মহলছড়ির যুদ্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রাম
২৭ এপ্রিল ১৯৭১। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক স্তরের ইতস্তঃত বিক্ষিপ্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ-সংগ্রামে এই দিনটির তাৎপর্য অনেক। এদিনেই পার্বত্য অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ‘মহলছড়ির যুদ্ধ’। এদিন সকাল ৯টার দিকে পাক- বাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য (১৩৬ জন) একটি মিজো ব্যাটেলিয়নকে (১০০০ জন) সাথে নিয়ে মুক্তিবাহিনীর মহলছড়ি অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। মেজর মীর শওকত এবং চন্দ্রঘোনা পেপার মিলের প্রকৌশলী ইসহাক ঐ সময় শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে যাচ্ছিলেন। শত্রু ইতোপূর্বেই গোপনে হেলিকপ্টারে করে দ্বিতীয় কমাণ্ডো ব্যাটেলিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য মিজো ব্যাটালিয়ন দু’টির অবস্থানে নামিয়ে দিয়েছিল। ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বাধীন বাহিনী যখন মহলছড়িতে পৌঁছে, তখন দুপুর তিনটা। দু’পক্ষেই চলে ব্যাপক গোলা-গুলি। একটি উঁচু পাহাড়ের উপর বিরাটকায় একটি গাছের আড়ালে অবস্থান নিয়ে মেজর শওকত এবং প্রকৌশলী (অনারারী ক্যাপ্টেন) ইসহাক তখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ক্যাপ্টেন কাদের হাজারো গুলি-গোলার মধ্যে পাহাড় বেয়ে মেজর শওকতের অবস্থানে পৌঁছান। উঁচু ঐ পাহাড়টির নিচেই ছিল বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সমতল প্রান্তর। তারপরই ছিল আরেকটি অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতার পাহাড়। ঐ পাহাড়টির জঙ্গল এলাকা থেকেই মিজো ব্যাটেলিয়ন এবং পাকিস্তানি কমাণ্ডোরা গুলি করে যাচ্ছিল। এক সময় বীভৎস উল্লাসধ্বনি দিয়ে মিজো ব্যাটেলিয়ন এবং পাকিস্তানি কমাণ্ডো ব্যাটেলিয়নের সৈন্যরা সমতল ভূমিতে নেমে আসে। উদ্দেশ্য, দৌড়ে এসে উঁচু পাহাড়টিতে অবস্থান নেয়া। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাও এ সুযোগ হারাতে নারাজ। শত্রুর অগণিত সৈন্য মুক্তিবাহিনীর অব্যর্থ গুলির আঘাতে পাহাড়ের গা ঘেসেই অনড় অচল হয়ে পড়ছিল। গোলা-গুলির মধ্যেই ক্যাপ্টেন কাদের লক্ষ্য করলেন যে, উঁচু পাহাড়টির বাম পাশে অন্য যে পাহাড়টি রয়েছে তাতে গিয়ে অবস্থান নিতে পারলে যুদ্ধের মোড়ই পাল্টে দেয়া সম্ভব। দুই পাহাড়ের অবস্থান থেকে সমতল এলাকায় ‘ক্রস ফায়ারের’ মাধ্যমে শত্রুর ব্যাপক ক্ষতিসাধন সম্ভব কিন্তু ঐ পাহাড়টিতে যেতে হলে মাঝে রয়েছে নিচু খোলা জায়গা। ঐ নিচু খোলা জায়গাটি লক্ষ্য করেই শত্রু অজস্র গুলি বর্ষণ করছিল।
ক্যাপ্টেন কাদের দু’জন ই পি আর এর সৈনিককে। এল এম জি নিয়ে তাঁর সাথে বাম পাশে। ঐ পাহাড়টিতে যাবার নির্দেশ দিলেন। ছাত্র শওকত ও ফারুক ক্যাপ্টেন কাদেরের সাথেই গেলেন। হাজারো গুলি-গোলার মধ্যে ক্যাপ্টেন কাদের অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পাশের পাহাড়টির উঁচু জায়গাটিতে গিয়ে পৌঁছলেন। ই পি আর সৈনিকদ্বয় নিচু থেকে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে ভয় পাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন কাদেরের গালি-গালাজ শুনে এক সময় ওরা পাহাড় বেয়ে নির্দেশিত অবস্থানে পৌছল। তিনটি এল এম জি থেকে এবার শুরু হলো গুলিবর্ষণ। শত্রু প্রমাদ গুণতে শুরু করলো। এক সময় ক্যাপ্টেন কাদেরের বাম দিকের অবস্থানের এল এম জি- টির ফায়ারিং বদ্ধ হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন কাদের এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন ‘ফায়ারিং বন্ধ করলে কেন?’ ছাত্র শওকতকে নির্দেশ দিলেন এল এম জি’টি তাঁর কাছে নিয়ে আসতে। চারদিকে চলছে অনবরত গুলি-বৃষ্টি। এরই মধ্যে শওকত এগিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন কাদেরের নির্দেশে। বিলম্ব সইছিল না তখন ক্যাপ্টেন কাদেরের। নিজ অবস্থান থেকে একটু বেঁকে বাম হাতের কনুই- এর উপর ভর করে আবারও চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘হল কী? এল এম জি- টা কোথায় শওকত?’ এমন সময় শত্রুর ৩/৪টি গুলি এসে বিঁধে ক্যাপ্টেন কাদেরের ডান বগলের কয়েক ইঞ্চি নিচে এবং বাম পাশের পেটে। শওকত এগিয়ে আসতেই শুনতে পান একটি শব্দ ‘বাঁচাও’। এ সত্ত্বেও এল এম জি’র ট্রিগার থেকে হাত সরলো না ক্যাপ্টেন কাদেরের। বা হাত দিয়েই গুলি করে চললেন। শওকত কাছে পৌঁছতে দেখেন ক্যাপ্টেন কাদেরের মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। তখন বিকেল প্রায় সাড়ে তিনটা। ঐ অবস্থাতেও ক্যাপ্টেন কাদের এল এম জি’র ট্রিগার থেকে হাত সরাতে চাইছিলেন না। শওকত ভাবলেন কোনরকমে ‘তাঁর স্যার’ ক্যাপ্টেন কাদেরকে রামগড় পৌঁছাতে পারলে হয়ত বাঁচানো সম্ভব হবে। হাজারো গুলি- গোলার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শওকত এবং ফারুক (এরা দু’জনই বর্তমানে সেনাবাহিনীতে কর্মরত ঊর্ধ্বতন অফিসার) ক্যাপ্টেন কাদেরকে কাঁধে করে পাহাড় থেকে নামিয়ে নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে একটি সাদা জীপে করে রামগড়ের উদ্দেশে রওয়ান দিলেন। তখন বিকেল ৩টা বেজে ৪৫ মিনিট। জীপের ড্রাইভার ই পি আর বাহিনীর সৈনিক আব্বাসও ছিল অসীম সাহসী। গুলি- গোলার মধ্য দিয়ে সিপাহী আব্বাস দ্রুতগতিতে জিপ চালিয়ে যেতে থাকলেন। ক্যাপ্টেন কাদেরের দেহটি তখন ছাত্র শওকতের কোলে। শওকত ও ফারুক আলগা করে দেহটি তাদের কোলে রেখেছিল-যাতে করে উঁচু-নিচু পাহাড়ী মেঠো রাস্তায় কম ঝাঁকুনি পায়। রামগড়ে পৌঁছে দেখা গেল ক্যাপ্টেন কাদেরের প্রাণ তাঁর দেহ ত্যাগ করেছে। রামগড়ে শহরের কেন্দ্রস্থলের কবরস্থানে সামরিক মর্যাদায় এবং ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী মাওলানা ডেকে এনে ক্যাপ্টেন কাদেরকে সমাহিত করা হলো। ওদিকে ক্যাপ্টেন কাদেরের দুঃসাহসিক অবস্থানের কারণে মেজর মীর শওকতের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর ৫০০ সেনাসদস্য নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ৩০ এপ্রিল রামগড়ে এসে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল। ঐ দিনের যুদ্ধে মিজো ব্যাটেলিয়নের প্রায় ৪০০ সৈন্য হতাহত হয়। পাকিস্তানি কমাণ্ডো কোম্পানিটির ৪০ জনের মতো সৈনিক হতাহত হয়। ক্যাপ্টেন কাদের যখন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, তখনই শত্রু সৈন্যরা পিছু হটে যাচ্ছিল।
[৫৯৭] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত