আধাসামরিক বাহিনী (ই.পি.আর)
বাংলাদেশ আধাসামরিক বাহিনী বলতে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস্ (ই.পি.আর) কে বোঝায়। এই রাইফেলস্ বাহিনীর তখন ৬টা সেক্টরের অধীনে ১৭ টা উইং ছিল যার মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল ১৫,০০০ তন্মধ্যে ৩,০০০ এর মতো ছিল অবাঙালি, বাকি ১২,০০০ সৈনিক ছিল বাঙালি। সেক্টর সদর দপ্তরগুলোর অবস্থান ছিলঃ
১নং সেক্টর – ঢাকা ২, ১৩, ১৫, ও ১৬নং উইং
২নং সেক্টর – সিলেট ১, ৩, ও ১২নং উইং
৩নং সেক্টর – যশোর ৪ ও ৫নং উইং
৪নং সেক্টর – রাজশাহী ৬ ও ৭নং উইং
৫নং সেক্টর – দিনাজপুর ৮, ৯ ও ১০ নং উইং
৬নং সেক্টর – চট্টগ্রাম ১১, ১৪ ও ১৭নং উইং
উপরোক্ত ৬টি সেক্টরের অধীনস্থ ১৭টি উইং সদরের অবস্থান ছিল নিরূপ:
১নং উইং – কুমিল্লা (সিলেট সেক্টর)
২নং উইং – ময়মনসিংহ (ঢাকা সেক্টর)
৩নং উইং – সিলেট (সিলেট সেক্টর)
৪নং উইং – চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া (যশোর সেক্টর)
৫নং উইং – খুলনা (যশোর সেক্টর)
৬নং উইং – চাঁপাই নবাবগঞ্জ (রাজশাহী সেক্টর)
৭নং উইং – নওগাঁ (রাজশাহী সেক্টর)
৮নং উইং – দিনাজপুর (দিনাজপুর সেক্টর)
৯নং উইং – ঠাকুরগাঁও (দিনাজপুর সেক্টর)
১০নং উইং – রংপুর (দিনাজপুর সেক্টর)
১১নং উইং – হালিশহর (চট্টগ্রাম সেক্টর)
১২নং উইং – খাদেমনগর (সিলেট সেক্টর)
১৩নং উইং – ঢাকা (হেডকোয়ার্টার, পিলখানা)
১৪নং উইং – হালিশহর (চট্টগ্রাম সেক্টর)
১৫নং উইং – ঢাকা (হেডকোয়ার্টার, পিলখানা)
১৬নং উইং – ঢাকা (হেডকোয়ার্টার, পিলখানা)
১৭নং উইং – কাপ্তাই (চট্টগ্রাম সেক্টর)
এই বাহিনীতে অফিসারদের মধ্যে কয়েকজন বাঙালি ছাড়া আর সবাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী। প্রত্যেক উইং-এ গোয়েন্দা সিগন্যাল ব্রাঞ্চ এবং ১টি করে মর্টার প্লাটুন ছিল যাতে ৬টা ৩ ইঞ্চি মর্টার ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পূর্বে ই.পি.আর বাহিনীতে সীমিত আকারে যে সমস্ত ভারি অস্ত্র ছিল, তাহলো- এ, এম, জি, ৩ ইঞ্চি মর্টার, ৪ ইঞ্চি মর্টার এবং ৬ পাউন্ডার গান (কামান)। এছাড়া কোনো কোনো উইং ও সেক্টরকে ১০৬ মি. মি. ট্যাংক বিধ্বংসী কামানও দেওয়া হয়েছিল। সাধারণ হাতিয়ার ছিল সনাতনি ৩০৩ রাইফেল, তবে বাহিনীতে আধুনিকীকরণের উদ্দেশে ৩০৩ রাইফেল এর স্থলাভিষিক্ত করার জন্য কোনো কোনো উইংকে চায়নিজ স্বয়ংক্রিয় রাইফেলও দেওয়া হয়েছিল যার বিনিময়ে ৩০৩ রাইফেলগুলো সময়াভাবে জমা দেওয়া সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। ঐসব স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের সাথে অবশ্য সে পর্যন্ত কোনো গোলাবারুদ দেওয়া হয়নি তবুও পরবর্তীকালে পাকিস্তানী বাহিনীর কাছ থেকে অধিকৃত গোলাবারুদ দ্বারা ঐসব রাইফেলগুলো ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছিল।
পুলিশ বাহিনী
পুলিশ বাহিনীর সদর দপ্তর কর্তৃক দাখিলকৃত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে সব র্যাংকের মোট পুলিশের সংখ্যা ছিল ৩৩৯৯৫ জন। তন্মধ্যে সশস্ত্র পুলিশের সংখ্যা ছিল ২৩৬০৬ জন। অবশিষ্ট ১০,০০০ পুলিশ অস্ত্রসজ্জিত না হলেও তারা অস্ত্র ব্যবহারে ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এদের পরিচালনার জন্য সাব-ইনসপেক্টর পদ পর্যন্ত অফিসারের মোট সংখ্যা ছিল ২৮৮৪ জন যাদের সবাই ছিল বাঙালি।
পুলিশ সদরের পরিসংখ্যানে তৎকালীন ঢাকা শহরে অবস্থানরত পুলিশের যথার্থ সংখ্যা দেওয়া সম্ভব না হলেও অনুমানকৃত পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে যে সারা শহরের তৎকালীন পাঁচটি থানা সহকারে পুলিশের সংখ্যা ছিল প্রায় ১,৫০০। তন্মধ্যে একমাত্র পুলিশ সদরের পুলিশ লাইনের ছিল ৪০০ জন সশস্ত্র পুলিশের অবস্থান। সদরের সাথে সবগুলো থানার তার ও বেতার যোগাযোগও ছিল সুসন্নিবেশিত। পদভেদে কিছু কিছু রিভলভার ও স্টেনগান ছাড়া এদের সাধারণ অস্ত্র ছিল সনাতনি ৩০৩ রাইফেল এবং পরিমিত হারে মজুদকৃত গোলাবারুদ। ভারি অস্ত্র বলতে পুলিশের কাছে তখনো স্বল্পসংখ্যক এল এম জি ব্যতিত আর কিছুই ছিল না, এখনো নেই৷
আনসার ও মুজাহিদ
আনসার হেডকোয়ার্টার থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সন পর্যন্ত ২২ বছরে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের ৩২০টি থানার অধীনে ৩২০০০ যুবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সে হিসেবে দেখা যায় যে ২৫ মার্চ ১৯৭১ সন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসারের সংখ্যা ছিল সাত লক্ষাধিক। এরা সবাই ছিল ৩০৩ রাইফেল চালনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং প্রচলিত ব্যবস্থানুসারে থানার সহকারী এ্যাডজুটেন্ট তার এলাকাধীন ঐ সব আনসারদের ২ ঘন্টা থেকে ২ দিনের নোটিশে হাজির করতে সক্ষম ছিলেন। ২৬ মার্চ ১৯৭১ বিদ্রোহ ঘোষণার পরপরই ঐ সব এ্যাডজুটেন্টগণ যুদ্ধক্ষেত্রে আনসার কোম্পানী নিয়োগ করে সারাদেশেই সেক্টর অধিনায়কগণকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নিয়োগকৃত ঐসব আনসারগণ বিভিন্ন সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছে।
পূর্ববাংলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিসংখ্যান
২৫ মার্চ ১৯৭১ সনের পূর্ববাংলায় পাকিস্তানের পাকিস্তানীদের শক্তি বলতে ছিল ১৪তম ডিভিশনের কয়েকটি ব্যাটালিয়ন মাত্র। সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের ৪টি ব্রিগেড সদর ছিল। ঢাকায় ৫৭তম ব্রিগেড, যশোরে ১০৭তম ব্রিগেড, রংপুরে ২৩তম ব্রিগেড এবং কুমিল্লায় ৩তম ব্রিগেড। এই চার ব্রিগেডে যে সৈন্য ছিল তা হলো- পদাতিক ব্যাটালিয়ন ১৫টি (১১টি পাকিস্তানী ও ৪টি ইস্ট বেঙ্গল), আরমার রেজিমেন্ট (ট্যাঙ্ক) ১টি, কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ১টি, ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী ৫টি, এক এক ব্যাটারী (বিমান বিধ্বংসী কামান) ১টি, মর্টার ব্যাটারী (১২০ মি. মি. মর্টার) ২টি। এই সব রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল নিরূপঃ
যশোর: ২৭তম বেলুচ রেজিমেন্ট ১ম ইস্টবেঙ্গল ও রেজিমেন্ট, ২২তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং ১টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী।
রাজশাহী: ২৫তম পাঞ্জাবী রেজিমেন্ট
সৈয়দপুর: ২৬তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট ও ৩য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট।
রংপুর: ১টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী
১টি আরমার (ট্যাঙ্ক) রেজিমেন্ট
১টি মর্টার ব্যাটারী ও ৬ষ্ঠ বেলুচ রেজিমেন্ট
সিলেট: ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট
কুমিল্লা: ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ১টি কমান্ডো ব্যাটালিয়ন
১টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী
১টি মর্টার ব্যাটারী
ঢাকা: ২২তম বেলুচ রেজিমেন্ট
১টি এফ, এফ ব্যাটালিয়ন
১টি পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ন ও ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট
ব্যাটালিয়ন (জয়দেবপুর) এবং ২টি
ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী
চট্টগ্রাম: ২০তম বেলুচ রেজিমেন্ট ও ৮ম ইস্টবেঙ্গল ব্যাটালিয়ন (অংশ)।
সামগ্রিকভাবে তখন পূর্ব-বাংলায় পশ্চিম-পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা ছিল আনুমানিক দশ থেকে বারো হাজার। কিন্তু ১৫ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯ম এবং ১৬ তম ডিভিশন দু’টিকে বাংলাদেশে এনে ৯ম ডিভিশন ঢাকা ও ময়মনসিংহ এলাকার প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত থাকে। ১৫ এপ্রিলের পর পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ আরও ২টি ডিভিশন ৩৬ তম ও ৩৯ তম ডিভিশন বাংলাদেশে আনে। সব মিলিয়ে পাকিস্তানীদের শক্তি ছিল প্রায় ১ লক্ষ নিয়মিত সৈনিক এবং রাজাকার, আলবদর ও আলশামস সহকারে আরও প্রায় ৫০ হাজার আধাসামরিক সৈনিক। এরা সবাই মুক্তিবাহিনী বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।
[৫৩১] আবু ওসমান চৌধুরী