মহামায়া যুদ্ধ, ঝিনাইদহ
১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১, ঝিনাইদহ সদর থানার মহামায়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে স্থানীয় রাজাকারদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মহামায়া গ্রামটি ঝিনাইদহ শহর থেকে ১২/১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। শহরের পাগলাকানাই মোড় থেকে কোটচাঁদপুর সড়ক ধরে প্রায় ১০ কিলোমিটার অতিক্রম করার পর ৩ সাড়ে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে গেলেই মহামায়া গ্রাম। গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে রয়েছে একটি দীর্ঘ দোহা। দোহাটিতে এখন আর তেমন পানি থাকে না। তবে ৭১ সালে এটি ছিল টইটুম্বুর।
যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে এ গ্রামের হিন্দু পরিবারগুলো নিজ বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে চলে যায়। তাদের জমির ফসল ভোগদখল করে স্থানীয় রাজাকাররা।
ঘটনার দিন সকাল ৯/১০টার দিকে স্থানীয় রাজাকার কামান্ডার মুইদের নেতৃত্বে ১০/১২ জনের একটি দল হিন্দুদের জমির ফসলের ভাগ নিতে মহামায়া গ্রামের সোবান বিশ্বাসের বাড়িতে হাজির হয়। তাদের এ আগমনে গ্রামবাসী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রাণের ভয়ে তারা রাজাকারদের সমস্ত দাবী-দাওয়া মেনে নেয়। ভাগ বাটোয়ারার পর সোবান বিশ্বাসের বাড়িতে রাজাকারদের খাবারের আয়োজন করা হয়। এ সময় গ্রামবাসী খুব কাছ থেকে রাজাকাদের অস্ত্রশস্ত্র দেখার সুযোগ পায়। রাজাকাররাও এতে খুব আহ্লাদিত হয়। জামাত নামে একজন গ্রামবাসী অস্ত্র দেখতে অতি উৎসাহী হলে রাজাকাররা তাকে মারধর করে।
একপর্যায়ে রাজাকাররা গ্রামবাসীর সঙ্গে খোস গল্পে মেতে ওঠে। এমন সময় হঠাৎ করেই গুলির শব্দ। বৃষ্টির মতো গুলি চলে রাজাকারদের সমাবেশস্থলে। রাজাকাররা কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের দলের চারজন মারা যায়। বাকিরা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। নিহতদের লাশ টেনে হিচড়ে ফেলে দেয়া হয় পার্শ্ববর্তী দোহায়। এ যুদ্ধে রাজাকারদের গুলিতে হাত উড়ে যায় শাহজাহানের।
যুদ্ধ বিজয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামবাসীদের সহায়তায় দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। প্রায় ২ঘণ্টা পর ঝিনাইদহ থেকে প্রচুর সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য রাজাকার সহযোগে মহামায়া গ্রামটি ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে না পেয়ে তারা গ্রামবাসীদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। বুটের আঘাতে এবং রাইফেল- বেয়নেটের খোঁচায় আহত করে প্রায় অর্ধশতাধিক লোককে।
উল্লেখ্য যে, রাজাকারদের ফসল লুটের খবর আগেই জানা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। ঘটনার আগের দিন শৈলকূপা-হরিণাকুণ্ডুর প্রায় ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি শক্তিশালী দল গভীর রাতে এসে মহামায়ার জবেদ মুন্সীর বাড়ি স্থ পাশ্ববর্তী বাড়িগুলোতে অবস্থান নেন। তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন কখন আসে তাদের শিকার রাজাকাররা। অবশেষে তারা এলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এবং পূর্ব পরিকল্পনা মত তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন রাজাকারদের উপর।
এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন অবসরপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট অফিসার মুজিবুর রহমান (কেশনগর), মোঃ দবীর উদ্দিন জোয়াদ্দার (শেখপাড়া), মোঃ মশিউর রহমান (কন্যাদহ), শহীদ নজরুল ইসলাম (শেখপাড়া), কুরিয়ার মোঃ রুস্তম আলী (যুগীপাড়া), তোজাম্মেল হক (শিংনগর), তৈয়ব আলী (মনোহরপুর), ফরিদ (মনোহরপুর), সাজেদুর (মনোহরপুর), ওয়াজেদ (মনোহরপুর), সুজিত সাহা (মির্জাপুর), গিরীন্দ্রনাথ (মির্জাপুর), আবু বকর (মির্জাপুর), আজগর (কুটিদূর্গাপুর), কামাল (মহামায়া)। অন্যদের নাম জানা সম্ভব হয় নি।
বি এম রেজাউল করিম
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত