সাগরনাল অপারেশন, মৌলভীবাজার
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া জুড়ি-ফুলতলা সড়কপথ সীমান্ত অঞ্চলে চলাচলের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। ফুলতলাসহ সীমান্তের এক দীর্ঘ অঞ্চলের সাথে যোগাযোগের এটাই একমাত্র মাধ্যম। এই সড়ক ধরে জুড়ি থেকে প্রায় ১৩ কি.মি. পূর্বে সাগরনাল। ফুলতলা এবং পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পগুলোতে অস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদ ও সৈন্য পরিবহনের জন্য পাকিস্তানী সৈন্যরা এই পথ ব্যবহার করত। তাই তাদের কাছে এই পথ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে বিভিন্ন কারণে মুক্তিবাহিনীর জন্য ফুলতলা মুক্ত করা খুবই জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু কুলাউড়া-জুড়ি-ফুলতলা সড়ক চালু থাকা অবস্থায় এই অঞ্চলকে মুক্ত করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। আগস্টের মাঝামাঝি পরিকল্পনা করা হলো প্রথমেই এ রাস্তা বন্ধ করার। জুড়ি- ফুলতলা সড়কে সাগরনাল বিচ্ছিন্ন করার জন্য সুবিধাজনক ও কার্যকরী স্থান হিসেবে মনে করা হয়। সময়টা ছিল আগস্ট মাস। এলাকাটি আবার ছোট ছোট পাহাড়ে পূর্ণ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল, এর মধ্যে বেরিয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধারা। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে যখন তারা সাগরনাল পৌঁছায় তখন রাত শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই। অধিনায়ক আব্দুল মোমিন বুঝিয়ে দিলেন যার যার দায়িত্ব। আজির উদ্দিন, গোলাম রব্বানী, লক্ষ্মী নারায়ণ চ্যাটার্জি ও মুকুল দে’সহ অংশগ্রহণকারী সকল যোদ্ধা যার যার অবস্থানে পৌঁছে যায়। সাগরনালে শত্রুবাহিনীরও ক্যাম্প আছে। এখানে তাদের টেলিফোন সংযোগ ব্যবস্থাও রয়েছে জুড়িসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সঙ্গে। আক্রমণের সাথে সাথে শত্রু যাতে অন্য জায়গা থেকে সাহায্য না চাইতে পারে তাই টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য একটি গ্রুপকে দায়িত্ব দেয়া হয়। জুড়ি এবং ফুলতলার রাস্তায় আরো দুটি গ্রুপকে মোতায়েন করা হয়, যাতে ঐ স্থান দুটি থেকে কোনো গ্রুপ এসে যোগ দিতে চাইলে কাট অব পার্টি হিসেবে এদের বাধা দিতে পাকিস্তানীরা যায়। এ্যাকশন পার্টি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান গ্রহণ তাদের পেছনে কভারিং পার্টি, সবাই প্রস্তুত। তবুও অপারেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত অধিনায়ক আবদুল মোমিন শেষবারের মতো পরীক্ষা করে নিলেন সবার অবস্থান। প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশ দিলেন সবাইকে। নিশ্চিত হলেন টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়া সম্পর্কে। এরপর আবদুল মোমিন নির্দেশ দিলেন চূড়ান্ত আক্রমণের। আর সঙ্গে সঙ্গে অঝোর বৃষ্টির মতো গোলা নিক্ষেপ হতে লাগল শত্রু ছাউনির ওপর। শত্রুরা পাল্টা আক্রমণ রচনা করে। রাতের শেষ প্রহর অগ্নিস্ফুলিঙ্গে রক্তিমাভ হয়ে ওঠে। প্রতি মুহূর্তে পরস্পরের দিকে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে অজস্র সীসাখণ্ড। অবশেষে এক সময় রণেভঙ্গ দেয় পাকিস্তানী শত্রুরা। ২ ঘণ্টার যুদ্ধে জুড়িফুলতলা সড়ক শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। এ অপারেশনের ফলে আতংক সৃষ্টি হয় পাকিস্তানী সামরিক জান্তার মনে। এ অপারেশনে নিহত হয় একজন পাকিস্তানী সৈন্য, অন্যদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে গুলি লাগে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত