সৈয়দপুরের যুদ্ধ, মুন্সিগঞ্জ
মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ সোলায়মানের লেখা হতে মুন্সিগঞ্জ জেলার সৈয়দপুর যুদ্ধ সম্পর্কে জানা যায়। শ্রীনগর এবং লৌহজং থানা শত্রুমুক্ত হবার পর মুক্তিযোদ্ধারা যখন ঢাকা অভিযানের পরিকল্পনা করছিলেন সেই সময় (২৫ নভেম্বর) পাক সেনাবাহিনী নওয়াবগঞ্জ ক্যাম্প ত্যাগ করে ঢাকার দিকে ফিরে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে তারা কয়েক দফা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে এক পর্যায়ে পাকসেনাদের কালীপুর গ্রামের খালের উত্তর পাড়ের বাড়িগুলিতে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবেলা করতে থাকে। কমান্ডার সোলায়মান তার ৬ প্লাটুন অর্থাৎ ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শত্রুদের সামনা সামনি আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেন। কালীপুর গ্রামটি সৈয়দপুর থেকে শুরু করে লম্বায় পূর্ব পশ্চিমে সুদীর্ঘ ছিল। কিন্তু পাক সেনারা মাত্র ৫ টি বাড়িতে অবস্থান নিয়েছিল। সোলায়মানের ডানপাশে ছিল আরেকটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের মাসুদ, ঝিলু, সেলিম, জাহাঙ্গীর, আওয়াল এবং কমান্ডার নাসির। তারা এসেই যুদ্ধ শুরু করে দেয়। ডানদিকে অর্থাৎ সৈয়দপুর বাজার এলাকার কমান্ডার জামাল চৌধুরী সহ আরও কয়েকটি দল পজিশনে ছিল। সবাই মিলে যুদ্ধ পরিকল্পনা করে ৪ টি মেশিনগান দিয়ে নির্দিষ্ট স্থান থেকে ৬ টি গ্রুপে ভাগ হয়ে সুপরিকল্পিতভাবে ডিফেন্স করছিল। মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করে বুঝিয়ে দিচ্ছিল তারা অত্যন্ত শক্তিশালী। সেই সময় আটকে পড়া পাক বাহিনীকে উদ্ধারের জন্য ঢাকা থেকে আগত অপর একটি শক্তিশালী দল নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থান নিলে স্থানীয় চেয়ারম্যান আদম আলী নদীর ওপার থেকে নৌকাযোগে পাকবাহিনীকে আটকে পড়া বাহিনীর নিকট পৌঁছাতে সাহায্য করে। মুক্তিসেনারা দিনের বেলা দূরবর্তী স্থান থেকে মেশিনগানের ফায়ার করে এবং রাতে পজিশন বদল করে ৪টি মেশিনগান একত্রে করে ২০হাত দূরে দূরে লাগিয়ে গুলি করে। ঢাকা হতে আসা এবং আটকে পড়া পাকবাহিনী মিলে বাড়িগুলিতে আগুন লাগিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে শ্লোগান দিতে থাকে। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধারাও ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে তাদের শক্তিমত্তা বোঝানোর জন্য ৪টি মেশিনগান হতে গুলি বর্ষণ করতে থাকে। সারা রাতই তারা থেকে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। পরের দিন ২৬নভেম্বর সকালের দিকে কয়েকশত পকসেনা নদীর পূর্ব পাড়ে গ্রামে আগুন লাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে থ্রী ইঞ্চি মর্টার ফায়ার করতে থাকে। দূরত্ব বেশি থাকায় মর্টারের গোলাগুলি মুক্তিসেনাদের থেকে ৪/৫ শত গজ দূরের সমানের চরের উপর পড়তে থাকে। বেলা ১:০০ দিকে ৩টি হেলিকপ্টার এসে মুক্তিযোদ্ধাদের মাথায় অনেক উঁচুতে কয়েবার চক্কর দিয়ে নদীর ওপারে নেমে পাক সেনাদের লাশ এবং আহতদের তুলে নেয়। একদল মুক্তিসেনাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে এবং অন্য আর এক দল মৃতদেহ এবং আহতদের নিয়ে আস্তে আস্তে মিলিটারী কায়দায় পালিয়ে যায়। যে বাড়িগুলি থেকে পাকসেনারা আক্রমণ প্রতিহত করছিল মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে এসে দেখতে পান মাটির বাসনে ভেজানো চাল এবং কাচামরিচ যা থেকে ধারণা করা হয় পাক সেনারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় জীবন রক্ষার্থে এগুলো খেয়ে জীবন রক্ষার চেষ্টা করেছিল। অনেক জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। কোথাও মাটি খুড়ে লাশ দাফন করেছে। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বহু রক্ত,রক্ত জমাট কাপড়-চোপড়ও পড়ে ছিল।
[৬২৭] হাসিনা আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত