সোনাগাজীর নবাবপুর ভোরবাজারের প্রথম যুদ্ধ, ফেনী
২৬ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ফেনী জেলার বীর জনতা দীর্ঘ একমাস ফেনী মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। এখানে অবস্থিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী প্রচুর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল ফেনী পাকিস্তানী হানাদারবাহিনীর দখলে চলে যাওয়ার পর তাদের দালাল শান্তিকমিটির সহায়তায় রাজাকারবাহিনী গড়ে তোলা হয়। ফেনী জেলার অন্যান্য স্থানের ন্যায় সোনাগাজী থানাতেও সোনাগাজী সদর, মুতিগঞ্জ, বক্তারমুন্সি ডাকবাংলোসহ আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রাজাকার-ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার-এর কয়েকজন সদস্যসহ সোনাগাজী থানার পূর্বাঞ্চলে নবাবপুর ও ভোরবাজার এলাকায় অবস্থান নেয়। রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মাসাধিকালব্যাপী কয়েকটি বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের পর এই অঞ্চলের রাজাকাররা বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এমতাবস্থায় রাজাকারদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী ফেনী থেকে সুবেদার গুল মোহাম্মদের নেতৃত্বে একদল সৈন্য সোনাগাজীতে প্রেরণ করে। তারা বক্তারমুন্সি ডাকবাংলোয় ক্যাম্প স্থাপন করে। সুবেদার গুল মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকার বাহিনী সোনাগাজী থানার বিস্তীর্ণ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েস করে। তারা লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও নারীনির্যাতনসহ নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর নির্মম অত্যাচার চালাতে থাকে। সুবেদার গুল মোহাম্মদের অত্যাচার, নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। নবাবপুর ও ভোরবাজার এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা গোয়েন্দা সূত্রে খবর নিয়ে জানতে পারে যে, অসম শক্তি নিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে অসম্ভব। এই সময় ফেনী নদীর পূর্বদিকে মিরসরাই থানায় সুবেদার রফিকের নেতৃত্বে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রণকৌশলের দিক দিয়ে শক্তিশালী একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিল। সুবেদার রফিক তখন ঐ এলাকায় ক্যাপ্টেন রফিক বলে খ্যাত ছিল সোনাগাজীর মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন রফিকের নিকট গুল মোহাম্মদের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে সাহায্য চেয়ে খবর পাঠালে তিনি সোনাগাজীর নবাবপুরে এসে এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হন। কমান্ডার রফিক নবাবপুরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর রণকৌশল নির্ধারণ করে মহেন্দ্র চৌকিদার বাড়ি ও ফতেপুরে মজল সওদাগর বাড়িতে অবস্থান নিয়ে আক্রমণের জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। মে মাসের শেষদিকে একদিন দুপুরবেলা সুবেদার গুল মোহাম্মদের নেতৃত্বে পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী ও রাজাকারবাহিনী সম্মিলিতভাবে বক্তারমুন্সি ক্যাম্প থেকে নবাবপুর ও ভোরবাজারের দিকে প্রধান সড়ক ধরে এগিয়ে আসছিল। মুক্তিযোদ্ধারা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে ডিফেন্স স্থাপন করে। হানাদার ও রাজাকারদের সম্মিলিত বাহিনী দুপুর বারোটার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলগত ডিফেন্সের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীনির্যাতনে লিপ্ত হয়। এমতাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। চার-পাঁচ ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণে টিকতে না পেরে সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে বক্তারমুন্সির দিকে পালিয়ে যায়। তাদের পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে কমান্ডার রফিকের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন হতাহতের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে ও আশপাশের এলাকায় গিয়ে হানাদার ও রাজাকারদের সাত/আটটি মৃতদেহ দেখতে পায়। এদের মধ্যে কালো পোশাক পরা বিশালদেহী একটি মৃতদেহ পানিতে ভাসতে দেখে লাশটিকে সুবেদার গুল মোহাম্মদের বলে তাদের ধারণা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একজন লাশের কাঁধের ফিতা খুলে কমান্ডারের নিকট নিয়ে আসলে তিনি এটি একজন সুবেদারের ব্যাজ বলে নিশ্চিত হন। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন লাশটিকে ভালোভাবে দেখে সুবেদার গুল মোহাম্মদের লাশ বলে শনাক্ত করে। কয়েক মুক্তিযোদ্ধা পার্শ্ববর্তী মুলকুতের বাড়ি থেকে দা-ছেনি নিয়ে এসে মৃত গুল মোহাম্মদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একজন মুক্তিযোদ্ধার রেইনকোটে পেঁচিয়ে কমান্ডার রফিকের নিকট নিয়ে আসছে। উল্লেখ্য যে, সুবেদার গুল মোহাম্মদ সমগ্র সোনাগাজী এলাকায় নিরস্ত্র মুক্তিকামী জনগণের ওপর যে অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল সেই খবর ভারতে অবস্থিত রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দের নিকট নিয়মিত পৌঁছাত। নেতৃবৃন্দ এই মর্মে ঘোষণা দিয়েছিল যে, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা সুবেদার গুল মোহাম্মদকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করতে পারবে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে। সেই কারণে প্রমাণস্বরূপ গুল মোহাম্মদের মাথা ভারতের শ্রীনগর ক্যাম্পে নেতৃবৃন্দের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য কমান্ডার রফিকের নিকট প্রদান করা হয়েছিল। ঘোষণা অনুযায়ী এই দুঃসাহসিক কাজের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল। নবাবপুরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী ও রাজাকাররা সতেরোটি চাইনিজ রাইফেল, ছাব্বিশটি ৩০৩ রাইফেল, পাঁচশো বুলেট ও পশ্চাশটি ছাতা ফেলে রেখে যায়, যা মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করে পরবর্তীতে তাদের অস্ত্রবল বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা শফিউল্লাহ মানু শাহাদাত বরণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মফিজুর রহমান, আনোয়ার, আবদুল কাদের ও ফজলুল হক গুরুতরভাবে আহত হন। শহীদ শফিউল্লা মানুকে ঐদিন রাতে নদীর পূর্বপার্শ্বে সহযোদ্ধা ও স্থানীয় জনগণ জানাজা শেষে দাফন করেন। প্রায় পশ্চাশজন মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের মধ্যে কমান্ডার রফিক,আবু ইউসুফ, সিরাজউদ্দিন, হাবিলদার রাজ্জাক,ওস্তাদ আবুল বশর, হাবিলদার মফিজুর রহমান,ওস্তাদ আবুল হালিম, আ স ম মোশাররফ হোসেন,মোহাম্মদ এমলি খান মিন্টু, এসএম জায়েদ হোসেন, খায়েজ আহম্মদ, হোসেন আহম্মদ,রফিউদ্দিন ক্বারি,একেএম খুরশিদ আহম্মদ, সালেহ আহমদ ছুটি, খাজা আহম্মদ,এম ছদরুদ্দীন, ফজলুল হক, সিপাহি মনির আহম্মদ, আনসার খোকা মিয়া, আনসার আবদুল কাদের,আনোয়ার আহম্মদ,মোহাম্মদ ছিদ্দিক,রুহুল আমিন উল্লেখযোগ্য।
[১১৩] শফিকুর রহমান চৌধুরী
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত