You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.17 | ষাটমা ব্রিজ অপারেশন, মৌলভীবাজার - সংগ্রামের নোটবুক

ষাটমা ব্রিজ অপারেশন, মৌলভীবাজার

মৌলভী বাজারের বড়লেখা-শাহবাজপুর রেল ও সড়কপথে যাতে পাক আর্মির সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে সে উদ্দেশ্যে ষাটমা ব্রিজ অপারেশনের গুরুত্ব মুক্তিবাহিনীর মাঝে ফুটে ওঠে। ফলে ১৭ জুলাই কুকিতলা ক্যাম্পের কমান্ডার ক্যাপ্টেন হকের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে থেকে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা রুহুল আহমদ বাবু এবং ন্যাপনেতা আবুল খয়ের চৌধুরী দায়িত্ব পান কমান্ডার এবং সহকারী কমান্ডারের। ৩৪ জন অসমসাহসী মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে তাঁরা সামরিক ট্রাকে বাংলাদেশ সীমান্তের মোকামটিলায় আসেন। মুক্তিযোদ্ধারা ৬টি স্টেনগান, ১৪টি ৩০৩ রাইফেল, ১২টি হ্যান্ড গ্রেনেড এবং ১৩৮ পাউন্ড বিস্ফোরক ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সাথে নেন। পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব বর্তায় বড়লেখা আওয়ামীলীগ নেতা সিরাজুল ইসলামের ওপর; কিন্তু রাস্তার পুরো তথ্য জ্ঞাত না থাকায় অসুবিধায় পড়তে হয়। পরে আবুল খয়ের চৌধুরী মস্তকিন আলীর ওপর পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব দেন। ২৮ জুলাই মোকামটিলা থেকে রওয়ানা হয়ে ডিমাই নামক স্থানে অবস্থান নেন সন্ধ্যা না হওয়ার কারণে। সন্ধ্যার পর বনবাদাড় পেরিয়ে ষাটমা সেতুর ১০০ গজ পূর্বে বাঁশঝাড়ের নিচে সমবেত হন। ছাত্রনেতা বেদানন্দ ভট্টাচার্য বিস্ফোরক দ্রব্যের বাক্স বহন করে এনে মাটিতে নামিয়ে রাখার সময় জোরে শব্দ হলে ষাটমা ব্রিজ পাহারারত রাজাকাররা শব্দ লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে এবং নারায়ে তকবির ধ্বনি করতে থাকে। রাজাকারদের কাণ্ড দেখে মুক্তিযোদ্ধারা উত্তেজিত হয়; কিন্তু প্রত্যুৎপন্নমতি বাবু পাল্টা গুলি করতে মুক্তিযোদ্ধাদের বারণ করেন। প্রায় ২শ’ গজ দূরত্বের রেলসেতু ও সড়কসেতুর উভয় পাশে চারটি কাট অফ পার্টি অবস্থান নেয়। আবুল খয়ের চৌধুরী, রুহুল আহমদ বাবু ৪ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ সড়কপথে সেতুর দিকে এগিয়ে যান। অন্য সকলে আবদুল মুকিতের নেতৃত্বে বাঁশঝাড়ের নিচে প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন। ৫০ গজ দূরে অবস্থান নিয়ে বাবু রাজাকারদের গুলি বন্ধের আহ্বান জানান। রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করতে যাবে সে মুহূর্তে অসাবধানতাবশত রাজাকার একজনের বন্দুক থেকে গুলি বের হয়। মুকিতের দল রাজাকারের গুলি বাবুর দলের প্রতি বর্ষিত হয়েছে সন্দেহে সেতু লক্ষ্য করে গুলি শুরু করেন। ৫ মিনিট গুলি চলার পরে রাজাকাররা সেতু ছেড়ে চলে যায়। বাবু অপারেশন পরিকল্পনা পরিবর্তন করেন। রেলসেতু অপারেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সড়কপথে নিয়ে আসেন। বাবুর ধারণা জন্মে, হানাদার বাহিনী অল্প সময়ের মধ্যে বড়লেখা থেকে এসে পড়বে। সুতরাং যা করার তা দ্রুত করতে হবে। তড়িৎগতিতে বাবু, খয়ের, বেদানন্দ ও সুরত আলীসহ ৬ জন বিস্ফোরক দ্রব্য এনে সেতুতে সংযোগ করতে লেগে যান। একদল পাকসেনা তখন সেতুতে চলে আসে। মুকিতের সাথে মুখোমুখি হলে তাকে রাজাকার ভেবে পাকসেনা কমান্ডারের নাম জিজ্ঞাসা করে। রাজাকার কমান্ডারের নাম বাবু মিয়া। মুক্তিযোদ্ধা মুকিত কমান্ডারের নাম বাবু মিয়া বলায় পাকসেনারা চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা সেতুর নিচে ৪টি গ্রেনেড, ২টি স্টেনগান ও ৪টি রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যান নিমিষে। পাক আর্মি চলে যাওয়ার পর বিস্ফোরক দ্রব্যাদির সংযোগ স্থাপন করা হয় এবং বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেন বাবু। কিন্তু পিয়ারপুটিং চার্জ হলেও, প্রেসার চার্জ হয়নি। ফলে অর্ধভগ্ন হয় সেতুটি। এদিকে কালীবাড়ি অর্থাৎ সেতুর দক্ষিণপাশের কালীবাড়ি বাজারে তখন কিছু পাক আর্মি ছিল। মস্তকিন আলী কালীবাড়ি বাজারের দিকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে অগ্রসর হতে গিয়ে পানিতে পড়ে গেলে পাক আর্মি তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। মস্তকিন আলী সাথিদের নিয়ে একসাথে পাল্টা গুলি চালালে রাজাকার ও পাক আর্মিরা বিছরাবাজার হয়ে আইল্যাপুরের দিকে ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে পিছু হটে যায়। মস্তকিন আলীও পিছু ধাওয়া করে আইল্যাপুরের কাছে থেকে ফিরে এসে বিছরাবাজারে একটি বাস দেখে গেরিলা ক্রলিং করে এগিয়ে বুঝতে পারেন বাসে কোন লোকজন নেই। ততক্ষণে বাবুর দল পথপ্রদর্শকসহ ৬ জন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া গঙ্গারজলের আরব আলীর বাড়িতে গেলে আজমল আলী মুক্তিযোদ্ধদেরকে ভারতে পৌঁছে দেয়া ফিরে আসার পথে এন্টিমাইন বিস্ফোরণে আজমল আলী রাস্তায় মারা গেলে মস্তকিন আলীর দল আজমলের লাশ নিয়ে গিয়ে কুতিল ক্যাম্পে কবর দেন। অপরদিকে বড়লেখা বাজারে ষাটমা সেতু অপারেশন সফল করতে যে কাট অফ পার্টি দেয়া হয়, মুক্তিযোদ্ধা সে পার্টি বড়লেখার বারইগ্রাম চৌমহুনায় ২টি ডিনামাইট স্থাপন করে নিমাইর পুলে অগ্রসর হলে পুল পাহারারত ফরমান আলী মুক্তি আ-যায়গা, মুক্তি আ-যায়গা বলে চিৎকার করলে ফরমান আলীকে গুলি করে মারা হয়। উক্ত নিমাইর পুল পাহারাতে বড়লেখা বাজারের ব্যবসায়ী এবাদ আলীও ছিল। তাকেও মুক্তিবাহিনী ধরে ফেলে কিন্তু বড়লেখার একজন মুক্তিবাহিনী তাকে চিনে নিয়ে লাথি মেরে ফেলে দেয় এবং পালিয়ে যেতে বলে। এবাদ আলী পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচে। মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন শেষ করে যাওয়ার পরদিন সকালে পাক মেজর শাহবাজপুর ক্যাম্প থেকে বড়লেখা ক্যাম্পে আসার পথে বারইগ্রাম চৌমুহনায় পোঁতা ডিনামাইট আঁচ করতে পেরে ডিনামাইট থেকে দেড় হাত দূরত্বে গাড়ি থামায় ভয়ানক হার্ড ব্রেক কষে। গাড়ি থেকে নেমে দুটি ডিনামাইট তুলে নিয়ে যায় মেজর আজম। সমূহ বিপদ কেটে উঠে মেজর আজম। নিশ্চিত মৃত্যুর আলিঙ্গন থেকে বেঁচে যায়। ষাটমার ব্রিজ অপারেশনে ব্রিজটি অর্ধভগ্ন হলেও চলাচলে বিঘ্ন ঘটে নি পাক আর্মিদের।
[৫৯৪] গোপাল দত্ত

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত