পিন্ডি ক্রমশই কিনারাই যেতে চাইছে
এর পরেও কি বুঝিয়ে বলার দরকার আণেছ রাওয়ালপিন্ডি কি চায়? নয়াদিল্লী কি এতই অবােঝ যে, সে এর পরেও শুধুই বিস্মিত আর ব্যথিতই হয়ে থাকবে? আরেকবার, আরও একবার, যখন পাকিস্তান আমাদের নাক খুষে দিল, তখনও কি আমরা কেবল এই কথাই বলে ক্ষ্যান্ত থাকব, “ছিঃ এই খেলার রীতি?”
আমাদের নাকাল করার এক উদগ্র বাসনায় পাকিস্তান যদি নিজের থুথু নিজের গায়ে মেখে থাকে, তাতে তার কিছু এসে যায় না। কলকাতা ও ঢাকা থেকে উভয় দেশের দূতাবাস কর্মীদের বিনিময়ের ব্যাপারে সুইস সরকারের মধ্যস্থতার প্রস্তাব পাকিস্তানই করেছিল। আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাম। এখন পাকিস্তান যদি নিজেই সেই প্রস্তাব বাতিল করে দিয়ে থাকে, তাহলে কূটনৈতিক আচরণের বিচারে সেটা অদ্ভুত হতে পারে, কিন্তু আমরা কি পাকিস্তানের কাছ থেকে সত্যিই কোনাে সুস্থ, ভদ্রতাসম্পন্ন আচরণ প্রত্যাশা করেছিলাম? আমরা কি জানতাম না ভারতকে যেন-তেন-প্রকারের নাকাল করাই পাকিস্তানের উদ্দেশ্য এবং সেই উদ্দেশ্যে কূটনৈতিক বিনিময়ের প্রশ্নটি তাদের কাছে একটা চমৎকার হাতিয়ার?
জেনিভা আচরণবিধির প্রতি যদি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবােধ পাকিস্তানের থাকত, তাহলে ব্যাপারটা অনেক আগেই অনেক ভালােভাবে মিটে যেত পারত। কিন্তু কোনাে সহজ মীমাংসা যে তার কাম্য নয় সেটা এই ব্যপারে তার বিচিত্র টালবাহানার মধ্যেই পরিষ্কার। নেপালী সহযােগিতায় কূটনীতিকদের ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবটি পাকিস্তানের জেদের জন্যে আদৌ কোনাে বরফ কাটতে পারেনি। রাশিয়ার একটি প্রস্তাব সম্পর্কে পাকিস্তান প্রথমে আগ্রহী হয়ে পরে তা বানচাল করে দেয়। পরে ইরানী বিমানে কূটনীতিকদের সরিয়ে আনবার কথা হয়, কিন্তু তাতেও কোনাে লাভ হয়নি এবং এখন পাকিস্তান সুইস মধ্যস্থতার জন্যে নিজেই প্রস্তাব করে নিজেই সেটা বাতিল করেছে। স্পষ্টতই, বিরােধটিকে জইয়ে রেখে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে একটা গােলমাল পাকিয়ে তুলতে চায় যাতে বাংলাদেশে তার কুকীর্তির ওপর থেকে বিশ্বের দৃষ্টি সরে যায়।
এটা আর সকলের চোখে দিনের আলাের মতই স্পষ্ট ছিল, ছিল না শুধু ভারত সরকারের চোখে। নইলে তারা আজ বাড়িয়ে পাকিস্তানের প্রস্তাবটি গ্রহণ করে বসতেন না। এর অর্থ এই নয় যে, মীমাংসার প্রস্তাবটি অগ্রাহ্য করাই তাদের উচিত ছিল। এর অর্থ এই যে, গ্রহণ করবার আগে পাকিস্তানের মতিগতি এবং শর্তাবলী সম্পর্কে নিঃসংশয় হবার জন্যে তারা আরাে কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারছেন এবং নিজেদের সর্তের কথা পরিষ্কার ঘােষণা করতে পারতেন। তাতে আর কিছু না হােক এইভাবে নাকাল হতে হতাে না। এখন মীমাংসা শুধু পরাহত হলাে না, সমস্ত ব্যাপারটা আরাে কঠিন ও জটিল হয়ে উঠলাে। কারণ সুইস প্রস্ত নি অগ্রাহ্য করার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান এই ব্যাপারে তৃতীয় পক্ষের মত্যস্থতাকেও বাতিল করে দিয়েছে। এর দ্বারা পাকিস্তান এটা স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিল যে, সে ভারতের সঙ্গে সরাসরি পাঞ্জা লড়তে পস্তুত। পাকিস্ত েিনর এই চ্যালেঞ্জের জবাব ভারত আর কিভাবে দিতে ইচ্ছুক আমরা জানি না। কিন্তু একটা ব্যবস্থা এখনই নেওয়া দরকার। পাকিস্তান যখন ব্যাপারটাকে ক্রমশ কিনারায় নিয়ে যেতে চাইছে তখন আমাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার কোনাে কারণ নেই। ঢাকায় আমাদের কূটনৈতিকরা যখন স্বগৃহে অন্তরীণ, তখন কলকাতায় মেহেদি মাসুদ আর তার সাঙ্গেপাঙ্গেদের চলাফেরার স্বাধীনতা বজায় রাখার কোনাে কারণ। থাকতে পারে না। অবিলম্বে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরােপ করা হােক। অন্তত পাকিস্তানের সঙ্গে আর ভালােমানুষি করার দরকার নেই, কেননা সাে ভালােমানুষির ভাষা বােঝে না।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৬ মে ১৯৭১