শালগড় অ্যাম্বুশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানায় শালগড় গ্রামের অবস্থান। এই গ্রামের ভেতর দিয়ে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রধান সড়ক চলে গেছে। এই সড়ক ব্যবহার করেই পাকিস্তানীরা কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া যোগাযোগ ও সরবরাহ চালু রাখে। তাছাড়াও এই রাস্তাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যও শত্রু এ পথে টহল পরিচালনা করে। শালগড় এলাকার সাধারণ লোকেরা পাকিস্তানপন্থী ছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর তেমন আস্থাশীল ছিল না। এ সকল কারণে এ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চরম আকার ধারণ করার আগে ২৬ এপ্রিল রাতে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (৪ ইস্ট বেঙ্গল)-এর সি কোম্পানি, ৭ নম্বর প্লাটুন বড় শালগড় এলাকায় কুমিল্লার দিক থেকে আগত প্রায় ২৫/২৮টি গাড়ির কনভয়ের ওপর একটি অ্যাম্বুশ পরিচালনা করে। শত্রুর তুলনায় অনেক কম শক্তি নিয়েও এ অভিযান পরিচালনা করে। যাতায়াত ও সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি এবং এলাকাবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আস্থাশীল করে তোলা এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল। রাত ১২ টার দিকে দক্ষিণ দিক থেকে অনেকগুলো গাড়ির হেডলাইটের আলোতে পুরো এলাকা আলোকিত হতে লাগল। সুবেদার ওহাব দলনায়কদেরকে নিজ নিজ অবস্থানে গিয়ে পজিশন নিতে নির্দেশ দেন। কনভয়টি ধীর গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল: কিছুক্ষণের মধ্যেই একেবারে শালগড় গ্রাম এলাকায় কনভয়টি প্রথম দিককার ৮/১০ টি জিপ, পিকআপ ও ট্রাক এসে পৌঁছায়। কনভয়টি শালগড় গ্রাম পেরিয়ে আসতেই সুবেদার ওহাব গণনা করে দেখলেন যে, ঐ কনভয়টিতে মোট ২৭টি গাড়ি রয়েছে। এতবড় একটি শত্রুসেনা কনভয়ের ওপর মাত্র ২৪ জন সৈনিক নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা ছিল দুঃসাহসিক ব্যাপার। শত্রুর কনভয়ের প্রায় সবকটি গাড়িই যখন ফাঁদ এলাকার ভেতরে এসে পৌঁছাল তখনই সুবেদার ওহাব তার অবস্থান থেকে প্রথম গুলি ছুঁড়বেন। সাথে সাথে সবকয়টি অস্ত্র থেকেই একযোগে গুলি নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। উভয় পক্ষে ব্যাপক গুলি বিনিময় শুরু হয়। দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলাগুলো শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি করতে থাকে। শত্রুর কনভয়টির সামনে জিপটি ফায়ারিং রেঞ্জের বাইরে যাওয়ার কারণে তা নায়েক তোফাজ্জলের নিক্ষিপ্ত গুলি আঘাত থেকে রক্ষা পায়। বাকি ২৬টি গাড়িই সুবেদার ওহাবের অ্যাম্বুশ পার্টির টার্গেট পরিণত হয়। আনুমানিক চার মিনিট কাল গোলাগুলি নিক্ষেপের পর সুবেদার ওহাব তার সিগন্যাল পিস্তল থেকে পর পর দুটি গ্রীন ভেরীলাইট ফায়ার করেন। সংকেত পাবার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুশ পার্টির সদস্যরা সৈয়দপুর স্কুল এলাকার দিকে পশ্চাৎপসরণ শুরু করে দেয়। খুব দ্রুততার সাথে উইথড্রলের কাজ চলে। কভারিং পার্টি ফায়ার কভার দিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাম্বুশ পার্টির একজন ল্যান্স নায়েক এবং গাইড জলিল ছাড়া সকল সদস্যই সৈয়দপুর স্কুলে একত্র হয়। এর পর প্রায় দুই মাইলের মতো গ্রাম হাঁটাপথ ধরে সবাই সিদলাই গ্রামে চান্দ মিয়া মেম্বারের বাড়িতে পৌঁছে। পৌঁছার পর উক্ত ল্যান্স নায়েক এসে পৌঁছেন। নায়েক তোফাজ্জল ব্যাপক গোলাগুলির মধ্যে তার এলএমজিটা একটা বাঁশঝাড়ের মধ্যে ফেলে এসেছিল। এই অপারেশনে নিজ পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ছিল এটিই। সিদলাই গ্রামের লোকজন জলিল ফকিরের সহযোগিতায় অবশ্য এই এলএমজি পরে দেবিপুর ক্যাম্পে সুবেদার ওহাবের নিকট পৌঁছে দিয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া তথ্যে জানা যায় যে, এই অভিযানে শত্রুর দুটি গাড়িতে আগুন ধরে যায় এবং মোট ১৮টি গাড়ি কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১০টি গাড়ির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। উঁচু রাস্তার আড়ালে অবস্থান নেয়ার কারণে লোকবলের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে ১৫ জনের মতো হতাহত হয়েছিল। উঁচু রাস্তার পশ্চিম পাশে আশ্রয় নেয়ার কারণে গুলির আঘাত থেকে অধিকাংশই রক্ষা পায়। গাড়ির কারণে রাস্তায় যানবাহন চলাচলের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়৷
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত