You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.09 | মাটিকাটায় পাকবাহিনীর জাহাজ দখল, টাঙ্গাইল - সংগ্রামের নোটবুক

মাটিকাটায় পাকবাহিনীর জাহাজ দখল, টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইল জেলার উত্তরাংশে ভুয়াপুর থানা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি। টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে উঠা এই মুক্তিবাহিনী জেলার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে আংশগ্রহণ করেছে। মুক্তিবাহিনীর এই সদস্যদের অধিকাংশই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। দেশের অভ্যন্তরে পাকবাহিনীর কাছ থেকে এবং থানা থেকে সংগৃহীত অস্ত্র দিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র করা হয়। টাঙ্গাইল একটি বিরাট অংশ জঙ্গলাকীর্ণ হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের অভ্যন্তরে থাকতে বেগ পেতে হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে পাকবাহিনী গতিবিধির উপর লক্ষ্য রেখে বারবার তাদের উপর অভিযান চালানো সহজতর ছিল। তাছাড়া টাঙ্গাইলের মুক্তিবাহিনী নিয়মিতভাবে যমুনা নদীতে পাকবাহিনীর চলাচলের উপর নজর রাখতে চেষ্টা চালায়। এই সময় দেশের অভ্যন্তরে রাস্তা এবং রেলপথের যোগাযোগ অনিশ্চিত থাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের উত্তরাঞ্চলে যুদ্ধাস্ত্র এবং রসদ সরবরাহের জন্য নদী পথ ব্যবহার শুরু করে। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ খুলনা এবং চট্রগ্রাম থেকে এই সমস্ত অস্ত্র গোলাবারুদ এবং যমুনা নদী দিয়ে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া প্রভৃতি অঞ্চলে সরবরাহ করা হত। এক গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মুক্তিবাহিনী টাঙ্গাইল জেলার মাটিকাটা এলাকায় যমুনা নদীতে পাকবাহিনীর অস্ত্র বোঝাই জাহাজ আক্রমণ করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ দখল করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই জাহাজ আক্রমণ একটি মাইল ফলক ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত। টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে একটি প্রধান সড়ক মধুপুর পৌছে দু’ভাগ হয়। একটি ময়মনসিংহ আর একটি জামালপুর জেলা সদরে পৌঁছেছে। টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ সড়কের মধ্যবর্তী অবস্থান ঘাটাইল থেকে একটি সড়ক পৃথক হয়ে সোজা পশ্চিম দিকে যমুনার তীরবর্তী ভুয়াপুর থানা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। ভুয়াপুর থানা সদরের দক্ষিণে ছোট মাটিকাটা বাজারের অবস্থান। এলাকাটি যমুনার তীরবর্তী হওয়াতে এখানে বড় ধরনের কোনো স্থাপনা বা শিল্প কারখানা গড়ে উঠেনি। মাটিকাটা বাজারের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর মধ্যে নিকবাইল বীরহাটা গোবিন্দদাসী গাবমারা ফালদা উল্লেখযোগ্য। প্রাথমিক সংবাদ আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর কাছে গোপন সূত্রে সংবাদ আসে যে নারায়ণগঞ্জ অবস্থানরত টার্মিনাল থেকে ৭টি জাহাজের অস্ত্র-গোলাবারুদ দেশের উত্তরাংশে সৈয়দপুর সেনানিবাসে পাঠানোর জন্য ভর্তি করা হচ্ছে। নারয়ণগঞ্জে অবস্থানরত ইপিআর সদস্য জনাব এনায়েত করিম এই সংবাদটি তার এক আত্মীয় নবী নেওয়াজের মাধ্যমে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেন। প্রাথমিকভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও পরিকল্পনা স্তরে খুব গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি বিবেচিত হয়নি। ৯ আগস্ট ১৯৭১ অস্ত্র গোলাবারুদবাহী ৭টি জাহাজ ভুয়াপুরের দক্ষিণে সিরাজকান্দি ঘাটে নোঙর করে। এর মধ্যদিয়ে ইপি আর সদস্য জনাব এনায়েত করিমের দেয়া সংবাদ সঠিক প্রমাণিত হয়। ৭টি জাহাজের মধ্যে ২টি বৃহদাকার এবং বাকি ৫টি মাঝারি ধরনের। বড় দুইটি জাহাজেন নাম ছিল S. U. Engineers L. C-3 এবং S. T. Rajon. এখানে উল্লেখ্য যে “S. T. Rajon” জাহাজের ক্যাপ্টেনের (সারেং) নাম মহর আলী। তার বাড়ি মির্জাপুর থানার উয়াসী পাইকপারা এবং S. U. Engineers L. C-3 এবং S. T. Rajon জাহাজের ক্যাপ্টেনের নাম মোহাম্মদ মোস্তাফা বাড়ি চট্টগ্রাম। সারেং মোস্তফার গ্রামের বাড়ি পাকবাহিনী জ্বালিয়ে দেয় এবং তার এক ভ্রাতুষ্পুত্রকে গুলি করে হত্যা করে। মোস্তাফা একভাই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। সেই অপরাধে পাকবাহিনী মেস্তাফাকে চারমাস আটকে রাখে। সৈয়দপুর সেনানিবাসে এই যুদ্ধাস্ত্র ভর্তি জাহাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য তাকে মুক্তি দেয়া হয়। কারণ সেই সময়ে যথেষ্ট সংখ্যক বাঙ্গালি সারেং কর্মরত ছিল না। মুক্তি পাওয়ার পর সারেং মোস্তাফাই ইপিআর এনায়েতে করিমকে গোপনে এই সংবাদটি দেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ৭ টি জাহাজ পাশাপাশি অবস্থান নেয়ায় তীরবর্তী লোকজন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে অনেকে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে দূরবর্তী অবস্থানে পরিবার-পরিজনসহ আশ্রয় নিতে শুরু করে। একই সময়ে পুরাখাসিয়া সাব সেক্টরের কমান্ডার মাস্টার সামছুল আলম ৫০ জন সহযোদ্ধাসহ পাকবাহিনীর চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্ত রে মাটিকাটা এলাকায় আসেন। তার কাছেও এই অস্ত্রবাহী পাকিস্তানী জাহাজের আগমন সংবাদ পৌছায়। তিনিও এই জাহাজ আক্রমণের লক্ষ্যে সহযোগীসহ ৯ আগস্ট ১৯৭১ মাটিকাটা বাজার এলাকায় অবস্থান গ্রহন করে। ১০ আগস্ট ১৯৭১ অস্ত্র গোলাবারুদবাহী জাহাজগুলো আরও অগ্রসর হয়ে যমুনা নদীতে প্রবেশ করে এবং মাটিকাটা বাজার থেকে কিছুটা দক্ষিণে নদীর মাঝ বরাবর পুনরায় নোঙর ফেলে। তথ্য সংগ্রহকারী দল স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে জানতে পারে বিশাল এই জাহাজগুলোকে উত্তর দিকে যেতে হলে মাটিকাটা বাজারের তীরবর্তী কোল ঘেঁষে যেতে হবে কারণ এদিকের নদীর পানির গভীরতা বেশি। পশ্চিম দিক দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বালুর চরায় জাহাজ আটকে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। কমান্ডার হাবিব তার কোম্পানিসহ মাটিকাটার কিছুটা দক্ষিণে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার ঝাঁকি জাল নিয়ে জাহাজের নিকটবর্তী এলাকা পরিদর্শন করে জাহাজের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী সৈনিকদের চলাচল প্রত্যক্ষ করেন। বৃহদাকার জাহাজ দুটি ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। এর সম্মুখভাগে মেশিনগান বসানো দেখে তিনি অনুমান করেন যে এই দুটি জাহাজে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রশস্ত্র থাকার সম্ভবনা বেশি। এই জাহাজ দুটি নিরাপত্তা বিধানে অতিরিক্ত শক্তি নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি প্রয়োজনীয় রেকি শেষে সহযোদ্ধাদের এই বিষয়ে ব্রিফিং করেন এবং আক্রমণের ব্যক্তির অবস্থান নির্দিষ্ট করেন। আক্রমণ পরিকল্পনায় নির্দেশ ছিল তিনি গুলি না চালানো পর্যন্ত কেউ যাতে গুলি না ছোঁড়ে। যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে কমান্ডার হাবিব মাটিকাটা বাজারের দক্ষিণ দিক থেকে মাটিকাটা বাজার পর্যন্ত এলাকায় নিজ সহযোদ্ধাসহ অবস্থান গ্রহণ করেন। সহযোদ্ধাদের মধ্যে জামশেদ, মোতাহার, জিয়া, ভোলা ও লুৎফরের নাম উল্লেখযোগ্য। মুক্তিবাহিনীর অপর দল, গ্রুপ কমান্ডার মাস্টার শামছুল আলমের নেতৃত্বে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে সবদিক বিচার করে নদীর পূর্বতীরে ট্রেঞ্চ খননের নির্দেশ দেন। যেখানে নদীর গভীরতা বেশি, পাড়ের কাছ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, অধীনস্ত যোদ্ধাদের নিয়ে তিনি সেই এলাকায় ট্রেঞ্চ খুঁড়ে জাহাজের আগমনের অপেক্ষায় থাকেন। ফলে পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই পৃথক দু’টি কোম্পানির অবস্থান পাশাপাশি এসে যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি ও মনোবল বেড়ে যায়। ১১ আগস্ট ১৯৭১ সকাল ১০টায় জাহাজগুলি কিছুটা এগিয়ে আবার থেমে নোঙর করে। একটি ছোট আকৃতির লঞ্চ পানি মাপতে মাপতে সম্মুখে এগিয়ে আসে। এই ছোট জাহাজটি সংকেত দেয়ার পর দুপুর ১২টায় পুনরায় জাহাজগুলো যাত্রা শুরু করে। এই সময় কমান্ডার শামছুল আলমের দল অবস্থানে ছিল না। খাবারের জন্য পাশের গ্রামে ছিল। হঠাৎ জাহাজ চলাচলের সংবাদে কমান্ডার শামছুল আলম তার দল নিয়ে পূর্বের পজিশনে যখন ফিরে আসেন তখন দুপুর ২টা। ইতোমধ্যে কয়েকটি জাহাজ তার পজিশনের স্থান অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গিয়েছে। কমান্ডার হাবিব তার পরিকল্পনা মতো ত্রিপল দিয়ে ঢাকা জাহাজের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করলে সহযোদ্ধারা এক সাথে ২টি জাহাজের উপর প্রচণ্ড গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। শামছুল আলমের যোদ্ধারাও একই আক্রমণ করে। অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে দুটি জাহাজ আত্মরক্ষার জন্য বাম দিকে ঘুরিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে বড় দুটি জাহাজ S. U. Engineers L. C-3 এবং S. T. Rajon বালুর চরায় আটকে যায়। বাকি ৫টি জাহাজ দ্রুত গতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে ২টি জাহাজ ক্ষত-বিক্ষত হয়। অধিকাংশ সৈন্য নিহত কিংবা আহত হয়। বাকিরা জাহাজের সাথে থাকা ছোট ছোট স্পিডবোটে যমুনা অতিক্রম করে জামালপুর অভিমুখে চলে যায়। সন্ধ্যায় ২টি জাহাজের ক্যাপ্টেন হাত উঁচু করে জাহাজের উপর এসে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকে। সন্ধ্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা জাহাজের উপর উঠে ৫০ জন খানসেনার মৃতদেহ দেখতে পান। একটি জাহাজে ছিল যুদ্ধাস্ত্র। অপরটিতে ছিল জ্বালানী তেল, ডিজেল ইত্যাদি। মুক্তিবাহিনী তড়িৎ নৌকা সংগ্রহ করে ১৭ নৌকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নামিয়ে শত্রুর পুনঃ আক্রমণের আশংকায় তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগের পূর্বে জাহাজ দুটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার আধঘণ্টা পর থেকেই প্রচণ্ড আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলতে শুরু করে এবং বিস্ফোরণ শুরু হয়। দু’টি জাহাজই আগুনে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সংগৃহীত অস্ত্র নিয়ে যথাসম্ভব নিরাপদ দূরত্বে সরে পড়ে। কমান্ডার হাবিব, রেজাউল করিম, জমসেদ মিয়া, এনায়েত করিম, মোতাহার হোসেন, জিয়াউল হক, ভোলা মিয়া, লুৎফর রহমান (কমান্ডার), মঞ্জুরুল হক, হাসান, আবদুস সামাদ, ফজলুল রহমান, গোলাম নবী, ফজলুল হক, আলী আকবর, আবদুস সালাম, নবী নেওয়াজ মোস্তফা, মুক্তা (কমান্ডার), শামছুল আলম (কমান্ডার), এম. এ. বারী তরফদার (কমান্ডার)।
১৯৭১ সালে টাঙ্গাইলে যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তার মধ্যে মাটিকাটায় জাহাজ ধ্বংস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেবল S. U Engineers জাহাজের লগও মুভমেন্ট অর্ডার পাওয়া যায়। সেই অনুসারে জানা যায়, কেবল এই জাহাজে ২১ কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্র ও রসদ ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশালকায় জাহাজ দুটি ধ্বংস হওয়াতে শত্রুপক্ষের প্রচুর অস্ত্র সম্ভার মুক্তিবাহিনীর হাতে চলে আসে। বিশাল বিপর্যয়ে শত্রুর মনোবল অনেকাংশে ভেঙ্গে যায়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর মনোবল অনেক বৃদ্ধি পায়। বিদেশি প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনেক গুরুত্ব লাভ করে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত