাে। সে যাক, আমরা অষ্টম অধ্যায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের রায়-এ আলােকপাত করব।
হত্যা
“অধিকৃত বাংলাদেশ”-এ পুরাে নয় মাস জুড়ে পাকিস্তানি সেনারা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল । বাঙালী নারীদের কথা বলতে গিয়ে ডাঃ ডেভিস বলেন যে, ধর্ষণের শিকার যারা, তাদের মধ্যে কতজন সেনাবাহিনী সদস্যদের দ্বারা নিহত হয়েছিলেন, সে কথা বলা কঠিন। “পঁচাগলা, নগ্ন, ছিন্নভিন্ন পােশাক পরিহিত নারীর মৃতদেহ বাংলাদেশের বিভিন্ন আঁধার কোণে প্রায়ই পড়ে থাকতে দেখা যেত, যেগুলি খুন ও আত্মহত্যার প্রমাণ। দেশের দুর্গম এলাকাতেও যমুনা। নদীর গর্ভে মৃতদেহ পড়েছিল,”১০ ডাঃ ডেভিস ড. বীনা ডি’কস্টাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন । স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই এ ধরনের মন্তব্য শােনা গিয়েছে, যদিও এসব ঘটনা ঘটেছে, তার ব্যাপকতা বা সহিংসতার শিকার নারীদের সংখ্যা বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা করা সম্ভব নয়।
যে দানবিক গর্ব ও পৌরুষের ধ্বজাধারী পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা হিংস্র অনাচার, খুন ও তিলে তিলে কষ্টের মধ্যে দিয়ে আটক নারীদের ওই কয়েকটি মাস নিয়ে যায়, তার রকমফের বিষয়ে নানা সত্য কাহিনী লােকের মুখে মুখে ঘােরে। অল্পবয়সী বন্দীদের বারবার ব্যবহারের জন্য বাঁচিয়ে রাখা হতাে। এটা চালু থাকত যতদিন পর্যন্ত তারা সেবা দিতে পারত। যখন বােঝা যেত যে বন্দিনী হয় গর্ভবতী হয়ে পড়েছে অথবা কোনাে যৌন রােগে আক্রান্ত হয়েছে, তথন সেনারা ধরে নিতেন যে এসব বন্দিনী সেবা প্রদানে অক্ষম হবেন। যদিও এর কোনাে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই, বন্দি অবস্থায় সেবা প্রদানে ব্যর্থ হলে তার কী হয়েছিল সে সম্পর্কে নানা গল্প। প্রচলিত আছে।
আরও জনশ্রুতি রয়েছে কীভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি নারীদের পণ্য হিসাবে ব্যবহার করেছে পুরাে নয় মাস। স্পষ্টত বারবার ব্যবহারে তাদের মূল্যমান হ্রাস পেয়েছে। শােনা কথায় জানা যায়, সে অবস্থায় নারীর ধর্ম বিশ্বাসের ওপরে তার ব্যবস্থাপনা নির্ভর করত। বন্দিনী মুসলমান হলে, অনেক ক্ষেত্রে তাকে ছেড়ে দেয়া হতাে; হিন্দু হলে তাকে পুনঃ পুনঃ ধর্ষণ করে তারপর খুন করা হতাে। অধিকৃত বাংলাদেশ” এভাবে কতজন নারীকে হত্যা করা হয়েছিল, তার কোনাে পরিসংখ্যান নেই।
আত্মহত্যা
যদিও আত্মহত্যা অবমাননাকর তবুও মর্যাদাহীন অনেক নারী সে শশাচনীয় সময়টিতে আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনের জ্বালা জুড়ােবার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন স্থান থেকে কুড়িয়ে পাওয়া মৃতদেহ থেকে স্পষ্টত বলা যায় যে, আত্মহত্যা ঘটেছে কারণ বাংলাদেশি সমাজে ধর্ষিত নারীদের কোনাে ঠাই নেই। তাছাড়াও নিত্যকার অপমান ও লজ্জার হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য ধর্ষিতারা নিজের প্রাণ নিজের হাতে শেষ করে দিতে কখনাে দ্বিধাবোেধ করেননি।
কেন এবং কীভাবে ধর্ষণের শিকার নারীরা নিজেদের ও গর্ভস্থ সন্তানের জীবন শেষ করার কঠিন সিদ্ধান্ত নেন, সেটা বুঝতে হলে বাংলাদেশি সমাজে পুরুষ ও স্ত্রীর ভূমিকা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পােষণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী বিষয়টি অনুসরণ করতে হবে। ধর্ষিতার পক্ষে গর্ভমােচন সম্ভব না হলে আত্মহত্যা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। বন্দি অবস্থায় কোনাে নারীর আঘাত লেগে থাকলে বা শারীরিক ক্ষতি হলে বাংলাদেশি সমাজে নারীকে সেজন্য দোষী করা হয়। বাস্তবিকপক্ষে, যেসব নারীকে পাকিস্তানিরা ধর্ষণ করে আটক রেখেছিল এবং পরে ছেড়ে দিয়েছিল, তারা সমাজে অদৃশ্য হয়ে যায়। বারংবার ধর্ষণের শিকার এসব নারী লুকিয়ে থেকেই আত্মহত্যা করে তাদের সমস্যার ইতি টানে। যুদ্ধের পর বহুদিন পর্যন্ত যেখানে সেখানে মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। এসব মৃতদেহ আত্মহত্যার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষর বহন করে ।
বহু ধর্ষণের শিকার নারীরা সে সময়ে নিজেদেরকে বাংলাদেশের ‘পতিত নারী’ হিসেবেই দেখেছেন। বলা যেতে পারে, এ বেদনাদায়ক পরিস্থিতিতে ধর্ষিত ও একাকি নারী কোনােদিকে কোনাে সহায়তা না পেয়ে আত্মহত্যাকে সহজ উপায় ভেবে নিয়েছিলেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ১৯৭১ সালে নারীর আত্মহত্যা নির্দেশক কোনাে তথ্যাদি নেই । যেসব সংখ্যা আমাদের জ্ঞানগােচরে আসে সেগুলাে মনে হয় অতিরঞ্জিত ও বাড়িয়ে বলা।
ডাঃ ডেভিস দাবি করেন যে, ধর্ষণের শিকার নারীদের সঙ্গে কেবল কথা বলেই তিনি জানতে পেয়েছেন যে, তারা পুনঃ পুনঃ অগণনবার ধর্ষিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, তারা অধিকাংশ সময়ই আধপেটা খেয়ে বেঁচে ছিলেন। চিকিৎসা পাননি বলে অনেকেই অসুস্থ হলে কেবল জীবনাবসানের জন্য অপেক্ষা করতেন। সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই ছিল কেমন যেন অবিশ্বাস্য এবং অবাস্তব মনে হয়েছিল । আত্মহত্যা সম্পর্কে ডাঃ ডেভিস একদম খােলাখুলিভাবে এভাবে মন্ত ব্য করেন: “ঐ সব ক্যাম্পে অনেকে মারা গিয়েছে । কেমন যেন অসম্ভব মনে হতাে সব! যেটা ঘটছিল, তা যেন বাস্তব ঘটনাবলিও নয়! কিন্তু প্রমাণাদি পরিষ্কার দেখাচ্ছিল যে ওসব ঘটছিল।”১১
১৯৭২ এর জানুয়ারি এবং এপ্রিল মাসের মধ্যে আত্মহত্যার বিষয়ে যে দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, তাতে ২০০ জন নারীর আত্মহত্যার উল্লেখ রয়েছে। ডাঃ ডেভিস ও তার সহকর্মীদের নিকট ২০০ আত্মহত্যার হিসেবটি গ্রহণযােগ্য মনে হয়েছে। তাদের মতে, যুদ্ধের পর পরিবারের ভালাের জন্য তারা মনে করেন আত্মহত্যার বিষয়ে সকলেই একটু রক্ষনশীলতার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। খুনখারাবির তদন্তে যাতে বেশি জানাজানি হয়, আত্মহত্যাকে নিরাপদ ‘Way Out’ ভাবা হতাে (অর্থাৎ অনেকে বাঁচা গেল, বাবা,’ বলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন)।
ডাঃ ডেভিস এমন অনেক অল্পবয়সী (১২-১৩ বছর বয়সী) মেয়েদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পেরেছিলেন, যারা নগ্ন অবস্থায় দলে দলে অবস্থান করত। তাদের থেকে সে করুণাবস্থার কথা নিজ কানে শুনেই ডাঃ ডেভিস বলেন: “যাতে পালাতে না পারে, তাদের পরনের শাড়ি খুলে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হতাে”। আরও মর্মান্তিক বিষয় যে, তাদের শাড়ি দেয়া হলে কয়েকজন ঐ শাড়ি দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। অনেকে শাড়িতে পাথর বেঁধে নিয়ে পুলের ওপর থেকে নিচে নদীতে ঝাপ দেন” ।* লজ্জা ও দুঃখে তারা আত্মহত্যার কথাই সবচেয়ে প্রথমে ভেবেছিলেন ।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে “অধিকৃত বাংলাদেশ”-এ ১৯৭১-এর নয় মাস এবং স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালেও যেসব বিদেশি সাংবাদিক এবং রিপাের্টার বাংলাদেশে আসেন, তারা ধর্ষণ, যৌনদাসত্ব এবং জবরদস্তি বেশ্যাবৃত্তি বিষয়ক কোনাে প্রতিবেদনের ওপরও তেমন কাজ করেননি। যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় সাংবাদিক ও প্রতিবেদকেরা সর্বদাই বলেছেন, কেবল বাংলাদেশি নারীরা বিপুল সংখ্যায় ধর্ষিত হচ্ছে। ব্যস, ওই পর্যন্ত।
জবরদস্তিমূলক গর্ভধারণ
আমরা লক্ষ্য করেছি ধর্ষণের যারা শিকার হয়েছিলেন, তাদের যেহেতু কোনাে সত্য-নির্ভর সংখ্যা পাওয়া যায় না, স্বভাবতই কতজন ধর্ষিতা গর্ভধারণ করেছিলেন সে হিসাব বের করা আরও কঠিন কাজ। ডাক্তারদের মধ্যে এ বিষয়ে দ্বিমত ছিল না। ১৯৭২ এর প্রথম তিন মাস তাদের অন্তঃসত্ত্বা হবার কোনাে সম্ভাবনা ছিল। নানাবিধ সূত্রের মাধ্যমে জানা যায় যে, বন্দিনী। বাঙালি নারীদের জোর জবরদস্তি গর্ভধারণে বাধ্য করা হয়েছিল এবং অনেককে যৌনদাসী হিসাবে আটক রাখা হয়েছিল । একাত্তরের ধর্ষিতাদের মধ্যে প্রথম জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করা নারী প্রিয়ভাষিণী, যার কথা আমরা একটু আগেই উল্লেখ করেছি, তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা বলেন। ১৯৯৯ সালে সংবাদমাধ্যমের সামনে তার নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য। প্রদান করতে গিয়ে তিনি কিছুই রেখে ঢেকে বলেননি।
এক কথায় বলতে গেলে, যা শােনা যায়, তার সবই ঘটেছিল। মিলিটারি ক্যাম্পগুলিতে অসহায় নারী বন্দীদের পালিয়ে কোথাও যাওয়ার সুযােগ ছিল না। ঢাকা এবং এর সংলগ্ন এলাকাসমূহ ছাড়াও অন্যান্য কয়েকটি জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত বহু ক্লিনিক ও পুনবসিন কেন্দ্র ভ্রমণ ও পরিদর্শন শেষে ডাঃ ডেভিস বেশ নিশ্চিত ছিলেন যে, গর্ভধারণের সংক্রান্ত ইস্যুগুলির সম্যক চেহারা কেমন হতে পারে ।
ধর্ষণের শিকার বহু নারীকে পরীক্ষার পর ডাঃ ডেভিস অবশেষে বলেন, ১৯৭১ এর সেনা আক্রমণ ও দখলদারিত্বের পর প্রায় ৪,০০,০০০ নারীর সঙ্গে বলাকারের ঘটনা ঘটেছিল। তিনি আরও মন্তব্য করেন যে ২০০,০০০ নারীর গর্ভধারণকে বেশ কম করেই হিসাব করা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নানা সূত্রের মাধ্যমে আমরা এও জানি যে এটা হয়েছিল এজন্য যে, সে সময়ে যে অগণিত নারী নিখোঁজ হয়েছিলেন তারাও এ হিসাবের আওতাধীন ছিলেন। অনেক পরিবার নিরুদ্দিষ্ট নারীদের বিষয়ে অত্যাচারের ভয়ে কোনাে খোঁজখবর করেননি; আবার তার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কোনাে কোনাে পরিবার তাদের মহিলা সদস্যের নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদটি পুরােপুরিভাবে গােপন রেখেছিলেন, যেটা আমরা ইতােমধ্যে উল্লেখ করেছি।
এ প্রসঙ্গে ডাঃ ডেভিস আরও বলেছিলেন যে, এ হিসাবে দখলদার সেনাবাহিনী গ্রামের দখল নেবার সময় যে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়, সে সংখ্যাটাও যােগ করা হয়নি। এ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করে ডাঃ ডেভিস উল্লেখ করেন যে, “যেহেতু দেশের এক-তৃতীয়াংশ গ্রাম। দখলদারবাহিনীর জওয়ানদের দ্বারা পিস্ট হয়েছিল, যে কারণে এক বিপুল সংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকবারই কথা, যদিও গর্ভধারণের ঘটনা সে তুলনায় কম। বাস্তবিকপক্ষে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে পৌঁছানাের পর যেসব গর্ভবতী নারীকে তিনি পরীক্ষা করেন, তারা তখন কমপক্ষে আট সপ্তাহের গর্ভবতী ছিলেন। এ সম্বন্ধে বর্তমানে তুলনা করার আর কোনাে পরিসংখ্যান নেই । একথা বলা নিঃষ্প্রয়ােজন যে, সামরিক শাসনের সময়ে খবরের কাগজে যাচাইযােগ্য কোনাে গর্ভধারণ সংখ্যা দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে একথা সত্য যে, যৌন সহিংসতার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল একাধিকবার । ধরে নেয়া যেতে পারে যে, যৌনাচারের ফলাফল সাধারণ ঘটনার মতােই ঘটেছিল।
আবার আরেক হিসাব অনুযায়ী ডাঃ ডেভিস-এর মতামত যে ৩,০০,০০০ ধর্ষণের শিকার ১২-১৩ বছর বয়সী নারীদের বছরে শতকরা ৩ ভাগ বৃদ্ধি ঘটলেও ধরে নেয়া যেত তাদের অর্ধেক গর্ভবতী ছিলেন। অর্থাৎ এ গ্রুপে ১,৫০,০০০ জন নারী। যেমনটি বলা হয়েছে, ধর্ষণের শিকার নারীদের অনেককে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। কারণ তাদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়াতে ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে পড়ছিল। তাদের অনেকেই সেবা দিতে অপারগ হয়ে। পড়েছিলেন কারণ তারা নানাভাবে যৌনরােগে আক্রান্ত ছিলেন। ডাঃ ডেভিস আবারও আরেক হিসেবের কথা উল্লেখ করে মন্তব্য করেন যে, ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে প্রতি জেলায় গর্ভধারণের সংখ্যা বেড়ে ১৫০০ তে দাঁড়িয়েছিল।” সে যা হােক, ডাঃ ডেভিস-এর মতে, তিনি যেসব জেলায় গিয়েছিলেন, সেসব জায়গায় “অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের ঘটনা তার হিসেবের তুলনায় কম ছিল।”
ধর্ষণের সংখ্যার নমুনা এবং ধারা দেখে এ কথাও অনুমান করা হয়েছে যে, যদি সেনাবাহিনী শহর ও গ্রামে কিছু এলাকায় আরও দীর্ঘতর দিনের জন্য অবস্থান করত, সৈন্যরা আরও বেশি। মাত্রায় অপরাধ সংঘটন করত। তাতে গর্ভধারণের সংখ্যা হয়তাে আরও বাড়ত। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, “যদি ৪৮০টি থানার অর্ধেকে প্রতি থানায় ১৫০০ গর্ভধারণের সংখ্যা ঐ অতিরিক্ত সময়ে বেশি সেনা নিয়ােগের কারণে স্বীকার করে নেয়া হয়, তাহলে ৩৬০,০০ গর্ভধারণের ঘটনা ঘটত”।* ডাঃ ডেভিস অবশ্যই এ রকম যুক্তির সঙ্গে তখন একমত পােষণ করেন। আবার এটাও ডাঃ ডেভিস-এর এক হিসাবে ছিল যে, অধিকাংশ অত্যাচারিত গর্ভবতী নারীর যত্ন নিতেন গ্রামের ধাই অথবা হাতুড়ে চিকিৎসক। যার ফলে অতি অল্প সংখ্যক নারীই শেষ পর্যন্ত গর্ভধারণ করেছেন। এটাই ছিল মােটামুটিভাবে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের চিত্র যখন তিনি বাংলাদেশে আসেন । অবাক হবার কিছু নেই, তিনি যখন প্রত্যন্ত গ্রামে সফর করেন, তখন তিনি “অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের সংখ্যা একটু কমই দেখেন, অর্থাৎ ঢাকায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধিদের প্রথম সাক্ষাতে যে নির্দেশ পান তার তুলনায় পল্লি এলাকায় গর্ভধারণের সুখ্যা কম দেখেন। ডাঃ ডেভিস বাংলাদেশে আসেন ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, আর যৌন সহিংসতা শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে । ধর্ষণের শিকার মায়েরা প্রকৃতপক্ষে শিশু প্রসব করতে শুরু করেন ১৯৭১ এর অক্টোবর মাস থেকেই । ডাঃ ডেভিস নিজেই বলেছেন: “যত নারী গর্ভধারণ করেন, তার অন্তত ১০% ভাগের স্বাধীনতার আগেই সন্তান প্রসব করার কথা।” এ কথা মনে রাখা প্রয়ােজন যে, ডাঃ ডেভিস পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য করেন ধর্ষিত নারীদের আশ্রম এবং হােম পরিদর্শনের পর । যে নারীরা ততদিনে ডাঃ ডেভিস-এর বাংলাদেশে আসার আগেই আত্মহত্যা করেছেন বা সেনাবাহিনীর সদস্যের দ্বারা খুন হয়েছেন সে নারীদের সম্পর্কে তিনি এর কিছুই জানার সুযােগ পাননি। আবার এটাও আমাদের মনে রাখা উচিত যে, যদিও প্রত্যেকটি জেলার তথ্য এবং সূত্র সরবরাহ করা হয়েছিল, ডাঃ ডেভিস পুরােপুরিভাবে প্রত্যেক জেলার রিপাের্ট সংগ্রহ করতে পারেননি। সুতরাং এখানে যুক্তিযুক্তভাবে মন্তব্য করা যেতে পারে যে, দেশের জন্য প্রযােজ্য হিসাব অনেক বেশি হবার কথা। ১৭টি জেলার মধ্যে অনেকগুলাে জেলার কোনাে সংখ্যা সেখানে গগনা করা হয়নি।
প্রসবকালে মৃত্যু
এ ধরনের তথ্যাদির কোনাে প্রমাণিত সংগ্রহ নেই, যদিও একথা সত্যি যে বহুসংখ্যক গর্ভবতী ধর্ষিত মা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সেই সংকটময় সময়ে চিকিৎসকের দল, মূলত যাদের কেবল জরুরি সহায়তা প্রয়ােজন সেটা দিতেই ব্যস্ত ছিলেন। এখানেও ডাঃ ডেভিসের কাছ থেকেই আমরা সবচেয়ে কাছের বর্ণনা পাই। তখনকার করুণ অবস্থা দেখে তিনি শিহরিত হয়ে উল্লেখ করেছিলেন, “দেশ জুড়ে বহুসংখ্যক কমবয়সী আকর্ষণীয়া তরুণী রয়েছে (সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাদামাটা মেয়ে খুঁজে ধর্ষণ করতে যাবে কেন?) যারা গ্রামে অল্পবয়সে গর্ভধারণ ও মােচনে অভ্যস্ত হয়েছেন, যার ফলে বর্তমানে তারা দীর্ঘ ও স্বল্পস্থায়ী জটিলতায় ভুগছেন। বড় ধরনের রােগে যারা ভুগছিলেন, তারা মারা গিয়েছেন। তাদের সংখ্যা কত জানা যায়নি।”
ডাঃ ডেভিস ছাড়াও তার সাথে ছিলেন আই পি পি এফ এর পরিচালক ডাঃ ম্যালকম পটুস। তিনি বাংলাদেশি এবং ভারতীয় চিকিৎসকদের পাশাপাশি কাজ করেন। সে সময়ে তারা কাজের চাপে এত ব্যস্ত ছিলেন যে, তাদের মতে, চিকিৎসকদের ওপর যে দায়িত্ব ন্যাস্ত ছিল, সে দায়িত্ব পালনে তাদেরকে পুরাে সময়টুকু মনােযােগ দিতে হয়েছে। তিনি তার অভিমত প্রকাশ করেন এটা বলে যে, অতিরিক্ত অর্থসংস্থান ও সময় ব্যয় না করলে মৃত শিশুর সংখ্যা নথিবদ্ধ করা কখনাে সম্ভব হবে না। নানা ব্যস্ততার চাপে সে সময়ে প্রসবকালে গর্ভবতী মায়ের অথবা নবজাতকের মৃত্যুর সঠিক হিসাব তাে দূরের কথা একটি আনুমানিক তালিকা। পর্যন্ত কেউ উপস্থাপন করতে পারেনি।
গর্ভমােচন
গর্ভমােচনের ঘটনা কত, এটা বুঝতে হলে আমাদেরকে শুরুতে স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশি সমাজে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ককে কীভাবে দেখা হয়। তাতে এমনকি দুপক্ষের সম্মতি থাকলেও সেটা পাপ বলে গ্রাহ্য করা হয়। একইসাথে জন্ম নিয়ন্ত্রণকে বিভীষিকা এবং গর্ভমােচনকে শিশুহত্যার শামিল ভাবা হয় । একথা নিঃষ্প্রয়ােজন যে, পশ্চিমা বিশ্বের একেবারে উল্টো অভিজ্ঞতা হয় কেউ পূর্বদেশে এলে । পশ্চিমে আইনের চোখে অবৈধ শিশুকে অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা থেকে রক্ষা করতে হবে, এরকম আইনি সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশি সমাজ এখনও অবিবাহিতা মা ও তার শিশুকে বাঁকা চোখে দেখে। অতএব ধর্ষণের শিকার মায়েদের প্রথম ঐকান্তিক চেষ্টা ছিল, গর্ভস্থ সন্তানকে বিনষ্ট করা । ঐ সংখ্যা কত হতে পারে, তার কোনাে তথ্যই নেই। যদিও জবরদস্তি গর্ভধারণের চিত্রের সঙ্গে খাপ খাইয়ে গর্ভমােচনের প্রচেষ্টা চলেছে নিরন্তর, এ কথা বলাই বাহুল্য। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে গর্ভমােচন ৩১২ ও ৩১৩ ধারা (দন্ডবিধি ১৮৬০) দ্বারা। নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত ছিল। উল্লিখিত আইনের মূল সারাংশ ছিল এরকমঃ কেউ নারীকে গর্ভমােচনে রাজি করালে, যদি তাতে নারীর প্রাণরক্ষা না ঘটে, তাহলে সেটা শাস্তিযােগ্য অপরাধ হবে। কিন্তু সে সময়ে আইনে ফাঁক থাকায় (এবং নানা ধরনের ব্যাখ্যাদানের সুযােগ থাকাতে) নতুন স্বাধীন দেশে কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক প্রমাণ করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দেশজুড়ে গর্ভমােচন সেবার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠার কারণে ডাঃ ডেভিস। সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব জনাব রুহুল কুদুসের সঙ্গে দেখা করে ডাঃ ডেভিস পরিস্থিতি পর্যালােচনা শেষে মুজিব প্রশাসনকে দন্ডবিধি সংস্কারের প্রয়ােজনীয়তার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। ধর্ষিত নারীদের জন্য গর্ভমােচন যেহেতু অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় সেবা হিসাবে বিবেচিত ছিল। সেজন্য মুজিব প্রশাসন সাথে সাথে প্রচলিত দন্ডবিধির সংস্কার করতে রাজি হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের শুরুর দিকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রাসঙ্গিক দন্ডবিধির সংশােধন করা হয় । ডাঃ ডেভিস তার মাঠ পর্যায়ের কাজে গিয়ে সাথে সাথেই বুঝতে পেরেছিলেন যে ধাত্রী ও হাতুড়ে চিকিত্সকরা সে বছর ব্যাপকভাবে গ্রামাঞ্চলে গর্ভমােচনের কাজ করেছিলেন। এ বিষয়ে তিনি বেশ শঙ্কিত ছিলেন। কারণ তার মতে, বিষয়টি তেমন বিপজ্জনক না হলেও শরীর ও স্বাস্থ্যের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত ও জটিলতা সৃষ্টির প্রবণতা হালকা করে দেখার মতাে নয়।
বাের্ড অবশ্য এ ব্যাপারে বারবার নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, সরকার যেহেতু গর্ভমােচণের পক্ষে, তাদের কর্মীদের এ সমর্থনপুষ্ট পরিবেশে কাজ করতে অসুবিধে হবার কথা নয়। তবুও দেখা গেল প্রকৃতপক্ষে বহু চিকিৎসক ও সেবিকা এ বিষয়ে যেসব কথাবার্তা হচ্ছিল তা সমর্থন করেননি। অনেক স্বাস্থ্যপেশাজীবী নৈতিক, আইনি ও নীতিগত প্রশ্নে বদ্ধপরিকর ছিলেন তাই অনেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। সরকার আশা করেছিলেন যে সে সংকটাবস্থায় সবাই তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অবিলম্বে গর্ভমােচনের বিষয়ে সহায়তা করবেন। কিন্তু মৌলিক প্রশ্নটির বিষয়ে অনেকে আপত্তি ও ভিন্নমত পােষণ করার জন্য গর্ভমােচনের কাজে অনেকে সম্পৃক্ত হতে চাইনি। যার ফলে কাজটিতে অনেক বিঘ্নতা ঘটে।
গর্ভমােচনের বিষয়ে প্রতিটি জেলা থেকে আসা ডেপুটি কমিশনারের সই স্বাক্ষর, সিভিল সার্জনের দাপ্তরিক সিল, জন্ম নিয়ন্ত্রণ আধিকারিক কর্তৃক সই করা চিঠিপত্র হচ্ছে নির্ভরযােগ্য তথ্যের উৎস। যারা এখনও জীবিত, তাদের কারাে কারাে সঙ্গে যােগাযােগ করা সম্ভব হয়েছে। যেমন, ডাঃ হালিদা হানুম আখতার এবং ডাঃ মােহাম্মদ এ বাসেদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে যা কিছু জানা হয়েছে তাদের ভাষ্যমতের সাথে আই পি পি এফ এর দলিলাদি নিরীক্ষা করে সেসবের সাথে যথাযথ প্রামাণিকতা যাচাই করেই এ বিষয়ের তথ্যাদির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । ডাঃ ডেভিসের সঙ্গে বেশ সংখ্যক বাঙালি ও বিদেশি এনজিও কর্মী, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসােসিয়েশন এর স্থানীয় শাখার প্রতিনিধিবৃন্দ দেশি পদ্ধতিতে গর্ভমােচনের বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। কিন্তু কেউই মােট কত গর্ভমােচন ঘটানাে হয়েছিল, তার কোনাে হিসাব দিতে পারেননি।
গর্ভমােচন বিষয়ে আরেকটি সুশিদিত তথ্য যেটা বিভিন্ন পারিবারিক সূত্র থেকে আলাপ আলােচনায় জানা গিয়েছিল, সেটা হলাে, সেনাদের উপস্থিতির মধ্যেই ধর্ষণের শিকার পরিবার চুপি চুপি ভারতে গিয়ে গর্ভমােচন করিয়ে আবার ফিরে আসার কথা। ভারতীয় খবর সূত্রে পাওয়া এবং চিকিৎসা পেশাজীবীদের কাছ থেকে এ বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়। বিশেষ করে যখন তারা সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে ফিরে আসেন ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে। ১৯৭২-এর শুরুতে। স্বাধীনতার পরও অনেক পরিবারে গােপনে এটা চালু ছিল। এ সম্পর্কে কোনাে প্রামাণিক দলিলাদি নেই বা থাকার কথাও নয়। এ সবের একটিই সূত্র, সেটা হলাে জনশ্রুতি।
তখনকার খবরের কাগজে এ বিষয়ে যাদের সাক্ষাৎকার ছেপেছিল, তাদের মধ্যে বিচারপতি কে এম সােবহান, বাের্ডের চেয়ারপার্সন, সিস্টার মার্গারেট ম্যারি, সুপিরিয়র, মিশনারিজ অব চ্যারিটি, ডাঃ জেফ্রি ডেভিস, আই পি পি এফ কর্মী (যার রিপাের্টের উপর ভিত্তি করে আমরা এ পর্যন্ত যতটুকু সম্ভব জেনেছি) এবং ওডেট ঋণ শুলজ। গর্ভমােচনের সংখ্যা তুলনা করলে একথা বলা যায় যে, উপরােক্ত ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকারে যেসব পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়েছে সেসব অনেকাংশে অতিরঞ্জিত করেই বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ডাঃ ডেভিস এর মন্তব্য: “যে ২০০,০০০ গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল, তাদের মধ্যে ১৫০,০০০ থেকে ১৭০,০০ জনের গর্ভমােচন করা হয়েছিল অত্যন্ত অনাকাক্ষিত পরিবেশে, তড়িঘড়ি করে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টায় । এ কথা নির্ধারিত সত্য যে, ১৯৭২ সালে যেসব বিদেশি চিকিৎসকেরা ঢাকায় আসেন, তারা বিভিন্ন ক্লিনিক, মাত সদন ও সেবা সদগুলোতে ধর্ষিত নারীদের সহায়তায় কাজ করেছেন। তারা নিজেরাই গর্ভমােচনের চাক্ষুষ |F)। সে সময়ের গণমাধ্যমের সুযােগে পৃথিবীর তাবৎ লােকই এ বিষয়ে কম-বেশি জানতে পারে। যথাযথ তথ্যাদির অভাবে এ বিষয়ে সংখ্যাকরণ একেবারেই সম্ভব নয়। তবু ও আমরা ৬৫ ডেভিস এবং অন্যান্যদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সে সময়ের ঘটনার ধারাবাহিকতা, সরকারের সর্বাত্মক চেষ্টা এবং ধর্ষিত নারীদের সার্বিক অবস্থা ও ব্যবস্থাপনার চিত্র আমরা দেখতে পাই।
যুদ্ধশিশুদের জন্ম, মৃত্যু, পরিত্যাগ ও দত্তকগ্রহণের ঘটনা
বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযােগ্য ও অধিক সংখ্যক দুপ্রাপ্য ঐতিহাসিক নথিপত্র ও দলিলাদি সংরক্ষিত রয়েছে “মাদার তেরেসা’র হােম” বা মিশনারিজ অব চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানের ঢাকা অনাথ আশ্রম ‘শিশু ভবন’ । বাংলাদেশ এ প্রতিষ্ঠানের নিকট যুদ্ধশিশুদের সম্পর্কে নানা তথ্য ও দলিল সংরক্ষণ বিষয়ে ঋণী। বহু পরিত্যক্ত শিশু মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টারেরা উদ্ধার করেন এ আশায় যে, দত্তক নিতে আগ্রহী মা-বাবা তাদের গ্রহণ করে আপন সন্তানের মতাে যত্ন-আদরে মানুষ করবেন । অক্টোবর ১৯৭১ থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৭২ এর মধ্যে বাংলাদেশে জন্ম নেয়া যুদ্ধশিশুদের জন্ম, মৃত্যু, পরিত্যাগ ও দত্তকগ্রহণের ঘটনাগুলি জানতে হলে আমাদেরকে আরও নৈপথ্য কাহিনী এবং বাংলাদেশের নানাবিধ সামাজিক বাধা নিষেধের পটভুমির তথ্য সংগ্রহ ও তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে। তবেই আমরা অবিদিত যুদ্ধশিশুদের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পােষণ করতে পারি ।
বিদেশি সাংবাদিকদের বহু সাক্ষাৎকার থেকে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুদ্ধশিশুদের জনুগ্রহণ ও পরিত্যাগের এক ধরনের চিত্র আঁকা সম্ভব। যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, এই শিশুদের সম্পর্কে গভীরভাবে প্রােথিত কুসংস্কারের কারণে এরা ‘অবাঞ্ছিত’ হিসাবে পরিগণিত হয় তাদের নিজ জন্মভূমিতেই। সে কারণে ঘূণেধরা সমাজে ওদের কেউ ছুঁয়ে দেখতেও রাজি ছিল না। এ গর্ভধারণ ছিল জবরদস্তি গর্ভধারণে বাধ্য করা যেখানে গর্ভধারিণী নারীর মতামতের ধার কেউ ধারেনি। লুকিয়ে থাকার পর গর্ভধারিণীর শরীরে পরিবর্তন আসার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি আর গােপন রাখতে পারেননি। মৃত্যুর ভয়ে অনেকে গর্ভমােচনের কথা না ভেবে গর্ভধারণের অনিচ্ছা সত্ত্বেও পূর্ণ মেয়াদ পার করেন, সন্তানের জন্ম দেন এবং অনাকাক্ষিত নবজাতককে দত্তক প্রদান করেন, সবই একান্ত গােপনে।
যদিও তাদের সম্পদ ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল, শিশু ভবন ও অন্যান্য প্রসব কেন্দ্রের কর্মীরা তাদের কেন্দ্রে এমন সব অভাবিত ঘটনার মুখােমুখি হয়েছিলেন যে, সেগুলাে তাদের ভাবিয়ে তুলেছিল। সেবা সদন কেন্দ্রে এসে পৌছালে সকল হবু মাকে তাদের নাম জিজ্ঞাসা করা হতাে । অনাথ আশ্রমের কর্মীরা বলেন, সবার গর্ভধারণ, মােচন, জন্মদান ও নবজাতককে পরিত্যাগ করার বিষয়ে পর্যাপ্ত গােপনীয়তা রক্ষিত হবে, এমন আশ্বাস দেয়া হয়। পরের অধ্যায়ে আমরা দেখব মুজিব প্রশাসন কী ঘনিষ্ঠভাবে অনাথ আশ্রম ও অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করে জিজ্ঞাসা করাে না, কাউকে বলাে না” শীর্ষক নীতিমালা প্রণয়ন ও বস্তিবায়ন করেছিলেন।
সংক্ষেপে সিস্টারদের কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, সন্তানসম্ভবা কোনাে মহিলাকে কখনাে কোনাে ধরনের প্রশ্ন (যেমন- কোথায়, কখন এবং কীভাবে গর্ভধারণকরেন বা কে সন্তানের বাবা ইত্যাদি সম্পর্কে) যেন জিজ্ঞাসা করা না হয়; প্রত্যেক অন্তঃস্বত্তা মহিলাকেও নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল তাদের গর্ভধারণের বিষয়ে তারা কখনাে কোনাে প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন না । ঢাকাস্থ মিশনারিজ অব চ্যারিটির সুপিরিয়র সিস্টার ম্যারি তার স্মৃতিচারণে বলেন গর্ভবতী মাকে তার গর্ভস্থ সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে জিজ্ঞাসা করা যাবে না, ধর্ষণের শিকার নারী তার অবমাননা বিষয়ে কিছুই বলবেন না বা তাকে বলতে বাধ্য করার চেষ্টা করা যাবে না। এ ধরনের নিশ্চয়তাদানের জন্য সন্তানসম্ভবারা অনেক স্বস্তিবােধ করেন এবং গর্ভমােচনের পরিবর্তে সন্তান প্রসবের সিদ্ধান্ত নেন।
যুদ্ধশিশুদের জন্মের বিষয়টি ঘিরে এমন এক উদাহরণ তৈরি হয়েছিল, যেখানে মায়েরা গর্ভমােচনে ব্যর্থ হয়ে গর্ভধারণ কালকে টেনে পূর্ণমেয়াদে নিয়ে সন্তানের জন্ম দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। মিশনারিজ অব চ্যারিটি হােমের সুপিরিয়র এ ব্যাপারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তিনি যেভাবে একের পর এক চিকিৎসা ও মাতৃসদন পরিদর্শন করে তরুণী সন্তানসম্ভাব্যদের সন্তানের জন্মদানে উৎসাহ দিয়েছিলেন, সে এক কথায় অনবদ্য সকর্ম । সিস্টার ম্যারি। ধর্ষিতা ও অত্যাচারিতাদের মায়েদের খুঁজে বেড়াতেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাদের খোঁজ পেলে তিনি জানাতেন যে, যদি তারা চান তবে তারা নবজাতককে বেবি হােমগুলােতে ছেড়ে যেতে পারেন। সে বিষয়ে সম্পূর্ণ গােপনীয়তা রক্ষা করা হবে ।
সে সময়ে সিস্টার ম্যারির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মাথা স্থির রেখে নির্যাতিত নারীদের সাথে একান্ত গােপনে কথা বলা। যতটুকু সম্ভব সন্তানসম্ভবাদের আত্মহত্যা এবং গর্ভমােচনে নিরুৎসাহিত করা। অর্থাৎ তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন কোনাে সন্তানসম্ভবা মা তার নিজের বা সন্তানের মৃত্যু ঘটাতে তৎপর না হন। তাছাড়া যারা সেবা সদনগুলােতে গর্ভমােচনের লক্ষ্যে। সেবা নিতে আসেন তাদের সবাইকেও তিনি সময় নিয়ে বুঝিয়েছেন যে, মিশনারিজ অব চ্যারিটি সব শিশুর দায়িত্ব নেবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কয়েক সপ্তাহ কেটে গেলে মুজিব সরকার যুদ্ধশিশুদের ইস্যুটিকে চুড়ান্ত প্রাধিকার দিয়ে জেনেভা Intemational Social Service (ISS)-এর সঙ্গে যুগ্মভাবে কাজ করে একটি নিরাপদ প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করার কাজে ব্রতী হন, যেখানে ধর্ষিত নারীরা আশ্রয় পাবেন, এবং গােপনে সন্তান প্রসব করবেন। কয়েক সপ্তাহ খোজার পর ঢাকাস্থ আই এস এস প্রতিনিধি ধানমন্ডিতে ৩২ নং সড়কে একটি দোতলা বাড়ির সন্ধান পান। তিনি বাড়িটিকে “যথার্থ উপযুক্ত বাড়ি, বড় বড় ঘর, দুটি রান্নাঘর এবং পাঁচটি স্নানাগার বিশিষ্ট” বলে উল্লেখ করেন। তিনি এটাও জানান যে বাড়িটিতে গর্ভধারিণী ধর্ষিতাদের থাকতে দেয়া হয়েছিল।
প্রকৃত প্রস্তাবে বহু গর্ভবতী নারী গর্ভনাশের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন । আবার অনেকে ব্যক্তিগতভাবে গর্ভনাশের বিরােধিতা করেছেন। কিন্তু তাদের বেলায় ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে বলপ্রয়ােগপূর্বক গর্ভধারণ হয়েছিল, সে বিষয়টা নিয়েও অসহনীয় দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন। ভাগ্যক্রমে মাদার তেরেসা যখন কলকাতা থেকে ঢাকা এলেন, তিনি জানালেন, গর্ভবতী নারীর উচিত গর্ভধারণের পূর্ণ মেয়াদ পার করে সন্তান প্রসব করা, বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাগত জানান। অবশ্য বাংলাদেশ সরকার এবং মাদার তেরেসার দৃষ্টিভঙ্গিতে এ বিষয়ে অনেক পার্থক্য ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গর্ভনাশের জন্য কোনাে ধরনের চাপ ছিল না। সরকার গর্ভনাশ ও গর্ভপাতের সিদ্ধান্তটি অন্তঃসত্ত্বাদের উপর ছেড়ে দিয়ে দুবিষয়ে তাদের দায়িত্ব নেন।
সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, ১৯৭২-এর সে সংকটময় সময়ে সরকারের অবস্থান সুস্পষ্ট ছিল। যে মূল বাতাটা সরকার সংবেদনশীলতার সাথে নির্যাতিত নারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে খুব কৌশলে এবং বিচক্ষণতার সাথে গােপণীয়তা রক্ষার নিশ্চয়তা দিয়ে পৌঁছানাের চেষ্টা করেন, সেটার বক্তব্যটি ছিল এরকমঃ সরকারি নীতি অনুসারে যারা গর্ভমােচনের পক্ষে, তারা গােপনে গর্ভনাশে সরকারের সকল সহযােগিতা পাবেন । যেক্ষেত্রে গর্ভমােচন করার সময় থাকবে না, সেক্ষেত্রে গর্ভিনীকে সন্তান প্রসবে উৎসাহ দিতে হবে; নবজাতককে লিখিতভাবে পরিত্যাগ করে জন্মদাত্রী মা তাকে সরকারের প্রত্নে রেখে চলে যেতে পারবেন। তখন সেবা সদন, নারী পুনর্বাসন বাের্ড, শিশু ভবন এবং বেবি হােমের বাইরেও কিছু আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তােলা হয়েছিল। একদিকে বিষয়টির গােপনীয়তা রক্ষা করা, অন্যদিকে যতদূর পর্যন্ত সম্ভব এ উদ্যোগ সম্পর্কে তথ্য পৌছে দেয়ার মধ্যে যে দ্বন্ধ, সে। দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হওয়াতে সরকারকে যথেষ্ঠ সাবধানতার সাথে কাজ করতে হয়েছিল । এ বিশেষ সংবাদ বা সরকারের উদ্যোগটি সবার কাছে পৌছানাের বিষয়ে কিছু সমস্যা থাকলেও সরকার মােটামুটিভাবে বাংলাদেশের সর্বত্র এ সংবাদ পৌঁছাতে সফল হয়েছিলেন। সব মিলিয়ে সরকারের প্রতিষ্ঠানসমূহ অজানা সংখ্যক ধর্ষিতা ও অবমানিতা ও তাদের নবজাতকদের ১৯৭২ সালে আশ্রয় দিয়ে সন্তানসম্ভবাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের সাথে একমত হয়েই আশ্রম ও বেবি হােমের সবাই মিলে এক সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করেন।
এছাড়া মায়ের গর্ভে মৃত্যু হয়েছিল (স্টিল বার্থ) এমন শিশু, অপুষ্ট ও অপরিণত নবজাতকের সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না, যদিও এর কোনাে সঠিক হিসাব নেই। সেবা সদন ও শিশু ভবনে যারা ছিলেন, তাদের অনেকের প্রসবকালে জটিলতা দেখা দিয়েছিল। যার মধ্যে মায়েদের উচ্চরক্ত চাপের কেইস ও মেয়াদ পূর্ণ হবার আগেই শিশুজন্মের কারণে ঘটেছিল। আর প্রাথমিক পর্যায়ে এ ধরনের উদ্ভূত পরিস্থিতি মােকাবিলা করার পর শিশু ভবনের নথিপত্র পরীক্ষা করার সময় অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক ছিল। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, শিশুদেরকে যথাযথভাবে কোনাে বিশেষ সংজ্ঞায় অন্তর্ভূক্ত না করে তাদেরকে নানাভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন, এই শিশুদের কখনাে বলা হয়েছে “অনাথ,’ পিতৃমাতৃহীন, বেআইনি’, রাস্তায় পাওয়া’ ইত্যাদি। কাজেই নথিপত্র পরীক্ষার সময় যে বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হয়েছে তা হলাে শিশুটির জন্মের তারিখ ।
লক্ষনীয়, আমরা ভূমিকাতে যুদ্ধশিশু ও প্রাসঙ্গিক শব্দের (যেমন “অনাথ,” “পরিত্যক্ত শিশু” এবং “যুদ্ধশিশু”) পার্থক্য নিরূপণ করে যথাযথ ব্যাখ্যা রেখেছি। ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে যেসব ধর্ষিতা যুদ্ধশিশুকে গর্ভধারণ করেন সে শিশুরা ১৯৭১ এর অক্টোবর থেকে ১৯৭২’র সেপ্টেম্বরের মধ্যেই জন্মানাের কথা। এ সময়সীমার বাইরে জন্মালে ঠিক যুদ্ধশিশুর সংজ্ঞায় তারা পড়ে না। আমরা ইতােমধ্যে আলােচনা করেছি যে, যুদ্ধশিশুর বাইরেও রয়েছে পরিত্যক্ত শিশু, অনাথ, পিতৃমাতৃহীন শিশু, ইত্যাদি । এরা কেউই যুদ্ধশিশুর সংজ্ঞায় পড়ে না। এরা পাকিস্তানি সৈন্যদের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেনি। সে সময়ের খবরের কাগজের প্রতিবেদনে যুদ্ধশিশু নিয়ে যেসব তথ্য প্রকাশ হয়েছিল সেসব অনুযায়ী বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় নারী পুনর্বাসন বাের্ড কর্তৃক ১৯৭২ সালে যে ২২টি সেবা সদন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ শিশুর জন্ম হয়েছিল। অবশ্য একথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, এ সংখ্যার সাথে সরকারের নির্ধারিত পরিসংখ্যানের মিল রয়েছে ।
আমরা (তৃতীয় অধ্যায়ে) দেখব ফ্রেড ও বনি কাপুচিনাের নেতৃত্বে সর্বমােট পাঁচজন কানাডীয় ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ সফর করেন। তারা এ বিষয়ে অন্যতম তথ্যের উৎস। যখন দলটি কানাডা ছেড়ে বাংলাদেশে রওনা দেয়, সে সময় তাদেরকে বলা হয়েছিলঃ “প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৭২ সালে ৫,০০০ যুদ্ধশিশু জন্ম নেবে। পাকিস্তনিদের হাতে এদেশের মানুষ যে কষ্ট করেছে বলে শুনেছে, তাতে মনে হতাে ৫,০০০ একটা যুক্তিযুক্ত অনুমান ছিল”। ধর্ষণের শিকার নারী ও গর্ভবতী নাজীদের দেখতে অনাথ আশ্রম, ক্লিনিক, সেবা সদন, বেবি হােমস ও অত্যাচারিতা নারীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিদর্শনকালে সমাজকর্মী জেরিনা রশিদ কানাডীয় দলটিকে অবগত করেন এটা বলে যে, আগে যেমনটি ভাবা গিয়েছিল, প্রকৃতপ্রস্তাবে যুদ্ধশিশুর সংখ্যা এবং প্রাপ্যতা তার তুলনায় বেশ কম।
ডাঃ ডেভিসের সরাসরি মন্তব্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেও তাই মনে হবে । কানাডীয় টিমের ২১ দিনব্যাপী ঢাকা সফরের সময়ে তারা চট্টগ্রাম, বরিশাল ও পাদ্রিশিবপুরস্থ মিশনারিদের সঙ্গে কানাডীয় হােলি ক্রস ব্রাদার্স এন্ড সিস্টার্সের মাধ্যমে যােগাযােগ করেন মুখ্যত ফাদার বেঞ্জামিন লাবুবের মাধ্যমে । তিনি ছিলেন তদানীন্তন পরিচালক, ক্রিশ্চিয়ান অর্গানাইজেশন ফর রিলিফ এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন । তিনি ১৯৭১ সালে মাঠ পর্যায়ে বহু ধর্ষণের শিকার নারীর সঙ্গে সময় কাটিয়ে ছিলেন এবং তার অভিজ্ঞতার আলােকে টিমকে নানাভাবে পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনিও বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের সংখ্যা বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি।
সিস্টার ম্যারির সঙ্গে কথাবার্তা বলে কানাডীয়রা জানতে পারেন, বহু জন্মদাত্রী মা সন্তানদের লুকিয়ে রাখছিলেন, যেহেতু তারা তাদের গােপনে পরিত্যাগ করতে চান অথবা কেউ কেউ নবজাতককে পরিত্যাগ করতে চান না, হয়তাে বা রাখতে চান। যুদ্ধশিশু ও তাদের মায়েদের নিয়ে অনেক জনশ্রুতি থাকলেও কিছু প্রকৃত প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে । কানাডীয় প্রতিনিধিদলের নিজ চোখে দেখার বর্ণনাদিসমূহ থেকে আমরা জানতে পারি তারা কীভাবে আশ্রমের কর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে ধর্ষিত মা ও নবজাতকদের ব্যবস্থাপনা যা হচ্ছে সেটা। জেনে অস্বস্তিতে পড়েন । সিস্টার ম্যারি নিজে তার প্রতিষ্ঠানে বহু যুদ্ধশিশুর জন্ম দেখেছেন। তিনি বলেন যে, অনেক মায়েরা বিশেষ করে যারা সেবাসদন ও বেবি হােমের না এসে গােপনে অন্য কোথাও সন্তান প্রসব করেছিলেন সেসব পরিবার তাদের নবজাতককে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল; আবার জন্মকালে অনেক নবজাতকের মৃত্যু অহরহ ঘটেছে।
প্রায় পুরাে দুসপ্তাহ হন্যে হয়ে ঘুরে নানা সূত্র ধরে যেমন দেশব্যাপী আশ্রম কর্মীদের সাথে। আলাপের পর শেষ পর্যন্ত কানাডীয় টিম যুদ্ধশিশুদের জনসংখ্যা সম্পর্কে আরেকটু পরিষ্কার। ধারণা লাভ করে। সমাজকর্মী জেরিনা রশিদ তাদেরকে ইতােমধ্যে বলেছিলেন যে, বাস্ত বিকপক্ষে যুদ্ধশিশুর জন্মের সংখ্যা অনেক কম। এবার তারা সরকারি প্রতিনিধির মাধ্যমে আরও নিশ্চিত হলেন। যদিও অনুমান করা গিয়েছিল যে, ৫০০০ যুদ্ধশিশুর জন্ম হবে, স্বাধীনতার পরপরই সেটা নিশ্চিতভাবে নিরূপণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীকালে আই এস এস এর প্রতিনিধি বিষয়টিকে এ বলে নিশ্চিত করেন যে: “যুদ্ধশিশুদের সংখ্যা সঠিকভাবে জানা এজন্য সম্ভব নয় যে এর সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কলঙ্কের কথা যা প্রচারিত হয়, তাতে ধর্ষিত মা ও শিশুর সংখ্যা সঠিকভাবে জানার উপায় থাকে না।”২৬ স্বচোখে দেখে এবং নিজ কানে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুনে কানাডীয় টিম যুদ্ধশিশুর সংখ্যা গগনা বিষয়ে তথ্যানুসন্ধানের কোনাে প্রয়ােজন মনে করেননি।
মাদার তেরেসা, যাকে পরবর্তীকালে ভালােবাসা ও আশার দূত” নামে অভিহিত করা হয় এবং সিস্টার ম্যারি, যাকে “অবাঞ্ছিত” শিশুদের মা অভিধায় ভূষিত করা হয়েছিল, এদের দুজনেরই যুদ্ধ শিশুদের ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তারা প্রত্যক্ষভাবে নানা অনাথ আশ্রম ও মাতৃসদনের সঙ্গে কাজকর্মে জড়িত ছিলেন বলে এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এমনকি তারাও যুদ্ধশিশুদের নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখে অপারগ ছিলেন। ঐতিহাসিক সত্য হলাে, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকার ক্লিনিক ও বস্তি ঘুরে ঘুরে তারা জন্মদাত্রী মায়েদের মনে আশার সঞ্চার করে তাদের। নবজাতককে পরিত্যাগে রাজি করান, বিনিময়ে মায়েদের দেয়া হয় সম্পূর্ণ গােপনীয়তার আশ্বাস ।
মৃত্যু লক্ষণীয় যে, সে সময়ে সংবাদ মাধ্যমগুলি নিরন্তর প্রয়াস চালিয়েছে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে। যুদ্ধশিশুদের জন্ম ও মৃত্যুর উপর খোজ খবর রাখা ও বস্তুনির্ভর সংবাদ সরবরাহ করার। ১৯৭২ সালের সম্পূর্ণটা জুড়েই এরকম নানা গুজব ছড়ানাে হয়েছে যে, লজ্জা ও সভ্রম রক্ষার। চেষ্টায় পরিবারের নিকট আত্মীয় ও বান্ধবেরা ব্যাগে বা বস্তায় নবজাত শিশুকে নিয়ে দূরে। কোথাও মাটিতে পুঁতেছে। এসবের কিছু কিছু অতিশয়ােক্তি হতে পারে, তবে সবটা নয়। শিশুদের কবর দেবার পর কোনাে চিহ্ন রাখা হয়নি। আরও শােনা গিয়েছে, শেষকৃত্য ‘ সম্পাদনে ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করা হয়নি, অনেক মৃতদেহ কেবল কাপড়ে মুড়ে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে চাপা দেয়া হয়েছে অথবা নিকটবর্তী নদী ও খালবিলে ফেলা হয়েছে। এ রকম খবর অহরহ কাগজে উঠেছে এবং স্বাভাবিকভাবে লােকজনের জ্ঞানগােচরে এসেছে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
তথন প্রায়ই রাস্তাঘাটে আংশিক ও পুরােপুরি বিনষ্ট ক্ষুদে মানুষের মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছিল। আমরা শুরুতে ডাঃ ডেভিস এর নাম উল্লেখ করেছি। তার ভাষ্য অনুযায়ী তিনি গর্ভবতী নারীদের গর্ভমােচনে সাহায্য করার সময় দেখেছেন অনেক অন্তঃসত্ত্বাদের গর্ভমােচনের সময় ছিল না। তিনি তখন তাদের অন্যবিধ সহায়তা দিয়েছিলেন, যাতে তারা বাঁচে এবং সন্তান। প্রসবে সমর্থ হয়। তিনি বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছিলেন যে, মায়েদের ওপর প্রচন্ড মানসিক চাপের দরুণ বাধ্যতামুলক গর্ভধারণে শিশুর জন্য ক্ষতিকর অভিঘাত বয়ে এনেছিল – অল্প ওজন নিয়ে জন্মানাে তার মধ্যে একটি।
মুমুর্ষ অবস্থায় যুদ্ধশিশুদের জন্ম এবং জন্মের পরপরই তাদের মৃত্যুর বিষয়েও অনেকে অনেক মন্তব্য করেছেন তাদের নিজ নিজ পর্যবেক্ষণ থেকে । চিকিৎসা পেশাজীবীদের মতে, মেয়াদের আগে জন্ম নেয়া শিশুদেরও কোনাে হিসাব নেই, যেমনটি নেই নানাবিধ জন্মক্ষত বা মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুর । অত্যাচারের শিকার নারীদের এবং সেনাবাহিনীর ভয়ঙ্কর অত্যাচারের চরম প্রত্যক্ষ করে অনাথ আশ্রমের কর্মীবৃন্দ যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন কীভাবে বেশিরভাগ জীবনরক্ষা করা যায়। যারা শিশু ভবন ও অন্যান্য প্রসূতি কেন্দ্রে কাজ করেছেন ভুলতে পারেন না সে ভয়ঙ্কর রাতগুলাে যখন তারা নবজাতকের শয্যাপার্শ্বে বিন্দ্রি, আলােহীন, আশাবিহীন সময় কাটিয়েছেন।
যুদ্ধশিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা নির্ণয় না করতে পারলেও কানাডীয় দলের সদস্যরা অনাথ আশ্রমে প্রত্যক্ষ করেন মর্মবিদারী সব দৃশ্য। সেগুলাে দেখে তারা যেসব মন্তব্য করেন সেগুলাে থেকে আমাদের ধারণা অনেকটুকু পরিষ্কার হয়। মােটের ওপর, কর্তব্যরত কর্মীদের নিষ্ঠা, তা সে। সেবা সদনে হােক অথবা অনাথ আশ্রমে, তাদের দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন, নামমাত্র ওষুধপত্র, সরবরাহের দ্বারা অধিকাংশ কম ওজন নিয়ে জন্মানাে শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা একটি মস্তবড় চ্যালেঞ্জ। তারা দেখেছেন অকালে জন্ম নেয়া নাজুক শিশুরা এতই দুর্বল ছিল যে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই বা কয়েকদিনের মধ্যেই এদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করে।
নবজাতকদের নানা অসুস্থতা, যেমন- কানে প্রদাহ, নিউমােনিয়া, ফোড়া, ফাংগাল প্রদাহ, ইত্যাদির কারণে সিস্টার ও অন্যান্য কর্মীরা অস্বস্তিতে পড়েন, কারণ ওদের চিকিৎসা করার। মতাে প্রশিক্ষণ তাদের ছিল না। নার্সদের কেবল কিছুটা সক্ষমতা ছিল। কোনাে কোনাে। নবজাতকের ফুসফুসে প্রদাহ ছিল, যা দেখে কর্তব্যরত সেবাকর্মী ঘাবড়ে যাচ্ছিলেন। অন্যান্যদের অবস্থাও যথেষ্ট খারাপ ছিল । আবার অনেক সুস্থ শিশুরাও নিউমােনিয়ায় আক্রান্ত। হবার পথে ।
যেহেতু এ বিষয়ে কোনাে কোনাে দাপ্তরিক নথিপত্র নেই। তাই মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায়, সবচেয়ে নিকৃষ্ট পরিবেশে যে যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়েছিল, অনেক সময় তাকে ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবার যত্ন ও সেবাটুকু দেয়া সম্ভব হয়নি। নিস্তেজ, দুর্বল ও স্বাস্থইনি অকালীয় নবজাতকদের জন্ম-মৃত্যুর দ্রুততা দেখে সিস্টার ম্যারি নিজে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, তাদের অবস্থার উন্নতির সম্ভাবনা আদৌ নেই। ১৯৭২-এর জুন মাসে এক সাক্ষাৎকারে তিনি সদ্যপ্রসূত শিশুদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে “নবজাতকেরা আরও কয়েক মাসব্যাপী মৃত্যুবরণ করতে থাকবে।” শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সিস্টার ম্যারির আশঙ্কা অথবা ভবিষ্যত্বাণী, যাই বলা  হােক না কেন, বাস্তবিকপক্ষে এসব নবজাতক জন্মের পরে বেশিদিন বাঁচেনি। সময়ের ধারাবাহিকতার প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধিৎসু মন ভুলে যাওয়া অতীত খুঁড়ে যে স্মৃতির সম্পদ তুলে আনে, তার সাহায্যে যুদ্ধশিশুর জন্ম ও মৃত্যুর কাহিনী যুক্তিযুক্তভাবে তৈরি করা কষ্টকর।
এক কথায়, সে সময়ের বহু নবজাতকই বাঁচেনি। এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনাে পরিসংখ্যান না থাকলেও যুদ্ধশিশুদের মৃত্যুর ঘটনাগুলাে স্বতঃসিদ্ধ এবং যুক্তিসম্মত । ভাগ্যের পরিহাস অসহায়হীন ও দুর্ভাগা মায়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গর্ভমােচনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে সত্যি কিন্তু দেখা যায় যে ওদের জন্মের অব্যবহিত পর তারা মৃত্যু বরণ করে। তাদের মাদের সে ব্যর্থ প্রচেষ্টাই যেন সফল হলাে তাদের জন্মের পরপরই মৃত্যুর মাধ্যমে । সংক্ষেপে বলা যেতে পারে ১৯৭২-এর সে সংকটময় সময়গুলােতে মৃত্যুর সংখ্যা নিরূপণ করার মতাে কৌশল বা তথ্য জানা ছিল না। তাছাড়া অতিরিক্ত কাউকে নিয়ােগ করে সংখ্যা গণনার দায়িত্ব দেওয়ার | কোনাে সঙ্গতিই সরকারের ছিল না।
পরিত্যাগ যেহেতু পরিত্যাগ করার বিষয়টি ছিল একান্ত গােপনীয় কাজ সেজন্য সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য কেউই কোনাে দায়িত্বে ছিলেন না। অনেক সময়ে দেখা গিয়েছে অনেকে গোপনে রাতের আধারে আশ্রম ও সেবা সদনের দরজার সামনে সিড়ির ধাপে পরিত্যক্ত শিশুদের রেখে যেতেন। আমরা শুরুতে জেনেছি পরিত্যক্ত শিশুদের বিষয়ে একটি জরুরি প্রস্তাবে তখন আশ্রম কর্তৃপক্ষ রাজি হয়েছিলেন। ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জন্ম নেয়া এই “অবাঞ্চিত শিশুদের নানাভাবে আখ্যা দিয়ে উল্লেখ করা হতাে কখনাে বা পরিত্যক্ত” শিশু; কখনাে বা “ফেলে দেয়া” শিশু; অথবা “ছেড়ে দেয়া” শিশু।
বিষয়টি অন্যভাবে ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, তাদেরকে বলা হতাে দত্তকের উদ্দেশ্যে দিয়ে দেয়া অপ্রার্থিত শিশু। তাদেরকে হস্তান্তর অথবা দিয়ে দেয়ার ঘটনার কোনাে পরিমাপ করাও। সম্ভব হয়নি। নির্দিষ্ট সংখ্যা না থাকলেও নানা বর্ণনার মাধ্যমে পরিত্যাগের সত্যতা প্রতিপাদন করা সম্ভব হয়েছে। শিশুর জন্ম যার ঔরসে, তার অনুপস্থিতিতে জন্মদাত্রী মা যদি শিশুকে ত্যাগ করেন, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, সেই মায়ের আর কোনাে
উপায় ছিল না। এছাড়া আইনি বিচারে এটা শিশুর জৈব পিতার অধিকার ছেড়ে দেয়া অথাৎ মা-বাবার অধিকার ছেড়ে দেয়া । মােটামুটিভাবে এ কথা তখন সবার জানা ছিল যে, পরিত্যক্ত শিশুদের ব্যাপারে অনাথ , আশ্রম কর্তৃপক্ষ এরপর শিশুর যত্নকারী ভূমিকা পালন করবে এবং বাংলাদেশ সরকার তার সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক (Statutory Guardian) হবে ।
যেসব সমাজকর্মী জন্মদাত্রী মায়েদের পরিত্যাগের সময় সহায়তা যুগিয়েছেন তাদের মতে একটি নবজাতককে তার মায়ের কাছ থেকে দ্রুত সরিয়ে নেয়া শিশুটির জন্য সর্বাপেক্ষা। ভালাে ব্যবস্থা। স্বাস্থ্যকর্মী ও সরকার উভয়ে একমত হয়ে এ লক্ষ্যে কাজ করেন। রূপকশােভিত অর্থে বলা যেতে পারে যে সংকটকালে শিশুকে পরিত্যাগের মানে হচ্ছে। জন্মদাত্রী মায়েরা যে কী পরিমাণ অসহায় অবস্থায় ছিলেন সে সম্পর্কে ধারণা করা যায় । রক্ষণশীল সমাজের চাপে তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিজেকে লুকোবার একটি নিরাপদ আশ্রয় স্থান। খুঁজছিলেন। অসহায় মায়েরা নিজেদের মতাে করে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিছুসংখ্যক নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই তাদের বিপদের সহায়ক ও পথপ্রদর্শক ছিলেন।
সে সময়ে বাঙালির মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, পাকিস্তানি সেনাদের প্রতি বাঙালিদের যে পুঞ্জীভূত ঘৃণা, সেটাও তাদের দুরাচারের কারণে জন্ম নেয়া শিশুদের পরিত্যক্ত অভিধায় আখ্যায়িত করার এক বড় কারণ। যেহেতু জন্মদাত্রী মায়েদের ওপর সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোননারকম আইনি অথবা সামাজিক চাপ ছিল না, পরিত্যাগ করাই তখন সবচেয়ে স্বাভাবিক ও সহজ সমাধান ধরে নেয়া হয়েছিল। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তদানীন্তন সরকারও ধর্ষণের ফলে জন্মগ্রহণ করা শিশুকে সুরক্ষা দেবার বিষয়ে গর্ভধারিণী মাকে জোর জবরদস্তি করার কথা ভাবেননি । এমতাবস্থায় অন্তঃস্বত্ত্বাদের পরামর্শ দেয়া হয়েছিল এটা বলে যে, শিশুর জন্ম হলেই তাকে জন্ম সনদপত্র দেয়া হবে। এ ধরনের কৌশলী প্রচারকার্যে অন্ত ঃসত্ত্বারা স্বেচ্ছায় সাড়া দেওয়ার দরুণ শিশুদের পরিত্যাগের সংখ্যাও অনেক গুণে বেড়ে যায় । অসুস্থ শিশুর অযত্ন হলে সামাজিক নিন্দা বা আপত্তি উঠবে, এমন কোনাে অবকাশ এক্ষেত্রে থাকায়, প্রসবের পরই অনিচ্ছুক মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে ত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ। করেনিজেদেরকে দায়-দায়িত্বমুক্ত করেন। প্রকৃত অর্থে তাই দেখা গেল যে, যেসব সেবা সদন এবং বেবি হােম জরুরি সরকারি ব্যবস্থা হিসাবে স্থাপিত হয়েছিল সেগুলােতে সন্ত নিসম্ভবারা গােপনে এসে সন্তান প্রসবের পরপরই সদ্যপ্রসূত শিশুদের পরিত্যাগ করে চলে যান।
সমাজকর্মী মাহমুদা বেগম যিনি স্বাধীনতার পর সরকারি দায়িত্বে নিযুক্তি পান, স্মৃতি রােমন্থন করে বলেন, “যুদ্ধকালীন স্মৃতি তার নিকট বিয়ােগান্তক মনে হয়, আরেক অর্থে অদৃষ্টের পরিহাসও বটে”। মাহমুদার মন্তব্য অনুসারে বহু ধর্ষণের শিকার নারীর গর্ভধারণ না করে। উপায় ছিল না, তাদের শেষ পর্যন্ত সন্তান প্রসব পর্যন্ত যেতে হয়েছে। বিষয়টি আরেকটি আঙ্গিকে দেখলে বলা যেতে পারে যে, ঐ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ তখন মায়েরা আনন্দ করবার মতাে কোনাে কারণ বা উপলক্ষ খুঁজে পাননি। তাদের মাতৃত্বের দাবি পূর্ণ হয়নি। আবার উইমেনস রিহ্যাবিলিটেশন বাের্ডের সমাজকর্মী হুসনে আরা কাশেম তার নিজ অভিজ্ঞতা ও পর্যালােচনার ভিত্তিতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “প্রথমবারের মতাে তাদের সন্তানের দিকে তাকিয়ে ধর্ষণের শিকার মায়েরা তাদের শিশুদের জন্য ভালােবাসার প্রকাশ দেখাতে অপারগ হয়েছিলেন, যা কিনা শিশুর জন্য অত্যাবশ্যকীয় ছিল”।” কাশেম আরও বলেন যে, যে পরিস্থিতিতে ধর্ষণের শিকার নারীরা গর্ভধারণ করেছিলেন এবং গর্ভবতী নারীরা সন্তান প্রসব করেছিলেন, সেই মায়েরা নবজাতককে সহজাত যত্ন আদরের কিছুই দিতে পারেননি। নবজাত শিশুকে যেভাবে আদর করা, কোলে নেয়া ইত্যাদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সেখানে মায়েরা তাদের ত্যাগ করার বিষয়ে ভাবছিল । ভাগ্যের কী পরিহাস!
এ কথা স্বীকার্য যে অনেকগুলাে প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসু প্রশ্ন মাথার ভেতরে পাক খায় এখানে, জন্মগ্রহণকালে কতজন যুদ্ধশিশু পরিত্যক্ত হয়েছিল? কতজন জন্মদাত্রী মা দত্তক দেবার পরিবর্তে আপন সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন? হয়তাে এসব প্রশ্নগুলাের সােজাসুজি জবাব কখনাে মিলবে না। বর্তমান অবস্থায়’৭১-এর যুদ্ধ শিশুর জন্ম, মৃত্যু এর পরিত্যাগের কোনাে পরিসাংখ্যিক বিশ্লেষণই সম্ভব নয়। পরিত্যাগের সংখ্যা খুঁজতে হলে ধর্ষণের একটা প্রামাণিক চিত্র ও সংখ্যার প্রয়ােজন, সেখানে দেখতে হবে জবরদস্তিমূলক গর্ভধারণের সংখ্যা, গর্ভমােচনের সংখ্যা এবং সবশেষে পরিত্যক্ত শিশুদের দত্তক দেয়ার সংখ্যা। যেহেতু এসবের কিছুই ঠিকমতাে নথিভুক্ত করা হয়নি কাজেই এসবের নির্দিষ্ট কোনাে পরিসংখ্যানও নেই । বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের খাতিরে আমরা শুধু যারা চাক্ষুষ সাক্ষী তাদের বর্ণনা উল্লেখ করতে পারি, যেমনআমরা নিশ্চিতভাবে জানি যুদ্ধশিশুদের অনাথ আশ্রমে রাখা হয়েছিল। তাদের অনেককে। বাস্কেটে বন্দি করে প্রবেশ দ্বারের বাইরে গােপনে রেখে যাওয়া হয়েছিল। তখন অনাথ আশ্রমের কর্মীরা, অল্পসংখ্যক শয্যা, রসদপত্র, অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে সেসব বিপুল চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি হয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন। সবাই আশা করেছিলেন যে অপেক্ষমান। বিদেশি লােকবল ও অর্থবল এসে পৌছালে নবজাতকদের ব্যবস্থাপনা হয়তাে বা বর্তমানের তুলনায় আরও একটু ভালাে হবে।
স্মৃতিচারণের উপর ভিত্তি এবং যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেনিশ্চিতভাবে কিছু স্বতঃসিদ্ধ। ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট সংখ্যা এবং তথ্যাদির অনুপস্থিতিতেও আমরা নিছক সংদৃষ্টিক ঘটনাগুলাের (যেমন, ধর্ষণ আর তার ফলশ্রুতিতে যুদ্ধশিশুদের জন্ম, তাদের। পরিত্যাগ ও দত্তক দেয়া ইত্যাদি) সমীক্ষিত আলােচনার মাধ্যমে প্রতিপােষণ করতে পারি যে, এ ঘটনাগুলাে স্বতঃসিদ্ধ । সরকারি পর্যায়ে বিশদভাবে সেগুলাের সংখ্যাকরণ না হলেও ঘটনার সত্যতা নিয়ে কখন কোনাে প্রশ্নই ওঠেনি। ‘৭১-এর ঐতিহাসিক সত্যের প্রমাণসিদ্ধতা যাচাই এর প্রয়ােজন নেই । মােটামুটিভাবে যে জিনিসের প্রয়ােজন, সেটা হলাে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে যাওয়া প্রমাণাদি দিয়ে যুক্তিসঙ্গত ও প্রতিপােষক সত্যের মাধ্যমে ঘটনাবলির বিবরণ দিয়ে নতুন গবেষণার মাধ্যমে যুদ্ধশিশুদের করুণ কাহিনী লিপিবদ্ধ করা।
দত্তক নেয়া দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা বিশদভাবে দেখব বাংলাদেশ ও কানাডাতে দত্তক ব্যবস্থা ও দত্তক দেয়া-নেওয়ার রীতি-নীতি ও কৃষ্টি। প্রসঙ্গত এটুকুই এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে বাংলাদেশে কয়েক ধরনের দত্তক নেবার প্রচলন রয়েছে। যেমন, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক; আরও রয়েছে নানাভাবে অপ্রাপ্তবয়সের ছেলেমেয়েদের দত্তক গ্রহণ এবং এতিমদের অভিভাবক নিয়ােগের ব্যবস্থা। তথ্যের অভাবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, বাংলাদেশে
১৯৭২ সালে কেউই যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে এগিয়ে আসেননি। মসজিদ, মন্দির অথবা প্যাগােড়া থেকেও কেউ আসেননি (একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটি যে আশ্রম সম্পর্কে আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে পড়ব)। যতদূর জানা যায় সামাজিক সেবা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, পারিবারিক চিকিৎসক, আত্মীয় অথবা পারিবারিক বন্ধু কেউই যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে এগিয়ে আসেননি। ঘটনাক্রমে স্থানীয়ভাবে দত্তক নেয়ার ঘটনা | ঘটলেও সেগুলাের কোনাে নথিপত্র নেই বলে আমরা সে সব বিষয়ে অভিহত নই। যেহেতু স্থানীয়ভাবে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়ার কোনাে তথ্যাদি নেই, আমরা এ বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে কিছু জানি না। ব্যক্তিগতভাবে কারাে জ্ঞানগােচরে দত্তক নেয়ার কোনাে কাহিনী জানা থাকলেও সেটা কোনাে প্রকাশনার মাধ্যমে আমাদের জানা নেই। দত্তক নিলেও ঐ পরিবারগুলি এখনও এ বিষয়ে কথা বলতে অনাগ্রহী।
সরকারি দলিল-দস্তাবেজ থেকে যা জানা যায় সেটা হলাে উচুহারে বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুদের পরিত্যাগ করার ঘটনা। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখব সেটা জানতে পেরে কেমন করে বিশ্বব্যাপী বহু সন্তান উৎপাদনক্ষম ও বন্ধ্যা দম্পতি বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। লন্ডনস্থ IPPF-এর আকাইভস্ থেকে শুরু করে কানাডীয় ও বাংলাদেশি আর্কাইভস্ এর দলিল-দস্তাবেজ থেকে যে দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে সেটার উপর ভিত্তি করেই বর্তমান বইয়ে পনেরােটি শিশুর বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আমরা দেখব কীভাবে একদল সাধারণ কানাডীয় দম্পতি এগিয়ে এসে পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং সফলভাবে তাদের দত্তক নিয়ে বাংলাদেশ থেকে কানাডাতে ফিরে যান।
এ পর্যন্ত আমরা যা জেনেছি সেটাকে এভাবে বলা যায় এই শিশুদের জন্ম, মৃত্যু, পরিত্যাগের ঘটনা এবং দত্তক নেয়া সংক্রান্ত সংখ্যাভিত্তিক তথ্যাদি জানার চেষ্টায় আমরা বাংলাদেশে কোনাে নির্ভরযােগ্য নথি পাইনি (কেবল মৌখিকভাবে একজনকে আরেকজনের সম্পর্কে বলা কিছু সংখ্যা ব্যতীত)। নির্দিষ্ট সংখ্যার অভাবে অনুমান ও যুক্তি মিশিয়ে (অর্থাৎ Guestimate’ করে) হিসাব করার চেষ্টা করা হয়েছে। এগুলাে সবই অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার সামিল, Guestimateগুলি যথেষ্ট সাবধানে করা হয়েছে। সংখ্যা নিরূপণের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নানা দালিলিক প্রমাণের মাধ্যমে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ১৯৭২ এর বিলম্বিত | হেমন্তকালের শেষে আশ্রমে পড়ে থাকা অনেক অনাথ শিশুই ছিল । কিন্তু সেপ্টেম্বরের শেষে দত্তক নেবার মতাে স্বাস্থ্যোপযােগী যুদ্ধশিশুদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত বিরল।
যুদ্ধশিশুর সংখ্যা এবং দত্তক দেয়া-নেয়ার সংখ্যা নির্ণয়ে আমরা কানাডীয় দলের সদস্য হ্যালকে ফেরির পর্যবেক্ষণ প্রাপ্ত তথ্যের কথা এখানে উল্লেখ করতে পারি। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে জানাতে পারব ফেরি দুদুবার ঢাকা যান এবং দুজন যুদ্ধশিশুকে দত্তক নিয়েছিলেন | শিশু ভবন থেকে । সে সময়ে তিনি তার সে সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার কথা একটি চিঠিতে লেখেন । নয়াদিল্লিস্থ কানাডীয় ইমিগ্রেশন তাকে কয়েকটি অনাথ আশ্রম পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানালে তিনি সেগুলাে পরিদর্শন করেন। তারপর এ বিষয়ে তিনি যা লিখেন সেটা ছিল এরকম যে, তিনি “১৯৭২-এর জুনের মাঝামাঝি এমন ২৫ জন শিশুকে দেখতে পান, যাদের বয়স ১ সপ্তাহ থেকে ৮ মাসের মধ্যে ছিল এবং যাদের দত্তক হিসাবে পাবারও সে সময় সুযােগ ছিল।”৩° হেলকে আরও জানান, ওদের মধ্যে ১৭ জনকে FFC-কে দত্তক নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। বাকি শিশুদের জন্য বিভিন্ন পরিবারে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় দত্তক শিশু হিসাবে গৃহীত হওয়ার প্রক্রিয়া কাজ চলছিল।
প্রমাণসিদ্ধ কোনাে সংখ্যা হাতের নাগালে না থাকায়, যে কোনাে একটি সংখ্যা বললেই সেটি ঐতিহাসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, দেশের ঐতিহাসিকেরাও ১৯৭২ সালে যুদ্ধশিশুদের জন্ম ও পরিত্যাগ করার ঘটনাবলি যেমন অনুসরণে ব্যর্থ হন, তেমনি বিদেশে দত্তক নেবার ঘটনাও বিস্মৃত হন। আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখব সরকার ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবার একটি কর্মসূচি তৈরি করেন। বিচারপতি সােবহানের মতে, “বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ার কারণে সংক্রান্ত দলিলাদি বাের্ড তদানীন্তন সরকারের নির্দেশানুযায়ী ধংস করে ফেলে।”
উপসংহারে বলা যায়, ধর্ষণ ও খুন ছিল দখলদারী সৈন্যদলের পক্ষে অত্যন্ত সাধারণ একটি অপরাধ । হিংস্র সেনা সদস্যদের হাতে প্রতিদিনই বাংলাদেশের অগণিত নারী হয়েছেন প্রমত্ত পাশবিকতার শিকার। অপরাধের শ্রেণি বিচার করে এবং যে পরিবেশে সেগুলাে সংঘটিত। হয়েছে, সেটা বিচার করে তাবৎ বিয়ােগান্তক ঘটনার সংখ্যা এবং জন্ম, মৃত্যু, পরিত্যাগ ও যুদ্ধশিশুদের দত্তক গ্রহণের ঘটনার সংখ্যা নিরূপণ এক কঠিন প্রস্তাবনা। পরবর্তী কয়েক অধ্যায়ে আমরা বিষয়টির আরও গভীরে অনুসন্ধান করব, যাতে যুদ্ধশিশুদের প্রথম দলের ১৫টি শিশুর দত্তকায়নের জন্য নির্বাচন, তাদের কানাডা যাওয়ার প্রস্তুতি, কানাডাতে আনুষ্ঠানিকভাবে দত্তকায়ন এবং সেখানে তাদের শ্বেতকায় মা-বাবার বাড়িতে বেড়ে ওঠা জীবন পরীক্ষা করব।

সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী